প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৪১
মুসতারিন মুসাররাত
শরৎ এর স্নিগ্ধ সকাল। আকাশ একদম নীল, মাঝে মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর মতো মেঘের দল। বাতাসে হালকা শীতল ছোঁয়া, তবে রোদটা উজ্জ্বল, কোমল আর আরামদায়ক। আমগাছের পাতার ফাঁক গলে এসে পড়ছে রোদ। সামনের আঙিনায় শিউলি ছড়িয়ে আছে। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠেছে সকালের বাতাস। এদিকে বাড়ির ভেতর একদম ভিন্ন চিত্র। রান্নাঘর থেকে আসছে চামুচ বাটির টুং টাং শব্দ। টেবিলে রাখা কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে ধীরে ধীরে, জানালার কাঁচে সেই ধোঁয়ার ছোঁয়া পড়ে হালকা আবছা ভাব তৈরি করছে। ব্রেড আর টোস্ট বিস্কুট টেবিলের উপর গুছিয়ে রেখে তনুজা পিছন ঘুরতেই ইভানের দিকে চোখ পড়ল। ইভান মাত্রই ঘুম থেকে জেগে রুম থেকে বেরিয়ে এদিকেই আসছিল। তনুজা আলতো হেসে বলল,
-” শুভ সকাল।”
ইভান দু’হাত উপরে তুলে ঘুমের রেশ কাটানোর আয়েশিভঙ্গি করে, পরপর বলে,
-” শুভ সকাল, ম্যাডাম।”
এতটুকু বলতেই হঠাৎ ঘাড়টা টনটন করে উঠল ব্যথায়। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো,
-” আহ্!”
ব্যথায় কপাল কুঁচকে নেয় ইভান। মুহূর্তেই তনুজার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
সোফায় শোয়ার কারণে ঘাড় ব্যথা হয়েছে, ইভান তা বুঝতে পারল। কিন্তু তনুজাকে আশ্বস্ত করতে ব্যথাকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল। গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলল,
-” তেমন কিছু নয়। হয়তো শোয়াটা ঠিকঠাক হয়নি, তাই..”
কথাটা বলতে বলতে ইভান একপাশে মাথা কাত করে গলা ঘোরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার মুখ কুঁচকে গেল। এই দেখে তনুজার চোখে উদ্বেগের ছাপ গাঢ় হয়। ব্যস্ত কণ্ঠে ফের শুধালো,
-” তেমন কিছু নয় মানে? ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলছেন। দেখি..দেখি কী হয়েছে?”
তনুজা দু’কদম এগোয়। ইভানের ঘাড়ে হাত রাখে। উষ্ণ হাতের স্পর্শে ইভান একটু চমকে উঠল, তবে বিরোধিতা করল না। তনুজা চিন্তিত বদনে বলল,
-” ব্যথা বেশি লাগছে?”
ইভান মুচকি হেসে বলল,
-” উম! এতক্ষণ ছিলো, তবে এখন নেই। তুমি হাত রাখার পর সব ব্যথা ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। তোমার হাতে ম্যাজিক আছে নাকি?”
নিম্নাষ্ঠে দাঁত চেপে ভ্রু নাচিয়ে শেষোক্ত প্রশ্ন করে ইভান।
তনুজা হাতটা সরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” ধ্যাত।”
তনুজার কপালে দুই আঙুল রেখে মৃদু টোকা দিয়ে ইভান বলল,
-” আমি ঠিক আছি, ম্যাডাম। চিন্তার কিছু নেই। সোফায় শোয়ার জন্য হয়তো একটু এমন হয়েছে। তবে ব্যাপার না, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।”
তনুজা বোকা বোকা চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে উঠল,
-” সোফায়? বেড ছেড়ে সোফায়! কিন্তু কেনো? বুঝলাম না তো!”
-” সেটা বুঝলে কী আর আগ বাড়িয়ে আমাকে আলাদা রাখার ফন্দি আঁটতে।”
ইভান মনেমনে বলে মুচকি হাসল। তাড়া দিয়ে মুখে বলল,
-” সেটা তোমাকে বুঝতে হবে না, মাই মিসেস। নাউ, কুইক্লি গিভ মি দা স্টিমিং কফি ইন ইয়োর হ্যান্ড। ফর মাই রিফ্রেশমেন্ট।”
ইভান সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল; তন্মধ্যে গম্ভীর কিন্তু মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
-” গুড মর্নিং, পাপা।”
ইভান মুখ তুলে তাকাল। ছেলেকে দেখে ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হয়। মুচকি হেসে বলল,
-” গুড মর্নিং, ইয়ান। ঘুম কেমন হলো?”
ইয়ান হালকা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
-” ভালো।”
এমন সময় ইয়ানের পেছন থেকে ছোট্ট একটা ঝড়ের মতো দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোফায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-” মনিন বয়ো পাপাআআ!”
গোলাপি রাতের পোশাকে জড়ানো চঞ্চল নাতাশা সোজা ইভানের কোলের উপর পড়ে। ইভান ত্রস্ত একহাতে সামলে নেয় বাচ্চা মেয়েটাকে। নাতাশা আবদার করে বসল,
-” আমি..আমি কাবো।”
কফির মগ দেখিয়ে নাতাশা বলে। ইভান হেসে বলল,
-” ছোটদের জন্য কফি নয়, ছোট্ট পাখি।”
নাতাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
-” তাহলে তকোলেট?”
-” চকলেট পাবে, তবে পরে। আগে নাস্তা করবে তারপর।”
ঠোঁট উল্টে বুঝদারের মতন ঘাড় কাত করল নাতাশা।
কিছুক্ষণ পর,
সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে আর মাঝেমাঝে কফির মগে ঠোঁট ছুঁয়াচ্ছে নিতি। ইয়ান চুপচাপ সোফায় একপাশে খেলনা গাড়িটা হাতে নিয়ে নাড়ছে। ওদিকে নাতাশা পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। ঘরময় দৌড়ঝাঁপ পারছে, থেকে থেকে চিল্লাচিল্লি তো আছেই। নৃত্য ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরোতেই নিতি হাঁক ছেড়ে ডেকে বলল,
-” নৃত্য? নাতাশা আর ইয়ানের ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দে। একটু ফ্রেশ করিয়ে দে না।”
নৃত্য ওদের দু’টোকে ডেকে বেসিনের সামনে দাঁড় করায়। পরপর দু’জনের ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দেয়। এদিকে নাতাশা ছোট হওয়ায় বেসিনের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, তাই হইহই শুরু করে দিলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-” আমি..আমি দেকতে..”
নৃত্য একহাত কোমড়ে রেখে বলল,
-” দাও, তোমার ব্রাশ আমার কাছে দাও। আমি সুন্দর করে করিয়ে দিচ্ছি।”
হাতটা তড়িৎ পিছুনে লুকিয়ে ফেলে নাতাশা। রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে কণ্ঠে ভর দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” না..আআআআ। আমি এতাই।”
নৃত্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ভেতর যায় টুল আনতে। ইয়ান ব্রাশ করতে করতে দেখে নাতাশা জিহ্ব দিয়ে ব্রাশের সাথে থাকা টুথপেস্ট চেটে চেটে খাচ্ছে। নাতাশা একটু চুপিচুপি পেস্ট খেতে থাকে। ইয়ান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখে বলল,
-” টুথপেস্ট খেতে হয় না। মাম্মা বলে ওটা খেলে অসুখ করে।”
নাতাশার কথাটা ভালো লাগল না। ও ভ্রু-ট্রু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে চাইল। এরমধ্যে নৃত্য টুল এনে নাতাশাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। নাতাশা গোলগোল চোখ করে ডান হাতটা নৃত্যের সামনে ধরে, ব্রাশটা দেখিয়ে বলে,
-” আয়ো।”
নৃত্যের কপাল কুঁচকে যায়। চেঁচিয়ে উঠল,
-” হায় আল্লাহ! টুথপেস্ট গেলো কই?”
নাতাশা উত্তর দেয় না। ইয়ান বলল,
-” ফুপ্পি ও টুথপেস্ট লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছিল।”
নৃত্যের একহাত কপালে চলে যায়। ইয়ানের দিকে গম্ভীর মুখে তাকায় নাতাশা। নৃত্য কিছু বলবে তার আগেই নাতাশা জিদ ধরে বলল,
-” আয়ো…আয়ো।”
নৃত্যের মুখ বিরক্তিতে ঠাসা। রাগে গজগজ করতে করতে ফের টুথপেস্ট লাগিয়ে দেয়। আর এবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দেয়, আর যেন না খায়। নাতাশা টুলের উপর দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে ব্রাশ করতে থাকে। আয়নার সামনে দাঁত বের করে দেখে আর কোমড় দুলায়। ইয়ান মুখ ধুতে যাবে, তখন নাতাশা চেঁচিয়ে উঠল,
-” আমি..আমি।”
অর্থাৎ, আগে ও করবে। নৃত্য বলল,
-” আচ্ছা ইয়ান বাবা একটু ওয়েট করো। আর এইযে আহ্লাদি ননি, আসুন আমি মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি।”
কিন্তু নাতাশা নাছোড়বান্দা! সে একাই মুখ ধুবে। একা একাই দুইহাতের মাঝে পানি নিয়ে খপখপ মুখে ছিটাতে থাকে। মুখে কম পানি যাচ্ছে, বেশি পানি বুকের উপর দিয়ে ভেসে পড়ছে। শেষে ফাজলামি করে হাতে পানি নিয়ে ইয়ানের দিকে ছিটিয়ে দেয়। আর একা একাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নৃত্য দুইহাত দিয়ে নাতাশাকে ধরে ঝট করে নামিয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে বলে,
-” দুষ্টুর মহারানী একটা!”
নাতাশা মুখ বাঁকিয়ে নিতির কাছে এগোয়। নৃত্য ট্যাপ ছেড়ে আদুরে গলায় বলে,
-” ইয়ান সোনা, আমি হেল্প করব?”
ইয়ান ঘাড় নাড়িয়ে জবাবে সম্মতি দেয়। ওদিকে নিতির সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট সফেদ দন্তপাটি বের করে দেখাতে থাকে নাতাশা। আবার একহাত মুখের সামনে ধরে ফুঁ দিতে থাকে। যেন ক্লোজ-আপ এর অ্যাড দিচ্ছে। নিতির ওড়নার কোণা ধরে আহ্লাদী স্বরে বলে,
-” মাম্মা পয়িসকার।”
নিতি মেয়ের দিকে তাকায়। দুইহাতে মেয়ের গাল চেপে টুপ করে চুমু খেয়ে বলে,
-” হ্যা হ্যা, খুব পরিষ্কার হয়েছে।”
হঠাৎ নাতাশার জামার দিকে নজর পড়তেই নিতি আঁতকে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! জামা তো একদম ভিজে চুপচুপ করছে। ভেজা জামা গায়ে থাকলে, ঠান্ডা বসে যাবে তো।”
নিতি মাথা তুলে নৃত্যের দিকে চেয়ে বলল,
-” নৃত্য বোন, নাতাশার ড্রেসটা চেঞ্জ করে দে তো। রুমে ব্যাগের ভেতর দ্যাখ জামা আছে। একটা তাড়াতাড়ি পড়িয়ে দে।”
নৃত্য বিরক্তিতে মুখ শুকিয়ে ফেলে। মনেমনে বলে,
-” এই তো আরেকজন! সক্কাল সক্কাল একের পর এক শুরু হয়ে গেল! এর তো মেয়ে জন্ম দিয়েই কাজ শেষ। সবকিছুতেই এর শুধু হুকুম জারি। আর মেয়েটা? সে তো একেবারেই উল্টো! ওর কোনকিছু করতে গেলেই যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে। ডানে যেতে বললে যায় বামে। উফ! আল্লাহ! পৃথিবীর সব অবিবাহিত খালাদের হয়েছে এক জ্বা’লা! বোনের বাচ্চা-কাচ্চাদের ফাই-ফরমায়েশ খাটতে খাটতে জীবন শ্যাষ।”
নৃত্য খানিক পরের দৃশ্য ঢের অনুমান করে নেয়। জামা পড়াতে গেলে, এটা নয় ওটা, ওটা নয় এটা। এই করে একগাদা জামা এলোমেলো করবে। অবশেষে নৃত্যকে সময় নিয়ে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। চোখের সামনে খানিক পরের দৃশ্য জ্বলজ্বল করে উঠতেই, নৃত্যর কেমন কান্না পায়।
সময়টা বেলা এগারোটা নাগাদ। পুকুরপাড়ে ইভান, নৃত্য আর ইয়ান,নাতাশা। ওরা উৎসুক হয়ে মাছ ধরা দেখছে। কেয়ারটেকার হাফিজের হাতে জাল। ধীরে ধীরে জালটা পুকুরের পানিতে ছড়িয়ে দেয়। ভদ্রলোকের চোখে তীব্র মনোযোগ, যেন মাছের অবস্থান ভালো করে বুঝতে চাচ্ছেন। জালটি পুকুরের শান্ত পানির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মাছেরা আটকা পরে। জাল টেনে তুলতেই কাজের মেয়েটা ত্রস্ত হাতে মাছ বাঁশের তৈরি ঝুঁড়িতে তুলতে থাকে। ছোট ঝুড়ি ভরে উঠছে, রঙিন ও তাজা মাছে। মাছগুলোর দেহে সূর্যের আলো পড়লে চকচকে হয়ে উঠছে। ইয়ান চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে দেখছে। কিন্তু নাতাশা মাছ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উচ্ছ্বাস করছে। ঝুড়ির উপর ঝুঁকে আঙুল দিয়ে ছুঁবে এমন ভাবসাব করছে। আবার পুকুরের পানি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলছে,
-” কটটো পাই..ইয়ু কটো পাই।”
ইয়ান শুধরে দিতে বলল,
-” পানি।”
নিতি মাছ ধরা দেখবে বলে পুকুরপাড়ে আসছিলো। এমন সময় পেয়ারা গাছের দিকে নজর পড়তেই থেমে যায়। একটা ডাল বাঁকিয়ে পেয়ারা ছিঁড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অল্পের জন্য নাগাল পাচ্ছিল না। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে সর্বোচ্চ উঁচু হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল নিতি। এমন সময় মাথার উপর দিয়ে একটা পুরুষালি হাত উঁচুতে ওঠে পরপর ঝট করে পেয়ারাটা ছিঁড়ে নেয়। নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে দিব্যকে দেখতে পায়। দিব্য ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
-” পেয়ারা পাড়ার জন্য হলেও তোর আরেকটু লম্বা হওয়া প্রয়োজন ছিলো।”
নিতি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” আমার হাইট স্বাভাবিকই আছে, হু। আমি মোটেই শর্ট নই।”
নিতির একহাত ধরে অন্যহাতে থাকা পেয়ারাটা ধরিয়ে দেয় দিব্য। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিতির মাথার উপর বরাবর নিজের দিকে একহাত টেনে দেখিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলে,
-” আমার কাঁধ সমান। উম! তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। আমার বউ হিসেবে তোর হাইট পার্ফেক্টই আছে।”
এই বলে বাম চোখটা টিপে শিষ বাজিয়ে গটগট পা ফেলে দিব্য এগিয়ে যেতে থাকে। নিতি ঠোঁট বাঁকিয়ে পেয়ারায় বাইট দেয়।
নাতাশা ঝুড়ি থেকে একটা পুঁটি মাছ হাতে তোলে। ফর্সা ছোট্ট কোমল দুই আঙুল দিয়ে মাছটার লেজ চেপে উল্টো দিক করে ঝুলাতে থাকে। তারপর ইয়ানের সামনে ধরে দোলাতে দোলাতে ঠোঁট গোল করে বলে,
-” ইয়ু…ইয়ু!”
নাতাশার চোখেমুখে কপট ভয়ের ছাপ। মুখাবয়ব এমন করছে যেন মাছটা দেখে ও নিজেও খুব ভ’য় পাচ্ছে। সাথে ইয়ানকে তার সঙ্গী বানানো। ইয়ান বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়। ইয়ানের গা বরাবর ছুঁইছুঁই করে খিলখিলিয়ে হেসে হাত নাড়িয়ে বলতেই থাকে,
-” ইয়ু….ইয়ু।”
এমন এটিটিউড করছে মনে হচ্ছে এই বুঝি ইয়ানের গায়ের উপর ফেলবে..ফেলবে। এই দেখে তৎক্ষণাৎ নৃত্য হইহই করে উঠল। ধ’ম’কের সুরে বলল,
-” নাতাশা? হাত থেকে নামাও ওটা! উফফ, আঁশটে ছুঁয়েছো! ইয়াক!”
নৃত্য নাকমুখ সিঁটকাতে থাকে। কিন্তু নাতাশা কি আর কথা শোনে? নাতাশা গোলগোল চোখ করে রাগি মুখবিবরে নৃত্যর দিকে চাইল। নৃত্য অতিষ্ঠ হয়ে নিতিকে ডাকল,
-” অ্যাই আপু! দ্যাখো তো তোমার মেয়ে কী করছে? ইশশ! কী ঘিনঘিনে! মাছ নাড়ছে।”
নিতি চমকে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! দ্যুতি মামণি, মাছ ধরছো? হাত গন্ধ হয়ে যাবে তো। তাড়াতাড়ি নামাও। নামাও বলছি।”
মায়ের কাছে নালিশ দেওয়ায় নাতাশা নৃত্যর উপর বেজায় চটে। নাক ফুলিয়ে, চোখ মোটা করে ঠোঁট চেপে চেয়ে রয়। এদিকে পেয়ারা চিবুতে চিবুতে নৃত্যের দিকে তাকিয়ে নিতি বলল,
-” নৃত্য, বোন আমার। নাতাশার হাতটা ভালো করে ধুয়ে দে তো। আঁশটে ছুঁয়েছে, এই হাতই আবার মুখে দিয়ে বসবে।”
নৃত্যর শুভ্র বদনখানি ঝটিকায় ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিরক্তিতে মনেমনে আওড়ায়,
-” ওহ্ গড! যেমন মেয়ে, তেমন মা। মেয়ের শুধু আকাম, আর মায়ের শুধু অর্ডার।”
পুকুরের টলটলে জলে দুপুরের টাটকা ঝলমলে রোদ খেলা করছে। হালকা বাতাস বইছে, পানির ওপর ঢেউ তুলে দিচ্ছে নরম করে। পুকুরের শান বাঁধানো সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে দিব্য। পানির ছোঁয়া ঠিক পায়ের কাছেই, কাচের মতো স্বচ্ছ পানি হালকা ঢেউ খেলছে। দিব্য উবু হয়ে এক হাতে পায়ের কাছের জিন্স ফোল্ড করছিল। এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠস্বর রিনিঝিনি ঝংকার তুলল। পাড়ে দাঁড়িয়ে নিতি বলল,
-” আমার শাওয়ার নেওয়া শেষ। এখন ওয়াশরুম ফাঁকা আছে। জলদি শাওয়ার নিয়ে নাও।”
দিব্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিতির দিকে না তাকিয়ে হাতঘড়ি খুলতে থাকে, তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে দুধাপ উপরের সিঁড়িতে রাখতে রাখতে বলল,
-” আজ পুকুরে গোসল করব। মোবাইল আর ঘড়িটা নিয়ে যা।”
নিতি শাড়ির কুঁচি একহাতে আগলে সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। দিব্যর থেকে একধাপ উপরের সিঁড়িতে পা জোড়া থামে ওর। দিব্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টিজোড়া থমকায়। নিতির পরনে নীল রঙের শাড়ি। নীল শাড়িতে যেন এক অপার্থিব আলো ছড়িয়ে পড়ছে ফর্সা গা থেকে। ভেজা চুলগুলো পিঠজুড় সুবিন্যস্ত ছড়িয়ে আছে, মাত্র গোসল করে এসেছে, শ্যাম্পুর গন্ধে বাতাসও মিষ্টি হয়ে উঠেছে। দিব্যর চোখ আটকে যায়, যেন এই মুহূর্তে বাইরে কিছুই আর দেখতে পাচ্ছে না। নিতি খানিকটা দুষ্টুমি মিশিয়ে একহাতে কানের ঝুমকাটা ছুঁয়ে নেড়ে দেয়, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। গলা খাঁকারি দিয়ে ,
-” এহেম! এহেম!”
শব্দ করে নিতি। নিতির কাজলটানা চোখে তাকাতেই দিব্যর হৃদস্পন্দন লাগামহীন ঘোড়ার গতিতে ছুটে। নিতির কাজলকালো চোখে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টি, যা দিব্যকে স্থির করে ফেলে। বাতাস একটু জোরে বয়ে যায়, নিতির চুল উড়তে থাকে। দিব্যর বুকের ভেতর কেমন একটা শিহরণ খেলে যায়। পরপর শুকনো ঢোক গিলতে থাকে। নিতি কানের ঝুমকা নেড়ে আড়চোখে চেয়ে দেখে দিব্যর মুখের এক্সপ্রেশন। নিত ধীরে ধীরে দিব্যর দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” এভাবে কী দেখছো?”
দিব্য নিজেকে তটস্থ করে ঘনঘন দু’বার পলক ফেলে। অতঃপর ফাঁকা ঢোক গিলে মুচকি হেসে ফেলল। কিন্তু চোখের গভীরে আটকে থাকা অনুভূতিগুলো তখনও নিতির দিকে ছুটে চলেছে নিঃশব্দে, নিরবধি। দিব্য জিন্সের পকেটে দুইহাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে মুখে বাঁকা হাসি টেনে বলল,
-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই..”
আলোর গতিতে নিতির মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়। নিতি মনেমনে ভেবে নেয়; দিব্য নিশ্চিত রোমান্টিক মুডে চলে গিয়েছে। এমন বলবে,
-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই হট লাগছে! বা একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে!”
নিতির এমন ভাবনায় এক বালতি ময়লা পানি ঢেলে দেয় দিব্য নিমিষেই। দিব্য বলল,
-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই মোটা লাগছে।”
কথাটা শ্রবণ হতেই তৎক্ষণাৎ নিতির মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল। কোথায় রোমান্টিক কথা আশা করেছিলো। সেখানে কীনা মোটা বলল। প্রায় মেয়েদের একটা স্বভাবজাত আছে, মোটা শব্দটা ঠিকভাবে হজম করতে পারে না। নিতির মুখ রাগে লাল হয়ে ধোঁয়া উঠার জোগাড়। নিতি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
-” তুমি একটা আস্ত অ’স’ভ্য! আমাকে মোটা লাগছে, হ্যা? আমি যথেষ্ট স্লিম, হু।”
নিতির রাগে দিব্য মজা পায়। গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। ওদিকে দিব্যর হাসিতে নিতির রাগ সপ্তম আকাশ ছুঁলো। দিব্যর বুকের উপর দুইহাত রেখে বাঁকা হেঁসে বলল,
-” আমাকে মোটা বলার শাস্তি স্বরুপ, তোমাকে তো পানিতে চুবানো উচিত। সেটা তো আর পারব না। তাই এ…টা।”
বলেই নিতি অকস্মাৎ এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলল, দিব্যর বুকে ধাক্কা দেয়। দিব্যর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। নিতির এমন সাহসের বহিঃপ্রকাশে ও হতবাক! কিন্তু দিব্যও কম যায় না। ধাক্কার চাপে টাল সামলাতে না পেরে পিছন দিকে হেলে পড়তে থাকে, ঠিক তখনই নিতির কব্জি চেপে ধরে টান মা’রে।
-” ঝপাৎ!”
শব্দ হয়। দু’জনেই জলের গভীরে তলিয়ে যায়। নিতি চট করে দিব্যর টিশার্ট আঁকড়ে ধরে। কয়েক সেকেন্ড ডুবে থাকার পর দু’জনে একসঙ্গে ভেসে ওঠে। দিব্য কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে পিছনে দিতে দিতে চোখ পাকিয়ে চায়। মাত্র গোসল করে শাড়ি-টাড়ি পরে একটু সাজগোজ করেছিল নিতি। এখনই সব ন’ষ্ট হওয়ার দরুণ নিতির সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে দিব্যর উপর বর্তায়। নিতি ঝট করে দিব্যর টিশার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” মাত্র আমি শাওয়ার নিয়েছি। কত সময় নিয়ে শাড়িটা পড়েছিলাম। জানো তুমি? দিলে তো সব ন’ষ্ট করে। তুমি তো এমনিতেই শাওয়ার নিতে। সেখানে আমাকে টানার কী দরকার ছিলো?”
নিতির রাগটাতে দিব্য মজা পেল। গা ছাড়া ভাবে বলল,
-” আরে, আরেকবার গোসল করে নিলি, ক্ষতি কী?”
কথাটা বলে চোখ টিপল দিব্য। দিব্যর কলার ধরে নিজের দিকে আরেকটু নুইয়ে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে নিতি বলল,
-” ইচ্ছে তো করছে তোমাকে?”
নিতির কথাই নিতিকে ফিরিয়ে দিতে দিব্যর ইচ্ছে করছিলো। নিতি আগে যেমন বলতো, -‘ কী চুমু-টুমু খেতে।’ তবে দিব্যর কণ্ঠনালী দিয়ে বেরুল না। দিব্য ডান ভ্রুটা নাচিয়ে ইশারায় শুধায়,
-” কী?”
নিতি কলার থেকে দুই হাত সরিয়ে নেয়। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
-” উফ্! তুমি আসলেই অসহ্য! কোনোদিন তোমার দ্বারা ভালো কিছু হলো না। ইদানিং তোমার ইনটেনশনই কেমন যেনো আমাকে জ্বা’লা’নো।”
এই বলে নিতি ভেজা শাড়ির আঁচলটা টেনে ঠিক করতে থাকে। দিব্য কপাল কুঁচকে বলল,
-” কখনো আমার না থাকার মূহুর্তে; আমার এই ছোট্ট ছোট্ট জ্বালানো গুলোই তোর বেশি স্মরণ হবে। দেখে নিস।”
নিতি মুখ ভাঙায়। মজার ছলে বলল,
-” কখনোই না। আমি আরো চিল করবো, হু।”
-” আলবাত মনে পড়বে। চোখের জল নাকের জল এক করে এভাবে বলবি..”
এতটুকু বলে দিব্য পানিতে সাঁতার দিতে দিতে সুর তুলল,
-” যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পানে চোখ রেখে, আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো।”
নিতি সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে উঠে পিছুন ফিরে চায়। রিনিঝিনি সুরে চেঁচিয়ে বলল,
-” তোমাকে মনে পড়ার প্রশ্নই আসে না। কজ তুমি তো কখনো আমাকে ভালোবাসিই বলোনি। আর যে নিতিকে ভালোবাসে না, তার কথা নিতির মনে পড়বে না, হুঁ।”
দিব্য সাঁতরে মাঝ পুকুর অবধি চলে যায়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ডাকল,
-” নিতি।”
নিতি পাড়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল চিপছিলো। টপটপ করে জলের কণা ঝরছিল আঁচল থেকে। দিব্যর ডাকে মাথা তুলে চাইল। দিব্য খোলা প্রান্তরে গলার স্বর চড়িয়ে বলল,
-” আমার উপর তোর খুব অভিযোগ, তাই না? প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে তোর কোনো অভিযোগ থাকবে না। তোর সব অভিমান হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে… দেখে নিস!”
রোদ ঝলমলে বিকেল। ওরা সবাই মিলে প্ল্যান করেছে বিকেলটা ঘুরাঘুরি করে কাটাবে। গাড়ির দরজার উপর একহাত রেখে অন্যহাতটা জিন্সের পকেটে গুঁজে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দিব্য। ইভান এগিয়ে আসতেই দিব্য বলল,
-” ব্রো, আজ আমি ড্রাইভ করি?”
ইভান প্রথমে একটু অবাক হলো। পরপর বলল,
-” শিওর! তোর ড্রাইভিং স্কিল তো আমার জানা। তবে স্পিড টা একটু কম রাখিস।”
দিব্য মাথা নেড়ে বলল,
-” আরে ধূর! সমস্যা নেই। আজ একদম স্মুথলি ড্রাইভ করবো। দেখে নিস।”
-” ইটস্ ওকে ছোটে। তবে বাচ্চারা আছে, খেয়াল রাখিস।”
এরমধ্যে নিতি মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে আসে। নাতাশার হাতে তুলতুলে সাদা রঙের ছোট্ট একটা পুতুল। দেখতে ঠিক যেন মিস্টার বিনের পুতুলটার ন্যায়। নাতাশা আদর করে টুটু বলে ডাকে। সবসময় পুতুলটা কাছে কাছে রাখে। এরমধ্যে তনুজা, ইয়ান আর নৃত্য আসে। দিব্য ইশারা করে নিতিকে ফ্রন্ট সিটে বসতে বলে। নিতি ভেংচি কেটে সামনে বসল।
অল্প স্বল্প ঘুরাঘুরি শেষে ওরা হাইওয়ের পাশে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। কিন্তু দিব্য গাড়িতেই থাকে। গাড়িতে বসে দিব্যর একহাতে কোকাকোলার ক্যান অন্যহাতে ফোন। এভাবে সময় কাটাতে থাকে।
ওদিকে ওরা হালকা নাস্তা পর্ব শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোয়। রেস্টুরেন্টের দরজা পেরিয়ে বাইরে কয়েক পা আসতেই নাতাশা হঠাৎ বলে উঠল,
-” মাম্মা! মাম্মা আমাল টুটু!”
নিতির কোলে ছিলো নাতাশা। নিতি মেয়ের হাতে পুতুল খোঁজে। কিন্তু মেয়ের হাত দু’টো ফাঁকা। অনেকক্ষণ লক্ষ্য করাও হয়নি। নিতি মেয়েকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-” কোথায় রেখেছো পুতুল? বলো?”
নাতাশা মনে করতে পারে না। অথচ কান্না জুড়ে দিলো,
-” আমাল টুটু তই?…তই?”
বলে বলে। নিতি বিরক্ত হয়ে কষিয়ে ধ’ম’ক দেয়। তনুজা বলল,
-” আহ্, নিতি। শুধু শুধু ওকে বকছো কেনো! বুঝিয়ে বলো। একটু খুঁজলে পাওয়া যাবে।”
নৃত্য কপাল কুঁচকে কিছু মনে করার ভঙিতে বলল,
-” গাড়িটা ওখানে পার্ক করার সময়ও আমি স্পষ্ট নাতাশার হাতে পুতুল দেখেছি। তারমানে এই জায়গায়তেই কোথাও আছে। অন্য কোথাও নয়।”
নাতাশা শব্দ করে কাঁদছে। তনুজা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ভেতরে রেখে আসেনি তো। হয়তো হাত থেকে নামিয়েছিলো, পরে আসার সময় মনে নেই।”
নাতাশার কান্না থামাতে ইভান কোলে নিল। বলল,
-” কাঁদে না ছোট্ট পরী। চলো ভেতরে গিয়ে খুঁজে দেখি।”
ওদেরকে দাঁড়াতে বলে ইভান ভেতরে যায় খুঁজতে। ইয়ান টিশার্টের কলার ধরে ফাঁকা করতে থাকে। পরপর তনুজার আঙুল ধরে বলল,
-” মাম্মা গরম লাগছে।”
-” ওয়েট বাবা। এইতো এক্ষুনি বাসায় যাব।”
তনুজা নিতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” নিতি, ইয়ানের গরম লাগছে। আমরা বরং গাড়িতে গেলাম। আর গিয়ে দেখি পুতুলটা গাড়িতে আছে কীনা!”
নিতি মাথা কাত করে সায় জানায়। তনুজা ছেলের হাত ধরে আসতে থাকে। হঠাৎ একপাশে থাকা রঙিন বেলুনের দিকে নজর পড়ে তনুজার। এগিয়ে গিয়ে বেলুন কিনে ইয়ানের হাতে দিয়ে বলে,
-” এগুলো থেকে নাতাশা যেটা যেটা চাইবে, সেটাই কিন্তু দিবে। নাতাশা এমনিতেই কান্না করছে, এটা পেলে যদি কান্না থামে।”
ইয়ান মাথা নাড়ায়। তনুজা পার্স খুলে টাকা দেয়। এরমধ্যে ইয়ানের হাত থেকে একটা বেলুন উড়ে যায়। ইয়ান সেটা ধরতে পিছু যায়। তনুজা পাশ ঘুরতে নিবে, তন্মধ্যে একটা অসহায় বৃদ্ধা মহিলা সাহায্য চাইতে আসে। তনুজা পার্স খুলে টাকা বের করতে থাকে। ইয়ান বেলুন ধরতে মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ ইয়ানের চোখ যায় একপাশে পড়ে থাকা নাতাশার পুতুলটার দিকে। ইয়ান আশেপাশে না তাকিয়ে পুতুলটা নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
ওদিকে নাতাশাকে কোলে নিয়ে ইভান বেরোয়। ভেতরে পাওয়া যায়নি পুতুল। ওরা আসতে থাকে। এদিকে তনুজা বৃদ্ধার দিকে টাকা বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধা নীরব স্বরে দোয়া করে চলে যেতেই তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে; ইয়ান পাশে নেই! হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে যায় তনুজার। তড়িঘড়ি উল্টোদিকে তাকাতেই দৃষ্টি জমে যায়। সেখানে যা দেখল, তাতে ওর শরীর হিম হয়ে আসে। একদিক দিয়ে বিরাট বাস গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে, আর অন্যদিক দিয়ে অশ্বারোহী শ’য়’তানের মতো তেড়ে আসছে এক প্রকাণ্ড ট্রাক। চারপাশের শব্দ যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। তনুজার পায়ের নিচের জমিন সরে যেতে থাকে, দৃষ্টির কোণ ঘোলা হয়ে আসে, সমগ্র পৃথিবী যেন দুলে উঠছে। তনুজার কণ্ঠ ফেটে বেরিয়ে আসে এক করুণ আর্তনাদ,
-” ইয়া…ন!”
তৎক্ষণাৎ তনুজা ছুটতে থাকে। গাড়ির বনেটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে দিব্য ফোন স্ক্রল করছিল। হঠাৎ তনুজার আতঙ্কিত চিৎকার কানে আসতেই চমকে উঠে সামনে তাকায়। মাঝ রাস্তায় ইয়ানকে দেখে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসে। মুহূর্তেই একলাফে নেমে দাঁড়ায় দিব্য। এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে সর্বোচ্চ বেগে দৌড়ায়।
তনুজার চিৎকার শুনে ইয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সামনে-পিছনে গাড়ি। এই দেখে ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কাঁপছে, চোখে অসহায় দিশেহারা ভ’য়। বুঝতে পারছে না কী করবে! তখন অতকিছু না খেয়াল করেই চলে আসছিল মাঝ রাস্তায়।
ইভানের দৃষ্টি আটকে যায় সেই এক দৃশ্যে; অতীতের কষ্টের স্মৃতিটা যেন ফের সামনে ফিরে এসেছে! প্রতিফলিত হতে চলেছে। লহমায় শরীর জমে যায়, একচুল নড়তেও পারছে না। চোখ বিস্ফারিত, নিঃশ্বাস ভারী। সুঠাম দেহটা কাঁপতে থাকে। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসে,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৪০
-” ইয়ান…তনুজাআআআ..”
কয়েক সেকেন্ড পরপরই নিতি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। ভেতরে জমে থাকা আ’তঙ্ক অবশেষে ফেটে পড়ে কণ্ঠে,
-” দিব্য…”