প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৫

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৫
মুসতারিন মুসাররাত

রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে নতুন দিন। সকাল থেকে কিচেনে রান্না করতে খুব ব্যস্ত তনুজা। নতুন বুয়া এখনো ঠিক করা হয়নি। ওদিকে শিরিন সুলতানার মাথাটা ধরেছে, তাই এখনো নিচে আসেনি। আজ সকল কাজ ত্রস্ত হাতে একা একাই করছে তনুজা। এতটুকু দম ফেলানোর ফুরসত মিলছে না তার। টেবিলে নাস্তাগুলো একএক করে সাজানোর সময় তামান্না এসে চেয়ার টেনে বসল। কপাল কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-” আজ এত বেলা হয়েছে তা কেউ ডাইনিংয়ে এখনো আসছে না যে। আর এসেই বা কী করবে! এখনো তো ব্রেকফাস্ট তৈরিই হয়নি। তা কী এতো রান্না করলে যে এতো বেলা হয়ে গেলো?”
একা হাতে সবকিছু করতে যে ঢের সময় লাগে; যে নিজে রান্না করে তা কেবল সেই জানে। শুয়ে-বসে শরীর না নাড়িয়ে চলা মানুষ তা কীকরে জানবে? আর বুঝবে! তনুজার জায়গায় অন্যকেউ হলে এভাবে বলতে দু-দু’বার ভাবতো না। কিন্তু তনুজার ধাতে নেই কারো সাথে রুড আচরণ করা। তাই তো সে স্বভাবসুলভ নম্র স্বরে প্রত্যুত্তরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” স্যরি ফুপি। একটু দেরি হয়ে গেলো। পরোটা, আলুর দম, কালাভূনা, আর সবজি।”
সামনে পরোটার প্লেট থেকে একটা পরোটা উঁচুতে তুলে নাক সিঁটকে তনুজার দিকে তাকাল তামান্না। রুঢ় গলায় চেঁচিয়ে বলল,
-” পরোটা! আমার রুটি কই? পরোটা বানিয়েছো ঠিক আছে। তবে জানো না তুমি, আমি তেলে ভাজা পরোটা খাই না। আমার জন্য তেল ছাড়া সেঁকে নিতে পারতে। তেলে চুপচুপ করছে সবগুলো। এখন আমি কী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো; শুনি?”
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় তনুজার বুক চিঁড়ে। পরপর বলে ওঠে,

-” আপনার জন্য রুটি করেছি। কিচেনে আছে নিয়ে আসছি।”
এইবলে কিচেনে পা বাড়াবে তনুজা এমন সময় নজরে আসে গাঁয়ে আঁটসাঁট পিৎ রঙের শার্ট, হাতার আস্তিন কনুই অবধি গোটাতে গোটাতে এদিকে তাকিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামছে ইভান। ইভানের মুখাবয়ব বড্ড শান্ত, ধূসর চোখজোড়া স্থির। সেদিনের কথা মনে পড়তেই তনুজা চমকায়, অপ্রস্তুত হয়। সবটা শুনে থাকলে, যদি সেদিনের ন্যায় ফুপিকে ত্যাড়া করে কিছু বলে উঠে ইভান! এই নিয়ে তনুজার ভেতর আতংকের সৃষ্টি হয়। পরপর নজর সরিয়ে তনুজা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়।
ইভান চেয়ার টেনে বসে। একএক করে নুরজাহান বেগম তারপর দিব্যর বাবা শাহরিয়ার মির্জা আসলেন। ইভান প্রথমে কথা তুলল,

-” দিদুন! শুধু রান্নার জন্য দু’টো বুয়া রাখবে। তুমি না পেলে আমায় বলবে, আমি আজকের মধ্যেই ঠিক করে দিবো।”
নুরজাহান বললেন,
-” একটা তো ধোঁয়া মোছার জন্য আছেই। আর রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য আবার দু’টো দিয়ে কী হবে, দাদুভাই? বাড়ির বউ আছে। কাল ওটাকে বিদায় দিয়েছি, আরেকটা ধীরস্থির ভাবে দেখেশুনে ঠিক করবো।”
-” তনুজার কলেজ আছে। তারপর একজনকে সবসময় অহেতুক অর্ডার করা মানে তারউপর জুলুম করা। যারা নিজে কিছু না করে অর্ডার করবে, তাদের জন্য হলেও দরকার আছে। আচ্ছা তোমাকে দেখতে হবে না। আমি নিজেই আজকে দু’জনকে ঠিক করে পাঠিয়ে দিবো।”

নুরজাহান ঢের বিরক্ত হয়। তবে আর কথা বাড়ালেন না। তামান্নার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে রাগে হিসহিস করতে থাকে। ভাইপো ইন্ডিরেকটলি বলল; তার বউয়ের উপর, অহেতুক অর্ডার করে সে। মুখটা রাগে অন্ধকার হয়ে যায় তামান্নার। নুরজাহান, তামান্নাকে উদ্দেশ্য করে শুধাল,
-” নিতি পৌঁছে গিয়েছে কী? ফোন দিয়েছে? তা আজ এতো তাড়াহুড়ো করে গেলো। না খেয়ে-দেয়েই সাত সকালে রওনা দিল যে। পরীক্ষা-টরিক্ষা আছে নাকি?”
-” খানিকক্ষণ আগে আমি ফোন করেছিলাম। এখনো পৌঁছায়নি। আজকে নাকি ওর প্রেজেন্টেশন আছে। তাই সকাল সকাল চলে গিয়েছে।”

প্রেজেন্টেশন কী তা নুরজাহানের বোধগম্য হয় না। তবে বুঝলেন পরীক্ষার মতোই জরুরী কিছু একটা। তনুজা খাবার সার্ভ করছিলো। আগে নুরজাহান আর চাচা শ্বশুরের প্লেটে পরোটা দেয়। তারপর ইভানের প্লেটে দিতে নেয়। ইভান চোখ তুলে তনুজার দিকে তাকাল। কিছু নোটিশ করে ইভানের কপাল কুঁচকে আসে। ইভান ভ্রু নাড়িয়ে ইশারা করে। তনুজা বুঝতে না পেরে বোকা বোকা চোখে চাইল। ইভান এবার এক আঙুল নিজের কপালে ডলে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” আটার ডো।”

-” ওহ্!” অস্ফুটে আওড়ায় তনুজা। পরপর বুঝতে পেরে শাড়ির আঁচল টেনে কপালটা ডলে নেয়। মূহুর্তেই শুকিয়ে যাওয়া আটার খুঁতখুঁত কালো রঙের শাড়ির আঁচলে জড়ায়।
সবার খাওয়া-দাওয়ার মাঝ পর্যায়ে দিব্য এসে বসে। মুখটা তার শুকনো। আশেপাশে তার নজর নেই। শাহারিয়ার মির্জা চোখ তুলে ছেলের দিকে চাইলেন। গম্ভীর মুখে শুধোলেন,
-” দিব্য! এসব কী শুনছি?”
দিব্য নির্লিপ্ত। সেকেন্ডেই পড়ে নেয় বাবাকে। বাবা কী বলবে তা যেন দিব্যর আগে থেকেই জানা। শাহারিয়ার সাহেব বলতে থাকেন,

-” তোমার মাম্মা যা বলল, তা সত্যি? তুমি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি ইউএসএ চলে যাবে?”
-” হুঁ।”
দিব্য ছোট্ট করে জবাব দেয়। উপস্থিত সবাই অবাক হয়। শাহারিয়ার সাহেবের মুখটা আরেকটু গম্ভীর হয়ে আসে। কপালে প্রগাঢ় খাঁজ পরে। ভরাট স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
-” হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”
-” এমনিই।”
ছেলের জবাব বড্ড গা ছাড়া আর হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হলো শাহারিয়ার মির্জার। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে এবার। মোটা গলায় বললেন,

-” এমনিই মানে? যখন পড়াশোনার জন্য আমি যেতে বলেছি, তখন যাওনি তুমি। তোমার নাকি দেশে থাকতেই ভালো লাগে। বাইরে বিদেশ বিভূঁইয়ে অচেনা জায়গা, অপরিচিত সবার মাঝে তোমার ভালো লাগবে না। থাকতে পারবে না তুমি। দেশে ঘরের বাইরে বেরুলেই চেনা মুখ, পরিচিত সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। নিজের চেনা শহর ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে থাকতে গেলে তোমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এমনই অজুহাত দিয়েছিলে। তা এখন হুট করে এমন বলছো কেনো? আমার মাথায় ধরছে না। তোমার ডিসিশন শুনে তোমার মাম্মা তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যাইহোক, তুমি এসব চিন্তা বাদ দাও। অফিসে জয়েন না করতে চাও, না করলে। বিসিএস দাও, বা তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই করো।”

দিব্য খাবার মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে বলল,
-” আমি মামার সাথে ফোনে রাতে কথা বলেছি। মামাকে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। আর আমি অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নট হুট করে। আর তখনকার দিব‌্যর সাথে আজকের দিব্যকে মিলাতে যেয়ো না, বাবা।”
-” তুমি এতটাও বড় হয়ে যাওনি দিব্য। যে নিজের ডিসিশন নিজেই নিবে। তোমার ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তোমার বাবা-মা বেঁচে আছে।”

ইভান মুখে থাকা খাবার চিবিয়ে যাচ্ছে। কেনো জানি খানিকক্ষণ আগের মতো স্বাদ, তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যাচ্ছে না। গলাধঃকরণ করতে কষ্ট হচ্ছে। ইভানের অবচেতন মন দিব্যর এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। মনের কোণে জমে থাকা রাগ-ক্ষোভের পর্দা যেন দূরে সরতে চাইছে। সেখানে ছোটভাইয়ের জন্য ফের আগের মতো এক টুকরো নির্মল ভালোবাসা, আদর স্নেহ ভিড় করতে জমাচ্ছে। দিব্যর বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে কেমন মুষড়ে উঠলো হৃদয়টা। পরম স্নেহ মাখা কণ্ঠে নিষেধ করতে ইচ্ছে করল। তবে অদৃশ্য একটা বাঁধা থাকায়; মনে হওয়া কথাটা আর বলে উঠা হলো না ইভানের। তারপরও অন্তরাত্মা চাইছে দিব্য সাথেই থাকুক। কথা না হলো। চোখের দেখা তো হয়। হাজার হোক ভাই তো। নুরজাহান রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,

-” বুঝি না বাপু। তোমাদের একেকজনের মতিগতি বোঝা বড় দায়। কখন কার কী মনে ওঠে, আর তাই করে বসো। ঠিক বিদেশ বিয়ে ঐ সাদা চামড়া আর পাটের আঁশের মতন সোনালি চুলওয়ালা বিদেশিনী বিয়ে করবে।”
সবাই চুপচাপ থাকলেও নৃত্য ফিক করে হেঁসে ওঠে। তনুজা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শাহারিয়ার মির্জা আদেশের সুরে বললেন,
-” দিব্য তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার মা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। শুনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুমি যাওয়ার পর একদম শয্যাশায়ী হয়ে যাবে আমি শিওর। তাই বলছি পা’গলামি বাদ দাও।”
দিব্য নির্বিকার ভাবে বলল,

-” স্যরি বাবা সম্ভব নয়। আমি মামার সাথে কথা বলেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব প্রসেস যেনো শেষ হয় বলে দিয়েছি। আর আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল-অনড়।”
শাহারিয়ার মির্জা এবার তেতে উঠলেন। কণ্ঠটা বেশ চড়িয়ে বলল,
-” ছোট থেকেই তুমি জিদি, রাগি ঠিক আছে। তোমার যা মনেহয় তাই করো; সেটাও ঠিক আছে। তাই বলে আমাদের একটা কথাও রাখবে না; এটা কখনোই আশা করিনি তোমার কাছে।”

সেই তখন থেকে নিজেকে, নিজের মেজাজকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো দিব্য। বাবার কথায় এবার আর শান্ত থাকা হলো না। ঝট করে মেজাজটা চটে গেল। ক্ষিপ্ত হলো সে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” হ্যাঁ আমার যা মনেহয় আমি তাই করি। আর সেটা সবার কাছে সবসময় রং হয়। আর এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমি চাইবো, সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। কারো মতামত আমার উপর চাপিয়ে দিবে না। আমার মনে হয়েছে তাই আমি বাইরে যেতে চাচ্ছি। সেখানে মাম্মা তারপর তুমি এত বাঁধা কেনো দিচ্ছো, বলো তো?”
ছেলের দিকে অসন্তুষ্ট চাউনিতে চাইলেন। ধ’ম’কের সুরে বললেন,

-” দিব্য গলার স্বর নামিয়ে কথা বলো। এভাবে কথা বলে নিজেকে আরো বে’য়াদব প্রমাণ করো না।”
বাবার কথায় রাগ হরহুর করে বাড়ল। স্বভাবসুলভ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগটা একহাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। চোখের পলকেই সুন্দর দেখতে কাঁচের জগটা টুকরো টুকরো হয়। সাথে কাঁচ ভাঙার শব্দে কেউ কেউ কেঁপে উঠল। দিব্য কোনদিকে নজর না দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। মূহুর্তেই পরিবেশটা নিস্তব্ধ আর থমথমে হয়ে যায়।

কয়েকদিন পর…
চাঁদনি রাত খোলা আকাশ। সাথে মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাস। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ইভান আর তনুজা। ইভানের হাতে কফির মগ। খানিকটা দূরত্বে দুইহাত বুকে ভাঁজ করে; আকাশপানে চেয়ে আছে তনুজা। মৃদু বাতাসে শাড়ির আঁচলটা হালকা উড়ছে। উড়ছে শ্যামাবতীর কপালের বেবি হেয়ার। এই দৃশ্য কারো হৃদয়ে ঝড় তুলছে তা কী জানে, শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা শ্যামাবতী? উঁহু! সে যে বড্ড বেখেয়াল। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা পাশে নামিয়ে রাখে ইভান। এক পা দু পা ফেলে তনুজার দিকে এগোয়। হঠাৎ ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণে তনুজা সম্বিত ফিরে পায়। পরপর দু’টো শক্ত উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পায় কোমড়ে। যে ছোঁয়ায় তনুজার পায়ের পাতা শিরশিরানি দিয়ে ওঠে। কেঁপে ওঠে পেলব শরীর। ইভান তনুজার কাঁধে থুতনি রাখে। মোহময় স্বরে ডাকল,

-” তনুজা”
তনুজার রুহুসহ সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল যেন। এই আদূরে মোহময় ডাকে হৃদপিন্ড ছলাৎ করে উঠল। গলাটা চৈত্রের খরার ন্যায় শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নেয় তনুজা। অস্ফুট স্বরে বলে,
-” হু।”
ইভান একহাতে তনুজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পরপর পুরুষালি শক্ত রুক্ষ দু’টো হাতে তনুজার পিঠ জড়িয়ে ধরে। ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস তনুজার চোখেমুখে আঁছড়ে পড়ছে। ইভানের গভীর নজরজোড়া তনুজার ভীতু, মায়াবী মুখবিবরে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। তনুজা ও-চোখে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। ও-চোখ দু’টো কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। ও চোখ দু’টোতে নজর রাখতেই বুকের ভেতরটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। তনুজা যেন ঐ গভীর নজরজোড়ায় বিলীন হয়ে যাবে। পরপর দৃষ্টি নামিয়ে নেয় তনুজা। ইভান তনুজার কপালে কপাল ঠেকায়। সফট ভয়েজে বলে সে,

-” আমার এখন মনে হচ্ছে, আসলে প্রণয় শুরু হতে হয় বিয়ের মাধ্যমে। যে বাঁধনটা দৃঢ়, শক্ত, মজবুত হয়। যেখানে প্রতিটা মূহুর্ত থাকে হালাল, পবিত্র। দু’জন দু’জনের দিকে তাকানোতেও থাকে নেকি। দিন যায় বাড়ে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা-টান- মহব্বত।”
তনুজার নিঃশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে। সাথে বাড়ছে অজানা আ’তংক-ভ’য়। ইভান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ইভানের হাত দু’টো আস্তে আস্তে তনুজার মসৃণ কোমড়ে নামে। একটু থেমে পূর্ণ দৃষ্টিতে তনুজার দিকে চেয়ে আওড়ায়,

-” তনুজা! তুমি আমার অতীত সম্পর্কে অবগত। আমার ব্যাপারে সবটা যেনে-বুঝে আমাদের এই সম্পর্কের একটা সুন্দর সূচনা করবে কী? আমি জানি তুমি সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পবিত্র। সেখানে আমার অতীতটা তোমার মতো অত সুন্দর নয়। আমার অতীতে এক বি’শ্বা’সঘাতিনী ছিলো। তবে তুমি এতটুকু বিশ্বাস তোমার বরের উপর রাখতে পারো, সে তোমার হক খোয়াইনি। তনুজা তোমার কাছে আমার ছোট্ট একটা রিকোয়েস্ট থাকবে, প্লিজ কখনো আমাকে ঠ’কিয়ো না। এমন কিছু করো না যাতে কোন একদিন আমাকে বলতে হয়, দিনশেষে আমি আবার ঠকে গেলাম। আবার সেই মেয়ে জাতির কাছে। প্রতারনা পেলাম সেই মেয়ে জাতির থেকে।”

তনুজার হাঁসফাঁস ঠেকছে। মানুষটা কত সুন্দর তার কথা অবলীলায় বলে ফেলল। আর তনুজাকে তার থেকেও পবিত্র তুলে ধরল। তনুজার বিবেক দং’শন করতে থাকে। সে কীকরে এখনো নির্লিপ্ত আছে! তারও কী উচিত নয়! অতীতটা বলে দেওয়া। তনুজার মন সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে। ওদিকে তনুজার চুপ থাকাকে ইভান মৌন সম্মতি ধরে নেয়। তনুজার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় ইভান। তনুজা দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে বেরিয়ে আসে; কাঁপা কাঁপা গলায় বলে সে,

-” ইভান, আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।”
তনুজার হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন তুলতুলে গালে গাল ঠেকায় ইভান। ইভানের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তনুজার সফট গাল ছুঁইয়ে যাচ্ছে। ইভান লো ভয়েজে বলল,
-” হুম। বলো।”
তনুজা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
-” ইভান আমার অতীতটা আপনার জানা জরুরী।……….আর বিশ্বাস করুন বিয়ের পর থেকে আমি সেসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছি। আমি সেদিকে ফিরেও তাকাইনি। আমার পৃথিবী আমি আপনি কেন্দ্রিক গড়ে তুলতে চাইছি। প্লিজ আপনি ভুল বুঝবেন না।”

পরপর তনুজা সবটা বলে। একসময় দিব্যর সাথে তার রিলেশন ছিলো। পুরোটা বলে তৃষার কাহিনী। দিব্যর নাম শুনে ইভানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তনুজার কোমড় থেকে হাত দু’টো আলগা হয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ ইভান দু’কদম পিছিয়ে যায়। দিব্যর হঠাৎ বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সব মস্তিষ্কে নাড়া দিতে থাকে। ইভান প্রচন্ড অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। ইভানের বিবেক তাকে ধিক্কার দিচ্ছে; ছিঃ ইভান ছিঃ! তোর আর দিব্যর মধ্যে পার্থক্য রইল কী? ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিলি। যতই দিদুন জোর করুক, তোর কী উচিত ছিলো না, বিয়ের আগে মেয়েটির সাথে একটিবার কথা বলে নেওয়া। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক যেন সচল হয় ইভানের। ইভান দপ করে দোলনায় বসে পরে। দুইহাতে মুখ ডেকে নেয়। ওদিকে তনুজা থরথরিয়ে কাঁপছে। রেলিং ঘেঁষে জমিনে বসে পরে তনুজা। দীর্ঘ সময় গড়াল। দু’জনে নীরব রইল। দিব্য বাইরে চলে যাচ্ছে মামণি খুব অসুস্থ। ইভানের কী করা উচিত বুঝে আসছে না!

অনেকটা সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর ইভানের মস্তিষ্ক সজাগ হয়। ইভান অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। পাথরের মুর্তির মতন ঠাঁই বসেই বলল,
-” এই বিয়েটা তো জোর করে হয়েছে। তাও ভুল বোঝাবুঝিতে। আর আমরা দু’জন তো এই জোর করে নামে মাত্র বিয়ের দোহাই দিয়ে আছি। এবার আমাদের উচিত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমি কালকেই উকিলের সাথে কথা বলবো। আমাদের ডিভোর্সের জন্য। যেহেতু বিয়েটা চাপে পরে হয়েছে তাই এটাকে সারাজীবন টেনে বেড়ানোর মানে হয় না। তুমি চিন্তা করো না। আমি আমার তরফ হতে তোমাকে মুক্তি দিবো। এখনো সময় আছে, তুমি দিব্যর সাথে জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবে। এব্যাপারে তোমাকে কেউ দায়ী করবে না। সমস্ত দায়ভার আমি নিজেই বহন করবো।”
তনুজার ভীষণ কান্না পেলো। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল।
.
কারো ধাক্কাতে হুঁশ হয় তনুজার। দপ করে চোখ মেলে চাইতেই হালকা সবুজ আলোয় আলোকিত হওয়া ছাদ দেখতে পায়। পরপর ইভানের দিকে নজর পরে। যে কিনা উদ্বিগ্ন হয়ে তনুজার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ঘুমের মধ্যকার কান্নার শব্দ কেমন বাইরে উম উম করে আসছিলো। তনুজা নড়ছিলো আর শব্দটা হচ্ছিল। ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তড়িৎ তনুজার পাশে ঝুঁকে একহাতে তনুজাকে ধাক্কা দেয়। উফ্! এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো তনুজা এটা ঠাহর করে। তবুও বুকটা ধড়ফড়িয়ে কাঁপছে তার। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর..তারপর আচমকা ইভানের বুকে গা এলিয়ে দেয়। মাথাটা ইভানের বুকের উপর পরে। ইভান একহাতে তনুজাকে আগলে নেয়। তনুজা হয়ত কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে অনুমান করে ইভান। তনুজার শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে ইভান অনুভব করে সেই কম্পন। ইভানের হাতটা তনুজার চুলের ভাঁজে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” তনুজা, কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
ইভানের বুকে তনুজার মাথা। ইভানের হার্টবিট শুনতে পারছে সে। মানুষটাও তাকে নিয়ে নিশ্চয় ঘাবড়ে গিয়েছে। এইযে কেমন দ্রুত গতিতে হৃদপিন্ডটা চলছে। তনুজা চোখদুটো বুজে নেয়। পরম একটা শান্তির জায়গায় মাথাটা রেখেছে সে এমন অনুভূতি হচ্ছে। আজ প্রথম সজ্ঞানে ইভানকে জড়িয়ে আছে সে। তবে আজ কোন দ্বিধা হচ্ছে না। কেমন শান্তি অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে তারজন্য এই পৃথিবীতে একমাত্র শান্তির আবাস স্থল এই বুকটা। তারজন্যই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা এই প্রস্থ বুকটা বরাদ্দ রেখেছিলো। স্বপ্নের কথা আর দৃশ্য মনসপটে ভাসতেই ভয়ে শিউরে উঠছে তনুজা। ইভান দুইহাতে তনুজাকে আগলে নিয়ে ফের বলল,

-” তুমি তো দেখছি খুব ভীতু মেয়ে। স্বপ্ন দেখে একদম নার্সারিতে পড়ুয়া বাচ্চাদের থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছো। রিলাক্স তনুজা রিলাক্স। এত ভ’য় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমি আছি তো।”
“আমি আছি তো” কথাটা তনুজার অস্থির চিত্তে প্রশান্তি নিয়ে আসলো। তনুজা ইভানের পিঠের টিশার্টসহ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সময় এভাবেই কাটল। ইভানের ভেতরেও একটা সুপ্ত অনুভূতি জন্মাতে থাকে। ভালোলাগায় আবেশিত হয় হৃদয়টা।

ঝকঝকে তকতকে বড়সড় পরিপাটি আলিশান অফিস রুমের রিভলভিং কালো চেয়ারটায় বসে ইভান। হাত দু’টো তার ল্যাপটপের কিবোর্ডে, চোখদুটো স্থির স্ক্রিনে। কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ তনুজার কথা মনে পড়ল। ইদানিং তার মনমস্তিষ্কের দখলদারিত্ব নেওয়া শুরু করেছে তনুজা। হুটহাট করেই তার তনুজার কথা মনে পড়ে যায়। এইযে এখন কাজের মাঝেও হঠাৎ তনুজার কথা মনে উঠল। ইভান স্ক্রিনে সময় দেখল। পৌনে চারটে বাজে। আজ ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলো তনুজাকে কলেজ থেকে বাসায় পৌঁছে দিতে। তিনটায় ক্লাস শেষ হওয়ার কথা। তনুজাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়েছে কীনা জানার জন্য ফোন হাতে নেয় ইভান। এরমধ্যে ফোনে বাড়ির নম্বর থেকে কল আসে।

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৪

-” বাড়ি থেকে এই সময় হঠাৎ কল?”
ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে ইভান। ফোনের ওপাশ থেকে নৃত্যর বলা কথা শুনে ইভান উদ্বিগ্ন হয়। সেকেন্ডেই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। কণ্ঠে ঝরে পরে সমস্ত উদ্বেগ-উদ্বিগ্নতা,
-” ত-তনুজা? কী হয়েছে তনুজার?”

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৬