প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৭
মুসতারিন মুসাররাত
বিশালাকার আলিশান অফিস কক্ষ। কৃত্রিম সাদা আলো ছড়িয়ে সর্বত্র। সব সময়কার মত রুমের বাতাসে মিশে আছে লেমন এয়ার ফ্রেশনারের সতেজ করা সুঘ্রাণ। পরপর বসা থেকে উঠে নামিদামি পর্দা একহাতে সরিয়ে ইভান একপাশে দাঁড়ায়। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে উদাসী হয়ে দাঁড়ায়। মোটা পুরু কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে রাতের আলোক সজ্জিত ব্যস্ত শহর দেখা যায়। চারিদিকে এত আলো ঝলমলে পরিবেশ; অথচ ইভানের হৃদয়জুড়ে অন্ধকারের ঘনঘটা। মনটা বড্ড বিষণ্ণ। বিরহে অস্থির চিত্ত। মনমস্তিষ্ক, নয়ন সবটাই নিজের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। মস্তিষ্ক বারবার একটি নাম স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। টলটলে সরোবরের জলের মতো স্বচ্ছ মৃগ আঁখি, মায়ায় ডুবানো পবিত্র-নিষ্পাপ বদন খানি নয়নে বারংবার ভাসছে। মনটা খুব করে তার সংস্পর্শ চাইছে।
আজ গোটা দিন ইভানের মনটা বিক্ষিপ্ত। কোন কাজে মন বসেনি। না চাইতেও মনটা উদ্বিগ্ন। তনুজা অভিমানী হয়ে অনুরাগে চলে গিয়েছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে ধরণীতে রাত্রির অবতরণ হয়েছে। তবুও তনুজার থেকে একটা কল, ছোট্ট একটা বার্তা অবধি আসেনি। অভিমানের পাল্লা এতটাই ভারী হয়েছে যে তনুজা একবারো ফোন করে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এটা স্থির করতেই বিরহে মন ভারী হয়ে ওঠে ইভানের। ভেতরটা হাঁসফাঁস করে উঠল। পরক্ষণেই মনে হলো, দো’ষ তনুজার নয়। দোষী স্বয়ং সে নিজে। সেই তো নীরব থেকে তনুজাকে ইগনোর করে এসেছে। তাই তনুজার রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান সাজে। ইভানের নিজের উপর নিজেরই রা’গ হচ্ছে। সাথে আফসোস হচ্ছে। সে বোধহয় একটু বেশিই অবহেলা করে ফেলেছিলো তনুজাকে। তনুজাকে ফোন করে সরি বলবে, সাথে খোঁজ খবর নিবে। আর…আর নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করবে। এইভেবে ইভান পকেট থেকে ফোন বের করে। কল লিস্টে গিয়ে পরম কাংখিত নম্বরের সামনে আঙুল থামে। আঙুল স্পর্শ করে সিম ওয়ান থেকে যেই কলে চাপ দিবে এমন সময় নক করার শব্দ হয়। ইভানের মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে। পরপর ফোন হাতেই এগোয়। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ইভানের পিএ বিনম্র স্বরে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” মে আই কাম ইন, স্যার?”
ইভান ভাবে একটু পরেই ধীরস্থির ভাবে তনুজাকে কল দিবে। রিভলভিং চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
-” ইয়েস কামিং।”
পিএ এনামুল হক ভেতরে এসে নিম্ন স্বরে বলল,
-” স্যার একটা ছেলে এসে বলছে, সিইও স্যারের সাথে দেখা করা জরুরী। আমি বারবার বলছি এখন অফিস আওয়ার নয়। স্যার রাজি হবেন না, আপনি আগামীকাল আসুন। কিন্তু উনি তো কিছুই শুনছেন না। আধা ঘন্টা হতে চলছে বাইরে ওয়েট করছে। আর বলছে, আজ দেখা করতেই হবে। নইলে সমস্যা হবে। তার নাকি দেখা না করা অবধি স্বস্তি মিলবে না। নাছোড়বান্দার মতো গো ধরে বসে আছে। যদিও ছেলেটির বেশভূষা দেখে মে’ন্টা’ল লাগছে না; তথাপি এরুপ কথায় কেনো জানি আমার অবাক লাগছে।”
ইভান গম্ভীর মুখাবয়ব করে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল। ইভানের দৃষ্টি দেখে আচমকা পিএ এনামুল হকের মুখ বন্ধ হয়। নতুন এই পিএ-র মুখটা একটু বেশিই চলে। এনামুল হক ফাঁকা ঢোক গিলে নিয়ে তড়িৎ বলল,
-” সরি সরি স্যার। আমি তাহলে ছেলেটিকে চলে যেতে বলি। গার্ড ডেকে বের করে দেই।”
ইভান টেবিলের উপর হাত দু’টো রেখে আদেশ করল,
-” তুমি এখন যেতে পারো। আর ছেলেটিকে পাঠিয়ে দাও।”
ইভানের সামনের চেয়ারে মুখটা কাঁচুমাচু করে ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে বসে লিমন। লিমনকে আগে থেকেই চেনে ইভান। দিব্য আর ইভান একই ব্যাচমেট হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিলো। লিমন, তৃষা দিব্য একই ডিপার্টমেন্টে ছিলো। অনার্সে ফাইনাল ইয়ারে উঠার পর র্যাগডে-তে শাড়ি পরিহিত সুন্দরী তৃষাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো ইভান। তারপর ভার্সিটির ক্যান্টিনে একদিন একই টেবিলে লাঞ্চ করার সময় অল্প স্বল্প কথাবার্তা। অতঃপর এফবিতে ফ্রেন্ড হওয়া, কন্টাক্ট নম্বর আদান-প্রদান। এভাবেই হয় প্রেমের সূত্রপাত।
আজকের সামনে বসা লিমনকে দেখে ইভানের প্রচন্ড রা’গ হচ্ছে। তবে কী জন্য এসেছে? আর যেহেতু এটা অফিস। এখনো কিছুসংখ্যক স্টাফ আছে। অফিসে সিনক্রিয়েট করতে চাইছে না। ইভান কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলো,
-” হঠাৎ আমার এখানে! কী দরকার? আবার কোন ষ’ড়য’ন্ত্র করতে নিশ্চয়?”
লিমনের হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। ক্রমশ ভ’য়ে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। কী করে বলবে? এই ভেবে বেচারার নাজেহাল অবস্থা। না বললেও রক্ষে নেই। দিব্য যে ক্ষে’পা’টে, ওকে বিশ্বাস নেই। একদম প’ঙ্গু করে জে’লের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। ২০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও চিন্তায়, অস্থিরতায় লিমন ঘামতে শুরু করে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুঝে ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নেয়। মিহি স্বরে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-” ইভান আ’ম স্যরি। আমি কিছু বলতে চাই। যা কিছু হয়েছে এরজন্য আমি নয় তৃষা দায়ী। আমি শুধু তৃষার কথামতো ওকে একটু হেল্প করেছি, ব্যস! তবে নিজের করা সেই কাজটুকুর জন্য আমি এখন অনুতপ্ত আর ক্ষমাপ্রার্থী।”
লিমন শর্টকাটে সবটা বলে কীভাবে, আর কী জন্য তৃষা তনুজার উপর প্র’তি’শোধ নিতে ওকে ব’লি’র পাঁ’ঠা বানায়। দিব্যর শিখিয়ে দেওয়া কথাটা শেষে বলে লিমন,
-” তৃষা নিছকই ভুল ছিলো। দিব্য আমাদের সাথে বা’জি ধরে তনুজাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমরা জানি দিব্য বাজিতে জিততেই অভিনয় করেছিলো। আর আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটা একটু এরকমই ছিলো। ফ্লার্টিং করতাম।”
দৃষ্টি নুইয়ে লজ্জিত মুখে অপ্রস্তুত গলায় একেকটা কথা বলছে লিমন। ইভান নিজেও দিব্যর ফ্রেন্ড সার্কেল সম্পর্কে অবগত। তারপরও কেনো জানি লিমনের সব কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” আজ হঠাৎ কী মনে করে নিজ থেকেই এসব বলতে আসা। না মানে কেউ কী প্রেশার দিয়েছে?”
লিমন ফাঁকা ঢোঁক গিলে নেয়। এইরে ইভান টের পেয়ে গেলো নাকি! নিজেকে ধাতস্থ করে তড়িঘড়ি করে বলল,
-” না না। কেউ চাপ দেয়নি। আর কে চাপ দিবে? ইদানিং আমার বিবেক রীতিমত আমাকে দং”শন করে যাচ্ছে। অ’প’রাধবোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে সত্যিটা বললে যদি একটু হলেও স্বস্তি মেলে। আর যখন জানলাম মূল কালপ্রিট তৃষা হওয়া সত্বেও সে এখনো কোনো শা’স্তি পায়নি; অথচ অল্প স্বল্প হলেও আমি পেয়েছি। তাই সত্যিটা বলতে আসছি।”
ইভান তাচ্ছিল্য হাসল। তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল,
-” হাউ ফানি! জ’ঘ’ন্য কাজ করার সময় বিবেকে একটিবারের জন্যও বাঁধল না। এখন নাকি বিবেকে বাঁধছে। আনবিলিভেবল।”
লিমন যেন কেঁদে দিবে এমন অবস্থা ওর। মুখটা সর্বোচ্চ অসহায় করে অ’প’রা’ধবোধে লজ্জিত হয়ে বলল,
-” আমি মন থেকে বলছি, আমি সত্যিই অনুতপ্ত। তৃষার কথামতো কাজটা করা মোটেই উচিত হয়নি। জানি ক্ষমার অযোগ্য। তারপর বলছি মাফ করে দিস। আমি খুব স্যরি।”
ইভান চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল। পরপর বলল,
-” স্যরি বললেই সব সলভ হয়ে যায়! তোদের জন্য আজ তিন-তিনটে মানুষ ভুক্তভোগী। তিন-তিনটে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তৃষার মাধ্যমে দিব্যর বিষয় শুনে আমি প্রতিনিয়ত অ’পরাধবোধে, অনুশোচনায় ভুগছি। মাঝখানে তনুজাকে কষ্ট দিচ্ছি। ওদিকে দিব্যও নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। দিব্যর কষ্টের জন্য আমার নিজেকে সম্পূর্ণ দায়ী মনে হচ্ছে।”
-” তৃষা মিথ্যে, বানিয়ে বলেছে। বললামই তো দিব্য বাজি ধরেই। আর দিব্য সব সময় বলতো ওর পছন্দের কেউ আছে। যাকে হুট করে বিয়ে করে দেখিয়ে দিবে। বাকি সব ওর প্রাঙ্ক।”
দিব্যর শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া বুলি আওড়ায় লিমন। তবে ইভানের বিশ্বাস হচ্ছে না। ও বলল,
-” আমি তৃষাকে খুব ভালো করে চিনি-জানি। ওর দ্বারা সর্বোচ্চ নি°কৃ°ষ্টতম কাজ করে একদম নিচে নেমে স্বার্থ সিদ্ধি করা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। তবে এখানে কিছু কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। আর এই অনুশোচনা, ক্ষমা চাওয়া সবটাই কেমন নাটকীয় লাগছে।”
আচমকা লিমন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পরপর ইভানের হাত দু’টো ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিস। আর আমি খুব ভ”য়ে আছি, বিষয়টা নিয়ে পু/লি/শ কেস-টেস হলে স্ক্যান্ডেল হয়ে যাবে। এরকম হলে আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। অনুরোধ করছি__”
ইভান হাত দুটো ঝট করে ছাড়িয়ে নিলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” কেনো জানি তোর এই চোখের জলে আজ আর চাইলেও সহানুভূতি আসছে না, বরং রা’গের পরিমাণ বাড়ছে। আমি নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। প্লিজ লেট মি অ্যালোন। আমার সামনে থেকে যা। তোদের মতো বি’শ্বা’সঘা’তক লোকদের দেখলে সিমপ্যাথি তো দূর শুধু ঘৃ/ণার পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না। আর এখন ইচ্ছে তো করছে..”
রাগ-ক্রো’ধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে শেষ কথাটা গিলে নেয় ইভান। অতিরিক্ত বাক্য ব্যয় না করে কড়া চাউনিতে চেয়ে দরজা বরাবর ইশারা করে কাঠিন্য সুরে বলল,
-” আউট। গেট আউট।”
শীতের সময় রাত গভীর হওয়ার দরুন শহুরে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা নগণ্য। নেই বললেই চলে। কুয়াশাচ্ছন্ন শুনশান রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করছে ইভান। মস্তিষ্ক সজাগ করে একহাতে ফোন তুলে কন্টাক্টে গিয়ে খুঁজে খুঁজে কাংখিত নম্বর বের করে। কানে এয়ারপড গুঁজে নেয়। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে গমগমে স্বর আসলো,
-” আরে ইভান! আজ হঠাৎ! তা কী মনে করে এতদিন পর এই অধমের কথা মনে পড়ল, ইয়ার?”
ইভান সৌজন্যমূলক বলল,
-” কী খবর তোর? এখন কোথায় আছিস তুই?”
সজীব বড় করে হামি দিয়ে ঘুমঘুম কণ্ঠস্বরে বলল,
-” এই তো ডিউটিতে আছি। আজ নাইট ডিউটি ছিলো।”
ইভানের ফ্রেন্ড সজীব বিসিএস দিয়ে এএসপি হয়েছে। আগে রেগুলার দেখাসাক্ষাৎ হলেও, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর যোগাযোগ কমে যায়। ইভান ড্রাইভ করতে করতেই কথা বলছে,
-” অনেকদিন আগে শুনেছিলাম রমনা থানায় তোর পোস্টিং হয়েছে। এখন কোথায় আছিস? এখানেই? নাকি ট্রান্সফার_”
কথার মাঝেই জবাব আসলো,
-” নাহ না; ট্রান্সফার হয়নি।”
ইভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরপর বলল,
-” শোন? আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।”
-” ওকে দোস্ত। ব্যাপার না। কোনো প্রকারের হেজিটেশন ছাড়াই বলে ফ্যাল। এই অধম তোর উপকারে আসতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবে। তো ঝটপট বল ইয়ার।”
ইভানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটল। ও বলল,
-“___________। এটা করতে হবে।”
ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রত্যুত্তর আসলো,
-” প্রবলেম নেই। তবে এরজন্য তো উপযুক্ত প্রমাণ যোগাড় করা লাগবে।”
-” নো টেনশন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।”
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলতে থাকে।
রাত গভীর। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। ইভান সবেমাত্র ফিরলো। বাড়ির সদস্যরা হয়ত ঘুমে বিভোর। রুমে ফিরে আনচান করা মনটার উচাটন বাড়ছে। বড্ড শুণ্যতা অনুভব হচ্ছে। আজ আর ফিরে মায়াবী মুখের দর্শন হয়নি। সে আশেপাশে থাকলে মা’দ’কতা মিশ্রিত মিষ্টি মিষ্টি সুঘ্রাণে মনটা আন্দোলিত হয়। ঘরময় থাকা মিষ্টি সুঘ্রাণটা মিসিং। নীরব থাকলেও সে চোখের সামনে ঘুরলে-ফিরলে মনের গহীনে আলাদা এক টুকরো প্রশান্তি বিরাজ করতো। সেখানে তার অনুপস্থিতিতে আজ ইভানের মন জুড়ে বিরহ বইছে। চোখের পাতায় ঘুম নামছে না। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে ইভান। একমনে তনুজার কথা ভাবছে। কথায় আছে, দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মর্ম বুঝিনা। ঠিক আমরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী আপনজনদের কদর ঠিকঠাক করতে জানি না। যখন হারিয়ে ফেলি, যখন তারা পাশে থাকে না; ঠিক তখনই তাদের গুরুত্ব কতটা উপলব্ধি করি। একাকীত্ব ইভানকে টের পাইয়ে দিচ্ছে তনুজা তার কাছে কতটা প্রয়োজনীয়। অল্প সময় হলেও, এই ক’মাসে তনুজা তার মানসিক প্রশান্তির পথ্য। এটা আজ ইভানের মনমস্তিষ্ক স্বীকার করতে বাধ্য। দূরে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে মনেমনে ভাবে ইভান,
-” সময়টা অল্প দিনের হলেও, তোমার মায়ায় খুব বেশিই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। তোমার শুণ্যতা আমাকে জানান দিচ্ছে; তুমি আসলে আমার কাছে কতটা জরুরী। যা কিছু আমার জন্য জরুরী, তার থেকেও বেশি জরুরী তুমি।”
ক্লান্ত চোখজোড়া বুঁজে নেয় ইভান। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ নিস্তব্ধতায় ঘেরা বিষণ্ণ রাতের সাথে মিশে যায়। ওর অবচেতন মন আওড়ায়,
-” সাইকোলজি তো বলে, ‘যখন কেউ কাউকে মন থেকে ভাবে, তখন পৃথিবীর অপর প্রান্তের মানুষটিও তাকে নিয়ে ভাবতে থাকে।’ এইযে আমি তোমায় নিয়ে ভাবছি। আমার মনমস্তিষ্ক তোমাকে ভাবতে বিভোর। তবে তুমিও কী একইভাবে আমার কথা ভাবছো?”
ইভানের হঠাৎ আফসোস হলো,
-” ইশশ্! কতই না ভালো হতো; আমার তোমাকে নিয়ে ভাবনাগুলো যদি ভাবার সাথে সাথে নোটিফিকেশন আকারে তোমার মনে পৌছাত। তাহলে তুমি বুঝতে, তুমি জানতে, আমি ঠিক কতটা তোমায় মিস করছি। কতটা তোমায় স্মরণ করছি।”
নির্ঘুম একটা রাত্রিযাপন করে ইভান। নিজ রুমে আজ কেনো জানি অস্থির লাগছে, বেশি হাঁসফাঁস ঠেকছে। আগেও তো কত একলা থেকেছে, তখন তো একাকীত্ব তাকে অস্থির বানায়নি। তবে আজ কেনো একাকীত্ব তাকে অস্থির করছে। সাথে অসহায় করে তুলছে। বিষণ্ণ মন নিয়ে রুম থেকে বেরোয় ইভান। বাড়ির বেশিরভাগ সদস্যরা এখনো জাগেনি। নামাজ শেষ করে দীর্ঘক্ষণ তাসবিহ পাঠ করে রুম থেকে বেরোয় নুরজাহান। উদ্দেশ্য মেয়ের রুমে যাবেন। কাল থেকে মেয়েটা বেহুদা রাগ করে না খেয়ে আছে। রুম থেকে অবধি বেরোচ্ছে না। মেয়েকে বোঝাবেন। হঠাৎ কালো হুডি গায়ে ইভানকে লিভিং রুম পেরিয়ে বাইরে বেরোতে দেখে হাঁক ছেড়ে পিছু ডাকলেন,
-” দাদুভাই!”
ইভান পরপর পিছু ঘুরে উত্তর দেয়,
-” হ্যা দিদুন।”
ইভানের মুখটা কেমন শুকনো শুকনো ঠেকছে; বৃদ্ধার নজর এড়ায় না। কিছু ভেবে কণ্ঠে একরাশ মায়া ঢেলে শুধালেন,
-” দাদুভাই এতো সক্কাল সক্কাল উঠছো আজ! তা শরীর ভালো আছে তোমার?”
শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক ব্যাপক। এইযে মন ভালো নেই; বাহ্যিক মুখাবয়ব দেখলেও আন্দাজ করা যায়। দিদুনকে কিছু বুঝতে দিবে না ভেবে ইভান জোর করে মুখটা হাসিহাসি করার চেষ্টা করল। মুখে বলল,
-” হ্যা ঠিক আছি। এমনি ঘুম ভে’ঙে গিয়েছে; তাই ভাবলাম একটু মর্নিং ওয়াকে বেরোয়।”
বৃদ্ধা খেয়ালি নজরে চাইলেন। সহসা কাছে ডাকলেন,
-” এদিকে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।”
ইভান অপ্রস্তুত হয়। নুরজাহান সোফায় নাতির পাশে বসলেন। প্রশ্ন করলেন,
-” কাল রাতে কখন ফিরেছো?”
অপ্রস্তুত গলায় জবাব দেয় ইভান,
-” দিদুন; একটু কাজ ছিলো তাই দেরি হয়ে যায়।”
-” নাতবউয়ের সাথে কথা হয়েছে?”
ইভান মিথ্যে বলে,
-” হ-হু।”
-” তা কালকে গিয়েছে। আজ দিন গেলে দু’দিন হবে। একটিবারও তো ফোন করে আমাকে বললো না, দিদুন ঠিকঠাক পৌঁছেছি। বলি বাপের বাড়ি গিয়ে কী তার দশটা ডানা গজিয়েছে? মাটিতে পা পরছে না, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে! এই বুড়িটার কাছে একটিবারও ফোন করার সময় হলো না তার।”
ইভান বেশ অবাকই হয়। তনুজা দিদুনকে অবধি ফোন করে বলেনি! ওর সাথে মান-অভিমান হয়েছে। তাই বলে বাকীদের সাথেও যোগাযোগ রাখবে না। ইভান পরপর ভাবল, সারাদিন দেখবে এরমধ্যে তনুজা ফোন না দিলে, ও তনুজাকে আনতে যাবে। আনতে গেলে, সামনে গেলে নিশ্চয় আর রাগ করে থাকবে না। নুরজাহান প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললেন,
-” বাড়িতে তো থাকো না। কোনো খোঁজ খবর রাখো না। এদিকে তোমার ছোটভাই। আমার ছোট কর্তা তো এক কে’লেঙ্কা’রি করে ফেলেছে। যদিও কথাটা বাড়ি ছাড়া বাইরে এখনো যায়নি। এখনো কাউকে জানাইনি। ভেবেছি পরে একসাথে দু’টো অনুষ্ঠান করে আত্মীয়-স্বজনদের জানাবো ।________। ছোট কর্তা নিতি কে পছন্দ করতো। আগে থেকে জানলে আর এতটা জল ঘোলা হয় না। নিতির জন্য অন্যত্র পাত্র দেখাও লাগত না। মাঝখানে কীভাবে কী হলো! যাইহোক বিয়ে হয়েছে সুন্দর করে ঘর-সংসার করুক, সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি।”
নুরজাহান সবটা বলেন। দিব্য আর নিতির এভাবে বিয়ের কথা শুনে ইভান যারপরনাই অ্যাস্টোনিস্ট হয়। পরপর লিমনের বলা কিছুকথা মনে উঠল। তবে কী লিমনের বলা সবটাই সত্যি!
ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটের ঘরে। শীতের দিন ছোট হওয়ায় তাড়াতাড়িই সাঁঝ নামে। ইভান ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে পরপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চেয়ারের সাথে রাখা ব্লেজারটা বামহাতের ভাঁজে রাখে। উদ্দেশ্য তনুজাকে আনতে যাবে, টার্গেট সন্ধ্যার আগেই পৌঁছানো। আর কিছুক্ষণ কাটিয়ে রাতেই ব্যাক করা। অফিস কক্ষে থাকতেই ফোনটা ভোঁভোঁ শব্দ তুলে কাঁপতে থাকে। তনুজার দাদির নম্বর দেখে আচমকা ইভানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোঁটে। ভাবে তনুজা করেছে আর নয়তো দাদিকে দিয়ে ইনভাইট করার জন্য। সাধারণত মেয়ে বাড়ি থাকলে, বাড়ির সদস্যরা জামাইকে আসার জন্য তোষামোদ করে থাকে। ইভান রিসিভ করে সালাম দেয়। ওপাশ থেকে উত্তর দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” কেমন আছো নাতজামাই?”
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। দাদি আপনার শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে?”
-” ভালো।”
হঠাৎ বৃদ্ধা শুধালো,
-” নাতজামাই! তুমি কোথায় অফিসে? তনুজা কেমন আছে?”
‘হ্যা অফিসে’ কথাটা বলতে গিয়েও আঁ’টকে যায় ইভান। তনুজা কেমন আছে? এটা শুনে। ইভানের কপালে জ্যামিতিক রেখার অনুরুপ ভাঁজের সৃষ্টি হলো। ওপাশ থেকে সুফিয়া বেগম বলতে থাকেন,
-” আজ ক’দিন হলো আপা কল দেয় না। আপার মোবাইলে কল দিলাম বন্ধ কয়। তাই তোমারে কল দিলাম। তুমি মনেহয় অফিসে আছো, কাজের সময় বিরক্ত করে ফেললাম।”
বৃদ্ধার সরল মনের শেষোক্ত কথা কর্ণকুহরে ঢুকে না ইভানের। মূহুর্তেই কালবৈশাখীর ন্যায় তান্ডব শুরু হয় ভেতরে। অস্থির চিত্তে তড়িৎ বেগে প্রশ্ন করে উঠল,
-” তনুজা বাড়ি যায়নি? ওর তো গতকাল আপনাদের ওখানে যাওয়ার কথা। বাড়ি যায়নি! তাহলে কোথায় গিয়েছে?”
বৃদ্ধা পাহাড় থেকে পড়ার ন্যায় চমকালেন, অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
-” ইয়া আল্লাহ! বল কী তুমি? কই তনুজা তো আমারে বলেনি কোনো আসার কথা। আজ ক’দিন নাগাদ তো ওর সাথে কথাই হয়নি। তনুজা তোমার বাড়িতে নেই?”
ইভানের নিজেকে এলোমেলো লাগছে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসছে। গলাটা কাঁপল ওর, কালকে তনুজার বাড়ি যাওয়ার কথা সংক্ষেপে বলে ইভান। বৃদ্ধার হাত-পা থরথরিয়ে কাঁপছে। মনটা কু ডাকতে শুরু করলো। বললেন,
-” তাহলে মাইয়াটা গেলো কই! আর মোবাইল খানাই বা বন্ধ কেনো? কোনো বিপদ আপদ হয়নি তো!”
ইভানের মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে আসছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। খানিকক্ষণ থ মে’রে থেকে বলল,
-” দাদি ওর কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় যায়নি তো?”
বিপদের সময় মাথা কাজ করে না, কোনো কিছু সহজে মাথায়ও আসে না। একেতেই বয়স্ক মানুষ, তার উপর অতি আদরের নাতনি। বৃদ্ধার নিজেকে নিষ্প্রাণ ঠেকছে। মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হয়েছেন। কেমন পাথর বনে যায়। অমনি অসাড় গলায় বললেন,
-” আমি কীভাবে কই? আমি কিচ্ছুই ভাববার পারছি না।”
ইভান বৃদ্ধার অবস্থা বুঝল। সাহস যোগাতে বলল,
-” দাদি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক তনুজাকে খুঁজে বের করবো। ইনশাআল্লাহ আজকেই। ও নিশ্চয় ওর কোন ফ্রেন্ডের সাথে আছে। ওর কোন ফ্রেন্ডের নম্বর আছে আপনার কাছে।”
বৃদ্ধা জড়বস্তুর ন্যায় বলল,
-” না নাই তো। তয় ওর বান্ধবী রুপার বাড়ির ঠিকানা জানি।”
-” আচ্ছা এটাই বলুন।”
ইভান এক সমুদ্র আশা নিয়ে প্রথমে তনুজার নম্বরে ডায়াল করে। কিন্তু বিধিবাম! নম্বর সুইচড অফ। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে উক্ত ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাবে এক্ষুনি। যদি ভাগ্য সহায় হয়। তনুজা রুপার বাসায় থাকলেও থাকতে পারে। পরপর ইভান কালকের ড্রাইভারের কাছে কল দেয়। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে লম্বা সালাম আসে। ইভান উত্তর দেয় না। বজ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” তনুজাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছেন?”
ওপাশ থেকে আইগুই করতে থাকে। ইভানের ফের ধ’ম’কে ড্রাইভারের কানের তালা ছুটে যাওয়ার জো। ভীতু হয়ে কম্পিত স্বরে বলল,
-” স্যার, ম্যাডামকে….রোডে নামিয়ে দিয়েছিলাম।”
কপালে শিরাগুলো দপদপ করে ওঠে। রাগে চোখদুটো জ্ব’লন্ত কয়লার ন্যায় লাল হয়। ধ’ম’ক দিয়ে কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” আপনাকে ওর বাসায় নামিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু আপনি তা না করে; ওখানে কেনো ওকে ছেড়ে এসেছেন?”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” স-স্যার ম্যাডাম বলেছিলেন।”
-” তনুজার যদি কিছু হয়, আমি তোকে খু//ন করে ফেলবো। আমি বারবার বলা সত্বেও।”
ইভান খট করে কল কে’টে ত্রস্ত হাতে ড্রাইভ করতে থাকে। আজকে যেন যানজট বেশিই। পাঁচ মিনিট গিয়েই পঁচিশ মিনিট জ্যামে আ’ট’কে থাকতে হচ্ছে। ইভান রাগে স্টায়ারিংয়ে ঘু°ষি মা°রে। অস্থিরতায় কপালে ঘাম জমতে শুরু করছে ওর। খানিকক্ষণের ব্যবধানে নিজেকে পা/গ/ল পা/গ/ল ঠেকছে। একহাত চুলের মধ্যে চালনা করে অস্ফুটে বলে,
-” ইটস্ অল মাই ফল্ট। যা কিছু হচ্ছে সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। তনুজার কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
যানজট পেরিয়ে রুপার বাসার দোড়ে পৌঁছাতে যেন পাহাড় পর্বত পাড়ি দেওয়ার মতো কঠিন আর দীর্ঘ সময় লাগল এমন মনে হচ্ছে ইভানের। যদিও যানজটের জন্য একটু বেশিই সময় লেগেছে। ইভান এক নাগাড়ে পরপর ডোর বেল চেপে যাচ্ছে। রুপার মা মাগরিবের নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসে দোয়া-দূরুদ পাঠ করছেন। রুপাকে ডেকে দরজা খুলতে বললেন। রুপা বিরক্ত হয়েই আসতে আসতে বিড়বিড় করে,
-” ইয়া আল্লাহ! কোন আ’জ’ব পাবলিক আসছে! ঠেকছে একটুও তার তর সইছে না। একনাগাড়ে বেল চেপেই যাচ্ছে। আরে বেলটাকে একটু জিরানোর টাইম দিবে তো, লোকজন আসতে সময় লাগবে না। যত্তসব!”
বলতে বলতে সিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলতেই রুপার চক্ষু চড়কগাছ হয়। ইভানকে দেখে এলিয়েন দেখার মতো চমকায়। কলেজে মিট হয়েছে ইভানের সাথে। তাই চিনতে দেরি হয় না। রুপা অবাক বনে যায়। বেচারি কিছু বলার আগেই ইভান প্রশ্ন করে,
-” তনুজা আসছে?”
রুপা চোখ পিটপিট করে চায়। আরেক দফা সে থমকায়। বলল,
-” তনুজা! আমাদের এখানে! ক-কই না তো।”
এবার ইভান চরম হতাশ হয়। ইশশ্! সৃষ্টিকর্তার উপর অভিমান হলো উত্তরটা পজিটিভ হলে খুব বেশিই কী ক্ষ’তি হতো! ইভান নিজেকে সামলে ফের বলল,
-” তনুজার সাথে তোমার কথা হয়নি? লাস্ট কখন এন্ড কবে কথা হয়েছিলো?”
রুপা দুদিকে মাথা দুলিয়ে বলল,
-” নাহ কথা হয়নি তো। লাস্ট গত সপ্তাহে কলেজে দেখা আর কথা।”
কিছু ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই রুপা সন্দেহি কণ্ঠে বলল,
-” কিছু হয়েছে ভাইয়া? কোনো সমস্যা?”
-” নাহ মানে…তনুজার কালকে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো। ও বাড়িতে যায়নি। ওর ফোন বন্ধ বলছে। আচ্ছা ওর আর কোন ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে? বিশেষ করে ___রোডের দিকে।”
রুপা খানিকক্ষণ ভাবে। ঠোঁট উল্টে বলল,
-” উম! আমার জানামতে নেই। আর ও কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে না। আমি শিওর। আমি ওর বেস্টি হওয়া স্বত্বেও আমার বাসায় কক্ষনো রাত থাকেনি। হাতেগোনা কয়েকবার বেড়াতে আসছে।”
-” আচ্ছা। ঠিক আছে। তোমায় বিরক্ত করায় দুঃখিত। ব্যাপার না। আমি খুঁজে বের করছি।”
ইভান আর সময় ন’ষ্ট না করে প্রস্থান করতে নেয়। এমন সময় কিছু মনে উঠতেই রুপা পিছু ডাকল,
-” ওয়ান মিনিট ভাইয়া ”
ইভান ঘুরে তাকায়। রুপা কপাল কুঁচকে বলল,
-“____রোডে তনুজার ফুপির বাসা। ওখানে খোঁজ নিয়েছেন?”
মেঘের আড়াল থেকে একফালি রোদ্দুর উঁকি দেওয়ার মতোন একটুকরো আশা উঁকি দেয় ইভানের মনে। ইভান ‘না’ বলতেই রুপা বলল,
-” ওখানে রঞ্জু ডেন্টিস্টের বাসা বলে খোঁজ করলেই চারতলা বিল্ডিং দেখিয়ে দিবে যে কেউ। ঐ বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ওর ফুপির বাসা। একবার তনুজার পরামর্শে ঐ ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। তাই জানা আরকি।”
ইভান বিনিময় বলল,
-” থ্যাংকস আ লট।”
রুপা প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে বলল,
-” টেনশন নিয়েন না। ইন শা আল্লাহ তনুজা ঠিক আছে।”
রুপার বলা ঠিকানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ইভানের রাত নয়টা বেজে যায়। ইভানকে বড্ড উসকোখুসকো লাগছে। কয়েক ঘন্টায় পুরো অন্যরকম ছন্নছাড়া লাগছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে বেল চাপে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রে করে, তনুজা যেনো এখানেই থাকে। অস্থিরতায় চোখদুটো বুঁজে নেয় ইভান। অবচেতন মন ভাবে,
-” ছায়ার থেকে যত দূরে সরে যাওয়া যায়, ছায়া তো তত কছে আসে! অনুরুপ অভিমান করলে নাকি মানুষকে আরো কাছে পাওয়া যায়। তবে কেনো আমার অভিমানে তুমি হারিয়ে গেলে!”
কয়েক সেকেন্ড পরে। মনটা খুব করে চায়,
-” প্লিজ তনুজা যেখানেই থেকো সেভ থেকো। আর তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরে এসো। আমি মন থেকে তোমাকে চাই। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রণয়ের বাঁধন এতটাও ঠুনকো নয়। তুমি রাগ-ক্ষোভ, অভিমান যাই করো না কেনো; কক্ষনো আমাকে ছেড়ে হারিয়ে যাবে না। তারপরেও অশান্ত মন সে তো মানতে নারাজ। সে তো নেগেটিভ চিন্তা করে করে আমাকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে। যতক্ষণ না তোমাকে দেখছি ততক্ষণ এক বিন্দুও স্বস্তি মিলবে না!”
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৬
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ইভানের ভাবনার ছেদ ঘটে। সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ মেলে চায়। মূহুর্তেই চোখদুটো শীতলতায় ছেয়ে যায়। বুকের ভেতর বইয়ে চলা মরুর সাইমুম দপ করে থেমে যায়। সেখানে পরম আকাঙ্ক্ষিত এক পশলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির ফোঁটায় যেমন শুকনো ভূমি প্রাণ পায়, গাছের জীর্ণ পাতা সজীবতা পায়; ঠিক তেমনি ইভানের তনুমনে, শিরায়-শিরায়, রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, শীতলতা বইয়ে যায়। অশান্ত মন শান্ত হয়। কিছুপল নির্নিমেষ অপলক দু’জনে নির্বাক চেয়ে রয়। আচমকা ইভান দু’পা এগিয়ে সামনের অবাক নয়নে চেয়ে থাকে রমণীকে জড়িয়ে ধরে।সামনের রমণী ইভানের এভাবে জড়িয়ে ধরায় ভড়কায়, হকচকায়। ইভান আলিঙ্গন শক্ত করে। তনুজার মাথাটা ইভানের বুকের উপর। ইভানের অস্থির বেপরোয়া গতিতে চলা হৃদস্পন্দন মেয়েটা শুনতে পায়। সময়টা যেন দু’জনেরই থেমে যায়।