প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৯
মুসতারিন মুসাররাত
অদূরে দাঁড়িয়ে পরপর নিতির কথাগুলো শুনে এক রমণীর ফর্সা মুখে অন্ধকার নামে। ক’দিন ধরে যে সন্দেহটা করছিলেন, তা যেনো লহমায় প্রকট আকার ছাড়িয়ে দিনের আলোর মতো ফকফকা পরিষ্কার হয়ে যায়। মায়েরা সাধারণত মেয়েদের মন খুব সহজেই পড়তে পারে। পড়ে নেয় চোখের ভাষা। সেদিন নিতির পড়ার টেবিল থেকে প্রয়োজনে পেন নিতে গিয়ে, আচমকা নজরে আসে খোলা ডায়েরির পাতা। নিতি খোলা রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। না চাইতেও কিছু শব্দ নজরে আসে। মেয়ে বড় হয়েছে, আর এই বয়সটা আবেগের। তাই আর অত মাথা ঘামায়নি। তবে তক্কে তক্কে ছিলেন, মেয়ের হাবভাব বোঝার।
এখানে রাগি রাজা বলতে যে দিব্যকে বুঝিয়েছে তা তামান্না ঢের বুঝতে পারলেন। মনেমনে তামান্নাও কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। দিব্যকে ভাইপো হিসেবে ভালোবাসে না এমন নয়। তবে তার কাছে আদরের মেয়ের জন্য দিব্য পারফেক্ট নয়। দেখতে সুদর্শন হলেও, দিব্যর মাত্রারিক্ত রাগ, জিদ মোটেই পছন্দ নয়। স্বয়ং নিজেও তিরিক্ষি মেজাজের হলেও, ঠান্ডা টলটলে পানির মতো স্বভাবের ছেলে তার পছন্দ। খুব করে চান ওনার স্বামীর মত ধৈর্যশীল আর খুবই অমায়িক পাত্র যেন মেয়েদের জন্য পান। এই হিসেবে ডক্টর ছেলেটাকে তামান্নার বেশ মনে ধরেছে। তামান্না গম্ভীর মুখে ডায়নিংয়ের দিকে এগিয়ে আসলেন। মেয়েদের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে শাসিয়ে উঠলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” ঘুম থেকে উঠেছো তো বেলা করে। দু’জনের একজনও সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরুলে না। আচ্ছা তা নাহয় বাদ দিলাম। খাবার খাওয়ার সময় যে চুপচাপ আদবের সাথে খেতে হয়; তা জানো না? নাকি দিনদিন বড় হচ্ছো আর আদব-কায়দা সব খুইয়ে বসছো।”
দুইবোন মায়ের হঠাৎ কঠোরতা দেখে বোকা বনে যায়। ছোট্ট মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবাক হয় নিতি। খাবার খেতে বসে দুইবোন একটু গছিপ করছে, এতে হঠাৎ কী এমন হলো! মাম্মা হুট করে কড়া করে বলছে! দুইবোন মা’কে রেসপেক্ট করে, সাথে ভ’য়-ও করে। টু শব্দও উচ্চারণ করল না। দৃষ্টি খাবারের প্লেটে নুইয়ে রাখল। তামান্না নিতিকে উদ্দেশ্য করে ফের বললেন,
-” নিতি তোমার না নেক্সট মান্থে ফাইনাল সেমিস্টার। কোথায় বই নিয়ে টেবিলে বসে থাকবে; তা না সারাক্ষণ দুইবোন আ-জা-ইরা গল্প গুজব করে সময় ন’ষ্ট করছো। আবার এদিকে তোমার যখন মন চায় অমনি ক্লাস মিস দিয়ে হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে আসো। বাড়িতে তো পড়তে দেখিনা কখনো। পড়াশোনার এরুপ দুর্দশা হলে সিজিপিএ যে কেমন হবে তা বোঝায় যাচ্ছে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে একটু থামলেন। ফের পুরোদমে শুরু করলেন,
-” নিতি তুমি তো বড় তোমার তো পড়াশোনা নিয়ে সবসময় সিরিয়াস থাকা উচিত। সেখানে কী করছ? নিজের মত ছোট বোনকেও পড়াশোনার প্রতি উদাসীন বানাচ্ছো; আর বাঁদরামি শেখাচ্ছো। এইযে নৃত্য আজ স্কুল মিস দিলো তোমার সাথে ঘুরতে যাবে বলে। তুমি বড় কোথায় ছোট বোনের বায়না না শুনে বোঝাবে। তা না করে তুমি সায় দিয়ে আরো উস্কে দাও। বাড়িতে এভাবে আড্ডা দিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি না করে হোস্টেলে গিয়ে থাকলে নিজের জন্যও ভালো হয়; বোনের জন্যও।”
নিতির মিষ্টি মুখটা বেজার হয়ে যায়। প্লেটের খাবার শুধু নেড়েই যাচ্ছে। ভারী মুখশ্রীতে মাথা নুইয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
-” স্যরি! মাম্মা।”
এরমধ্যে দিব্য উঠে চলে যেতে যেতে মনেমনে আওড়ায়,
-” উফ্! কখন কার কী হয়! বুঝা মুশকিল! ফুপি বোধহয় সারা বছরের শাসন আজ এক মিনিটে শেষ করছে। যত বয়ান জমানো ছিলো তা যেন এখনই দেওয়ার ছিলো।”
তামান্না মুখটা গম্ভীর করেই ওদিকে সোফায় গিয়ে বসলেন। নিতি প্লেটের অবশিষ্ট খাবার রেখেই উঠে যায়। বেসিনে হাত ধোঁয়ার সময় নৃত্য ফিসফিসিয়ে বলল,
-” অ্যাই আপু! মুখটা বেজার করে রাখো না তো। মন খারাপ করো না। আমার মনেহয় মাম্মা অন্যকোন রা’গ এভাবে মিটালো। পৃথিবীর সব মায়েদের এক কমন ডায়লগ, কমন বিষয়; বাচ্চাদের উপর সব রাগ মেটাতে পড়াশোনা টেনে আনা।”
নিতি ঠোঁট টিপে ফিক করে হেঁসে ফেলল। এরমধ্যে নুরজাহান বেগম সোফায় বসে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
-” নিতি এদিকে আয় তো।”
নিতি এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল। নুরজাহান হাতে থাকা মুঠোফোনটা নিতির দিকে বাড়িয়ে বললেন,
-” দ্যাখ তো এই যন্ত্রখানার আবার কী হলো! কেমন আলো জ্বলে একা একাই কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভরা পৌষের কনকনে শীতেও আমার মত বুড়ি যতটা না কাঁপতে থাকে, তারচেয়েও বেশি কাঁপছে যন্ত্রখানা। এর হঠাৎ হলো টা-কি?”
নিতির ভীষণ হাসি পেলো। ঠোঁট চেপে হাসল। সোফায় আয়েশ করে বসে ফোনটা হাতে নিলো। পরপর মুখে কপট চিন্তার ছাঁট ফেলে ভারিক্কি গলায় বলল,
-” ভারী চিন্তার বিষয় তো তাহলে! যেখানে সত্তোরোর্ধ্ব বুড়ি কনকনে শীতে যতটা না কাঁপে, আর শীত না আসতেই যন্ত্রটা তার থেকেও অত্যধিক বেশি কাঁপছে। তাহলে তো নির্ঘাত বড়সড় সমস্যা। বলার অপেক্ষা রাখে না; ভ’য়ং’কর সমস্যা হয়েছে। ভালো করে দেখতে হচ্ছে তো।”
থেমে দুষ্টুমির স্বরে ফের বলল,
-” নানুআপু সমস্যা ধরা পড়েছে। তবে সলভ করতে হলে, বিগ অ্যামাউন্ট লাগবে।”
নুরজাহান বুঝলেন না। কুঁচকানো চামড়ার কপাল আরো খানিকটা কুঞ্চিত করে বললেন,
-” সে আবার কী?”
নিতি কপাল চাপড়ে বলল,
-” বিগ অ্যামাউন্ট মানে হলো, মোটা অংকের টাকা লাগবে। তবেই ফোনের এই কম্পন দূর হবে।”
-” কত টাকা?”
-” এই বেশি না। পাঁচ হাজার হলেই আমি ঠিক করে দিতে পারব।”
নিতি মজা করে বলতে থাকে। তামান্না ওপাশের সোফায় বসে ছিলেন। এবারে মেয়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। নুরজাহান একহাতে নিতির কান চেপে ধরে বললেন,
-” ফা’জ’লামি বন্ধ করে ঠিক করে দে। কী ভেবেছিস? বুড়িটা একেবারেই জানে না, বুঝে না! আরে আমার এই যন্ত্রখানার দামও তো পাঁচ হাজার টাকা নয়।”
নিতি ঠোঁট মেলে হাসল। বলল,
-” সে দাম যাইহোক! নাতনি ঠিক করে দিচ্ছে এইজন্য হলেও তো বকশিস দিতে হয়।”
বাটন ফোনটা চাপ লেগে ভাইব্রেশন হয়ে গিয়েছিলো। নিতি বেছে বেছে সুন্দর একটা রিংটোন সেট করে দিতে থাকে। নুরজাহান স্বল্প হাসলেন। বললেন,
-” যা বকশিস পাচ্ছিস। তোদের দুইবোনের আজকের কেনাকাটার টাকা আমি দিচ্ছি।”
নিতি স্মিত হেসে বলল,
-” আমি এমনি মজা করে বলেছি, লাগবে না নানুআপু। পাপা টাকা দিয়েছে। ওগুলো দিয়েই কিনে শেষ করতে পারব না।”
-” তোর পাপার দেওয়া টাকা রেখে দে। আরেকদিন করিস। আজ আমারটা দিয়েই কর। আর শোন আমি বেশি করে টাকা দিয়ে দিবো, তোদের কেনাকাটা করার সময় নাতবউয়ের জন্যও কিছু কিনে আনিস। আমি তো বুড়ি হয়েছি। বি-ষ ব্যাথায় কোথাও বেরুতে পারি না। তাই শখ-আহ্লাদ করে নিজে পছন্দ করে তোদের জন্য কিছুই দিতে পারি না। যাইহোক তোরা নিজেরাই পছন্দ করে কিনেনিস।”
নিতি ফোনটা নানুর দিকে বাড়িয়ে ভাব নিয়ে বলল,
-” নানুআপু আমি চাকুরী পেলে প্রথম মাসের স্যালারী দিয়ে তোমাকে একটা স্মার্টফোন গিফট করব, হু।”
-” তোমাদের সেই স্মাট ফোন চালানোর জন্য আমাকে একটা মানুষ ভাড়া করে রাখতে হবে তো। এটা তাও একটু আধটু পারি। কল ধরতে কা’ট’তে। ওটায় কোথায় কী করব, এই ভেবে দিশেহারা হবো!”
নৃত্য গমগমে স্বরে ফোড়ন কাটল,
-” ব্যাপার না নানুআপু। আমি আছি তো। আমি নাহয় তোমার হেল্পিংহ্যান্ড হবো।”
তনুজা উপরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনল। দিদুন যে তার জন্যও এভাবে বলল, এটা শুনে আবেগাপ্লুত হয় ও। এই সংসারটা এখন নিজের মনেহয়। আগের মত খারাপ লাগে না ওর কাছে। একটা জায়গায়ই শুধু অস্বস্তি তাছাড়া স্বপ্নের মত সাজানো গোছানো পরিপূর্ণ একটা সংসার। যা প্রত্যেকটা মেয়েরই চাওয়া থাকে।
রুমময় শুনশান নীরবতা আর নিস্তব্ধতায় ঘেরা। ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটার ঘরে পৌঁছায়। পড়ার টেবিলে বসে সাদা-কালো দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে তনুজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। আজ চারদিন হচ্ছে ইভান অফিশিয়াল কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছে। সেখানে কনফারেন্স আছে। প্রতিদিন নিয়ম করে রাতে এক মিনিটের জন্য হলেও তনুজাকে ফোন দিয়ে ভালো-মন্দ খোঁজখবর নেয়। আজ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে; গড়িয়ে যাচ্ছে রাত্রির প্রহর। তারপরও ইভানের ফোনকল না পেয়ে আচমকা তনুজার চিন্তা হতে থাকে। উদ্বেগ, উদ্বিগ্নতায় কেমন অস্থির ঠেকছে। মনটা খুব করে চাইছে একটা ফোনকল। হোক না সেটা দু-তিন বাক্যের। বইটা সামনে মেলে বারংবার ফোনের দিকে চাইছে ও। একবার ভাবে আজ নাহয় নিজেই ফোন দিয়ে খোঁজ নিক। পরক্ষণেই আবার জড়তা আড়ষ্টতায় মিইয়ে যায়। অনেকটাক্ষণ গড়ানোর পর; দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে বেরিয়ে ফোন হাতে কললিস্টে উপরে থাকা ‘Evan’ নামে সেভ করা নম্বরটিতে কল করে। রিং হওয়ার দ্বিতীয় বারের মাথায় রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ঘুমুঘুমু কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
-” বলো।”
হঠাৎ তনুজার জিভ ভারী হয়। গুছিয়ে রাখা শব্দগুলো কেমন অগোছালো এলোমেলো হয়ে যায়। অকস্মাৎ কী বলবে ভেবে দিশেহারা মেয়েটা! ইভান অনেকটা সময় নিলো। অবশেষে নীরবতার পাল্লা ভারী হতে না দিয়ে ঘুমঘুম আদূরে গলায় ডাকল,
-” তনুজা?”
আদুরে প্রগাঢ় স্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই তনুজার বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠল। সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
-” হুঁ।”
-” ফোন দিয়ে চুপ করে আছো যে। কথা বলছ না। আচ্ছা আমি কী ফোন কে’টে দিবো?”
তনুজা অপ্রস্তুত হয়ে মিহি স্বরে প্রত্যুত্তরে বলল,
-” না..মানে।”
ইভান তনুজার কথাশুনে চোখ দু’টো বুঁজেই নিঃশব্দে হাসল।
-” বি ইজি।”
পরপর সময় দেখে কিছু ভেবে ইভানের কপাল গুটিয়ে আসে। উদ্বিগ্ন গলায় শুধাল,
-” রাত একটা বাজতে চলল। এখনো ঘুমাওনি? শরীর খারাপ লাগছে? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
তনুজার চোখদুটোয় আজ কেনো জানি ঘুম নামছিলো না। তার অবচেতন মন মানুষটাকে মিস করছিলো। প্রতীক্ষায় ছিলো কাংখিত ফোনকলের। একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন শুনে তনুজা আনমনে হাসে। কোমল কণ্ঠস্বরে বলল,
-” ঘুম আসছিলো না। তাই বই নিয়ে বসেছিলাম। পড়ছিলাম আর..।”
এতটুকু বলে থেমে যায় তনুজা। ওপাশ থেকে নিচু স্বরে শুধায়,
-” আর? আর কী?”
-” আর তেমন কিছু না। আপনি আজ ফোন দেননি, তাই ভাবলাম ফোন দিয়ে খোঁজ নিই।”
-” কনফারেন্স শেষে ওখানে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। ডিনার করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে আজ বেশ দেরি হয়ে যায়। বেশি রাত হওয়ায় ভাবলাম তুমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছো, তাই আর কল দিয়ে ডিস্টার্ব করিনি। সারাদিন ব্যস্ততায় ভীষণ ট্রায়ার্ড ছিলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ি।”
-” ওহ্। আমি বোধহয় কল করে বিরক্ত করে ফেললাম।”
-” মোটেই না।”
ইভানের কণ্ঠ দৃঢ় শোনাল। খানিকক্ষণ দু’পাশে নীরবতা চলল। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রুমময় সেই শব্দ প্রগাঢ় শোনাল। ওপাশের ব্যক্তি নীরবতাকে প্রশ্রয় দিলো না। ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” বাই দ্য ওয়ে তুমি কী আমাকে মিস করছিলে? ভালোটালো-বেসে ফেলনি তো আবার?
তনুজা লজ্জা পায়। নিরুত্তর রয়। ইভান মৃদু হাসল। তনুজার লজ্জা, অস্বস্তি বাড়তে না দিয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,
-” আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড় কেমন।”
তনুজা অকস্মাৎ প্রশ্ন করে উঠল,
-” আপনি ফিরছেন কবে?”
-” চিন্তা করো না তাড়াতাড়িই ফিরব ইনশাআল্লাহ। হয়ত দু-তিন দিনের মধ্যেই।”
-” আচ্ছা।”
কয়েক সেকেন্ড পর ইভান কণ্ঠে আদর জড়িয়ে শান্ত শীতল গলায় ডাকলো,
-” তনুজা?”
-” হু।”
-” আই মিস ইউ।”
শব্দগুলো কর্ণকুহর হয়ে মস্তিষ্কের নিউরনে সাড়া জাগাতেই বরফের মতোন হিম শীতল হয়ে আসে তনুজার গোটা শরীর। সারা শরীরে বিদ্যুৎস্পন্দন খেলে যায়। তনুজা নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ রয়। ইভান প্রত্যুত্তর না পেয়ে চোখদুটো বুজেই ম্লান হাসল। কণ্ঠে আবেগ আদর জড়িয়েই বলল,
-” অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়। নিজের যত্ন নিও। গুড নাইট, মাই মিসেস। বাই।”
তনুজার মনে টুকরো টুকরো প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। আলতো গলায় প্রত্যুত্তরে আওড়ায়,
-” টেইক কেয়ার। গুড নাইট, বাই।”
একদিন পর….
দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আযানের মিষ্টি ধ্বনি ভেসে আসছে। সূচনা হয় আরেকটি নতুন দিনের। পুব আকাশে লালাভ বর্ণ, বাড়ছে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। তনুজার ঘুম হালকা হতেই নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ পায়। পিটপিট করে চোখ মেলে চাইতেই ভূত দেখার মতো চমকায়, ভড়কায়। বিস্ময়ে চোখদুটো কোটর ছাড়িয়ে যাওয়ার জো হয়েছে। ইভানের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ওর কোমল দেহখানা। উষ্ণ হাতে কোমড় পেঁচিয়ে জড়িয়ে আছে ইভান। “ইভান কখন আসলো?” এটা ভেবে অবাক হলেও, এখন মানুষটার এত কাছে ঠাহর করতেই তনুজার গোটা শরীরে বিদ্যুৎস্পন্দন খেলে যায়। বেড়ে যায় শ্বাস-প্রশ্বাস। তনুজা তড়িৎ কোমড় পেঁচিয়ে রাখা ইভানের হাতটা ছাড়াতে নেয়। মূহূর্তেই কানে আসলো ঘুমঘুম কণ্ঠস্বর,
-” চুপচাপ ঘুমাও। আর আমাকেও শান্তিতে ঘুমাতে দাও। প্লিজ ডিস্টার্ব করো না। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।”
ডিম লাইটের সবুজ আলোয় ইভানের বুঁজে থাকা চোখমুখের দিকে চাইল তনুজা। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে উঠল,
-” আপনি? কখন আসলেন? আর আপনার না আগামীকাল আসার কথা।”
ইভান আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চোখদুটো বুজে রেখেই বলল,
-” কাজ শেষ হয়ে গেল। ভাবলাম শুধু শুধু রাত থেকে কী লাভ! তারচেয়ে বাসায় ফিরে প্রশান্তিতে ঘুম দেওয়া যাবে। যেমন ভাবা, তেমনি রাতেই ব্যাক করা।”
-” বাসায় কখন আসলেন? আমাকে একবারো ডাকলেন না যে!”
আচমকা তনুজাকে ছেড়ে দিয়ে নড়েচড়ে ওঠে; কনুই বালিশে ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথা রাখে ইভান। পরপর তনুজার দিকে ঝুঁকে বলল,
-” সাড়ে তিনটে নাগাদ বাসায় ফিরেছি।”
-” আমায় ডাকলেন না কেনো?”
ইভান শান্ত চাউনিতে চাইল। নির্লিপ্ত জবাবে বলল,
-” প্রয়োজন মনে করিনি।”
থেমে, কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চাইল; শীতল কণ্ঠে বলল,
-” এসে ঘুমন্ত এলোমেলো তোমাকে দেখতেই থার্টি মিনিটস পেরিয়ে গিয়েছে। তোমার নির্মল ঘুমটা ভাঙতে একদম ইচ্ছে করেনি। বরং যেটা ইচ্ছে করেছে সেটিই করেছি।”
বিস্ময়ে তনুজার চোখদুটো রসগোল্লার আকার নিলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনরকমে শুধাল,
-” মানে? কি করেছেন?”
ইভান শব্দ করে হাসল। তনুজার কপালের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেবি হেয়ার ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তনুজার মৃগ আঁখিজোড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরপর উষ্ণ হাতের ছোঁয়া নরম গালে পেতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় তনুজার। তনুজার সফট গালে হাত রেখে ইভান নিচু ঠান্ডা গলায় ডাকলো,
-” তনুজা?”
-” হুঁ।”
-” চোখ খোলো। তাকাও আমার চোখের দিকে।”
ধীরে ধীরে ঘনপল্লব মেলে চায় তনুজা। ইভানের ঘোরলাগা চোখে চোখ মিলতেই তনুজার বুক দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। অদ্ভুত অনুভূতিতে তনুমন কম্পিত হয়। গোটা শরীর অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে থাকে। ইভান তনুজার চোখে চোখ রেখে হাস্কি স্বরে বলল,
-” ভ’য় পেয়ো না। আমি তোমার ঘুমের সুযোগ নেইনি। আপাতত আমার ইচ্ছে তোমাকে টাইটলি জড়িয়ে প্রশান্তির সহিত ঘুমানো।”
এই বলে ইভান তনুজাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। ফের মুচকি হেসে বলল,
-” এটাই করেছিলাম। মাঝখানে তুমি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে। এখন গুড গার্লের মত, ঘুমিয়ে পড়। আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। আ’ম টায়ার্ড।”
তনুজা ইতস্তত গলায় আওড়ালো,
-” আপনি ঘুমান। আমি উঠব। সকাল হয়ে গিয়েছে, না উঠলে দেরি হয়ে যাবে।”
ইভানের কানে মনেহয় কথাটা ঢুকেনি। ইভানকে নির্লিপ্ত, নির্বিকার দেখে তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” ইভান ছাড়ুন। এখন ঘুমালে দেরি হয়ে যাবে। কিচেনে যেতে হবে তো। ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে।”
-” বাড়িতে বুয়া আছে, আরো লোক আছে। তোমাকে অত ভাবতে হবে না। একদিন দেরি করে উঠলে ব্যাপার না। আমি ভীষণ ক্লান্ত। ডিস্টার্ব করো না, ঘুমাতে দাও।”
-” আশ্চর্য! আপনি ঘুমান। আম__”
কথাটা সম্পুর্ন করার আগেই লম্বা একটা দাঁড়ি টেনে দেয় ইভান। তনুজার গলায় মুখ ডুবায়। গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
-” তুমি কী চাইছো, না হওয়া বাসরটা আজ সারি? অনবরত কথা বলে আমাকে উস্কে দিচ্ছো। শেষমেষ দূর্ঘটনা ঘটলে, আমাকে দায়ী করে বসো না কিন্তু।”
ইভানের স্পর্শ তারপর লাগামহীন এহেন কথা শুনে তনুজা মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হয়। লজ্জায় ভেতরে ভেতরে নুইয়ে পরে। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে চুপচাপ চোখদুটো বুজে নিলো। ইভান হাতের বাঁধন শক্ত করে তনুজার গলায় মুখ গুঁজে অস্ফুট স্বরে বলল,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ১৮
-” তুমি পাশে থাকলে আমি অনুভব করি এক আকাশ শান্তি। নিমিষেই দূর হয়ে যায় আমার সকল অবসাদ আর ক্লান্তি! আমার প্রশান্তি, আমার অর্ধাঙ্গিনী।”