প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১২
মুসতারিন মুসাররাত
মধ্য দুপুর। তপ্ত রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও মেজাজ যতটা না উত্তপ্ত ছিলো, তৃষাকে দেখার সাথে দপ করে ইভানের মেজাজ ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগিয়ে ওঠে। ওটা তৃষা মস্তিষ্ক এটা ঠাহর করতেই ইভানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। এতদিনে শুকিয়ে যাওয়া অপমানের ঘা টা দগদগ করে উঠল। এই মেয়ে! এই একটা মেয়ের জন্য! বন্ধুমহলে সে আজ থেকে দেড় বছর আগে চরম অপমানিত হয়। শুধু কী বন্ধু মহলেই? উঁহু! বন্ধুমহলেই নয়, তাদের এলিট সোসাইটিতেও রিতিমত কানাঘুষা চলতো।
ভালোবাসা হারিয়ে যতটা না কষ্ট পেয়েছিলো তার থেকে বেশি কষ্ট হয়েছিলো বন্ধুদের তারপর সোসাইটির লোকদের তাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসি ঠাট্টা করায়। ক’দিন হৈচৈ পড়ে যায়, বিয়ের দিন কনে পালিয়েছে! তাও আবার হবু বরের ছোট ভাইয়ের সহায়তায়। নিশ্চয় ছোট ভাইয়ের সাথে অ্যাফেয়ার্স আছে। আজ সেই ছলনাময়ী নারীকে দেখে ঘৃ/ণা ছাড়া আর কিছুই আসছে না। পরপর ইভান দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তাকাতেও আজ রুচিতে বাঁধছে তার। নিজের উপরও তার রাগ হচ্ছে। একসময় এই মেয়েটিকে সে পছন্দ করেছিলো। বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। এখন এটা ভেবে ইভানের নিজের উপর নিজেরই আফসোস হচ্ছে। ইভানের হঠাৎ উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা একটা লাইন মনে পড়ল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” অল দ্যাট গ্লিটারস ইস নট গোল্ড।”
তৃষার সাথে এই বাগধারাটা খাপে খাপ। ইভান দৃষ্টি নামিয়ে চুলের ভাঁজে আঙুল চালনা করে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। তন্মধ্যে পরিচিত মেয়েলি গলার মিহি স্বর আসলো,
-” ইভান!”
মুখে প্রশস্ত হাসির রেখা নিয়ে ইভানের দিকে এগোয় তৃষা। ইভান পরপর কপাল কুঁচকে দাঁত কটমট করে চায়। তৃষা নিশ্চিত হয়, দিব্য খুব জেদি তাই ওর সাথে কখনোই হবে না। ছুঁড়ে ফেলা জিনিসে ও ফিরেও তাকায় না। এখন যদি ইভান তারজন্যই এখানে আসে, তাহলে ইভানকে মেনে নেওয়াই বেটার। এটা ছেড়ে ওটা দেখলে নিজেরই লস। যা লস হয়েছে হয়েছে। এখন পুরোনো দিকেই যাওয়া বেটার হবে। মনেমনে এসব ভাবে তৃষা। মুখে কৃত্রিম বেদনার ছাপ টেনে নেয়। আরো বেদনার্ত অসহায় কণ্ঠে বুলি আওড়ায়,
-” ইভান আ’ ম স্যরি। আমি খুব খুব স্যরি। আমি জানি আমার কোন মুখ নেই তোমার সামনে দাঁড়ানোর। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। সেদিন ওভাবে পালিয়ে যাওয়া আমার কোনমতেই ঠিক হয়নি। ইভান আমি রিপেন্ট। আমি সত্যিই অনুতপ্ত নিজের করা বো°কা°মির জন্য। ইভান তুমি দ্যাখো দ্যাখো আমি নিজের ভুল শুধরে নিতে আবার ফিরে এসেছি। আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তোমার ভালোবাসার কাছে আমার শত ভুল এক নিমিষেই মাফ হয়ে যাবে। আর যেটা আমি করেছিলাম, সেটা তো পড়াশোনার জন্যই। তুমিই তো আমাকে ডেনমার্ক যেতে দিতে রাজি হচ্ছিলে না। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে মানছি ওভাবে যাওয়া আমার অনুচিত হয়েছে। প্লিজ ইভান প্রাডন মি।”
হঠাৎ রাগের জায়গায় ইভানের হাসি পায়। ইভান দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে শব্দ করে গা দুলিয়ে হাসলো। হাসি থামিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” নাইস অ্যাক্টিং! আর কোনো গুণ না থাকলেও অ্যাক্টিং এর গুণটা ভালোই আয়ত্ত করেছো। অ্যাক্টিং এ তোমার তো অস্কারজয়ী হওয়ার কথা। এই একটা জিনিসই তো খুব ভালো পারো। আর এই গুণ দিয়েই তো দিনের পর দিন ছেলেদেরকে বো°কা বানিয়ে রাখো।”
কথা বলতে বলতে আচমকা খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো তনুজার দিকে নজর পরে ইভানের। যে কিনা একহাতে কাঁধের ব্যাগের ফিতা চেপে ধরে দৃষ্টি নত করে মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে। বান্ধবীর থেকে বিদায় নিয়ে সে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ায়। এদের দু’জনের গলার মৃদু আওয়াজ তার কানে আসে। তৃষার কথা শোনার সাথে সাথেই তনুজার বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছিল। হঠাৎ কেমন শুণ্যতা অনুভব হচ্ছিল। এই মাইকোলজি নিউ মিস তৃষা চৌধুরীই তাহলে সেই তৃষা। ইভানের এক্স। ইভান কী জবাব দেয় তাই শুনতে তনুজা আগ্রহী ছিলো।
-” ইভান ট্রাস্ট মি। ভালো প্রেমিকা আমি হতে পারিনি। তবে আই প্রমিজ একজন ভালো জীবন সঙ্গী হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেবো। বিলিভ মি। আর তোমার রাগ ক্ষোভ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই থেকেই এমন বলছো। এইযে তুমি এখানে আসছো, আমি জানি আমাকে তোমার জীবনে ফিরে পেতে চাও। আমি আর কোনো বো°কা°মি করতে চাই না। আই উইল কাম ব্যাক ইনটু ইউর লাইফ, ইফ ইউ ওয়ান্ট,।”
ইভানের খুব বাজেভাবে কিছু বলতে ইচ্ছে করল। তবে কণ্ঠনালী অবধি শব্দগুলো আসলেও মুখ দিয়ে বের করে না সে। কোনো রকম শব্দগুলো গিলে নেয়। পরপর কিছুভেবে মুখে হাসি টেনে নেয়। একটু জোরেশোরে ডাকে,
-” তনুজা!”
তনুজা চকিতে চাইল। ইভান হাত নাড়িয়ে ঠান্ডা গলায় ফের বলে,
-” কী হলো! আসো।”
তনুজা বাধ্য মেয়েটির মতোন আলতো পায়ে এগোয়। তৃষা বিস্ময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চায়। সাদা-আকাশি রঙের মিশ্রণের স্যালোয়ার স্যুট গায়ে। টানাটানা চোখ, গোলগাল মুখ। তনুজার আপাদমস্তক চোখ বুলায় তৃষা। এই সেই তনুজা! তার কাছে সাধারণ একটা ছাপোষা মেয়ে ঠেকছে তনুজাকে। তনুজা এসে ইভানের পাশে দাঁড়ায়। ইভান চোখের পলক তুলে তৃষার দিকে চায়। প্রগাঢ় স্বরে বলে,
-” মিট মাই ওয়াইফ। সী ইজ ফারিশতা নূর তনুজা। মাই মিসেস। মিসেস ইভান।”
তৃষা পরপর তনুজার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইভানের পানে চায়। ইভানের চোখ দু’টোতে স্পষ্ট রাগ আর ঘৃ/ণা। তৃষা সহসা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঐ চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস তার হলো না। ইভান যে প্রত্যুত্তরটা এভাবে দিবে তা তৃষা স্বপ্নেও ভাবিনি। আজ ইভান এখানে তৃষার জন্য আসেনি, সে এসেছে তনুজার জন্য। তৃষার ভাবনায় বুড়িগঙ্গা নদীর দূষিত পানি ঢেলে দেয় ইভান। অপমানে থমথমে হয়ে যায় তৃষার শুভ্র মুখ। ইভান হাত বাড়িয়ে তনুজার একটা হাত ধরে। তনুজার কোমল আঙুলের ভাঁজে নিজের রুক্ষ-শক্ত লম্বা লম্বা আঙুল গলিয়ে দেয়। ইভানের আকস্মিক ছোঁয়ায় তনুজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়। সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় তনুজার। বুকটা তার অস্বাভাবিক কাঁপছে। ইভান নির্লিপ্ত আছে। তনুজার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,
-” লেটস গো।”
তৃষার সাথে কথা বলার ইচ্ছে আর রুচি কোনটাই তার নেই। তনুজার বিস্ময় কা°ট°ছে না। রুমের মধ্যেও যে মানুষটা দুইহাত দূরত্বে থাকে। তার হঠাৎ কী হলো রাস্তায় মানুষের মধ্যে হাত ধরেছে!
-” কী হলো চলো! তুমি কী চাইছো এখন সবার সামনে তোমাকে কোলে চড়িয়ে গাড়িতে বসাতে! দ্যাখো রাস্তায় লোকলজ্জার ব্যাপার-স্যাপার আছে। সো সম্ভব নয়। তাই বলছি রাতে তোমার সব ইচ্ছে একসাথে পূরণ করবো। এখন ফাস্ট চলো।”
তনুজার কান দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তনুজা দফায় দফায় অবাক হচ্ছে। আর লোকটার হঠাৎ কী হলো! ভেবে দিশা পাচ্ছে না তনুজা। ইভানের থেকে এহেন লাগামহীন কথা তনুজা কস্মিনকালেও ভাবেনি। তনুজা অপ্রস্তুত হয়। মুখ দিয়ে রা শব্দটিও বেরোয় না।
ইভান ফিরেও তাকায় না তৃষার দিকে। তনুজার হাত ধরে সে গাড়ির কাছে যায়। ইফতিয়ার ইভান জানিয়ে দিতে চায়, তার জীবনে তৃষা নামক রমণীর কোন অস্তিত্ব নেই। আজ তৃষার মতোন অভিনয় দিয়েই সে তৃষাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। ইভান ড্রাইভ করছে। তনুজা কোণা চোখে চাইছে। তনুজার কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, তবে সাহসে কুলায় না।
পড়ন্ত বিকেল। জানালা গলিয়ে বিকেলের নরম রোদ এসে নিতির চোখেমুখে পড়ছে। নিতি নরম বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে, হাতে তার গল্পের বই। পা দু’টো জানালার গ্রিলের উপর রাখা। হঠাৎ কিছু মনে হতেই ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসে। পরপর তনুজার রুমের সামনে যায়। দরজাটা ভিড়ানো ছিলো। এই সময় ইভানও তো বাড়িতে থাকে না। তাই নক না করেই রুমে ঢুকে সে। হালকা কেশে ঘরময় নজর বুলায়। ফাঁকা ঘর। সোজা ব্যালকনিতে যায় সে। সেখানে এক রমণী দুইহাত বুকে গুঁজে উদাসীন হয়ে আকাশপানে চেয়ে। নিতি পিছন থেকে তনুজার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
-” ভাবিমণি! এখানে এভাবে দাড়িয়ে কী করছো?”
তনুজা উদাসী হয়ে ভাবনায় এতটাই ডুব দিয়েছিলো যে নিতির উপস্থিত টের পায়নি সে। আচমকা নিতির এভাবে ধরায় চমকে উঠে। পরপর নিতির গলা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,
-” ওহ্; তুমি। আমি তো চমকে গিয়েছিলাম।”
-” চমকে গিয়েছিলে, নাকি যাকে ভেবেছিলে তার জায়গায় আমাকে দেখে হতাশ হলে! নিশ্চয় ভাইয়াকে ভেবেছিলে। তোমার সে ভাবনায় সে গুড়ি বালি দিয়ে সেখানে তোমার রায় বাঘিনী ননদিনীকে পেলে। যে কীনা বি’র’ক্ত করতে চলে এলো।”
তনুজা নিতির দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো। বলল,
-” এই না না মোটেই ওরকম কিছু ভাবিনি আমি। তুমি ভুল বলছো। আর কে বলেছে আমি বিরক্ত হবো। একলা ছিলাম তোমার আসাতে ভীষণ ভালো লাগছে।”
নিতি বিনিময় মিষ্টি হাসে। তনুজা মিষ্টি করে বলে,
-” চলো রুমে বসবে।”
নিতি ব্যালকনিতে থাকা দোলনায় আয়েশ করে বসতে বসতে বলে,
-” উঁহু; রুমে নয়। এখানেই বসি। তুমিও বসো। রুমে একা ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে গল্প করি গিয়ে। তুমিও বসো।”
-” হুম।”
তনুজা নিতির পাশে বসে। নিতি এটা-ওটা বলছে তনুজা অল্প স্বল্প বলছে। অনেকক্ষণ গল্প করার পর নিতি হঠাৎ শুধোয়,
-” ভাবিমণি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, প্লিজ বে°য়া°দ°বি নিও না ক্যামন? আগে বলো মাইন্ড করবে না।”
তনুজা আলতো হেসে বলে,
-” আচ্ছা বাবা আচ্ছা। আমি কিচ্ছু মনে করবো না। তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”
-” আমি তো তোমাদের বিয়ের মধ্যে ছিলাম না। নৃত্যর থেকে সবটা শোনা। আচ্ছা তুমি আমায় একটু মনে করো বলো তো সেদিন কী হয়েছিলো?”
তনুজার মুখের হাসি মূহুর্তেই মুখে পুরা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো নাই হয়ে যায়। মুখটা ম্লান হয়ে আসে। বলে,
-” সে রাতের কথা আমি ঠিক মনে করতে পারি না। আমার পুরো রাতের কথা কিছুই মনে নেই। তবে সবাই যেটা ভাবে সেরকম কিছুই হয়নি এটা আমি শিওর। কারন সেরকম কোন সিমটম দেখা যায়নি।”
নিতি তনুজার কথা সবটা বুঝল।
-” আচ্ছা তোমাকে রাতের কথা বলতে হবে না। আমি যতদূর জানি ভাইয়ারও একই কথা ছিলো। তবে তুমি একটু কষ্ট করে মনে করো। সেদিন তোমার সব মনে থাকা অবস্থায় কী কী ঘটেছিলো? পুরো দিনের কথাই বলো।”
তনুজা মস্তিষ্কে প্রেশার দিয়ে মনে করতে থাকে। আর বলতে থাকে। একপর্যায়ে সে বলে,
-” রোজকার মতো আমি ডিনার সেরে রুমে বসে পড়ছিলাম। এরমধ্যে খালা (বুয়া) দুধ নিয়ে আসে।”
নিতি থামিয়ে দেয়,
-” দুধ নিয়ে আসে মানে? এটা সেদিনই প্রথম নাকি আগেও এনেছে।”
-” সেদিন দিয়ে দুইদিন। আগেরদিনও এনেছিলো। বলেছিলো আন্টি খেতে বলেছে। ইয়ে মানে মামণির কথা বলে।”
-” মামী বলেছে তুমি শিওর ছিলে?”
-” আন স্যরি মামণি তো আমায় খুব আদর করতো। খাওয়ার সময় নিজে তুলে দিতো। তাই এখানে অবিশ্বাস করার কিছু ছিলো না। তারপর মামণি জানতেন আমার প্রেশার লো। দাদি বলেছিলো। তাই থেকে।”
-” আচ্ছা তুমি বলে যাও।”
-” তারপর আমি পড়তে থাকি। আমার হঠাৎ প্রচন্ড ঘুম পায়। আমি চোখ মেলে চাইতে পারছিলাম না। এমনিতেই আমি ছোট থেকেই ঘুমে কাবু। তবে সেদিন একটু বেশিই ঘুম পাচ্ছিলো। তারপর আমার আবছা মনে পরে, আমি বিছানায় যাবো বলে আগে ওয়াশরুমে যাই। তারপর..তারপর।”
-” তারপর কী? তারপর কী ভাবিমণি?”
-” আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। বোধহয় ওয়াশরুম থেকে এসেই শুয়ে পড়ি।”
-” বোধহয়? তুমি শিওর করে বলতে পারছো না, রাইট?”
-” হু। তবে এরকমই হবে।”
-” আচ্ছা তুমি যে রুমটায় থাকতে সেখানে তো অ্যাটাস্ট ওয়াশরুম নেই। উপরের করিডোর পেরিয়ে কমন ওয়াশরুম ইউজ করতে, রাইট?”
-” হু।”
নিতি মনেমনে আওড়ায়, ” এখানেও বুয়া। আচ্ছা বাকিটা দেখা যাক।”
নিতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” আচ্ছা ভাবিমণি একটা কথা বলতো এই বিয়ে হওয়াতে ভাইয়ার উপর তোমার কী রাগ-ক্ষোভ আছে? তাকে কী তুমি কোনভাবে দায়ী মনে করো? যা বলবে সত্যি বলবে। একদম মন থেকে।”
তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। থেমে থেমে বলে,
-” আসলে প্রথম প্রথম আমার মনে হতো হয়তো উনি দায়ী। তবে একসাথে থাকতে গিয়ে বুঝলাম, না এখানে উনার হয়তো কোনো দোষ নেই। আর আমার সেই মূহূর্তে প্রচন্ড খারাপ লেগেছিলো, আমি নাহয় মেয়ে। আর মেয়ে মানুষ মন থেকে চাইলেও অনেক কিছু সম্ভব হয় না। সবার সামনে জোর গলায় বলা যায় না। তবে উনি ছেলে হয়ে কেনো এই বিয়েতে রাজি হলো। যেখানে সবাই যা ভাবছে তা সম্পূর্ণ ভুল। উনি রাজি না হলেই এই বিয়ে হয় না। তিনটে জী_”
এতটুকু বলেই থেমে যায় তনুজা। অসম্পূর্ণ রাখে কথা। নিতি বুঝে কথাটা। তিনটে জীবন বলতে তনুজা একচুয়েলি কী বলতে চেয়েছিলো। নিতি আলতো হেসে বলে,
-” তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, মেনে নাও না আমার ভাইয়াকে। এটা আমার থেকে একটা সরল আবদার এর বেশি কিছুই নয়। আর হ্যা আমার ভাইয়াটা কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ না। ভাইয়ার জীবনের কিছু ট্রাজেডি ভাইয়াকে চেঞ্জ করে দেয়। আমার মনেহয় তুমি চাইলে তাকে আবার আগের মতোন কনভার্ট করতে পারবা। তার দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে নিজের জন্য জায়গা করে নাও তার মনে। আর মানুষের জীবনে কিছু না কিছু অতীত থাকে। তবে সারাজীবন অতীত আঁকড়ে থাকে না অনেকেই। নতুন করে বাঁচতে শেখে।”
তনুজা অবাক হয়। এখানে অতীত বলতে শুধু কী ইভানের কথাই বলেছে? নাকি তার কথাও বলেছে? তবে কী নিতি ওর আর দিব্যর কথা জানে? নিতি সরাসরি বলে তনুজাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। তাই দ্রুত প্রসঙ্গ বদলাতে বলে,
-” এইরে তুমি আমার ভাবি। সম্পর্কে বড়। অথচ আমি নির্বোধের মতোন ছা/গ/লামি করে যাচ্ছি। তোমাকে জ্ঞান দিচ্ছি। স্যরি ভাবিমণি।”
দুইহাত কানে ধরে নাকমুখ কুঁচকে হেসে বলে নিতি। নিতির বাচ্চামো স্বভাব দেখে তনুজা হেসে ফেলে।
রাত এগারোটা পেরিয়েছে। ইভান রুমে ঢুকে। তনুজাকে বিছানায় না দেখে তার কপালে ভাঁজ পরে। পরপর রুমে ঢুকে হাতের ব্লেজারটা সোফায় রাখে। একসাথে লাগানো বুক সেলফের সাথে সেট করা চেয়ারে নজর যায়। তনুজা চেয়ারে বসে টেবিলের উপর থাকা বইয়ের উপর মাথা দিয়ে হাত দুটো টেবিলের উপর রেখে ঘুমুচ্ছে। এই মেয়ে কী ঘুমকাতুরে রে বাবা! পড়তে বসেও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ইভান তো জানে না। দিদুন বলেছেন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে, আগেই না ঘুমিয়ে পড়তে। আজ অপেক্ষা করবে বলে বই নিয়ে ঝিমুচ্ছিলো তনুজা। অবশেষে ঘুমের সাথে যুদ্ধে না পেরে মাথাটা টেবিলে রাখতেই পারি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
ইভান ওয়াশ রুমে যায়। পরপর ফ্রেশ হয়ে গ্রিন কালারের টিশার্ট আর এ্যশ কালারের টাউজার গায়ে জড়ায়। তনুজা ওভাবে ঘুমিয়ে আছে বেচারির উপর মায়া হলো। পাশে দাঁড়িয়ে তিনবার করে ডাকার পদক্ষেপ নিয়েও ইভান থেমে যায়। এত সুন্দর ঘুমটা ডেকে ভাঙতে ইচ্ছে করলো না। আচমকা ইভান তনুজাকে কোলে তুলে নেয়। আলগোছে শুয়ে দেয়। তনুজা ঘুমের মধ্যে ঠোঁট নাড়ালো। একদম বাচ্চাদের মতো লাগলো। তনুজাকে শুয়ে দিয়ে সোজা হতে গিয়ে ইভানের টিশার্টে টান পরে। চোখে পরে তনুজার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইনটা তার টিশার্টের বোতামে আটকিয়েছে। ইভান তনুজার দিকে আরেকটু ঝুঁকল হাত দিয়ে বোতাম থেকে চেইনটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে।
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১১
ইভানের গরম নিঃশ্বাস তনুজার গায়ে পরছে। ইভানের হাত দু’টো কাঁপছে। মেয়েলি মিষ্টি গন্ধটা মা°দ°কতার মতো ঠেকছে। ইভান চেইনটা ছাড়ায়। পরপর তনুজার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রীতে তাকাল। নিউ ফ্লারিস্ট রোজের মতোন লাগছে মুখটা। পুরো আদুরে, মায়া জড়ানো একটা মুখ। ইভান একহাতে তনুজার মুখের উপর থাকা বেবি হেয়ার সরিয়ে দেয়। তনুজা যেনো চুম্বুকের মতোন টানছে তাকে। আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ইভান বড়বড় শ্বাস ফেলে শুয়ে পরে। মেয়েটা তাকে খুব বেশিই জ্বালাতন করছে। তাকি সে জানে? উঁহু! সে তো বিভোরে আরামসে ঘুমুচ্ছে। এদিকে আরেকজনের ঘুম হা’রা’ম করে।