প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৯
Drm Shohag
পরদিন সকাল সকাল সামিয়া তার মামার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ১০ মিনিট। সামিয়া তার মামা মামিকে না বলেই বেরিয়ে এসেছে। অনেকটা পথ এসে তার মামিকে কল করে বলে দিয়েছে, সে শহরে ফিরে যাচ্ছে। এখানে থেকে আর কোনো রিস্ক নিতে চায় না সে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে টিকিট কেটে বাসে উঠে বসে সামিয়া। আর ১৫ মিনিট পর বাস ছাড়বে বলেছে।
নাছিমকে সকাল সকাল তার মা বাড়ি থেকে বেরতে দেখে,, তিনি এগিয়ে এসে বলেন,
– কোথায় যাচ্ছিস বাবা?
নাছিম মায়ের কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। গতরাত থেকে তার মায়ের সাথে কথা বলেনি সে। প্রচন্ড রে’গে আছে তার মায়ের উপর। তাকে না জানিয়ে কি করে বিয়ের ব্যাপারে এতোটা এগোতে পারলো? তার মা কি জানে না, তার সিচুয়েশন? আবারও মায়ের ডাকে নাছিম পিছু ফিরে তাকালো।
– তুই কি আমার উপর রা’গ করেছিস বাবা? আমার কি ইচ্ছে করে না, ছেলের বউ ঘরে আনতে? কেন এমন জেদ করছিস বল তো? কোথায় যাচ্ছিস না খেয়ে দেয়ে?
নাছিম শক্ত গলায় বলে,
– বি’ষ আনতে যাচ্ছি। খাবারে মিশিয়ে খাইয়ে দিও। তাহলে আর আফসোস হবেনা ছেলের বউয়ের জন্য। কারণ আমি তো বেঁচেই থাকবো না।
মুহূর্তেই নাছিমের মায়ের চোখজোড়া ভরে ওঠে। ভারী গলায় ডাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– নাছিম?
নাছিম চোখ বুজল। রা’গ সংবরণ করে মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি মা!
একটু থেমে আবারও বলে,
– বিয়ে শব্দ টা আমার সামনে উচ্চারণ করে পুরনো ঘা আর তাজা করে দিওনা মা, প্লিজ!
কথাটা বলে হনহন করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। নাছিমের মায়ের চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তার ছেলের জীবন কী আর গোছানো হবে না?
নাছিম গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসেছে। তার অফিসের লোককে কল করে জানিয়েছে, তার মাকে যেন গ্রাম থেকে নিয়ে যায়। সে বাসে যাবে। বাসে যাওয়া আসার অভ্যাস নাছিমের আগে থেকেই আছে। মাঝে মাঝে গাড়ি ছাড়া এভাবেও ভালো লাগে। বাসের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনের কথা মনে পড়ল, যেদিন সে মাইরার পাশের সিটে বসায় মাইরা চেঁচিয়ে উঠেছিল। এরপর সে সিট এক্সচেঞ্জ করেছিল। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে মাইরার দিক থেকে কখনো কোনো সাইন পায়নি, তবে সে সবসময় মাইরাকে নিয়ে ভাবতো, সবটা সময়। কিন্তু তখন জানতো না, মাইরা তারই বন্ধুর ভালোবাসা সাথে বউ। ভাবনাগুলো চেপে বাসে উঠে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে সিট নম্বর অনুযায়ী একটি ফাঁকা সিটে নাছিম বসে পড়ে। কেউ পাশে বসায় সামিয়া চোখ মেলে পাশে তাকিয়ে নাছিমকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
– আপনি এখানে বসছেন কেন?
নাছিম বাম দিকে সামান্য ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
– এটা আমার…
সামিয়াকে দেখে থেমে যায়। আরে এটা সেই মেয়ে না? যে গতরাতে তার কাছে এসে বিয়ে ভাঙতে বলেছিল? হ্যাঁ সেই মেয়েই তো। কিছু বলল না। সোজা হয়ে বসে গলা ঝেড়ে বলে,
– এটা আমার সিট।
সামিয়া কিছু বলল না। জানালার দিকে আরেকটু চেপে বসল। নাছিম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে-ও ডান দিকে একটু সরে বসল। ডান পা খানিকটা বেরিয়ে আছে, এভাবেই থাকলো নাছিম। সামিয়া যদিও আড়চোখে দেখেছে, কিন্তু কিছু বলল না। মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো। দুনিয়ায় আর মানুষ ছিল না? এই লোককেই এখানে বসতে হলো? তার চেয়েও বড় কথা, কোনো মেয়ে ছিল না? অ’স’হ্য লাগলো সামিয়ার। কিছু বলতেও পারছে না, সইতেও পারছে না।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝে বাস ছেড়ে দেয়। সামিয়া জড়সড় হয়ে বসেছে। জানালা খুলে রাখায় মৃদু হাওয়া জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে এসে সামিয়া, নাছিমের গা ছুঁয়ে দেয়।
বাস চলতে থাকে। সামিয়ার দৃষ্টি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর পানে, যা আপাতদৃষ্টিতে চলমান মনে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যায়।
সামিয়া আড়চোখে নাছিমের দিকে তাকালে দেখল নাছিম সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে আছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবারও দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ করে।
রাতে ঠিক করে ঘুম না হওয়ায় সামিয়ার চোখে ঘুম ধরা দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের মাঝে সামিয়া ঘুমিয়ে যায়।
এদিকে নাছিমের-ও একই অবস্থা। কখন ঘুমিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
হঠাৎ-ই বাসের ঝাঁকুনিতে নাছিম, সামিয়া দু’জনের মাথা একসাথে ধাক্কা লাগে। ধাক্কা টা বেশ জোরেই লেগেছে। সামিয়া, নাছিম দু’জনের কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমুঘুমু চোখ মেলে তাকালে দু’জনের চোখাচোখি হয়। ব্যাপারটা কি হয়েছে, কেউ-ই ঠিক করে বুঝতে পারছে না। যখন বুঝল দু’জনের মাথা একসাথে ঠেকিয়ে আছে, নাছিম দ্রুত সোজা হয়ে বসে। সামিয়া নিজেও সোজা হয়ে ডান হাতে মাথার ডান পাশ ডলে। অনেক ব্য’থা পেয়েছে বেচারি। নাছিম আড়চোখে দেখল সামিয়া মাথা ডলছে। সে গলা ঝেড়ে বলে,
– স্যরি!
সামিয়া মৃদুস্বরে বলে,
– আমিও স্যরি!
নাছিম আর কিছু বলল না। সামিয়া বামদিকে সিটে মাথা এলিয়ে রেখে চোখ বুজল। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে যায়। নাছিম ঘুমায়নি। হেলান দিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। সামিয়া বোধয় ঘুমিয়েছে। রাস্তার মোড় ঘুরতে গিয়ে সামিয়া ঘুমের ঘোরে এবার নাছিমের সাথে জোরেসোরে এক ধাক্কা খায়। বেচারির ঘুম তো ভেঙেছেই, সাথে নাছিমের অদ্ভুদ দৃষ্টি দেখে মেয়েটি ল’জ্জায় নুইয়ে পড়ে। মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে,
– ভাইয়া আমি স্যরি! আসলে ঘুমিয়ে থাকায় বুঝতে পারিনি।
নাছিম বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সামিয়ার কথার উত্তর না করে প্রশ্ন করে,
– বিয়ে ভেঙে দিতে বলছিলে কেন?
সামিয়া সাথে সাথে মাথা তুলে নাছিমের দিকে তাকায়। সে তো অন্যকাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারেনা। আর কারণটা সে নাছিমকে কি করে বলবে? যেখানে নাছিম শুদ্ধর ফ্রেন্ড। সামিয়া নাছিমকে শুদ্ধর ফ্রেন্ড হিসেবে চেনে। তবে নাছিমের সাথে তার মামা বিয়ে দিতে চাইছিল, এটা সে গতকাল নাছিমকে বিয়ে ভেঙে দিতে বলার কথা আসার পর নাছিমকে দেখে চিনেছিল। এরপর তার কাজিনদের কাছে শুনেছিল, নাছিম মাইরাকে পছন্দ করত, তার কাজিন কোথা থেকে জেনেছে সামিয়া তা জানেনা। কিন্তু নাছিম তাকে বিয়ে করতে গিয়েছিল, মাইরাকে পছন্দ করার পর-ও। ব্যাপারটা সামিয়ার কাছে একটু অদ্ভুদ লেগেছে। আবার ভেবেছিল, হয়তো নাছিম মুভ অন করে ফেলেছে, কিন্তু সে তো পারেনি।
নাছিম আবারও বলে,
– বলছো না যে?
সামিয়া জবাব দেয়,
– আপনি মাইরাকে ভুলে গিয়ে মুভ অন করেছেন, কিন্তু সবাই তো এক নৌকার মাঝি নয়। আমার নৌকা আলাদা।
নাছিম বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সামিয়ার দিকে। সামিয়া কথাটা বলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় নাছিমের দিক থেকে। নাছিম অবাক হয়ে বলে,
– হ্যালো মিস! আমি বিয়েতে সম্মতি দিলে এতোক্ষণে তুমি আমার বউ থাকতে!
সামিয়া বাইরে দৃষ্টি রেখে উত্তর করল,
– জ্বি, সম্মতি না দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
নাছিম ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– মা আমাকে না জানিয়ে তোমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, নয়তো এই টপিক এতোদূর গড়াতো না। আর তাছাড়া আমি এমন নৌকার মাঝি, যে নৌকায় কেউ কখনো উঠতে পারবে না।
সামিয়া মলিন মুখে প্রকৃতি দেখে। কেন যেন তার ভালো লাগছে না। সে বুঝল, শুদ্ধর ফ্রেন্ড নাছিমের তার মতোই অবস্থা। সে তার ফ্রেন্ড, তার কাজিনদের মতো নাছিমকে নিয়ে বিদ্রুপ করল না। ভাবলো না, একজন বিবাহিত মেয়ের জন্য কেন জীবন থেমে রাখে? যেখানে সে সুখে-শান্তিতে সংসার করছে? কথাগুলো বলা যতটা সহজ, মানা কি ততটা সহজ? চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়? মুখে যায়, মনে নয়।
নাছিম প্রশ্ন করে,
– তুমি পড়াশোনা করছ?
সামিয়া মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।
– আমার ব্যাপারে কিভাবে জানলে?
সামিয়া নাছিমের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,
– আমার কাজিনদের থেকে শুনেছি। আর মাইরা তো আমাদের গ্রামের-ই মেয়ে।
নাছিম সাথে সাথে প্রশ্ন করে,
– বার্বিডল জানে?
সামিয়া অদ্ভুদভাবে তাকায়। নাছিম কেমন যেন হঠাৎ-ই বিচলিত হয়ে প্রশ্নটা করল। সামিয়া জিজ্ঞেস করে,
– বার্বিডল কে?
নাছিম চুপ থাকলো। সামিয়া হয়তো বুঝল। তাই আর জিজ্ঞেস না করে উত্তর করল,
– আমি এসব ব্যাপারে জানিনা। তবে আপনি তার জন্য দেবদাস হয়েছেন এটা মেবি ও জানেনা।
নাছিম কিছুটা বিব্রতবোধ করে। সামিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাছিম আবারও প্রশ্ন করে,
– তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
সামিয়া মৃদু হেসে বলে,
– জ্বি।
নাছিম চোখ বুজে বলে,
– ওহ ওকে। নিউ লাইফের জন্য কংগ্রাচুলেশনস। বয়ফ্রেন্ড কে বিয়ে করবে বলে বাড়ি থেকে পালাচ্ছ নিশ্চয়ই? ছেলেটার ভাগ্য আছে বলতে হবে।
সামিয়া ঘাড় ফিরিয়ে নাছিমের দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,
– সে বিবাহিত!
সামিয়ার কথাটা শুনে নাছিম ভ্রু কোঁচকালো। একটু পর চোখ মেলে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এক বিবাহিত ছেলের জন্য তুমি বিয়ে করছ না?
নাছিমের কথাটা সামিয়ার পছন্দ হলো না। তার মনে হলো, তার ফ্রেড, কাজিনদের মতো নাছিম-ও তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করল। মেয়েটির মন খারাপ হয়। নিজেকে সামলে বলে,
– ঠিক যেমন আপনি।
নাছিম থতমত খেয়ে তাকায়। গলা ঝেড়ে বলে,
– ছেলে আর মেয়ের মাঝে অনেক তফাৎ আছে। তোমাকে একদিন না একদিন বিয়ে করতেই হবে। বাট আমি ছেলে,, আমার জন্য সিঙ্গেল থাকাটা খুব বেশি প্রবলেম হবে না।
সামিয়া কিছু বলল না। নাছিম আবারও বলে,
– তোমার মুভ অন করে বিয়ে করা উচিৎ।
সামিয়া মৃদু হেসে বলে,
– আপনি পারবেন?
নাছিমের মুখ আগের চেয়েও মলিন হলো। বিয়ে শব্দটার সাথে বার্বিডলের একটা কানেকশন ছিল তার লাইফে। আর এখন বিয়ের সাথে বি’ষের কানেকশন পায়। বিয়েটা হয়তো আর সম্ভব নয় তার দ্বারা।
বাস কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে দাঁড় করালে নাছিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে বাস থেকে নেমে যায়। সামিয়া বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলো। একে একে সবাই নেমে গেলে সামিয়া আস্তেধীরে বাস থেকে নেমে যায়।
মাইরা কলেজ শেষে কলেজ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। একসাইডে দাঁড়িয়ে ইরফানের অপেক্ষা করে। আজ মিলা কলেজ আসেনি বলে মাইরার মুড অফ। পরিচিত কাউকে দেখে মাইরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পিছন থেকে মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে বলে,
– সামিয়া আপু কেমন আছো?
সামিয়া মাইরার ডাকে পিছু ফিরে তাকায়। সে এখানে টিউশন পড়াতে এসেছে। আজ সকাল সকাল গ্রাম থেকে এসে জমানো কাজগুলো করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। লেট করে ঘুম থেকে ওঠায় তাড়াহুড়োয় খুচরো টাকা নেয়নি। দুটো পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে বেরিয়েছে। এখন রিক্সায় এসে বেকায়দায় পড়েছে। অতঃপর মাইরার উদ্দেশ্যে বলে,
– মাইরা, তোমার কাছে খুচরো ৪০ টাকা হবে বোন?
মাইরা অসহায় কণ্ঠে বলে,
– না আপু। আমার কাছে পাঁচশ টাকার নোট আছে হয়তো। এটা চলবে না?
– পাঁচশ টাকা তো আমার কাছেও আছে। এটা হবে না। রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা আমি আশেপাশে দোকানে দেখি পাই কি-না!
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
– আচ্ছা আপু।
মাইরা এক সাইড দিকে আবারও দাঁড়িয়ে ইরফানের জন্য অপেক্ষা করে। সামিয়া আশেপাশে বেশ কয়েকটা দোকানে খুচরা চায়, কিন্তু সবার একই উত্তর, খুচরা নেই। সামিয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। কি করবে এখন?
এই ৫০০ টাকা দিয়ে দিবে? সে কত হিসাব করে দিন চালায়, ৫০ টাকা-ও কত সেভ করে। সেখানে পুরো ৫০০ টাকা গচ্চা যাবে? ভাবনার মাঝেই কিছুটা দূরে নাছিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সামিয়া ভাবনা রেখে দ্রুতপায়ে নাছিমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– ভাইয়া আমাকে ৪০ টাকা ধার দিতে পারবেন?
নাছিম ফোনে কথা বলছিল। পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালে সামিয়াকে দেখে অবাক হয়। আরও বেশি অবাক হয়, তার কাছে ৪০ টাকা চাওয়ায়। ফোনে কথা বলা শেষ করে মৃদুস্বরে বলে,
– বুঝলাম না।
সামিয়া হাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রিক্সাওয়ালা কে দেখিয়ে বলে, তার কাছে খুচরা না থাকায় ভাড়া দিতে পারছে না। নাছিম কিছু বলল না। এগিয়ে গিয়ে তার ওয়ালেট থেকে ৪০ টাকা বের করে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দেয়।
সামিয়া নাছিমের পাশে দাঁড়িয়ে ছোট করে বলে,
– ধন্যবাদ।
এরপর নাছিমের দিকে তার হাতে থাকা পাঁচশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– আপনি এখান থেকে ৪০ টাকা নিয়ে বাকিটা আমাকে ফেরত দিন।
নাছিম তার ওয়ালেট পকেটে রাখতে রাখতে সামিয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে,
– লাগবে না।
সামিয়া মাথা নেড়ে বলে,
– না না এমন করবেন না। আমি ঋণী হয়ে যাবো আপনার কাছে।
নাছিম হাতঘড়িতে একবার সময় দেখল। সে অফিসের একটা কাজে এখানে এসেছিল। কাজটি করে দ্রুত ফিরতে হবে। আগামীকাল ফ্লাইট।
কিছু একটা ভেবে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি ৪০ টাকার হেল্প করে সেটা ফেরত নিইনা।
একটু থেমে আবারও বলে,
– আমার মনে হয়, আমরা একই নৌকার মাঝি। এটা সকালে প্রুভ হয়েছে। সেই হিসেবে ধরে নাও, উই আর যাস্ট ফ্রেন্ড। তাই এই হেল্প নরমাল।
এটুকু বলতেই নাছিমের ফোনে আবারও কল আসলে সে এক্সকিউজ মি বলে সামিয়ার পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
সামিয়া হাতের টাকা তার ব্যাগে রেখে উল্টো ঘুরতে গিয়েও ঘুরলো না। পরিচিত কেউ দৃষ্টিতে আটকে গিয়েছে। শুধু পরিচিত? নাহ, ভীষণ পরিচিত! মনের ঘরে বাস করা সাহেব।
শুদ্ধ ফারাহ’র হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফারাহ’র চোখেমুখে ক্লান্তি। ভার্সিটির ক্লাস করে মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। শুদ্ধ বা হাতে ফারাহ’কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– খারাপ লাগছে পাখি?
ফারাহ শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
– লাগছে। কিন্তু আইসক্রিম খেতে পারলে সব ক্লান্তি দূর হবে।
শুদ্ধ চারপাশে ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
– তোমাকে স্পেশাল আইসক্রিম খাওয়াতে না পারায় আমার মনটা পুড়ে যাচ্ছে গো পাখি।
ফারাহ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তোমার স্পেশাল আইসক্রিম তুমি-ই খাও। আমি নরমাল আইসক্রিম-ই খাবো।
শুদ্ধ আফসোসের সুরে বলে,
– না না, এসব কি বলো? বউ মানেই স্পেশাল। স্পেশাল বউকে নরমাল আইসক্রিম খাওয়ানো যায়? কিন্তু এসব স্পেশাল আইসক্রিম যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না, বুঝলে পাখি? পার্কে বেশি পাওয়া যায়।
ফারাহ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মানে?
শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে বলে,
– পাখি তো পার্কেই বেশি থাকে মেবি। স্পেশাল আইসক্রিম পাখির পেছন ছাড়া পাওয়া যায় না, বুঝনাই পাখি?
ফারাহ চোখমুখ কুঁচকে নেয়। শুদ্ধর বাহুতে কয়েকটা থা’প্প’ড় মেরে বলে,
– ছিঃ! তুমি জীবনে ভালো হবে না? আমার আইসক্রিম খাওয়ার মুড টাই নষ্ট করে দিল! খাবোই না আর।
কথাটা বলে ধুপধাপ পা ফেলে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ফারাহ। শুদ্ধ হাসলো। কিছু বলল না। দোকান থেকে দু’টো আইসক্রিম কিনে ফারাহ’র পিছু যায়। ফারাহ গাড়িতে উঠে বসেছে। শুদ্ধ গাড়ির জানালা দিয়ে ফারাহ’র সামনে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিলে ফারাহ রে’গে বলে,
– এগুলো নিয়ে যাবে তুমি? খাওয়ার রুচি নষ্ট করে দিয়ে এখন বমি করাতে চাইছ?
শুদ্ধ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– ভালোবাসি তো! নরমাল আইসক্রিম চাইলে, নরমাল আইসক্রিম এনে দিলাম। নাও পাখি বউ, খেয়ে নাও।
ফারাহ আইসক্রিম দু’টো নিয়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর ঠাস করে রেখে বলে,
– তুমি কিনেছ, তুমি-ই খাবে। আমার মুখের খাবার কেড়ে নেয়াই তোমার কাজ।
শুদ্ধ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
– স্পেশাল আইসক্রিম না খাওয়ানোর আফসোসে বউটা এতো রা’গ করছে! কি যে করি!
ফারাহ রে’গে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ আড়চোখে ফারাহকে দেখে বলে,
– রাস্তাঘাটে এভাবে খেয়ে ফেলা চোখে দেখলে প্রবলেম হয় পাখি। বেড রুমে গিয়ে আমাকে খাবে কেমন?
ফারাহ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল শুদ্ধর দিকে। তার নিজেকেই দু’টো থা’প্প’ড় দিতে ইচ্ছে করছে। শুদ্ধ গাড়ির গ্লাস দু’টো তুলে দিয়ে এগিয়ে এসে ফারাহ’র ঠোঁটজোড়ায় কয়েকটা শুকনো চুমু খেয়ে গালে গাল ঘষে মৃদুস্বরে বলে,
– এভাবে তাকালে ফারাহ পাখিকে আগুণ সুন্দরী লাগে! আমার সত্যিই প্রবলেম হয় পাখি।
শুদ্ধর কথা বলার ধরনে ফারাহ ল’জ্জা পায়। শুদ্ধ মৃদু হাসলো। আর কিছু বললো না। সোজা হয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
সামিয়া ভেজা চোখে শুদ্ধ আর ফারাহকে পুরোটা সময় দেখল। গাড়ির ভেতর ওঠার পর আর দেখতে পায়নি। ওই আবদ্ধ গাড়িতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল। শুদ্ধর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর আজ প্রায় ১ বছরের মাথায় শুদ্ধকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখতে পেল, তাও আবার সেই মেয়েটার সাথে, যে শুদ্ধর বউ। তার খারাপ লাগা শোভা পায় না। কিন্তু মন কি মানে? ভাবনার মাঝেই কখন যে রাস্তার অনেকটা মাঝখানে চলে এসেছে, মেয়েটি বুঝতেই পারেনি। পিছন থেকে মনে হলো মাইরার চিৎকার শুনতে পায়,
– সামি…….
বাকিটুকু আর শুনতেই পায় না, যেন ডাকটুকু থেমে গেল। সামিয়ার চোখদুটো স্থির হয়ে গেল। চোখের পলকে সামিয়ার স্থান হয় কয়েক হাত দূরে। একটি বড়সড় মাইক্রোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিঁটকে গিয়ে পড়েছে পিচঢালা রাস্তার ওপর। মেয়েটির মনে হলো, দুনিয়া থেমে গিয়েছে,, নড়চড় বিহীন দেহ পিচঢালা রাস্তার উপর পড়ে রইল। স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ শুদ্ধদের ছুটে চলা গাড়িটির দিকে। যে গাড়ি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে লাগলো। সামিয়ার চোখজোড়াও বুজে আসলো। চোখের কোণ ঘেঁষে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসলো,
– সা.সাহেব ভালোও থাক.কবেন।
কথাটুকু বলেই চোখজোড়া বুজে নেয়।
মাইরা দৌড়ে এসে সামিয়ার পাশে বসে। মেয়েটির পুরো শরীর কাঁপছে। এইতো একটু আগেই একটি সুস্থ-সবল সামিয়ার সাথে কথা বলল মাইরা। মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝেই কি হয়ে গেল? মাইরার নিজেকে দিশেহারা লাগে। আশেপাশে তাকালে দেখল সবাই চেয়ে আছে। কেউ এগোয় না। মাইরা কাঁদতে ইচ্ছে করল। এরা মানুষ না জা’নো’য়া’র? শহরের মানুষেরা কি এমন-ই হয়? মাইরা সামিয়ার গালে হাত দিয়ে ডাকতে লাগলো,
– আপু? সামিয়া আপু? প্লিজ চোখ খোলো।
সামিয়া চোখ খোলে না। কিন্তু থেকে থেকে কেমন ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। মাইরা সামিয়ার পাশে থেকে উঠে দু’পা সামনে এগোলে নাছিমকে দেখে কান্নামাখা গলায় বলে,
– ভাইয়া? একটা হেল্প করুন প্লিজ!
নাছিম ঢোক গিলে কোনোরকমে বলে,
– কি হয়েছে বার্বি….
বাকিটুকু আর বলল না। মাইরা নিজেই দৌড়ে সামিয়ার কাছে এসে সামিয়ার পাশে বসে বলে,
– ভাইয়া সামিয়া আপুকে হসপিটালে নিতে হবে। আপু কথা বলছে না। আপুকে হসপিটালে নিয়ে চলুন না ভাইয়া!
নাছিম দৃষ্টি নিচু করলে র’ক্তা’ক্ত সামিয়াকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। এইতো কয়েক মিনিট আগেই মেয়েটি তাকে ডাকলো, তার কাছে হেল্প চাইলো। এটুকু সময়ের মাঝে কি হয়ে গেল? মাইরা নাছিমকল এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও নাছিমের সামনে এসে অনুরোধের স্বরে বলে,
– ভাইয়া, আপনি অন্তত দয়া করে আপুকে হসপিটালে নিয়ে চলুন। এখানে কেউ এগিয়ে আসছে না। চলুন প্লিজ! লেট করলে আপুর কিছু হয়ে যাবে তো!
নাছিমের সম্বিৎ ফিরে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে সামিয়ার পাশে বসে। নিজের সকল জড়তা কাটিয়ে র’ক্তা’ক্ত আ’ধম’রা সামিয়াকে কোলে তুলে নেয়। এরপর দ্রুত পায়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সামিয়ার বা হাত ছেড়ে দেয়া। নাক-মুখে র’ক্তের ছিটেফোঁটা।
মাইরা নাছিমের পিছু পিছু দৌড়ায়। নাছিম তার ব্যাকসিটের দরজা খুলে সামিয়াকে শুইয়ে দেয়। মাইরা নিজে থেকেই সামিয়ার মাথার কাছে উঠে বসে। সামিয়ার মাথাটা নিজের কেলে নিয়ে হাঁপানো কণ্ঠে বলে,
– ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলুন প্লিজ!
নাছিম মাইরার দিকে তাকালো। মাইরার চোখে পানি। নাছিম অবাক হলো। সামিয়ার সাথে মাইরাকে কখনো দেখেনি। অথচ মাইরা এই মেয়েটার জন্য এতো ভাবছে কেন? ভাবনা রেখে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে। মাইরা সামিয়ার গালে হাত দিয়ে একটু পর পর ডাকে,
– সামিয়া আপু? এ্যাই সামিয়া আপু? ঠিক আছো? একটু আগেই তো আমার সাথে কথা বললে। সামিয়া আপু?
নাছিম গাড়ির স্পিড বাড়ায়। সামনের আয়নায় একবার দৃষ্টি পড়লে মাইরার কান্নামাখা মলিন মুখ দেখল। মাইরার কণ্ঠ কানে বারি খায়,
– সামিয়া আপু? ও সামিয়া আপু?
নাছিম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
– সামিয়া
এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– মেয়েটি কে?
মাইরা সামিয়ার দিকে চেয়েই বলে,
– এটা তো সামিয়া আপু। আপনার বন্ধু শুদ্ধ ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আপনি চিনেন না আপুকে?
কথাটা বলে মাইরা আবারও সামিয়াকে ডাকে। নাছিমের চোখেমুখে আরও বিস্ময় ভর করে। শুদ্ধর সাথে এই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল? আর মেয়েটি.. নাছিম আর ভাবতে পারলে না।
হসপিটালে এসে সামিয়াকে ওটি-তে নিতে হয়। মেয়েটির অবস্থা গুরুতর!
মাইরার টেনশনে মাথা কাজ করছে না। হঠাৎ-ই মনে পড়ল ইরফান তাকে কলেজে নিতে এসে খুঁজে পাবে না। তাকে না খুঁজে পেয়ে ইরফানের অবস্থা কি হবে? কি করবে এখন? কিছুটা দূরে নাছিমকে দেখে মাইরা এগিয়ে গেল সেদিকে। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– ভাইয়া আপনার ফোন টা একটু দিবেন?
নাছিম ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মাইরার দিকে তাকায়। সাথে সাথে দৃষ্টি নিচু করে বলে,
– ফোন নেই।
তখনই নাছিমের ফোন বেজে ওঠে। মাইরা অদ্ভুদভাবে তাকায় নাছিমের দিকে। নাছিম কিছুটা বিব্রত হয়, তবে সে মাথা তুলল না। ফোন বের করে কলে কথা বলে পকেটে ফোন রেখে দেয়। মাইরা আবারও বলে,
– ভাইয়া ফোন টা একটু দিন না? দু’মিনিট পরেই দিয়ে দিচ্ছি।
নাছিম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। বার্বিডলের এভাবে বলা কথা তাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, মেয়েটি যদি জানতো! নিজেকে সামলায়। গলা ভিজিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
– স্যরি! দিতে পারবো না।
কথাটা বলে নাছিম ঢোক গিলল, যেন একটা বড়সড় কাঁটা গিলে ফেলেছে।
মাইরা অসহায় চোখে তাকায়। এই লোকটা এমন অদ্ভুদ কেন? ইনি না ইরফানের ফ্রেন্ড, তাহলে এমন অদ্ভুদ কেন বুঝলো না।
কোথায় ভাবলো, ইরফানকে কল করে এখানে আসতে বলবে, কিন্তু সে তো ফোন-ই পাচ্ছে না। এখন ইরফানকে কিভাবে বলবে, সে এই হসপিটালে?
দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালে ইরফানকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়। ইরফান দ্রুতপায়ে তার দিকেই আসছে
মাইরা মৃদুস্বরে বলে,
– শিসরাজ?
নাছিম মাইরার বলা আনকমন নিকনেইম টি শুনতে পেয়ে ভীষণ অবাক হয়। সামনে তাকালে ইরফানকে দেখে ঢোক গিলে।
মাইরা ইরফানের দিকে এক পা বাড়ানোর আগেই ইরফান মাইরাকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে তার বুকে। নাছিম দেখল ইরফানের দু’হাতের বন্ধনীর মাঝে মাইরাকে। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে কয়েকপা বামদিকে সরে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
ইরফান মাইরাকে শক্ত করে ধরে মৃদুস্বরে বলে,
– মাই বার্ডফ্লাওয়ার। কি হয়েছে তোমার? তুমি কি সিক?
মাইরা ইরফানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছু বলতে চায়, তার আগেই ইরফান মাইরার সাদা হিজাবে র’ক্তে’র ছিটেফোঁটা দেখে ভীতস্বরে বলে,
– হোয়াট হ্যাপেন্ড বার্ডফ্লাওয়ার? আর ইউ ওকে?
কথাটা বলতে বলতে ইরফানের দৃষ্টি আটকায় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নাছিমের উপর। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
মাইরা কোনোরকমে বলে,
– না না আমি ঠিক আছি। আমি তো….
মাইরার কথা বলার মাঝে ইরফান নাছিমের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে,
– এখানে কি করছিস তুই?
মাইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সে তার বলা কথাটুকু শেষ করতে পারে না। নাছিম ইরফানের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ইরফান আমি…
ইরফান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– তোকে আমি খু’ন করব নাছিম।
নাছিম ঢোক গিলল। মাইরা একবার ইরফানের দিকে তাকায়, আরেকবার নাছিমের দিকে। ইরফান মাইরার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায়। মাইরা ইরফানের দৃষ্টিতে ভ’য় পায়। ইরফান মাইরার হাত শক্ত করে ধরল। মাইরা হাতে ব্য’থা পায়। বা হাতে ইরফানের হাত ছাড়াতে চায়, তবে পারে না।
ইরফান হাতের বাঁধন আরও শক্ত করল। দ্রুতপায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। মাইরা ইরফানের পায়ের সাথে তাল মেলাতে পারে না।
পিছন থেকে নাছিম অসহায় চোখে তাকায়। সে জানতো, মাইরা তার ফোন থেকে ইরফানকে কল করলে ইরফান তাকে যা-ই বলুক,, মাইরাকে রে’গে কি না কি বলবে,, ইরফানের রা’গ মাইরার জন্য তার ভ’য় লাগে। প্রথম প্রথম মাইরাকে কত মারতো! আজ আবার মা’রবে না তো? তার জন্য বার্বিডল আবরও মার খাবে? নাছিম জড়তা নিয়ে বলে,
– ইরফান ওকে কিছু বলিস না। আমি….
ইরফান সাথে সাথে পিছু ফিরে। ভস্ম করে দেয়া চোখে তাকায় নাছিমের দিকে। ইরফানের দৃষ্টিতে নাছিম থেমে যায়। ইরফান ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শক্ত গলায় বলে,
– আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না নাছিম।
নাছিম মাথা নিচু করে নেয়। মাইরা কিছুই বুঝতে পারছে না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইরফান মাইরার হাত টেনে এগিয়ে গিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যায়। নাছিমের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব!
ইরফান মাইরাকে নিয়ে তার গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। গাড়ির দরজা খুলে দিলে মাইরা ইরফানের দিকে তাকায়। মিনমিন করে বলে,
– আপনার কি হয়েছে?
ইরফান ডান হাত তুলে মাইরার গাল চেপে ধরতে গিয়েও আলগা করে ফেলে হাত। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ইউ নো বার্ডফ্লাওয়ার? আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে এক্ষুনি খু’ন করে ফেলি। বাট আই কান্ট। কজ, ইউ আর মাই….
ইরফান বলার আগেই মাইরা বলে ওঠে,
– হার্ট।
ইরফান শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আপনি রা’গ করেছেন কেন শিসওয়ালা?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– গাড়িতে বসো।
মাইরা ঢোক গিলে বলে,
– আপনাদের দুই বন্ধুর মাঝে কি আমাকে নিয়ে ঝামেলা হয়?
ইরফান শক্ত কণ্ঠে বলে,
– থা’প্প’ড় খেতে চাইছ? রাগিয়ো না আমায়। ফাস্ট বসো।
মাইরা এসব ভাবনা রেখে বলে,
– আপনি……
ইরফান মাইরাকে ঠেলে সিটে বসিয়ে দেয়। এরপর গাড়ির দরজা শব্দ করে লাগিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। সময় নষ্ট না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। মাইরা দ্রুত ইরফানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– কোথায় যাচ্ছেন শিসওয়ালা? যাবেন না। আমার কথাটা একটু শুনুন।
ইরফান চোয়াল শক্ত করে নেয়। গাড়ির ব্রেক কষে
বা হাতে মাইরাকে টেনে তার কোলে বসায়। মাইরার মুখ চেপে রে’গে বলে,
– আবার ওখানে যাবি? এ্যাই তোরা আমার মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে দিবি না বলে মিশনে নেমেছিস?
মাইরা তার মুখ থেকে ইরফানের হাত সরাতে চায়। ইরফান শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে মাইরার দিকে। মাইরা অসহায় চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান মাইরার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে মাইরার মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে নেয়। মাইরা ভাঙা গলায় বলে,
– আপনি আমাকে অকারণে রা’গ দেখাচ্ছেন কেন শিসওয়ালা? আপনি যে বলেছিলেন আর রা’গ দেখাবেন না।
ইরফান কেমন করে যেন তাকায় মাইরার দিকে। একটু পর ইরফান মাইরাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি! তোমার বডিতে এসব কীসের ব্লাড বার্ডফ্লাওয়ার? অ্যান্ড এখানে কেন এসেছ? অ্যান্ড নাছিম……
একটু বলে থেমে যায় ইরফান। নাছিমের কথা ভাবতেই প্রচন্ড রা’গ উঠছে তার। সে বারবার মাইরার দিকে তাকিয়ে রা’গ নেভাচ্ছে যেমন, তেমনি নাছিম মাইরার আশেপাশে ছিল ভাবতেই ঠাণ্ডা মে’জা’জ গরম হয়ে যাচ্ছে। রা’গ থেকেই মাইরাকে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে মাইরাকে নিজের সাথে চেপে ধরে। মাইরা চোখ বুজল। ইরফানকে সে বুজল। কিছু বললো না। ডান হাত ইরফানের পিঠে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– আপনি জানেন? শুদ্ধ ভাইয়ার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সে এক্সিডেন্ট করেছে। ওই আপুটার অবস্থা একটুও ভালো নয় শিসওয়ালা।
মাইরার কথা শুনে ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দেয়। অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরার চোখজোড়া ভেজা। ভাঙা গলায় বলে,
– সামিয়া আপুর ওখানে নিয়ে যাবেন শিসওয়ালা? নিয়ে চলুন না?
ইরফান ছোট করে বলে,
– পরে নিয়ে আসবো।
কথাটা বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। মাইরা অসহায় চোখে তাকায়। তবুও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরে আনবে বলেছে যখন, তখন আনবে।
– আপনার পেশেন্ট এর অবস্থা ক্রিটিকাল। চাইলে দেখা করতে পারেন।
ডক্টরের কথায় নাছিম দ্রুত মাথা তুলে তাকায়। সামিয়ার কথা মনে পড়তেই সে দ্রুতপায়ে ওটি রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
ভেতরে গিয়ে দেখল সামিয়া মেয়েটি কেমন যেন ছটফট করছে। নাছিম ঢোক গিলল। সামিয়ার মুখ দেখলে তার বারবার শুদ্ধর কথা মনে পড়ছে।
সামিয়া এমন ছটফট করছে কেন? নাছিমের কেমন যেন ভ’য় লাগলো। সামিয়া তার লালিত চোখজোড়া মেলে। নাছিমের দিকে চেয়ে কিছু বলতে চাইছে যেন। নাছিম দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে সামিয়ার পাশে দাঁড়ায়।
সামিয়া বহুকষ্টে আদো আদো স্বরে বলে,
– ভাভাইয়া আআআপনার রঋণ…….
এটুকু বলে থেমে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না মেয়েটি। নাছিম বোধয় বুঝেছে সামিয়ার কথা। তার ভীষণ খারাপ লাগছে এই মিষ্টি মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে।
নাছিম মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তো তোমাকে বলেছি, এজ আ ফ্রেন্ড, আমি তোমাকে হেল্প করেছি। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?
কথাটা বলে নাছিম খেয়াল করল, সামিয়া হঠাৎ-ই কেমন স্থির হয়ে যায়। নাছিম ভ্রু কোঁচকালো। ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ওকে কি কোনো ইনজেকশন দিয়েছেন? ও শান্ত হয়ে গেল যে? আপনারা ওর ট্রিটমেন্ট করান প্লিজ। টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না, কেমন?
ডক্টর সামিয়ার মুখের উপর কাপড় টেনে দিয়ে ব্য’থিত স্বরে বলে,
– সি ইজ ডেড।
কথাটা শুনতেই নাছিম বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ডক্টরের দিকে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামিয়ার উপর টানা সাদা কাপড়টির উপর নজর বুলায়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সামিয়া বেশ কিছুক্ষণ আগে তার সামনে পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে হেল্প চেয়েছিল। অথচ সেই মেয়েটা আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। নাছিম কেমন নির্জীব চোখে চেয়ে রইল।
খেয়াল করল, সামিয়ার বা হাত বেড থেকে নেমে অনেকটা ঝুঁলে আছে। হাতের ফাঁক থেকে একটি কাগজ পড়ে গেল।
নাছিম নিচু হয়ে কাগজটি কুড়িয়ে নিল। কাঁপা হাতে তিনটে ভাঁজ খুললে প্রথমেই চোখে পড়ে~
প্রিয় শুদ্ধ সাহেব,
নাছিম চিঠিটায় চোখ বুলায়। পুরো লেখাটুকু পড়ে তার গলায় কাঁটা বিঁধলো কেন যেন। কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয়।
দু’হাতে তার মুখে হাত বুলায়। ঠিক কতক্ষণ যে এভাবে বসে থাকলো জানেনা। সামিয়ার হাতটার দিকে চেয়ে থাকলো বেশ অনেকক্ষণ। এরপর কাঁপা হাতে সামিয়ার হাত ধরে ধরা গলায় বলে,
– তোমাকে ভালো বন্ধু হিসেবে পাওয়ার আক্ষেপ থেকে গেল সামিয়া!
বাড়ি ফিরে মাইরা ইরফানকে অনেকক্ষণ থেকে বলছে, সামিয়ার খবর নিতে। মেয়েটি কতগুলো ধমক খেয়েছে, আবার ইরফানকে বুঝিয়েছে।
ইরফান সবশেষে মাইরার কথা ভেবে তার সব রা’গ জেদ সরিয়ে রেখে নাছিমের নাম্বারে কল করে। ওপাশ থেকে নাছিমের ভারী গলা ভেসে আসে,
– ইরফান, মেয়েটি মা’রা গিয়েছে রে!
নাছিমের কথাটা শুনে মাইরা ইরফান দু’জন দু’জনের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ইরফান ঢোক গিলে বলে,
– হোয়াট?
নাছিম কথা বলতে পারেনা। মেয়েটি তার চোখের সামনে মা’রা গিয়েছে। এইতো আজকেই দেখা হলো মেয়েটির সাথে, নাছিম তাকে হয়তো কথার কথা বন্ধু বলেছিল, কিন্তু মেয়েটি থেকে গেলে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হতো না?
মাইরা দু’হাতের মাঝে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। ইরফান কল কেটে দ্রুত মাইরাকে আগলে নেয় তার সাথে। মৃদুস্বরে বলে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৮
– কাঁদছ কেন বার্ডফ্লাওয়ার? তুমি তো তাকে সেভাবে চিনতে না!
মাইরা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
– আমার অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে শিসওয়ালা। কিন্তু এমন মেয়ের সাথে কখনো পরিচয় হয়নি, যার বাবা মা নেই। সামিয়া আপুই একমাত্র ছিল, যার বাবা মা কেউ ছিল না। আমি জানি বাবা মা না থাকলে কিভাবে বড় হতে হয়! আমার তো সামিয়া আপুকে নিজের বোন মনে হতো! সামিয়া আপু হয়তো তার দুঃখ আমাদের বলেনি, কিন্তু আমি জানি,, সে অনেক দুঃখ নিয়ে বড় হয়েছে। আপুটা কোথায় হারিয়ে গেল! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!