প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৮
মুসতারিন মুসাররাত
সূর্যের কোমল আলো জানালার ফাঁক গলে রুমে প্রবেশ করছে, সফেদ পর্দায় পড়ে মৃদু দোল খাচ্ছে। পুরো ঘরময় এক শান্ত মায়াবী আবহ, সময় যেন থমকে আছে। বিছানায় এলোমেলো চুলে শুয়ে থাকা নিতি ধীরে ধীরে চোখ মেলে, অনুভব করে শরীরে এক নতুন ব্যাথা। কিন্তু সে ব্যাথায় ক্লান্তি নেই। বরং মিশে আছে এক মধুর সুখের পরশ। কিঞ্চিৎ মাথা তুলে পাশে শুয়ে থাকা দিব্যর দিকে তাকায় নিতি। শান্ত নিঃশ্বাস ফেলে গভীর ঘুমে বিভোর মহাশয়। দিব্যর দিকে তাকাতেই নিতির মুখ লজ্জার আভায় রঙিন হয়ে ওঠে, ঠোঁটের কোণে খেলে যায় এক চপল হাসি। নতুন দিনের সাথে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। শরীরজুড়ে এখনো রাতের উষ্ণতা বইলেও, মন নাম না জানা প্রশান্তির স্রোতে ভাসছে।
বিছানার পাশ থেকে চুলের ক্লিপটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে নিতি। এলোমেলো চুল গুছিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। তারপর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। কিছুক্ষণ পর….
হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে সিল্কি হালকা ব্রাউন কালার করা চুল পিঠজুড়ে খোলা রাখে। পরপর ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে ড্রেসিংটেবিলের থেকে নেলপলিশটা হাতে নিয়ে বসে নখে লাগাতে থাকে। এমন সময় খট শব্দ তুলে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে, সাদা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দিব্য এগিয়ে আসছে। ঘুম থেকে ওঠার পর এখনো দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। দু’জনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই, রাতের নীরবতা যেন এখনো রুমের কোণে লেগে আছে। নিতি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় আড়ষ্ট হলেও, দিব্যর মধ্যে নেই কোনো অস্বস্তি। যেন সবকিছু স্বাভাবিক। দিব্যর নির্লিপ্ততা তারপর কিছু মনে হতেই নিতির মনের কোণে অজানা অভিমান জেগে ওঠে। ফর্সা মুখটা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে আসে। চুল মুছতে মুছতে দিব্য একপলকে নিতির দিকে তাকায়। কপালে ভাঁজ ফেলে ডান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” এরপর থেকে নখগুলো ছোট ছোট করে রাখবি। নখ দিয়ে আমাকে আহত করে ছেড়েছিস।”
নিতি মূহূর্তেই লজ্জায় অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও বাইরে থেকে নিজেকে দৃঢ় রাখে। এবার যেন নিতি কথা বলার একটা মুখ্য স্কোপ পেয়ে বসল। ওর মনের গহীনে জমে থাকা অভিমান এবার ক্ষীণ স্বরে বেরিয়ে আসে,
-” তুমি কিন্তু এখন অবধি মুখ ফুটে আমাকে ভালোবাসো বলোনি। এখনো তোমার ভালোবাসা প্রকাশ করোনি। আর ভালোবাসা বি..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই দিব্য ভ্রু তুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” রাতে কী প্রকাশ করলাম?”
লজ্জা অস্বস্তিকে একপাশে ঠেসে নিতি অভিমানি কিশোরীর মতো গাল ফুলাল। মুখ শক্ত করে বলল,
-” ভালোবাসা ছাড়া স্পর্শের মূল্য নেই, নেই কোনো অর্থ। যতদিন হৃদয় থেকে ভালোবাসতে না পারবে ততদিন তোমার এই স্পর্শ আমি মানি না, হু।”
দিব্য ফিচেল হেসে বলে,
-” মানিস আর না মানিস, যা খুশি কর। কিন্তু এই নিয়ে শাহবাগে আন্দোলনে নেমে যাস না আবার।”
নিতি কটমট চোখে চাইল। দিব্য ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে চুলে ব্রাশ চালাতে লাগল। বডি স্প্রে করতে করতে নিতির রাগি মুখের দিকে চেয়ে দিব্য ফের বলল,
-” ওহ্ আই সী! তোর আবার শাওয়ার নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, রাইট? এত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে না বলে সরাসরি বলতে পারিস। তুই চাইলে ডোর-উইন্ডো লকড করে এই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটাকে মাঝরাত বানিয়ে ফেলতে পারি।”
নিতি রাগে গজগজ করতে করতে হাতের নেলপলিশের কৌটা দিব্যর দিকে ছুঁড়ে মা’রে। দিব্য একহাত দিয়ে ক্যাঁচ ধরে নিখুঁত ভঙ্গিতে। নিতি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিড়বিড় করে,’ অ’স’ভ্য, ফা’জি’ল কোথাকার! সবসময় ধূর্তের মতন কথা ডাইভার্ট করে।’ মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” তুমি ইচ্ছে করে আমার কথা এড়িয়ে যেতে আ’জে’বা’জে বলছো। আমি এক বলছি, আর তুমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিচ্ছো।”
দিব্য উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। একহাত জিন্সের পকেটে গুঁজে অন্যহাত ভেজা চুলে চালনা করে ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” এত গবেষণা বাদ দিয়ে কাজ কর। ব্রিং মি ব্লাক কফি কুইকলি। সার্ভ ইয়োর হাজব্যান্ড।”
ঠান্ডা স্বর অথচ আদেশ স্বরুপ শেষের কথা বলে দিব্য। আদেশ দেখে নিতি তাজ্জব বনে যায়। পরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে ত্যাড়ামির সুরে বলল,
-” পারব না। নিচে গিয়ে খেয়ে আসো।”
ব্যালকনির দোলনায় আসন পেতে নিতি একমনে দুলছে। চোখদুটো চেয়ে আছে রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে আকাশের দিকে, সেথায় যেন লুকিয়ে আছে ওর মনের কথার পসরা। ভাবনার অথৈ সাগরে ডুব দিয়ে অবচেতনে আওড়ায় নিতি,
-” জানি, একদিন তোমার চোখে ঠিকই আমার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসার ছোঁয়া দেখব। চোখে হারাবে আমায়। কিন্তু তুমি জানো? জানো কী? উঁহু জানো না, আমিই বলছি; তুমি আকাশের বিশালতার মতো ভালোবাসলেও, আমার ভালোবাসার গভীরতার কাছে তা ক্ষীণ মনে হবে। কারন, আমি জানতাম তোমার মনে অন্যকেউ আছে, তবুও তোমাকে ভালোবেসেছি নিঃস্বার্থভাবে।”
চোখদুটো বুঁজে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতি। মনে মনে বলে,
-” আমি বরাবরই বিশ্বাস করেছি, যা আমার তকদিরে নেই, তা কখনোই আমার হবার নয়। আর যা সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, তা কেউ চাইলেও কেড়ে নিতে পারবে না। আমার বিশ্বাস টলেনি। সময়ের সাথে হয়েছে প্রমাণিত। জানি না আজকাল কী হয়েছে আমার! কেনো জানি অদ্ভুত এক অনুভূতি জেঁকে বসেছে আমার মাঝে। নিজের অনুভূতি প্রকাশে অনীহা জাগে। মনেহয় আমার রাগি রাজার কাছে আমায় ত্যাড়ামির রানিতেই মানায়।”
নিতির ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হয়। আকাশের দিকে চেয়ে আনমনে হেসে বিড়বিড় করে বলে,
-” ভালোবাসি আমার রাগি রাজাকে। দিন গুনছি, ব্যাকুল হয়ে প্রতিক্ষায় আছি; কবে শুনবো তোমার মুখ থেকে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত শব্দ– ‘লাভ ইউ টু’।”
নিতির ভাবনার সুতো ছিঁ’ড়ে হঠাৎ উষ্ণ বাতাস চোখেমুখে লাগাতে। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকাতেই দেখে, কফির মগ হাতে কপাল কুঁচকে দিব্য চেয়ে আছে। ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয়,
-” এভাবে বসে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস? ভাবলাম দিনদুপুরে শ্যাওড়া গাছের পেত্মী ভর করেছে তোর উপর! তাই দোয়া পড়ে ফুঁ দিলাম।”
নিতি কটমট করে তাকায়। দিব্য পাশে ধপ করে বসে কফির মগে ছোট ছোট চুমুক দেয়। নিতি বুকের উপর হাত রেখে বলে,
-” ইয়া আল্লাহ! তুমি আর মানুষ হবে না! অন্যমনস্ক ছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম তো! আরেকটু হলে অ্যাটাক ফ্যাটাক হয়ে যেতো।”
দিব্য মগে ঠোঁট ছোঁয়ায়, চোখ সরু করে নিতির দিকে চেয়ে থাকে। তারপর কফির মগটা বাড়িয়ে বলে,
-” চমকে গেলে এখন এক চুমুক খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে যা।”
নিতি নাক সিঁটকে বলল,
-” অ্যা! এঁটো! ভাবলে কী করে তোমার এঁটো খাবো?”
দিব্য ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” রাতে তো ঠিকই কিস করলাম। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালাম। তখন কী…?”
নিতির মুখে গোলাপি আভা পরে। কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। এখানে থাকলে দিব্য আরো কী বলবে কে জানে! লজ্জায় লাল হওয়ার থেকে দ্রুত এখানটা প্রস্থান করাই শ্রেয়। এইভেবে নিতি তড়াক উঠে দাঁড়ায়, বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক তখনই দিব্য আলগোছে বাম পা-টা টেনে দেয় সামনে। নিতি বেঁধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দিব্য ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। নিতি গিয়ে সোজা দিব্যর বুকের উপর পড়ে। নিতি খিচে চোখ বুঁজে ফেলে। বড় করে শ্বাস নেয়। অতঃপর তাকিয়ে বলল,
-” তুমি খুব খারাপ। এভাবে..”
কথার মাঝেই, দিব্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” বাররে আমি আবার কী করলাম? নিচে পরে কোমড় ভাঙার থেকে তোকে সেভ করলাম। তার বদলে থ্যাংকস তো দিলি না, উল্টো খারাপ বলছিস।”
-” তুমি ইচ্ছে করে পা বাড়িয়ে ফেলে দিয়েছো। আবার থ্যাংকস আশা করছো।”
দিব্য হাতের মগটা নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টিশার্ট দুইহাতে টেনেটুনে ঠিক করে বলল,
-” তুই দেখেছিস আমি ফেলেছি তোকে?”
-” দেখতে হয় না। বোঝা যায়। আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছে তোমার পা-টা তুমি আমাকে ফেলতে ইচ্ছে করে বাড়িয়েছিলে।”
-” এইযে যেমন বলছিস; দেখতে হয় না, বোঝা যায়। ঠিক তেমনি আমিও বলছি; সবকিছু মুখে বলতে হয় না। অনুভব করে নিতে হয়।”
কথা শেষ করেই কালবিলম্ব করে না দিব্য। গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে। নিতি গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙিতে দিব্যর কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে।
স্কয়ার হাসপাতালের সুসজ্জিত করিডোর ঝকঝকে সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দেয়ালে নরম নীল রঙের শেড, আর এখানে-ওখানে সবুজ গাছের টব রাখা। সি-সেকশন অপারেশন থিয়েটারের বাইরে ওয়েটিং চেয়ার থাকলেও ইভান বসতে পারছে না। অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে, বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তনুজার লেবার পেইন ওঠার সাথে সাথে হসপিটালে এডমিট করা হয়। কিছুক্ষণ দেখার পর ডক্টর সি-সেকশনের কথা বলে। তনুজা এখন ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে ইভানের সময় যেন থমকে গিয়েছে দুশ্চিন্তায়। শিরিন সুলতানা চেয়ারে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। পাশে বসা নিতি দুইহাতে মুখ চেপে ধরে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। সবার চিন্তা সবটা যেনো ভালো হয়। শিরিন ইভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইভানের কাঁধে হাত রাখে। ইভান এতটাই তনুজার চিন্তায় বিভোর ছিলো যে শিরিনের স্পর্শে চমকে তাকালো। শিরিন আশ্বাস দিতে বললেন,
-” ইভান বাবা বসো। আর টেনশন করো না। সব ঠিক হবে ইন শা আল্লাহ।”
ইভান নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে বলল,
-” আমি ঠিক আছি মামণি। তুমি দাঁড়িয়ে কেনো, বসো।”
এরমধ্যে দরজা খোলার শব্দ হতেই ইভান ত্রস্ত এগোয়। দরজা খুলে সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে নার্স বেরিয়ে আসে। মনে হচ্ছে নার্সের হাতে ছোট্ট তুলতুলে পুঁচকে প্যাকেট। নরম সাদা মখমলের টাওয়েলে মোড়ানো একরত্তি শিশুকে ধরে আছে নার্স। উজ্জ্বল হাসিতে বলল,
-” কনগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে।”
ইভান অস্ফুটে আওড়ায়,
-” আলহামদুলিল্লাহ।”
শিরিন এগিয়ে আসে পরপর নিতি উঠে আসে। নার্স একবার ইভানের দিকে তাকায় তো আবার শিরিনের দিকে কার কাছে দিবে বুঝতে পারছে না। শিরিন আলতো হাসি মুখে টেনে ইশারায় ইভানের কাছে দিতে বলে। নার্স বাচ্চাটাকে ইভানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইভানের হাত দু’টো কাঁপছে, বুক ধুকপুক করছে। কাঁপাকাঁপা হাতে কোলে নেয়। জীবনে এতটা আবেগ একসাথে অনুভব হয়নি ওর। ইভানের চোখদুটো আনন্দে ছলছল করছে। বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে। কালো মিচমিচে চোখের মণি, গোলাপি গাল, কুঁচকে আছে ছোট ছোট আঙুলগুলো, পাতলা তুলার মতো ফিনফিনে চুল। নিখুঁত ছোট্ট প্রাণটাকে দেখে টপ করে দুফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে পড়ে ইভানের। ইভান আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দেয় ছেলের মুষ্টিবদ্ধ হাতে। মূহুর্তেই বাচ্চাটি যেন বাবার আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে। এমনভাবে আঙুল ধরেছে মনে হচ্ছে, এটাই ওর নিরাপত্তা আর ভালোবাসার আশ্রয়। ইভান ছোট প্রাণটির কপালে চুমু খায় ফিসফিস করে বলে,-” আমার ছেলে। আমার অংশ।”
নিতি ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
-” দেখি দেখি কেমন হয়েছে?”
ইভান পরপর মাথা তুলে নার্সের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
-” সিস্টার তনুজা? তনুজা কেমন আছে? ও সুস্থ আছে তো?”
নার্স আশ্বস্ত করে,
-” পেশেন্ট ভালো আছেন। কিছুক্ষণ পরেই ওনাকে কেবিনে শিফট করা হবে। গাইনি ম্যাম বেরুলে, ম্যামের থেকে জেনে নিয়েন।”
ইভান মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” শিওর। থ্যাংকস।”
ইভান গভীর শ্বাস ফেলে। অতঃপর ছেলের হাতের মুষ্টিতে চুমু খায়। একরাশ ভালোবাসা মিশে দেয়। নতুন এক জীবন এসেছে, কিন্তু তনুজার সুস্থতা না জানা অবধি, তনুজাকে কাছ থেকে না দেখা অবধি পুরোপুরি শান্তি হবে না। ইভানের সব অপেক্ষা সেই মূহূর্তের জন্য। যখন তনুজার হাত ধরে বলতে পারবে, – ধন্যবাদ! আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহারটি দেওয়ার জন্য।”
বাচ্চা একহাতের দুইটা আঙুল একসাথে মুখে পুরে ‘চপচপ’ শব্দ করে চুষতে থাকে। নিতি চট করে বলে উঠল,
-” এইরে বাবা সোনার বোধহয় ক্ষুধা পেয়েছে।”
বাচ্চা এরমধ্যে নড়াচড়া শুরু করে দিলো। শিরিনের দিকে চেয়ে ইভান বলল,
-” মামণি তুমি ধরো, এত ছোটো আমার ভয় হচ্ছে হাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাবে।”
কোল বদল করতেই গলা ফাটিয়ে -” উঙা উঙা উঙা ” করে কান্না শুরু করে দিলো বেবি। শিরিন দুই হাতে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করে। বলল,
-” তনুজাকে বেডে দিলে ফিড করাতে হবে।”
নিতি পাশ থেকে বলল,
-” ওলে ওলে বেবিটা একদম কাঁদে না।”
হঠাৎ কান্না থেমে যায়। নিতি চোখ বড়বড় করে চেয়ে বলল,
-” বাহবা! ফুপির কথা তো খুব শুনলে।”
নিতির কথাশুনে শিরিন হেসে ফেলে। ইভানও মেপে স্বল্প হাসে।
কেবিনজুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। পুরো পরিবেশ মুখরিত, যেন খুশির রঙ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই তনুজাকে বেডে শিফট করা হয়েছে। স্যালাইনের নল হাতে লাগানো। তবুও চোখেমুখে মাতৃত্বের শান্তির ছাপ স্পষ্ট। পাশে টুলে বসে শিরিন। কোলের মধ্যে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায়। এই তো একটু আগে দিব্যর সাথে নৃত্য এসেছে। বাচ্চাকে দেখবে বলে বায়না ধরেছিল। নৃত্য এক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাচ্চাকে দেখছে, আর কৌতূহলী চোখে এটাসেটা বলছে।
দিব্য সবার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। এখনো ওরা কেউ খাবার মুখে তোলেনি। ভোররাতে তনুজাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আটটায় ওটি হয়। এখন এগারোটা বাজতে চলছে। দিব্য ইভান দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। দিব্য জিন্সের পকেটে দুইহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” দিদুন তো বাচ্চাদের মতো বায়না ধরেছিলো। এখন হসটপিটালে দেখতে আসবে। আমি তাড়া দেখিয়ে চলে আসছি।”
-” আমি একটু আগে দিদুনকে ভিডিও কল দিয়ে দেখিয়েছি। আর বুঝিয়ে বলেছি, শুধু শুধু অসুস্থ মানুষ আসার কী দরকার! সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পরশুই রিলিজ দিবে।”
-” অনেক বেলা হয়েছে তোরা তো কেউ এখনো খাসনি। আগে খেয়ে নে।”
ইভানের কপালের উপর এলোমেলো হয়ে কিছু চুল পরেছিলো। একহাতে কপাল থেকে চুলগুলো পিছুনে ঠেলে সটান দাড়িয়ে বলল,
-” আমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসবো। মামণি আর নিতি না খেয়ে আছে, ওরা বরং খেয়ে নিক।”
শিরিনকে উদ্দেশ্য করে ইভান বলল,
-” মামণি তুমি আর নিতি খেয়ে নাও। আমার একটু কাজ আছে। কাজ সেরে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসবো।”
শিরিন ইতস্তত গলায় বলল,
-” খেয়ে গেলে বেটার হতো না।”
ইভান নম্র স্বরে বলল,
-” প্রবলেম নেই। তোমরা খেয়ে নাও।”
এরমধ্যে নিতি বাচ্চাকে কোলে তুলে এনে দিব্যর সামনে ধরে বলে,
-” ভালো করে দেখে বলো তো, ভাইপো কেমন হয়েছে দেখতে?”
দিব্য ছোট্ট মুখটির দিকে তাকিয়ে একহাতে গাল ছুঁয়ে দেয়। কোলে নেওয়ার ইচ্ছা হলেও, এত ছোট কীভাবে ধরবে? এইভেবে কোলে নেওয়া হয় না। গাল থেকে দিব্যর হাতটা বাচ্চার নরম হাত ছুঁলো। আদুরে গলায় বলল,
-” বাবাটা একেবারে তুলতুলে। সো কিউটেস্ট!”
নিতি হাসল। বলল,
-” ও কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ডাবল আদর পাবে।”
নিতির এহেন কথায় দিব্যর ভ্রু কুঁচকে যায়। নিতি বলতে থাকে,
-” এইযে আমি ওর ফুপি প্লাস কাকিমা। তাহলে তুমি ওর চাচ্চু প্লাস ফুপা। তাহলে ডাবল সম্পর্কের জন্য ডাবল আদর।”
ইভানের দিকে তাকিয়ে নিতি শুধোয়,
-” ঠিক বলেছি না ভাইয়া?”
ইভান বিনিময় স্মিত হাসে। দিব্য বিরক্ত চোখে নিতির দিকে চায়। বলল,
-” ফুপার থেকে চাচ্চুর সম্পর্ক আগে। এটা র’ক্তে’র তাই আমার কাছে এই পরিচয়ই আগে। আর আদরের কথা যদি বলিস? তাহলে বলব; আমার ভাইপো, আমাদের বাড়ির প্রথম সন্তান তারজন্য তো হাজারগুন আদর থাকবে।”
শিরিনকে ডেকে বলে দিব্য,
-” মাম্মা? আমি এখন আসছি। কোনো দরকার হলে ফোন দিও, ক্যামন?”
শিরিন বলল,
-” আচ্ছা।”
কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বলল,
-” ও হ্যা, একটু আগে নিতি বলছিলো বাসায় যাওয়ার কথা। নিতিকে বাসায় পৌঁছে দে। আর নৃত্য আছে ও নাকি থাকবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাক। তুই সন্ধ্যায় নিতিকে নিয়ে আসিস। মেয়েটা সেই ভোররাত থেকে এখানে। থেকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আসবে না হয়।”
দিব্য ছোট করে ‘ঠিক আছে’ বলে। নিতি বাচ্চাকে আলগোছে তনুজার ফাঁকা হাতটার উপর শুয়ে দেয়। পরপর বিদায় নিয়ে দিব্যর সাথে বেরিয়ে যায়।
শিরিনের কল আসায় ব্যালকনিতে যায়। নৃত্য কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে হাঁটছে। হাসপাতালটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। উৎসুক চোখে এক এক করে সব ঘুরে দেখছে। এদিকে এতক্ষণে ইভান একটু ফাঁকা স্পেস পেল। তনুজার পাশে গিয়ে বসে আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” তনুজা, কোনো প্রবলেম হচ্ছে?”
তনুজা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” নাহ। ঠিক আছি।”
তনুজার বুকের সাথে লেপ্টে ছোট্ট শিশুটা শান্তভাবে শুয়ে আছে। ওর নিঃশ্বাসের মৃদু স্পন্দন যেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুর। ইভান একটু ঝুঁকে তাকায় বাচ্চার দিকে, মুখে বিস্ময় আর আবেগের মিশেল। অতঃপর তনুজার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
-” মাই বিগেস্ট গিফট ইন লাইফ ইস আওয়ার বেবি। থ্যাংকিউ। থ্যাংকিউ সো মাচ তনুজা।”
তনুজা বিনিময় প্রশস্ত হাসলো। ইভান আনন্দময় প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
-” আই ফিল লাইক দ্য হ্যাপিয়েসট পার্সন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।”
তনুজা আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,
-” ইভান জানেন? ও যখন ভূমিষ্ঠের পর প্রথম কেঁদে উঠল। ওর কান্নার শব্দ আমার কানে পৌঁছাতেই মনে হলো নতুন একটা সূর্য উঠল আমার বুকে। সেই মূহূর্তে আমার আনন্দে কান্না পাচ্ছিল।”
আরো কিছু কথাবার্তা শেষে ইভান বাচ্চার মুখে কয়েকটা চুমু খায়, অতঃপর টুপ করে তনুজার কপালে চুমু আঁকে। তনুজা নাক কুঁচকে সরু চোখে চায়। ইভান মুচকি হেসে বলল,
-” প্রথমে মাই প্রিন্স কে বাই জানালাম। তারপর তার মা’কে। তার মায়ের আদরে এখন থেকে সে ভাগ বসাল।”
তনুজা হাসতে গিয়ে পেটের স্ট্রিচে টান পরে কপাল কুঁচকে নেয়। পরপর স্বাভাবিক হয়। ইভান ছেলের গাল ছুঁয়ে ‘বাই’ বলে বিদায় নেয়।
ঋতুতে শরৎকাল চলছে। তনুজাকে গতকালই বাসায় আনা হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে, নিচে লিভিংরুমে বসে নিতি-নৃত্য দুইবোন পায়েস খাচ্ছে আর গল্প করছে। নৃত্য বলল,
-“চারদিন হয়ে গেলো, বাচ্চার নাম তো ঠিক করা হয়নি এখনো।”
-“ভাইয়া বলেছে, সাতদিনে আকিকা দিয়ে নাম রাখবে।”
নৃত্য কয়েক চামুচ খেয়ে হাতের বাটিটা কিচেনে রাখতে যায়। ঠিক তখনই দিব্য নিচে আসে, ডায়নিং থেকে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে বাইট দিয়ে এগিয়ে আসে। সিঙ্গেল সোফায় বসে নিতির দিকে একপল চায়। নিতির হাতে পায়েসের বাটি আর পাশে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি গাইড। দিব্য ত্যাড়া করে বলে,
-” যেভাবে সারাক্ষণ বই নিয়ে বেড়াচ্ছিস, মনে হচ্ছে প্রথমবারেই তোর ক্যাডার হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।”
নিতি একটু বিরক্ত হয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-“হতেও তো পারে।”
দিব্য আপেলে বাইট দিতে থাকে। হঠাৎ নিতির গালে পায়েসের কিচমিচ পড়ে। নিতির একদম ভালো লাগে না। গালে পড়ার পরই ওর গা গুলিয়ে ওঠে। কোনো রকমে গলাধঃকরণ করে গা ঝাঁকি দেয়। দিব্য কপাল কুঁচকে চায়। নিতি হাতের বাটি সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রেখে সোফায় কাঁধটা এলিয়ে দেয়। দিব্য কপালে ভাঁজ ফেলে শুধোয়,
-“সামথিং হ্যাপেন্ড?”
নিতি ওড়নার আঁচল দিয়ে কপাল আর গলা মুছতে মুছতে সোজা হয়ে বসে বলল,
-” ইদানিং মাথা ঘুরছে। কেমন বমি বমি পায়। এই তো, মাত্র বমি হয়ে বন্যা বয়ে যাচ্ছিল প্রায়।”
দিব্যর কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান চোখে নিতির দিকে চেয়ে থাকে। নিতি দিব্যর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে কিছু বোঝায়। দিব্যর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফাঁকা ঢোঁক গিলে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-“রিয়েলি? তুই ঠিক বলছিস?”
নিতি সোজা হয়ে বসে বলল,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৭
-” মুখের এক্সপ্রেশন এমন করছো, মনে হচ্ছে ইন্নোসেন্ট বাচ্চা তুমি। এমন কিছু হওয়ার চান্স নেই।”
দিব্যর চোখ বিস্ময়ে ড্যাবড্যাব হয়ে যায়। গালে থাকা আপেল চিবুতে ভুলে যায়। থ মে’রে চেয়ে রয়। নিতি খিলখিলিয়ে হেসে বাম চোখটা টিপে বলল,
-“জাস্ট প্রাঙ্ক করলাম। তুমি আমার মজাকে সত্যি ধরেছো নাকি?”
দিব্য দাঁত কটমট করে মনেমনে বলে,
-” সাধে কী আর আমি একে এলার্জি বলি। এমন বিষয় নিয়েও কেউ প্রাঙ্ক করে? এই এলার্জি নিতিকে না দেখলে জানতাম না। ওহ্ গড!”