প্রণয়ের প্রিয়কাহন শেষ পর্ব
শার্লিন হাসান
নবদিনের সূচনালগ্ন। প্রকৃতিতে ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে অবিরত। ইশরাক সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে,কফির মগ নিয়ে ব্যালকনিতে বসেছে। জাইমা সে পড়ে,পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইশরাক তাকে ডাকেনি।
কফি শেষ করে রুমে আসে ইশরাক। দেওয়াল ঘড়িতে নজর আটকে যায়। সকাল সাড়ে সাতটা বাজছে অথচ জাইমা এখনো ঘুমাচ্ছে। অনেক বেলা অব্দি ঘুমালে ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইশরাকের মনে হয়না, সেই ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে জাইমার কোন ধারণা আছে।
জাইমার সামনে দাঁড়ায় ইশরাক। কোমড় অব্দি সাদা চাদর জড়ানো। কোলবালিশের উপর মাথা দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। চুলগুলো পুরাই এলোমেলো। ইশরাক জাইমার সামনে বসে। আলতো হাতে জাইমার মুখের উপর থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানের পিঠে রাখে। নরম কোমল গালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করে। পরক্ষণে হাত সরিয়ে নেয়৷ উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে, “মৈশানী উঠো। নাশতা করতে হবে তো।”
জাইমার সাড়া শব্দ নেই। ইশরাক পুনরায় ডাক দিতে গেলে তার ফোনটা বেজে উঠে। সেটা হাতে নিতে দেখে, দাদী কল দিয়েছে। তাও ভিডিও কল। ইশরাক কল রিসিভ করে সালাম দেয়। রাহেলা খান সালামের জবাব নিয়ে, ইশরাককে খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করে। কথা বলা শেষে রাহেলা খান বলেন, “জাইমা কোথায়? তার কাছে দেও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ঘুমাচ্ছে।”
“জাগিয়ে তোলো। ওর যা ঘুম! দুনিয়া কেয়ামত হয়ে গেলোও সেটা সহজে ভাঙতে চায়না।”
ইশরাক এগিয়ে আসে। জাইমার কাঁধে হাত রেখে নাড়াচাড়া দিতে জাইমা চোখ মেলো তাকায়। বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে, “কী সমস্যা?”
“এতো বেলা অব্দি কেউ ঘুমায়?”
“কেউ না ঘুমালেও, আমি ঘুমাই।”
“দাদী কথা বলবে।”
জাইমা লাফ দিয়ে উঠে বসে। ইশরাকের থেকে ফোন নিয়ে স্ক্রীনে তাকায়। রাহেলা খানের সাথে গল্প গুঁজবে মেতে উঠে। ইশরাক রুমের দরজা খুলতে দেখে ডোডো দরজার সামনে দাঁড়ানো। ডোডোকে দেখে ইশরাক হেঁসে ফেলে। ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। দু’জন সোফার উপর বসে। জাইমা কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দেয়। বালিশের পাশে থাকা ওরনাটা গলায় দেয়। বিছানা ছেড়ে ঘুম ঘুম চোখে ফ্রেশ হতে চলে যায়। জাইমা যেতে ইশরাক বিছানার কাছে আসে। সেটা গুছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।
জাইমা রেডি হয়ে আসে। ইশরাকের কাজ শেষ হয়ে যায় ততক্ষণে। জাইমা রুম গুছানো দেখে উৎসুক হয়ে বলে, “আরেহ বাহ! আপনি রুমও গুছাতে পারেন?”
“হ্যাঁ, অগোছালো কিছু আমার পছন্দ না। বিশেষত রুম।”
“অহ্।”
কথাটা বলে জাইমা মেকি হাসে। মনে পড়ে যায় নিজের রুমের অবস্থার কথা। কী,কী অবস্থা যে করে রাখে সে! রুপা নাহয় দাদী গুছিয়ে দেয়। নিজে খুব কমই গুছায়। জাইমার কাছে অগোছালো রুমই ভালো লাগে। অদ্ভুত তবুও সত্যি!
ইশরাক জাইমাকে উপরনিচ পরখ করে বলে, “চলুন, নাশতা খেতে হবে।”
“ওয়ান মিনিট।”
“কী?”
“আপনি আমাকে তুমি করে বললেই যাব।”
“বলব।”
“না এক্ষুনি বলতে হবে। আপনার কাজিন পোহাকে তো তুমি করে বলেন। সেখানে নিজের বউকে বলতে এতো আপত্তি কিসের?”
“ও তো পূর্বপরিচিত। আপনি তো স্টুডেন্ট হিসাবে পরিচিত হয়েছেন।”
“তো?”
“আচ্ছা, আসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ইশরাকের ‘তুমি’ সম্মোধনে জাইমা ফিক করে হেঁসে দেয়। ইশরাক জাইমার পেছন দিয়ে আসে। দু’জন আগেপিছে নিচে আসে।
সবাই মোটামুটি উপস্থিত হতে চেয়ার টেনে বসে জাইমা। তার একপাশে আছে আনায়া। আরেক পাশে ইশরাক বসেছে। সে জাইমাকে জুশ,ব্রেড,জেলি সব এগিয়ে দিচ্ছে। জাইমা সবার দিকে একনজর তাকায়। পোহা,ইশরাত পাশাপাশি বসা। আরেক পাশে রাজিয়া আহমেদ বসা। তখন সাজেদ খান ইশরাককে বলেন, “সন্ধ্যায় পার্টি আছে। তোমার যাদের,যাদের ইনভাইট দেওয়ার দিয়ে দিও।”
ইশরাক ছোট্ট করে জবাব দেয়, “হু!”
জাইমা, ইরার সাথে গল্প করায় মেতেছে। এরই মাঝে খান মহল ডেকোরেশন কাজ শুরু হয়েছে।
ইশরাক এখানে ছিলো কিছুক্ষণ। তার রুমে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার আগে জাইমাকে জিজ্ঞেস করে, “এখানে থাকবে নাকী রুমে আসবে?”
“যাব।”
জাইমা ইশরাকের সাথে রুমে চলে আসে। এসেই খাটের উপর পা মেলে বসে পড়ে। ইশরাক কলে কথা বলছে। জাইমা বোরিং ফিল করছে। ইশরাকের কথা শেষ হতে জাইমা বলে, “এ্যাই আপনার কাছে চিপস,চকলেট আছে?”
ইশরাক থমথমে মুখ করে বলে, “এসব আনহেলদি খাবার আমি খাইনা।”
“আমি খাই। বাইরে যাবেন?”
“না। আজকে থেকে এসব খাওয়া বন্ধ।”
জাইমা চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ইশরাকের উদ্দেশ্যে বলে, “আসলেই, টিচাররা যে কিপ্টা হয় এটার প্রমাণ পেলাম। এই জন্যই আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি।”
ইশরাকের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। জাইমা তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। জাইমার হাবভাব দেখে ইশরাক কিছু বলেনা। অনেক্ক্ষণ চুপ থেকে বলে, “সন্ধ্যার জন্য ড্রেস রেডি আছে?”
“শাড়ি আছে। এছাড়া আর কী?”
“শাড়ি সুন্দর তো!”
ইশরাকের কথায় জাইমা মৃদু হাসে। তবে জবাব দেয়না। দু’জনের মাঝে এখনো বেশ ফর্মালিটি রয়েছে। জাইমাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনা। ইশরাকও না।
সন্ধ্যায় অতিথি আসা শুরু করে। খান মহলের অনেকে রেডি তো অনেকে রেডি হচ্ছে। সাজ্জাদ খান,জামিলা,রাহেলা খান, রুপা তারা সবাই এসেছে।
সবাই সবার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। জাইমা রুমে রেডি হচ্ছে। আনায়া তাকে শাড়ি পরতে হেল্প করছে। ইশরাক সে অনেকক্ষণ আগেই রেডি হয়ে,নিচে চলে এসেছে।
আপাতত সে রুমে কিছুটা ভীড়। জাইমার সাজগোছ শেষ হতে সে গল্প গুঁজবে মেতে উঠে। অনেকক্ষণ রুমে থাকার পর সাজেদ খান এসে ডেকে নিচে নিয়ে যান। জাইমা তার শ্বশুরের সাথে নিচে আসে। জাইমা আসতে,ইশরাকও সেদিকে আসে। দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ানো। সাজেদ খান নিকপর বিজনেস পার্টনারদের সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে,ছেলে এবং ছেলের বউকে। ইশরাকের ফ্রেন্ডসরাও এসেছে। তাঁদের বেশীরভাগ প্রফেসর, ম্যাজিস্ট্রেট আর বিজনেসম্যান।
ইশরাক,জাইমার পিকচার্স তোলা হয়। সাথে ফ্যামিকি পিকচার্সও।
পার্টিতে কেউ,কেউ কাপল ডান্স করছে। ড্রিক্সের গ্লাস হাতে কেউ,কেউ কথা বলছে। ইশরাত তার ভাবী এবং ফ্যামিলির সাথে।
পোহা আজকে সরে সরে আছে। তবে দূর থেকে আগাগোড়া সবটাই পরখ করছে। ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। গেস্টরা সবাই ডিনার করে। গিফট দিয়ে বেশীরভাগ বিদায় নিয়েছে। জামিলা,সাজ্জাদ খান তারাও বিদায় নিবে। জাইমা তার বাবার বুকে মাথা দিয়ে রেখেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। সাজেদ খান পাশে দাঁড়ানো। দুই ভাই তেমন কথা বলেনি আবার বলেছে। জাইমার মন খারাপ দেখে সাজেদ খান বলেন, “এখন তো তেমার বাবা দুজন। ওই বাড়িতে একজন এ বাড়িতে একজন। এতো মন খারাপের কী আছে মা?”
জাইমা মাথা নাড়ায়। সাজ্জাদ খান হাসেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ইশরাক আসতে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমার মেয়ের খেয়াল রেখো। একটু ছটফটে, মানিয়ে নিও।”
ইশরাক মাথা নাড়ায়। জাইমার দিকে তাকিয়ে বলে, “জ্বী,আপনি চিন্তা করবেন না বাবা।”
ইশরাকের থেকে বাবা সম্মোধন পেয়ে সাজ্জাদ খান খুশি। জাইমা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জামিলা এসে ইশরাককে সাবধান করে বলে, “ওকে কিচেনে একা ছেড়ো না।”
এ কথায় উপস্থিত সবাই হেঁসে ফেলে। জাইমা মুখটা মলিন করে নেয়। ইশরাক নিজের হাসি থামিয়ে নেয়। জাইমাকে পুনরায় পরখ করে। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে। শাড়িতে একদম বুঝার উপায় নেই, মেয়েটা যে এখনো বাচ্চা। একদম পারফেক্ট বউ লাগে।
সাজ্জাদ খান বিদায় নেয়। জাইমা বাকীদের সাথে উপরে চলে যায়। তারা সবাই আনায়ার রুমে আড্ডা দিতে বসেছে। রাজিয়া আহমেদ টায়ার্ড থাকায় চেঞ্জ করতে চলে গেছেন। সাজেদ খান মেডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
ইশরাক নিচে কলে কথা বলছিলো। রাত একটার বেশি বাজে। ভীষণ টায়ার্ড ফিল করছে সে। টেবিলের উপর থাকা একটা কোল্ড ড্রিংকের গ্লাস নজরে আসতে সেটা হাতে নেয়। পান করতে,করতে কলে কথা বলছিলো সে। কয়েক ঢোক পান করার পর মাথাটা কেমন ঝিমুনি দিয়ে উঠে। ফোনটা পকেটে রেখে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায় ইশরাক। নিজের ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সে। ভীষণ অবাক হয়! পার্টিতে কোন নেশা জাতীয় পানীয় রাখা হয়নি, তবুও এটা কী হচ্ছে?
ইশরাত পার্টি শেষে রুমে এসে পড়েছে। ড্রেসও চেঞ্জ করেনি। তার কোল্ড ড্রিংকেও নেশা জাতীয় কিছু ছিলো। যেটা পান করে সে বেহুশ!
ইশরাক যখন হেলেদুলে যাচ্ছিলো তখন পোহাও নিচে আসছিলো। ইশরাককে দেখে এগিয়ে আসে। কাছাকাছি আসতে দেখে ইশরাক নিজের ভারসাম্য রাখতে পারছেনা তবুও চেষ্টা করছে। পোহা এসে ইশরাকের হাত ধরে ফেলে। কাছাকাছি হওয়ায় ইশরাকের পারফিউমের কড়া ঘ্রাণে সে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ে। পোহাকে দেখে ইশরাক হাত ঝাড়ি দেয়৷ আঙুল উঠিয়ে বলে, “ডোন্ট টাচ মিই।”
সে হেলেদুলে একাই রুমে যায়। পোহাও পেছন দিয়ে আসে। ইশরাকের হাত ধরে তাকে খাটের কাছে নিয়ে যায়। যেহেতু ইশরাক নিজের ভর প্রায় ছেড়ে দিয়েছে,পোহা সেটা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ইশরাককে খাটে শুইয়ে দিয়ে নিজেই তার বুকের কাছে মুখ নেয়। চোখ বন্ধ করে পারফিউমের স্মেল নেয়। ইশরাকের চোখ দু’টো ঘুমে নিভন্ত।
জাইমা সবাইকে গুড নাইট দিয়ে রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইশরাকের পাশে পোহাকে দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। দৌড়ে আসে সে! পোহাকো সরিয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় পোহার গালে। চড় খেয়ে পোহার হাত গালে চলে যায়। রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জাইমার দিকে। নিজে পুনরায় চড় দিতে গেলে
জাইমা পোহার হাত ধরে নেয়।নিজের দখলে নিয়ে সেটা মোচড় দিয়ে বলে, “আমার হাজবেন্ডের থেকে দূরে থাকবি নাহলে হাত ভেঙে দেব।”
“তোর স্বামী আমাকে ডেকে এনেছে। ইউ নো, আজকে তোর থেকে বেশি আমাকেই হট লেগেছে।”
জাইমা পোহার উপরনিচ পরখ করে। স্লিভলেস গাউন। একপাশে হাটু অব্দি কাটা। পা দেখা যাচ্ছে। জাইমা সেদিকে তাকিয়ে হাসে। জবাব না দিয়ে পোহার হাত ধরে তাকে দরজার সামনে নিয়ে আসে। কাঁধ বরাবর ধাক্কা দিতে পোহা তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। তার উপর পড়েছে হাই হিল! নিচে ধপাস করে পড়তে জাইমা দরজার কপাটে হাত রেখে বলে, “নেক্সট টাইম পারমিশন ছাড়া রুমে আসলে এভাবেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব।”
“ইউ চিপ…
” সর শালী নষ্ট মেয়ে। পরের বরের দিকে তাকায় আবার এখানে ইংরেজি বলে।”
“থার্ড ক্লাস!”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১৬
“নিজেকে দেখ! কী একটা ড্রেস পড়েছে তাকে নাকী হট লাগছে! লাগছে বালের মতো। থু,থু!”
কথাটা বলে জাইমা দরজা লাগিয়ে দেয়। পোহা সেদিকে তাকিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জাইমা দরজা লক করে জোরে শ্বাস নেয়। ইশরাক ঘুমাচ্ছে। পায়ের জুতো গুলোও খুলেনি। সেগুলো নিয়েই বিছানায় শুয়ে আছে। জাইমা চেঞ্জিং রুমে চলে যায়। শাড়ি,জুয়েলারি রেখে চেঞ্জ হয়ে সাদামাটা থ্রিপিস গায়ে জড়িয়ে নেয়। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ইশরাক সজাগ নেই নাহলে কী যে করত! এখন রাগ দেখিয়েও লাভ হবে। ইশরাকের দিকে আর যায়নি সে। লাইট অফ করে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে।