প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১০
শার্লিন হাসান
এক্সকিউজ মি! ড্রামা মানে? গেস্টদের সাথে কীভাবে বিহেভিয়ার করতে হয় শেখেননি? অবশ্য শিখবেন কীভাবে? যেমন গার্লফ্রেন্ড তেমনি তার বয়ফ্রেন্ড।”
জাইমার কথায় ইশরাক মৃদু চেঁচিয়ে বলে, “গার্লফ্রেন্ড? হোয়াট?”
জাইমা, পোহার দিলে আঙুল দেখিয়ে বলে, “উনি তো একটু আগে আমায় শাসিয়ে বললো, উনি নাকী আপনার গার্লফ্রেন্ড।”
জাইমার কথায় পোহা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবে সেটা প্রকাশ না করে বলে, “হোয়াট? মাথা খারাপ তোমার? আমি এসব কেন বলতে যাব?”
জাইমা ভীষণ অবাক হয়ে বলে, “মিথ্যে বলছ কেন?”
“তুমি এতো ঝগড়ুটে? তোমার মেন্টালিটি এতো নিচু? শেষমেশ আমাকে নিয়েও বাজে কথা বলছ?”
জাইমার রাগ হয়। সেজন্য জবাব দেয়, “এক্সকিউজ মি! কথা বার্তা সাবধানে বলো।”
“যা সত্যি তাই বললাম।”
“কথা ঘুরালে…
” ব্যাস! মিস মৈশানী খানম, আমার সাথে ড্রামা সাজিয়ে অনেক বেশি মিথ্যে বলা হয়েছে, নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আপনি এখন আসতে পারেন।”
মৃদু চিৎকার করে কথাটা বলে ইশরাক। উপস্থিত সবাই খানিক কেঁপে উঠে। জাইমার মুখে অম্বরের কালো মেঘে জমে গেছে। ভয়ে কিছু বলার মতো পেলো না সে। কেউ কিছু বলার মতো সাহস করেনি। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশরাকের নাকের ঢগা লাল হয়ে আছে। চোখমুখে কঠোর ভাব পরিলক্ষিত। জাইমা পোহার দিকে একবার তাকায়। মেয়েটা মিটমিট হাসছে। রাহেলা খান কিছু বলার মতো পেলো না। তবে এটা শিওর হলেন যে, জাইমা এর আগেও কিছু উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করেছে যার দরুন তার প্রতি ইশরাকের মনোভাব এরকম বিগড়ানো টাইপের হয়ে গেছে। জাইমা অপমানে মুখ থমথম করে নেয়। এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসে। রাজিয়া আহমেদ ইশরাকের দিকে তাকিয়ে বলে, “এটা তুমি কী করলে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“প্লিজ আম্মু, এই মেয়েকে তুমি চিনো না। ওর মাঝে ভদ্রতার ‘ভ’ নেই। আমার সাথে ভার্সিটিতে যে নাটক করেছে তা আর না বলি।”
“ও এখন গেস্ট। তোমার বাবা শোনলে কী বলবে?”
তখন রাহেলা খান জবাব দেন, “ও একা কীভাবে যাবে? টাকা পয়সা কিছুই আনেনি। লান্সের সময় হয়েছে, আর ও চলে গেলো?”
ইশরাক এবার চুপ। রাগের মাথায় তো তাড়িয়ে দিলো। এখন তো আবার খারাপ লাগছে। পোহা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “ও এতো ঝগড়ুটে বাবাহ্! আমার জীবনে এরকম মেয়ে দেখিনি। কয়েকঘন্টায় সব এলোমেলো করে দিলো।”
কেউ টুঁ শব্দ করেনি। সবাই লান্স করতে বসলেও ইশরাক বসেনা। সে ফোন হাতে বেরিয়ে যায়। রাজিয়া আহমেদ বার কয়েক বলেছে, “লান্স করে যেতে।” ইশরাক সে কথা কানেও তুলেনা।
এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে জাইমা। ভীষণ বাজে অনুভূতি হচ্ছে। আজ অব্দি কেউ তার সাথে এরকম উঁচু গলায় কথা বললো না, ইশরাক বললো। এভাবে কেউ তাকে ধমক দেয়নি ইশরাক আজকে দিলো। কেউ তাকে তাড়িয়ে দেয়নি, ইশরাক তাড়িয়ে দিলো। সেজন্য জাইমা মনে,মনে শপথ নিয়ে নিয়েছে, “আর কখনো এই বাড়িতে আসবে না। আর না কখনো ইশরাকের সাথে কথা বলবে। শুধু ভার্সিটির টিচার নাহলে সে কখনোই ইশরাকের মুখোমুখি হতো না। আর বিয়ে! সেসব তো অনেক দূরের ব্যপার। যেহেতু জাইমার বাবা রাজী না এবার জাইমাও রাজী হবেনা।
জাইমা ফোনের কভার চেক করে। কোনরকম টাকা পয়সা পেলো না। ভাবছে কী করে যাবে! অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়, ওভার কল করে। বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে দিয়ে। জাইমা ওভার কল করার জন্য ফোন হাতে নিলে সেখানে আগমন হয় আরশানের। আগমন বললে ভুল হবে, সে গাড়িতে বসেছিল। জাইমাকে দেখে এদিকে আসে গাড়ি নিয়ে। জাইমা আরশানকে দেখে ফোনটা সরিয়ে নেয়।
আরশান জাইমার উপরনিচ পরখ করে বলে, ” মিস জাইমা তুমি এখানে?”
“বাসায় যাব। ওভার কল করছিলাম আরকী..
” আমি থাকতে ওভারকল কেন? গাড়িতে বোসো তোমায় বাসায় নামিয়ে দিব।”
“ধন্যবাদ। আমি যেতে পারব।”
“আরেহ, আসো না। যেতে,যেতে গল্প করাও হয়ে যাবে।”
জাইমা না করেনি। আরশানের পাশের সীটে বসে পড়ে। আরশান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জাইমার বাসার দিকে পথ ধরে।
তারা যাওয়ার পেছন দিয়ে ইশরাক আসে। তবে সে জাইমার নাগাল পায়নি। জাইমা আরশানের গাড়িতে করে চলে গেছে সেটা দেখেছে। যেহেতু চলে গেছে, ইশরাক তেমন মাথা ঘামায়নি সে বিষয়ে।
বাসার সামনে এসে আরশানকে ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে যায় জাইমা। এখনো ইশরাকের করা অপমান তার মস্তিষ্কে কিলবিল করছে। বাসার ভেতরে যেতে দেখে সব শূন্য। একটা মানুষও নেই। জাইমা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। জামাকাপড় পাল্টে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। দাদীকে ভীষণ মিস করছে সে। এমনিতেও ইশরাকের অপমানের পর সে বাড়িতে , জাইমাকে কেউ আটকে রাখতে পারত না। যতই উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করুক না কেন, তার কাছে নিজের আত্মসম্মান সবার আগে। আর কখনো সে বাসায় যাওয়া হবে না এটা নিশ্চিত জাইমা।
সন্ধ্যায় সাজ্জাদ খান জাইমাকে ডাকেন। মনের দুঃখ কষ্ট ভুলে জাইমা বাইরে আসে। দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি, এখনো না। এমনিতে জাইমা খাবার খেতে পছন্দ করে। সেখানে এখন অব্দি না খানা। যদিও খিদে পেট চৌচির। সাজ্জাদ খান জাইমাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কেমন লাগলো সে বাসা?”
জাইমা থম মেরে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়, “সব ভালো। সবাই ভালো।”
“তুমি একাই এসেছ নাকী ইশরাক দিয়ে গেছে?”
“ওনাদের ড্রাইভার দিয়ে গেছে।”
“তোমার দাদী কবে আসবে?”
“সেসব বলেনি কিছু।”
“বাসার সবাই ভালো তো?”
“হুম।”
কথাটা বলে জাইমা কিচেনে যায়। নিজের জন্য এল গাদা খাবার ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে রুমে চলে আসে। খাটের উপর ল্যাপটপে মুভি দেখতে,দেখতে খাওয়া শুরু করে। এছাড়া মাইন্ড ফ্রেশ করার মতো উপায় ফেলো না সে।
মুভিতে বোরিং লাগায়, জাইমা খাওয়া শেষ করে বুকশেলফের সামনে দাঁড়ায়। সদ্য কিনে আনা, শার্লিন হাসানের নতুন বই ‘বুকপকেটের মায়াবিনী’ তে হাত বুলায়। একটা বুকপকেটর এবং তাতে থাকা লাল রমের গোলাপ ও চিঠিটা একদম জীবন্ত মনে হলো। জাইমা লোভ সামলাতে পারেনি। বই হাতে পড়তে বসে যায়। একজন উড়নচণ্ডী ছেলে এবং তার বিপরীতে দৃঢ়চেত অনাড়ম্বর কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেয়ে নিয়ে সৃষ্ট গল্প বুকপকেটের মায়াবিনী।
জাইমা পুরো বইটা শেষ করতে পারেনি। সেজন্য উঠে নিজের প্রেজেন্টেশন রেডি করে। আগামী কালকে সে প্রেজেন্টেশন দিবে। যেহেতু আজকে দেয়নি। এতো সব কাজের মাঝে ইশরাকের দেওয়া অপমান জাইমা ভুলতে পারেনি।
নিজের হাতের কাজ সামলে জামিলার রুমে যায় জাইমা। গিয়েই জামিলার গলা জড়িয়ে ধরে দুগালে চুমু খেয়ে বলে, “আগামী কালকে প্রেজেন্টেশন দেব। একটা শাড়ি দিও।”
“নিজের পছন্দে একটা নিয়ে যেও।”
“থাংকু।”
কথাটা বলে জাইমা, জামিলার কোলে শুয়ে পড়ে। জামিলার হাত নিজের মাথায় রেখে বলে, “মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করো তো আমার জন্য।”
“কী হয়েছে মা?”
“কিছুনা আম্মু।”
কথাটা বলে জাইমা চোখ বন্ধ করে নেয়। মায়ের আদরে ভীষণ কান্না আসছে জাইমার। পোহা কীভাবে অস্বীকার করে তাকে সবার সামনে খারাপ বানাল। ইশরাকও পোহাকে বিশ্বাস করে তাকে অপমান করলো? জাইমা বুঝলো নিজের কান্না আটকে রাখা দায়। সেজন্য লাফ দিয়ে উঠে বসে। নিজের রুমে ছুটে এসে অশ্রু বিসর্জন দেয়। খাটে শুয়ে, একটা টেডি বুকের সাথে চেপে ধরে গুনগুন করে কাঁদতে থাকে।
সন্ধ্যা থেকে ইশরাককে নিয়ে সবাই নালিশ দিচ্ছে। বিশেষত সাজেদ খান খবরটা শোনার পর ছেলেকে বকেই চলেছে। তার ভাইয়ের মেয়ে প্রথম তার বাড়িতে এসেছে, সেখানেও ইশরাক তাকে ধমকে চলে যেতে বলেছে। কত বড় লজ্জাজনক ব্যপার সেটা কী ইশরাক বুঝে? নিজের রাগকেই তো উপরে রেখেছে।
লিভিং রুমে এই নিয়ে একের পর এক আলাপচারিতা চলছে। সেই সাথে ইশরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। ইশরাক সবার বকাঝকা শুনে স্তব্ধ। দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “মৈশানী কে বলো, আগামী কালকে রেডি হয়ে থাকতে। আমি ওকে পিক করে নিয়ে আসব।”
বিনিময়ে রাহেলা খান হাসেন। ইশরাক ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়। জিজ্ঞেস করে, “কী হলো?”
“তোমার মনে হশ ও আর আসবে?”
ইশরাক জবাব দেয়না। রাহেলা খান পুনরায় বলে, “আমার জাইমা বাচ্চা স্বভাবের, কোমলমতি শিশুদের মতো। সেজন্য ওকে কেউ ধমক দিয়ে কথা বলেনা। ওর মনটা একদম বাচ্চাদের মতো। যেখানে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে ও কোনদিন আসবেও না। আমার নাতনির আত্মসম্মান বোধ প্রখর। বুঝেছ?”
ইশরাক কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। তখন সাজেদ খান বলেন, “যেহেতু মর্ম ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ও আসবেনা। সেখানে একবারে মর্মর বউ করে নিয়ে আসি। তখন চাইলেও যেতে পারবে না।”
সাজেদ খানের এরকম পরিবর্তন দেখে ইশরাক খানিক অবাক হয়। কয়দিন আগেও তো বললো, ‘বিয়েতে রাজী না।’ এখন হুট করেই রাজী? রাহেলা খান ছেলের কথায় খুশি হয়ে বলে, “তাহলে দেরি কেন? আমার জাইমা বিয়ে পাগল মেয়ে। ওর কাহিনী তো তোমরা জানো না।”
তখন ইশরাত বলে, “বলো দাদী। দেরি করছ কেন?”
রাহেলা খান বলেন, “ওর বউ সাজার শখ। পড়াশোনায় আগ্রহ কম। জামিলা,সাজ্জাদ বকাঝকা করে পড়াশোনা করায়। এইচএসসিটা ঠেলেঠুলে দিয়ে সে সারাক্ষণ বিয়ের ফযিলত নিয়ে ওয়াজ চালাতো বাসায়। যদিও ওর বাবা-মা কেউ থাকত না। সন্ধ্যায়ও চালাত। এর বিয়ে হয়েছে, ওর বিয়ে হয়েছে এসব বলতো। এরপর ভার্সিটি ভর্তি করালে প্রথম তো ঠিক ছিলো। কিন্তু ফাইনাল দিতে রাজী হয়নি। বলতে, অসুস্থতা নিয়ে সে কী কাহিনী। তার নাকী হাতে ব্যাথা, পায়ে ব্যাথা,মাথায় ব্যাথা। ডক্টরের কথা বললে যেতে রাজী হয়না। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভার্সিটিমুখী করা যায়নি। তবে আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান করত, কেন তাকে পড়াশোনা করে মেরে ফেলছি? বিয়ে কেন দিচ্ছিনা? একবছরের মতো বাসায় থেকে যখন দেখলো কেউ এসব নিয়ে ভাবছেনা আবারো ভার্সিটি গেলো। এখনো বিয়ের জন্য লাফায়। তবে বাবা-মাকে বলার সাহস পায়না।”
রাহেলা খানের কথায় সবাই মৃদু হাসলেও ইশরাক হাসেনা। সে তো হারে হারে টের পেয়েছে এই মেয়ে ঠিক কী পরিমাণ ফাঁকিবাজ আর বিয়েপাগল।
এই মূহুর্তে জাইমার কোন ব্যপার নিয়ে সে আগ্রহী না। সেজন্য আলগোছে সরে আসে। ইশরাক যেতে পুনরায় বিয়ের ব্যপার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
সকাল,সকাল জাইমা পার্লারে এসেছে শাড়ি পরতে। নাশতা বাইরে সেরে নিয়েছে। শাড়ি পরে রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। আজকে নিজের সব দুষ্ট বুদ্ধি বাসায় বেঁধে রেখে এসেছে।
জাইমা নিজের ডিপার্টমেন্টে যায়। মেহেরের সাথে বসতে মেহের জাইমাকে উপরনিচ পরখ করে বলে, “মাশাআল্লাহ তোমায় এতো সুন্দর লাগছে। প্রফেসর তো অজ্ঞান হয়ে যাবে।”
“প্লিজ প্রফেসর নিয়ে আমায় কিছু বলোনা। আমি প্রেম করব না।”
“ঠিক আছে।”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৯
জাইমা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। যখন ইশরাকের ক্লাস শুরু হয় তখন সে সব ধান্দা ছেড়ে দেয়। গতকালকের হিসাবে আজকে জাইমার প্রেজেন্টেশন। যেহেতু তার ড্রেস আপ বলছে সে রেডি। সেজন্য ইশরাক জাইমাকে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য বলে। জাইমাও দেরি করেনি। সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়। পুনরায় নিজের সীটে এসে বসে। ইশরাক নিজের আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে মাঝেমধ্যে জাইমার দিকে তার নজর যাচ্ছে।
এতোদিন যে সুন্দর লাগেনি এরকম না। জাইমা খুব কম সাজে। তবে স্বল্প সাজে তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। আজকে শাড়ি পরাতে তাকে তো একদম পরীর মতো লাগছে।