প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৬ (২)

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৬ (২)
Drm Shohag

মাইরার কথায় ইরফান ভীষণ অবাক হয়৷ আলতো হাতে মাইরার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিয়ে নরম গলায় বলে,
– ডোন্ট ক্রাই বার্ডফ্লাওয়ার। তোমাকে কে কি বলেছে আমায় বলো?
মাইরা কান্নামাখা চোখে চেয়ে আবেগি স্বরে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
মাইরার এমন ডাক যেন ইরফানের হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা লাগে। ইরফান মাথা নিচু করে মাইরার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

– মাই বার্ডফ্লাওয়ার, কি হয়েছে বলো? আমি সব ঠিক করে দিব।
মাইরা চোখ বুজে নেয়। নাক টেনে বলে,
– আমার মা ভাই আমার নিজের নয়। সত্যি বলছি।
ইরফান মাইরার ঠোঁটজোড়ায় একটা চুমু খায়। এরপর মাইরার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ইট’স ওকে। বাট, তাদের সাথে কথা বলছো না কেন? তারা তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– আমি ওদের সাথে কথা বলতে চাই না। আমার পরিবার না থাকলে আপনি আমায় মানবেন না?
কি বাচ্চামি কথাবার্তা। ইরফান চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে ধমকে বলে,
– এসব উল্টাপাল্টা কথা বললে থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব স্টুপিট।
মাইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সে বুঝতেই পারেনি ইরফান তাকে ধমকাবে। মাইরা অভিমানী চোখজোড়া নামিয়ে ইরফানকে ছেড়ে দাঁড়ালো। ইরফানের সামনে থেকে সরে যেতে চাইলে ইরফান মাইরাকে তার সাথে চেপে ধরে। মাইরা নিজেকে ছাড়াতে মোচড়ামুচড়ি করে। ইরফান চোখ ছোট ছোট করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– স্টুপিট গার্ল রাগিয়ো না আমায়।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– ছাড়ুন বলছি। আমি কারো সাথেই কথা বলবো না।
কথাটা বলে মাথা নিচু করে গাল ফুলিয়ে রাখে। ইরফান ডান হাত মাইরার গালে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ইউ নো? ইউ আর মাই হার্ট।
মাইরার শরীর শিরশির করে। চোখ তুলে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– নিজের হার্টকে কেউ নিজের থেকে আলাদা করে?
মাইরা ত্যাড়া কণ্ঠে বলে,

– আপনার তো হার্ট-ই নেই। আপনি হার্টলেস।
ইরফান চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। এই স্টুপিট কে সে কি বলে, আর এটা কি বোঝে। মাইরা ইরফানের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে মনে হাসে। ইরফান মাইরাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে,
– হার্ট আছে কি নেই, এর প্রুভ দিয়ে দিব ভেরি সুন। আগে সুস্থ করে নিই তোমাকে। দ্যন সব বোঝাবো স্টুপিট।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– কিভাবে বোঝাবেন?
কথাটা বলে ইরফানের বুকের বা পাশে মাইরা তার ডান হাতের দু’আঙুল দিয়ে খোচা দিয়ে বলে,
– এইজায়গা কেটে আপনার হার্ট দেখাতে হবে। তাহলে আমি বুঝব। কিন্তু এমন করলে তো আপনি বাঁচবেন না। তাহলে কিভাবে হবে?
ইরফান মাইরার গলার ভাঁজে আঙুল চালিয়ে বলে,

– আমি মা’রা গেলে তুমি শোক পালন করতে পারলে তোমাকে এভাবেই বোঝাবো।
মুহূর্তেই মাইরার চোখজোড়া ভরে ওঠে। করুণ সুরে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান কেমন করে যেন তাকায় মাইরার চোখের দিকে। মেয়েটি এতো আবেগ নিয়ে এই নাম কীভাবে উচ্চারণ করে ইরফান ভেবে পায় না।
ইরফান মাইরার কপালে শব্দ করে চুমু এঁকে মাইরার চোখের দিকে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার অ্যান্ড শিসওয়ালা একসঙ্গে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার আর্জি উপরওয়ালার কাছে।
এবার ঠিক আছে?
মাইরার চোখজোড়ায় আরও খানিক বিন্দু বিন্দু পানি জমে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
লাবিব বেলকনিতে এসে মাইরার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, তার ছোট ছোট দু’হাতে মাইরার পা ধরে। এরপর মাথা উঁচু করে মাইরার দিকে তাকিয়ে ডাকে,

– আপুই আপুই আমাকে কুলে নাউ।
মাইরা লাবিবের কথা শুনে মাথা নিচু করে তাকায়। তার চোখে পড়ে লাবিব টলমল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। মাইরার কাঁদতে ইচ্ছে করল। নিচু হতে গিয়েও হলো না। ইরফানের দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– ওকে কোলে নাও বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
– ওর বাবা আমায় অনেক কথা শুনিয়েছে। আমি মা আর ভাইয়ের সাথে মিশলে ওর বাবা অনেক রাগ করে।
ইরফান মাইরার কথা শুনে অবাক হয়। লাবিব ফুঁপিয়ে ওঠে,
– আপুই আপুই আমাকে কুলে নাউ। আপুই….

ইরফান মাইরাকে ছেড়ে কিছুটা ঝুঁকে বা হাতে নিজেই লাবিবকে কোলে নিল। এরপর মাইরাকে ডান হাতে তার দিকে টেনে আনে। মাইরার মাথা তার বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– কি হয়েছে বার্ডফ্লাওয়ার? আমাকে বলো। নয়তো সল্ভ করব কিভাবে?
লাবিব কান্নামাখা চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরাও টলমল চোখে লাবিবের দিকে চেয়ে আছে। মাইরা ইরফানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। লাবিবের বাবা যে তাকে কু’কু’রের চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছে। সে আবারও কি করে এদের দিকে মুখ তুলে তাকাবে? সে তো পারছে না।
ইরফান দ্রুত মাইরার মাথা উঁচু করে ধরে। মাইরার চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ইরফান ডান হাতে মাইরার চোখের পানি মুছে দেয়। এরপর মৃদুস্বরে ডাকে,

– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা চোখ খোলে না। ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে লাবিবের দিকে তাকায়। লাবিবও ঠোঁট উল্টে শব্দহীন কেঁদে দেয়। ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– খুচিব ডুলাবাই আপুই কতা বুলে না কিনু?
ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এক স্টুপিট আরেক স্টুপিট কে তার উল্টাপাল্টা নাম শিখিয়েছে। ইরফান এসব রেখে সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– বলবে, ওয়েট।
মাইরার দিকে চেয়ে গলা ঝেড়ে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার চোখ খোলো।
মাইরা চোখ খুলল না। ইরফান আবারও ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?

মাইরার কোনো রেসপন্স না পেয়ে ইরফান একটু ঝুঁকে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। সাথে সাথে মাইরা চোখ বর বড় করে তাকায়। দু’হাতে ইরফানকে ঠেলে সরাতে চায়, ইরফান ডান হাতে মাইরাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে। মাইরা ছটফটায় নিজেকে ছাড়াতে। তবে পারে না।
কিছুক্ষণ পর ইরফান নিজেই মাইরাকে ছেড়ে দেয়। মাইরা দ্রুত ইরফানের বুকে মুখ লুকায়। ইরফান ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ঠোঁটজোড়া মুছে লাবিবের দিকে তাকালে দেখল লাবিব অবুঝ নয়নে চেয়ে আছে ইরফানের দিকে।
মাইরা হঠাৎ-ই সোজা হয়ে দু’হাতে ইরফানকে ধাক্কা দিয়ে রে’গে বলে,

– অ’স’ভ্য লোক। আমার ভাইকে আপনার চোখে পড়ে না?
ইরফান মাইরাকে কিছু বলল না। ঘাড় বাঁকিয়ে লাবিবের দিকে চেয়ে বলে,
– তোমার আপুই আমার কি হয় বলো তো?
লাবিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
– বুউ
ইরফান আবারও প্রশ্ন করে,
– বউদের কি করতে হয়?
লাবিব আবারও কিছু একটা ভেবে বলে,
– আদল
– আমি আমার বউকে কি করেছি?
লাবিব সাথে সাথে উত্তর দেয়,
– আদল

ইরফান ঠোঁট বাঁকায়। মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়। বা হাত কোমড়ে দিয়ে ডান হাতে লাবিবের কান টেনে বলে,
– এই ছানা এসব পাকা পাকা কথা কোথা থেকে শিখেছিস?
লাবিব ঠোঁট উল্টে বলে,
– খুচিব ডুলাবাই
মাইরা ইরফানের দিকে রে’গে তাকায়। ইরফান স্বাভাবিক ভাবে মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা রে’গে বলে,
– আপনি আসলেই একটা অ’স’ভ্য লোক।
ইরফান তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মাইরার ভেজা ঠোঁটজোড়া মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আই নো। এসব বাদ দাও। তোমার ভাই হাসছে দেখ। ওকে কোলে নাও।
মাইরা সাথে সাথে লাবিবের দিকে তাকায়। সত্যিই লাবিব হাসছে। মাইরা আবারও ইরফানের দিকে তাকালে ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– আমি সব প্রবলেম সল্ভ করে দিব। ও তো বাচ্চা, রাইট? ওকে কোলে নাও।
মাইরা টলমল চোখে ইরফানের দিকে তাকায়। ঠোঁট উল্টে বলে,

– আপনি এতো ভালো কেন?
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– একটু আগেই তো বললে আমি অ’স’ভ্য।
মাইরা লাবিবকে কোলে নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– অ’স’ভ্য-ই আপনি। আমার ভোলা ভালা ভাইটাকে কিসব উল্টাপাল্টা শিখিয়েছেন।
ইরফান কিছু বললো না। মাইরা লাবিবের দু’গালে অগণিত চুমু খায়। লাবিব দু’হাতে মাইরার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিলিয়ে হাসে। ইরফান চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– এসব রেখে ওর সাথে কথা বলো।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফানকে পাত্তা না দিয়ে লাবিবের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইয়া তুই আপুইকে ছাড়া আর কাঁদবি না আচ্ছা?
লাবিব ঠোঁট উল্টে বলে,

– কাঁদবু। আপুই টুমি আমাকে কুলে নাউনি কিনু? তুমু খাউনি কিনু?
মাইরা লাবিবের গালে চুমু খেয়ে বলে,
– এইযে এখন নিয়েছি। চুমুও খেয়েছি।
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– তোমরা দুই ভাইবোন কি কিস এর খেলা খেলো? স্টুপিট।
মাইরা আর লাবিব দু’জনেই ইরফানের দিকে বিরক্ত চোখে তাকায়। লাবিব বিড়বিড় করে, – খুচিব ডুলাবাই
মাইরা ইরফানের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলে,
– আপনার প্রবলেম কি? আমাকে আর ভাইকে শুধু ডিস্টার্ব করেন কেন?
ইরফান একটু ঝুঁকে মাইরার ঠোঁটজোড়ায় শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,

– আমার জিনিস সবাইকে বিলিয়ে দেয়ার হ্যাবিট ছুটাবো, স্টুপিট।
মাইরা কিছু বলতে গেলে ইরফান মাইরাকে চুপ করিয়ে বলে,
– তোমার ভাইয়ের বাবা তোমাকে কি বলেছিল? ফাস্ট বলবে।
মাইরার মুখ মলিন হয়ে যায়। দৃষ্টি ঘুরিয়ে লাবিবের দিকে তাকায়। তার মা আর ভাইয়ের সাথে র’ক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মাইরা তো এদের নিজের চেয়েও বেশি কিছু ভাবে। ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– স্পিক আপ বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে থেমে থেমে সবই বলে। লাবিবের বাবা তাকে সেদিন যা যা বলেছিল সব-ই ইরফানকে বলে।
সব শুনে ইরফান দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রা’গ সংবরণ করে। বিড়বিড় করে,

– বাস্টার্ড, বার্ডফ্লাওয়ার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত উড়ে নে।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে ভারী গলায় বলে,
– আমার নিজের বাবা মা কেউ নেই শিসওয়ালা। শ্যামা মা জন্মের সময় মা’রা গিয়েছে আর বাবা কয়েক মাস পর মা’রা গিয়েছে।
কথাটা বলতে বলতে মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখটা নিয়ে মাইরার চোখের পানি মুছে দেয়। নরম সুরে বলে,
– ডোন্ট ক্রাই বার্ডফ্লাওয়ার। আমি সব ঠিক করে দিব, ওকে? অ্যান্ড আর কখনো বলবে না তোমার কেউ নেই। সবাই আছে তোমার।
একটু থেমে আবারও বলে,

– তোমার ভাইয়ের বাবা ভালো মানুষ নয়। আর খা’রা’প মানুষদের জন্য ভালো মানুষদের মনে কষ্ট দিতে নেই। তোমার মা আর ভাইয়ের কোনো দোষ নেই, রাইট? তাহলে তাদের কেন ক’ষ্ট দিচ্ছ?
মাইরা বলতে নেয়,
– কিন্তু লাবিবের বাবা…
ইরফান মাঝপথে বলে,
– বলেছি না, সব ঠিক করে দিব। সে নিজেই তোমার কাছে এসে তোমার মা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলবে।
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
– কিভাবে?
ইরফান মাইরার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
– এতো জানতে হবে না। এসো তোমার মায়ের সাথে কথা বলবে।
কথাটা বলে মাইরার হাত ধরে বেলকনি থেকে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। মাইরার হাত ছেড়ে দিলে মাইরা এগিয়ে যায় তার মায়ের দিকে। লাবিব কে বেডের উপর নামিয়ে দিয়ে মাইরা নিজেই তার মাকে জড়িয়ে ধরে।
ইরফান কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।
মাইরার মা মাইরার পিঠে হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– আমাদের কাউকে একটিবার কেন বললি না মা?
মাইরা নিরবে চোখের পানি ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ পর তার মাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মাইরার মা মাইরার চোখের পানি মুছে দেয়। মাইরা নাক টেনে বলে,

– আমার জন্য তোমার কত অশান্তি হয়, আমি না থাকলে তো সেসব আর হবে না।
মাইরার মা মাইরার মুখে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে,
– আমার মেয়ের চেয়ে আমার কাছে ওসব সস্তা শান্তি বড় হয়েছে কখনো? ওসব ভাবতে না করিনা আমি তোকে? ওসব আমি বুঝে নিব। তোর মায়ের ভালোবাসা চোখে পড়ে না মা? তুই ছাড়া তোর এই মা শূণ্য বুকে কিভাবে থাকবে, একবারও ভাবিস নি কেন?
মাইরা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মায়ের বুকে মাথা রেখে কান্নাভেজা গলায় অভিযোগ করে,
– তোমার স্বামী বলেছে, আমি তোমার আর ভাইয়ের সাথে কথা বললে সে আমাকে মে’রেই ফেলবে। বলেছে আমি না-কি তোমাদের জাদু করেছি। তাই তোমরা আমাকে ভালোবাসো। বলেছে, তুমি তো আমার নিজের মা নয়, একদিনও পেটে ধরনি, তবে কেন তোমাকে মা ডাকি? ওসব শুনে আমার খুব ক’ষ্ট হয়েছে মা। সবাই কেন বলে তুমি আমার মা নয়?

কাঁদতে কাঁদতে বলা মাইরার কথগুলো শুনে মাইরার মা নিরবে চোখের জল ফেলেন। রুমা নেওয়াজ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ফারাহ, ইনায়ার চোখে পানি। মাইরা তাদের চেয়ে কত ছোট। অথচ মেয়েটার জীবনে কত কষ্ট! একটা মানুষ কত কষ্ট পেলে তার বাঁচার ইচ্ছে ম’রে যায়?
মাইরা আবারও বলে,
– তোমার স্বামী বলেছে, আমি না-কি কু’কু’রের চেয়েও নিকৃষ্ট। কু’কু’রকে তাড়িয়ে দিলেও তো তারা আর আসে না। কিন্তু আমি বারবার তোমার আর ভাইয়ের কাছে যাই। আমি তো আমার পর মা ভাইকেই অনেক ভালোবাসি। সেটা কেউ কেন বোঝে না মা?
ইরফান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাইরার প্রতিটি আহাজারি শুনলো। নির্জীব চোখে মাইরার পানে চেয়ে রইল কতক্ষণ কে জানে। তার বার্ডফ্লাওয়ার এতো দুঃখ নিয়ে হেসে খেলে বেড়াতো? সে ছাড়বে না ওই বাস্টার্ড কে। শুধু তার বার্ডফ্লাওয়ার একবার সুস্থ হয়ে নিক। সুদে-আসলে সব ফেরত দিবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়গাটি প্রস্থান করে ইরফান।
মাইরার মা মাইরার মাথা তুলে দু’হাতে মাইরার চোখজোড়া মুছে দেয়। আবারও মাইরার মুখে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে,

– আমার সোনা মা তুই। এই যে তোর মা বলছে, ওই লোকটাকে আমি ছাড়বো না। তুই দেখিস। আর কখনো এসব পা’গ’লামি করবি না।
মাইরা নাক টেনে বলে,
– তোমাকে কিছু করতে হবে না। শিসওয়ালা সব ঠিক করে দিবে বলেছে।
মাইরার মা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– শিসওয়ালা কে?
মাইরা থতমত খেয়ে তাকায়। ল’জ্জা পেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
– তোমার মেয়ে জামাই।
মাইরার মা মৃদু হেসে মাইরার ভেজা মুখ মুছে দেয়। মাইরা তার মায়ের দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– মা আমি বাঁচবো তো?
মাইরার কথায় মাইরার মা অসহায় চোখে তাকায়। চোখজোড়া আবারও ভরে ওঠে। ফারাহ এগিয়ে এসে মাইরার পাশে দাঁড়িয়ে মাইরাকে তার দিকে ফিরিয়ে বলে,
– এই মাইরা এসব বাজে কথা কেন বলো তুমি? ইরফান ভাই তোমাকে পাতালে নিয়ে যাবে, তবুও তোমার কিচ্ছু হতে দিবে না বুঝেছ?
মাইরা ফারাহ’কে জড়িয়ে ধরে হেসে বলে,

– তুমি অনেক ভালো আপু।
ফারাহ নিজেও মাইরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আমার ছোট বোন মাইরার চেয়ে ভালো কেউ এখনো হতে পারিনি, বুঝলে?
মাইরা একটু হাসলেও আবারও নিরবে চোখের পানি ফেলে। সে জানে তার অবস্থা ভালো নয়। তাকে তো ডক্টর নিজেই বলেছিল, তার অবস্থার কথা। সে ভুলে যায়নি। এতো এতো ভালোবাসার মানুষগুলোকে রেখে মাইরার যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তার যে মরণব্যাধি।
ফারাহ বুঝল মাইরা কাঁদছে। মেয়েটির নিজেরও চোখ ভিজে যায়। মাইরাকে সে ক’দিন-ই বা চেনে। অথচ মাত্র ক’দিনেই মেয়েটা এতো আপন করে নিয়েছে, ফারাহ’র সত্যিই মনে হয় মাইরা তার একদম নিজের ছোট্ট একটি বোন। ছোট বোনেরা ঠিক যেমন চঞ্চল, দুষ্ট হয়, মাইরাও তেমনি এক দুষ্ট, মিষ্টি, চঞ্চল মেয়ে।
ইনায়া পিছন থেকে মাইরাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা গলায় বলে,
– এই মাইরা আমার ভাইয়া তোমাকে ঠিক সুস্থ করে আনবে বুঝছ? মিলিয়ে নিও।
ইনায়ার কথায় মাইরা মলিন হাসে।
মাইরার মা এগিয়ে গিসে তার ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমা নেওয়াজ এর পাশে বসেন। রুমা নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইরার মাকে সান্ত্বনা দেয়।

ইরফান তার অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট রাকিবকে কল করে বলে,
– রাকিব আমার ইন্সট্যান্ট হেলিকপ্টার লাগবে। টাইম হাইলি টুয়েন্টি মিনিট’স। আমি ঠিকানা মেইল করছি। গট ইট?
রাকিব আমতা আমতা করলে ইরফান রে’গে বলে,
– থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে টাকা ঢালো আর আমার কাজ কর।
ওপাশে রাকিব চুপসে গিয়ে বলে,
– জ্বি স্যার।
ইরফান আবারও বলে,
– কানাডার দু’টো টিকিট বুক করে রাখো আজকের মধ্যেই।
রাকিব মিনমিন করে বলে,
– স্যার আজকে ফ্লাইট না পেলে?
ইরফান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– পাবে। ফাস্ট কর।

কথাটা বলে কল কেটে দেয়। এরপর রাকিবকে এই হসপিটালের ঠিকানা পাঠায়। ফোন পকেটে রেখে দু’হাত আড়াআড়িভাবে বুকে গুঁজে দাঁড়ায়। দৃষ্টি অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশপানে। দৃষ্টিতে প্রাণ নেই।
পাশে এসে শুদ্ধ কখন দাঁড়িয়েছে ইরফানের সে খেয়াল নেই। শুদ্ধ বেশ অনেকক্ষণ ইরফানের দিকে চেয়ে রইল। এরপর ইরফানের কাঁধে হাত রেখে ডাকে,
– ইরফান?
ইরফান কিছু বলল না। আকাশপানে চেয়েই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে ইরফান নির্জীব গলায় বলে,
– হুম
শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,
– সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইরফান কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বলে,
– ভার্সিটিতে নেক্সট ওয়ান ইয়ার আমি থাকছি না।
ভিসি আঙ্কেলের সাথে আমি কথা বলে নিব। তুই আঙ্কেলের সাথে একবার মিট করে নিস আমার হয়ে।
শুদ্ধ মাথা নেড়ে বলে,
– আচ্ছা। তুই রাকিবকে হেলিকপ্টার ম্যানেজ করতে বললি কেন?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,

– চট্টগ্রাম রওয়ানা হব বার্ডফ্লাওয়ারকে নিয়ে। ইয়ামিন আঙ্কেল অনেক বড় অনকোলজিস্ট। উনার আন্ডারে ট্রিটমেন্ট করাবো। এর জন্য এক সেকেন্ড টাইমও ওয়েস্ট করতে চাই না।
শুদ্ধ একটু ভেবে বলে,
– তোর ইয়ামিন আঙ্কেলও যদি মাইরাকে অপারেশন করাতে বলে?
ইরফান এবার ঘাড় ঘুরিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকায়। রে’গে বলে,
– তোরা বারবার কেন এই এক টপিক নিয়ে কথা বলছিস? আমি নিতে পারছি না। বার্ডফ্লাওয়ারের অপারেশনে অনেক রিস্ক। ওর কিছু…..
ইরফানের গলা ভারী হয়ে আসে। চোখদুটো লাল। ডান হাতের আঙুলগুলো দ্বারা কপাল ঘষে নির্জীব গলায় বলে,
– আমায় একা ছেড়ে দে।
শুদ্ধ কিছু বলল না। ইরফান একটু পর বলে,
– ইয়ামিন আঙ্কেল অপারেশন করতে বললে, ইন্সট্যান্ট ওকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করব। অ্যান্ড আজকেই কানাডার ফ্লাইটে উঠব।
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলে,

– মাইরার পাসপোর্ট, ভিসা…..
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– অল কমপ্লিট।
শুদ্ধ আগের চেয়েও অবাক হয়ে বলে,
– কিভাবে?
ইরফান আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এরপর বলে,
– কানাডায় আমার পিএইচডি করতে যাওয়ার কথা ছিল আর এক মান্ত পর। নিজের উপর ভরসা পাচ্ছিলাম না, কি যেন ভেবে বার্ডফ্লাওয়ারের সব ওকে করে রেখেছিলাম।
শুদ্ধ বিস্ময় চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। সে এসবের কিছুই জানতো না। নিজের বিস্ময় চেপে বলে,
– মাইরাকে ডিরেক্ট কানাডায় নিয়ে যাচ্ছিস না কেন?
ইরফান ঢোক গিলে বলে,

– নিজের লোক থাকতে অন্যদের কাছে ওকে নিতে চাই না তাই। ইয়ামিন আঙ্কেল আমার বাবার মতোই। বার্ডফ্লাওয়ারকে নিজের মেয়ে ভেবে ট্রিটমেন্ট করবে। অ্যা’ম নট সিওর, সে পারবে কি-না। কজ, সে আগের মতো প্রফেশনালি এসবে অ্যাড নেই পার্সোনাল কারণে। আমার ঠিক না লাগলে দ্যান কানাডা।
শুদ্ধ মৃদু হেসে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরফান আবারও সেই অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি রাখে। মৃদুস্বরে বলে,
– বিজনেসে ফুললি ফোকাস করার সাথে সাথে কানাডায় গিয়ে ওর জন্য কিছু অ্যারেঞ্জ করছিলাম। ওকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। বাট আমি কানাডা গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।
ইরফানের কণ্ঠে প্রাণ নেই। লম্বা শ্বাস টেনে আবারও বলে,

– বাচ্চা মেয়েটা কত বড় সারপ্রাইজ দিয়ে দিল আমায়! ও তো আমার লিটল গার্ল ছিল।
ইরফানের কথাটায় যেন হাজারো আক্ষেপ, দুঃখ, কষ্ট চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। এরপর আবারও ধরা গলায় বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার যাস্ট দেখতে ছোট, ওর কাজগুলো অনেক বড় মানুষদের মতো। আমি ওর থেকে এমনটা কখনো এক্সপেক্ট করিনি। ও আমাকে খুব বাজেভাবে ভেঙে দিয়েছে শুদ্ধ।
কথাগুলো বলে ইরফান শুদ্ধর দিকে একবার তাকায়। শুদ্ধ অবাক হয়ে ইরফানের চোখে চোখ রাখে। ইরফানের লালিত চোখজোড়ায় পানি চিকচিক করছে। শুদ্ধর দৃষ্টিতে তা এড়ায় না।
ইরফান সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয় শুদ্ধর থেকে। আর এক সেকেন্ডও এখানে দাঁড়ালো না। শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে গটগট পায়ে জায়গাটি প্রস্থান করল।
শুদ্ধ বিস্ময় চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইরফান কখনো নিজেকে মেলে ধরে না। ওর স্বভাবটাই এমন। সেই ছোট থেকে দেখে আসছে। অথচ আজ একটা বাচ্চা মেয়ে সত্যিই কিভাবে ভেঙে দিয়েছে ইরফানকে। ইরফান নিজের মাঝেই নেই যেন। কখন কি করছে সে নিজেই জানে না। এই যেমন মাইরার অপারেশন করাতে হবে, মাইরা আরও তিন মাস আগে ডক্টরের কাছে এসেছিল, তখন ট্রিটমেন্ট স্টার্ট করলেও অপারেশনের কাছে যাওয়া লাগতো না হয়তো। কিন্তু এখন উপায় নেই। তাছাড়া মাইরার অবস্থা আর পাঁচজনের চেয়েও শোচনীয়। কিন্তু ইরফান মানবে না। ও নিজেও জানে, বোঝে মাইরার এ ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু ও সব ওয়ে ট্রাই করবে।
শুদ্ধর মাইরাকে ভীষণ কথা শোনাতে ইচ্ছে করল, মাইরার এইসব কথা লুকানোর জন্য। মেয়েটার জীবনটাই যে অনিশ্চয়তায় ভাসছে। মাইরার কিছু হলে ইরফানের কি হবে?
কথাগুলো ভেবে শুদ্ধ মলিন মুখে চেয়ে রইল।

একটি বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠের মাঝখানে হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। হেলিকপ্টারের প্রপেলারের ভারী, তীব্র শব্দ। প্রপেলারের ঘূর্ণায়মান ব্লেড থেকে প্রবল বাতাস বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ একজন হেলিকপ্টারের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,
– আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরার মাথার হিজাব টেনে ঠিক করে দেয়। এরপর মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মৃদুস্বরে বলে,
– যেখানে নিয়ে গেলে আমার বার্ডফ্লাওয়ার সুস্থ হবে সেখানে।
মাইরা ইরফানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। হেলিকপ্টারের দিকে যত এগোয় প্রপেলারের শব্দ তত তীব্রভাবে মাইরার কানে লাগে, সাথে বাতাস।মাইরা দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। ইরফান মাইরাকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নেয়।
হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ইরফান একবার পিছু ফিরে দাঁড়ায়। সবাই ইরফান-মাইরার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

শুদ্ধ মৃদু হাসলো। তার মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা, যেদিন সে ইরফান কে জিজ্ঞেস করেছিল, বউকে সুখী করতে কত টাকার প্রয়োজন পড়ে। সেদিন ইরফানের বলা হেলিকপ্টারের উদাহরণ টা ইরফানের সাথেই মিলে গেল। তবে মাইরা কি সুস্থ হবে? কথাটা ভেবেই শুদ্ধর মুখ মলিন হয়।
তারেক নেওয়াজ ঝাপসা চোখে চেয়ে রইল ছেলে আর ছেলের বউয়ের পানে। তিনি মাইরার জন্য দুঃখ করেছিলেন, আফসোস করেছিলেন, তার ছেলে মেয়েটাকে একটু ভালোবাসতে পারলো না কেন। অথচ আজ যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, তার সেই ছেলেটাই তার বন্ধুর মেয়েকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
লাবিব তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঘূর্ণায়মান প্রপেলারটির দিকে চেয়ে রয় খানিকক্ষণ। এরপর দৃষ্টি নামিয়ে তার আপুই এর দিকে তাকায়। ছোট্ট ছেলেটি কি বুঝলো কে জানে, সে হাসলো না। আর পাঁচজনের মতো কাছ থেকে হেলিকপ্টার দেখে তেমন উৎফুল্ল হলো না। মলিন মুখে তার আপুই এর দিকে চেয়ে রইল।
মাইরা ভেজা চোখে সবার দিকে একবার তাকায়। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান হেলিকপ্টারের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। একজন ইরফানেরর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

– স্যার অল ওকে।
ইরফানের গম্ভীর স্বর,
– ওকে।
কথাটা বলে ইরফান হেলিকপ্টারের ভিতর প্রবেশ করে। মাইরা ফুঁপিয়ে ওঠে। তার এসব ভালো লাগছে না। ইরফান সিটে বসে মাইরাকে তার কোলে বসায়। কেউ একজন হেলিকপ্টারের দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর ধীরে ধীরে নিচ থেকে উপরে উঠতে থাকে, ফলে হেলিকপ্টার হালকা দুলে ওঠে।
মাইরা ইরফানের গলা দু’হাতে শক্ত করে ধরে। ইরফানের গলায় মুখ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ইরফান মাইরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ডোন্ট ক্রাই বার্ডফ্লাওয়ার।

মাইরা শুনতে পেল কি-না! আরও শক্ত করে ইরফানকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তাকে আর কোথায় কোথায় যেতে হবে বাঁচার জন্য? সে বাঁচবে তো? তার শিসওয়ালাকে ছেড়ে, তার ছোট্ট ভাইকে ছেড়ে, তার মাকে ছেড়ে কাউকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না তার।
ইরফান মাইরার মাথা তার গলা থেকে সরিয়ে নেয়। মাইরা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। ইরফান ডান হাতে মাইরার মুখ মুছে দেয়। এগিয়ে গিয়ে মাইরার ঠোঁটজোড়ায় সময় নিয়ে চুমু খায়। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বেশ কয়েকটা চুমু আঁকে। কিছু বলল না আর। শুনতে পাবে না। এরপর সোজা হয়ে বসে ইরফান। অসহায় চোখে অস্পষ্ট মাইরাকে দেখে।
মাইরা সময় নিয়ে নিজেকে সামলায়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। হেলিকপ্টারের ভেতর লাইট অফ থাকায় তেমন স্পষ্ট দেখতে পেল না ইরফানকে। অস্পষ্ট দেখল। ইরফান আবারও মাইরার মুখ মুছে দিয়ে মাইরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। মাইরা চোখ বুজল। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।
ইরফান নিজেও চোখ বুজল। অসহায়ত্বের সংজ্ঞা এতো নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে হবে ইরফান কখনো কল্পনাতেও আনেনি। কথাটা ভেবে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের কাছাকাছি ইরফানদের হেলিকপ্টার চট্টগ্রামে পৌঁছায়। ইরফান মাইরাকে নিয়ে তার আঙ্কেলের বাড়ি যায়নি। হসপিটালে গিয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক এর মতো সময় নিয়ে মাইরাকে বেশ ভালোভাবে চেক-আপ করে জানায়,
মাইরার অবস্থা খুবই খা’রা’প। ওকে ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে।
লাস্ট কথাটা শুনে ইরফানের দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল।
ইরফান নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল। সে যেন তার প্রাণহীন দেহ বয়ে বেড়াচ্ছে।
এরপর মাইরাকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে ঢাকার উদ্দেশ্যে আবারও রওয়ানা হবে বলে। আবারও প্রায় ১ ঘণ্টার কিছুটা বেশি সময় নিয়ে ইরফান মাইরাকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করে।
ঘড়িতে তখন রাত ১০:৩০।

ইরফান মাইরাকে কোলে নিয়েই নেমে দাঁড়ায় হেলিকপ্টার থেকে। মাইরাকে নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে অনেকটা দূরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ইরফান। আশপাশটা একদম ফাঁকা দেখে ইরফান মাইরাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। মাইরা ইরফানের সাথে লেগে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথা উঁচু করে ভাঙা গলায় ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটা এতো কাঁদতে শিখেছে কবে থেকে?
দু’হাতে মাইরার মুখটা ধরে মৃদুস্বরে বলে,
– কাঁদছিলে কেন বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার আবারও চোখ ভিজে যায়। সে ডক্টরের কথা শুনে নিয়েছে। তাকে অপারেশন করাতেই হবে। আর অপারেশন করালে সে ম’রে যাবে। তার অবস্থা একদমই ভালো নয়। মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,

– শিসওয়ালা আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
ইরফান মাইরার কথাটা শুনে সূক্ষ্ম হাসে তবে মুখে তীব্র ব্য’থার ছাপ। মাইরার কপালে শব্দ করে একটা চুমু এঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
– শুনবে?
মাইরা চোখের পাতা ফেলে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে। ইরফান দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখটা নিয়ে মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে গায়,

bahut peyar karte hain
Tumko sanam……..
[অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়]
Kasam chaahe le lo [কসম চাও নিয়ে নাও]
Kasam chaahe le lo
Khuda ke kasam……. [খোদা-রী কসম]
Bahut peyar karte hain
Tumko sanam………
[অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়]
hamari gazal hain
Tasavvur tumhara……
[আমার গজলে তোমার হাসি]
Tumhare bina ab nh
Jeena hamara………
[তোমায় ছাড়া এখন, না বাঁচি]
Tumhein yoon hein chaahenge [তোমায় আমি চাইবো]
Tumhein yoon hein chaahenge [তোমায় আমি চাইবো]
Jab tak hain dum…………[যতক্ষণ আছে দম]

এটুকু গেয়ে থেমে যায় ইরফান। তার গলায় কিছু বেঁধেছে মনে হলো। মাইরা ইরফানকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। ইরফান এক পা পিছিয়ে যায়।
মাইরা নিজেও দু’পা পিছিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে মাঠের মাঝে বসে পড়ে মেয়েটা। দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে,
– আমি শুনে নিয়েছি শিসওয়ালা, আমি বাঁচবো না।
আমি ম’রে যাবো বলে আপনারা এখন এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছেন। এসব আমার চাই না। এতো ভালোবাসা দেখিয়ে আমায় দুনিয়া লোভী করে দিতে চাইছেন। আপনারা সবাই স্বার্থপর। আমি আমার শ্যামা মায়ের কাছে যেতে চাই। আপনারা আবার আমায় অবহেলা করুন। আমি হাসিমুখে চলে যেতে চাই। আমার কাঁদতে ভীষণ কষ্ট হয়। আমি কেঁদে কেঁদে মরতে চাই না। আমি ভালোবাসা চাই না।
কথাগুলো বলতে বলতে হেঁচকি তুলে কাঁদে মাইরা। ইরফানের দম আটকে আসছে বোধয়৷ চোখ দু’টো ভরে গিয়েছে। সে মাইরার দিকে এগোলে না। নির্জীব চোখে কান্নারত মাইরার পানে চেয়ে রইল। তার কানে বাজে তার আঙ্কেলের বলা কথা,

– ইরফান আব্বু, আমি তোমার নিজের মানুষ। অপারেশন ছাড়া মেয়েটার আর কোনো ওয়ে নেই। আর ওর অপারেশনে ভীষণ রিস্ক। তোমাকে ৮০% মৃত্যুর দিকে ঠেলে ওকে অপারেশন থিয়েটারে দিতে হবে। ওর টিউমার অলরেডি ক্যান্সারে ট্রান্সফার হয়েছে বুঝেছ? আগে যাদের দেখিয়েছো, আই থিংক, তারা এটা ধরতে পারেনি।
তুমি ওকে কানাডা নিয়ে যাও, এটা ভালো ডিসিশন। তবে আমার মনে হয়, তারাও একই কথা বলবে।
কথাগুলো ভেবে ইরফানের র’ক্তলাল চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তে নেয়। ইরফান ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে পানির কণা ছিটকে ফেলে। ঢোক গিলতে চায়, পারে না। কেমন ছটফট লাগে। মাইরার কান্না তার কানে এসে বারি খায়। দু’হাতে মাথার চুল টেনে চিৎকার করে বলে,
– স্টপ ক্রায়িং বার্ডফ্লাওয়ার।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৭