প্রণয়ের বাঁধন শেষ পর্ব
মুসতারিন মুসাররাত
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এক অনিশ্চয়তার কাহিনি। যেখানে এক সেকেন্ডে সব কিছু বদলে যেতে পারে। মানুষের জীবনে যে নিরাপত্তার অনুভূতি থাকে, তা কেবল একটি অদৃশ্য স্বপ্ন, কারণ সেকেন্ডেই সব কিছু এলোমেলো হতে পারে। এক সেকেন্ড পর কি ঘটবে? তা থাকে অজানা। আশেপাশে না তাকিয়ে তনুজা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলে। হঠাৎ শাড়ির কুচির সাথে পা আঁটকে পিচের রাস্তার সাইড বরাবর জমিনে পরে। নরম হাত দুটি পিচের ছোটছোট ইট-পাথরের উপর পড়ে রক্তাক্ত হয় মূহুর্তেই। ইয়ান মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, দিশেহারা চোখে চারপাশ দেখছে। দু’দিক থেকে ধাবমান গাড়িগুলো অসুরের মতো ধেয়ে আসছে। ইয়ান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, এক বোবা আ’ত’ঙ্ক বাচ্চাটাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
তনুজার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে ভ’য়ে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে। চোখ দুটো জলে ভরে উঠে সেকেন্ডেই। কন্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বুক ফাটলেও চিৎকার করতে পারছে না। কণ্ঠও যেন আটকে গেছে অসহায় আ’ত’ঙ্কে। চিৎকার করে ডাকতে চায়,
-” ইয়ান, এখানে আসো! এক দৌড়ে মায়ের কোলে এসো!”
কিন্তু ওর গলা চেপে ধরে রেখেছে যেন অদৃশ্য শিকল। দুই হাতের তালু পিচের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তনুজা। কিন্তু শরীরে যেন এক ফোঁটা বল নেই। নেতিয়ে পড়ছে পুরো শরীর।
ওদিকে অনুভূতির নার্ভ যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে ইভানের। ইভান ছেলে আর বউয়ের এহেন দৃশ্য দেখে বাকশুণ্য! সুঠাম দেহটা কাঁপতে থাকে। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসে,
-” ই..য়া..ন…তনুজা..আ.আ.আ..”
গোধূলির নরম আলো পড়ছে তনুজার ক্লান্ত আতংকিত মুখবিবরে। ওর দুচোখের গভীরে এক অনির্বচনীয় আ’ত’ঙ্ক। নিজের দিকে না তাকিয়ে, তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে। ভাঙা কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে ফিসফিসিয়ে ওঠে,
-” ই…য়া..ন বা..বা…”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সময় যেন থমকে যায়। অসহায়ের থেকেও অসহায় ঠেকছে সবার। এক নিঃশ্বাসে ছুটছিল দিব্য। ওর চোখ নিবদ্ধ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ইয়ানের দিকে। পিছন থেকে ধেয়ে আসা ট্রাক যেন এক বিশাল অজগরের মতো গ্রাস করতে আসছে মুহূর্তের ব্যবধানে। ঠিক তখনই এক অটোবাইক পাশ কাটানোর সময় ব্রেক করতে করতে ধাক্কা লাগে দিব্যর গায়ে। বিকট শব্দ ছিঁড়ে ফেলে মুহূর্তের নীরবতা। দিব্য ছিটকে পড়ে সামনে, কপাল ফে’টে যায়। লাল র’ক্তে’র ধারা বয়ে নামে সড়কের রুক্ষ পিচের উপর। কিন্তু ব্যথা অনুভবের সময় কোথায়? দিব্য দিগুন শক্তি নিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।ইয়ানের ভীত দৃষ্টির সামনে দিয়েই ছুটে যায়। র’ক্তা’ক্ত কপাল, ধুলো মাখা শরীর নিয়ে তবুও থামেনি দিব্যর পা। ট্রাকের গর্জন ক্রমেই নিকটতর। সময়ের সুতোর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দিব্য বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। গভীর বিশ্বাসে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়ানের দিকে, বাড়িয়ে দেয় বলিষ্ঠ হাত, আঁকড়ে ধরে ছোট্ট বাহুটি। তারপর…তারপর….সব কিছু যেন এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিতি দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। গলার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে এক আকুল আর্তনাদ,
-” দি..ব্য..ও..ও..ও…”
ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলে, যেন কিছুই দেখতে চায় না। সময়ের সীমানা ভেদ করে এক তীব্র হাহাকার ছুটে আসে বাতাসে। চারপাশ স্তব্ধ করে দিয়ে বেজে ওঠে হৃদয়ের আর্তনাদ। নিতির চিৎকার যেন ওদের সবার হৃদয়ের গভীরতম শূন্যতাকে স্পর্শ করে। আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বেদনার আবেশে। তনুজার পক্ষে এত কাছ থেকে সবটা দেখা সম্ভব হয় না, বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তখনই চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলেছিল। এক দম বন্ধ করা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ঠোঁটের ফাঁক থেকে,
-” ইয়া আল্লাহ! কেনো বারবার আমার সাথেই এমন হয়!”
নিতি দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হাঁটুদ্বয় জমিনে গিয়ে ঠেকে। চোখের বাঁধ ভেঙে এলোমেলো কান্না উপচে পড়ছে। কিন্তু গলা দিয়ে একটিও শব্দ বেরোচ্ছে না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শোক মেয়েটাকে নিঃশেষ করে ফেলছে। বারবার দুপুরে দিব্যর বলা কথাগুলো কানে বাজছে।
-” আমার উপর তোর খুব অভিযোগ, তাই না? প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে……তোর সব অভিমান হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে… দেখে নিস!”
নিতির ভেতরটা ডুকরে ওঠে। চিৎকার করে বলতে চায়,
-” আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। তুমি কেনো তোমার কথাগুলো সত্যি করতে উঠেপড়ে লাগলে! কেনো? কেনো?”
দিব্যর রাগি মুখ, দিব্যর কখনো অল্প স্বল্প হাস্যোজ্জ্বল মুখ সব যেন একসাথে নিতির চোখে ভাসছে। নিতি ফুঁপিয়ে ওঠে; ঠিক তক্ষুনি কাঁধে উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভূত হয়। নৃত্য পাশে বসে চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে দৃঢ়ভাবে কাঁধে হাত রাখে। ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,
-” আপু, অ্যাই আপু?”
নিতির ফুঁপিয়ে ওঠা বাঁধনহারা হয়। নৃত্য ফের বলল,
-” আপু দ্যাখো..দ্যাখো একবার…”
নিতির বুকের গভীরে সাহসের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, তবু নৃত্যের দৃঢ় আহ্বানে ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্য ধরা পড়ে। সড়কের ধুলো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। সময়ের প্রবাহে সবকিছুই যেন আবছা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধূলোর ওপারেই দেখা যায়….দিব্য ইয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।
নিতির কাছে সবটা যেন স্বপ্নের মতো ঠেকে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে ওর হৃদয়। অপরদিকে, তনুজার চোখ দুটো বিস্ময় আর বেদনার এক অপূর্ব মিশ্রণে চকচক করছে, সেখানে জমাট বাঁধা এক গল্প আছে; ভাঙার, গড়ার, আবার নতুন করে জোড়া লাগার।
অপর দিক থেকে আসা বাস ঠিক সময়মতো ব্রেক কষে। কিন্তু বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসা ট্রাক থামে না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বড় অংশের জন্য দায়ী থাকে ট্রাক। পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে উঠে গিয়ে কেড়ে নিয়েছে নিরীহ মানুষসহ পথচারীর প্রাণ।
এই তো কিছুদিন আগে রাস্তার পাশের হোটেলে ঢুকে পরে ট্রাক। ঘটনাস্থলেই নি’হ:ত হয় বেশ কয়েকজন। উফ্! আর এটা তো ছিল হাইওয়ে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় ঘটল এক অলৌকিক মুহূর্ত। শেষ মুহূর্তে ইয়ানের বাহু ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে নিল দিব্য। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই, হয়তো দু’জনেই পিষ্ট হয়ে যেত ট্রাকের নীচে…
ইয়ান থরথরিয়ে কাঁপছে। দিব্যর কপাল বেয়ে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়েছে। তনুজা আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। দিব্য ততক্ষণে ইয়ানের ছোট্ট মুখটা নিজের হাতের তালুর মাঝে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ভ’য় নেই বাবা। মাম্মার কাছে যাও।”
তনুজা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে দিব্যর দিকে তাকায়। মুখে কিছু বলা হয়ে ওঠে না, কিন্তু চোখে ছিল এক সমুদ্দুর গভীর কৃতজ্ঞতা। দু’জনের মধ্যে আগের সেই জড়তা না থাকলেও কথাবার্তা খুব বেশি হয় না। ইয়ান মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তনুজা ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর চোখ বেয়ে নীরবে ঝরতে থাকে অশ্রুধারা।
কখনো প্রকৃতি নির্মমভাবে রিভেঞ্জ নেয়, আবার কখনো সে-ই দিয়ে যায় অপার ভালোবাসা আর প্রতিদান। দিব্যকে বাঁচাতে গিয়ে ইভানের মা প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর আজ সেই দিব্য নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ইভানের ছেলেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যদিও জীবন-মৃ’ত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে, তবু এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। ইভান ছুটে এসে দিব্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চোখে অশ্রু, গলায় অস্ফুট ধ্বনি,
-” দিব্য, দিব্য..তুই ঠিক আছিস তো?”
দিব্য র’ক্তা’ক্ত কপালে মৃদু হাসির ছোঁয়া এনে বলে,
-” আ’ম ওকে।”
ইভান পকেট থেকে রুমাল বের করে দিব্যর কপালে চেপে ধরে, কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে,
-” ব্লিডিং হচ্ছে, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চল। ব্যান্ডেজ করাতে হবে।”
দিব্য মাথা নেড়ে বলে,
-” এতটুকু কিছু না। বরং বাসায় চল, ইয়ান খুব ভ’য় পেয়েছে।”
কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল নিতি। বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। অভিমানের ভারে পা এগোতে পারছে না। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে দিব্যর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলতে। কিন্তু আজ আর নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না নিতি।
নৃত্যর কোলে নাতাশা, ছোট্ট মেয়েটি দিব্যর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
-” পাপা! পাপা, তুমি লক্ত! ইশশ…ব্যথা?”
দিব্য এক ঝলক আড়চোখে অভিমানী নিতির দিকে তাকায়। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খায়। সস্নেহে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ব্যথা নেই, আমার রাজকন্যা। আমি একদম ঠিক আছি।”
সবার আগে কাছের এক ক্লিনিকে নিয়ে দিব্যর কপালে ব্যান্ডেজ করানো হয়। ডাক্তার প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। অতঃপর সবাই ফিরছিল বাসায়। গাড়ির ভেতর কেউ কেউ তখনও সেই ভয়াবহ মুহূর্ত নিয়ে কথা বলছিল। এমন সময় দিব্যর কোলের উপর চুপচাপ বসে থাকা নাতাশা ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলে উঠল,
-” আমাল পাপা থুপার হিয়ো!”
এক মুহূর্তের জন্য গাড়ির ভেতর ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের উষ্ণতা। নাতাশার মিষ্টি আধো বুলিতে সবাই হেসে উঠল। দিব্য স্মিত হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ছে রাত। তবু সবার মনে এখনো সেই ভ’য়া’বহ মুহূর্তের ছায়া। একসঙ্গে বসে কথাবার্তা বলার মাঝেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে বিকেলের ভয়াবহ দৃশ্য! ফিরেই ইভান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে; সকাল হতেই ফিরে যাবে। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব নয়। ঘুরতে এসে কী যে হতে যাচ্ছিল! দিব্য অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু ইভান অনড়। চোখের সামনে এখনো স্পষ্ট ভেসে উঠছে সেই ঘটনাগুলো, ভাবলেই শরীর শিউরে উঠছে।
ঘড়ির কাঁ’টা রাত এগারোটা ছুঁয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার শেষ হয়েছে।
নিতি সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, কথোপকথনে অংশও নিচ্ছে। কিন্তু দিব্যর দিকে তাকাচ্ছে না। একটিও শব্দ বলেনি। দিব্য ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকতেই দৃষ্টি চলে যায় বিছানার দিকে। নিতি হাতের উপর থেকে নাতাশার মাথাটা আলতো করে বালিশে শুইয়ে দিচ্ছে। দিব্য কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। নিতি ধীরেসুস্থে উঠে, দিব্যর দিকে না তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়। দিব্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে নিতির দিকে। অভিমানী নিতিকে দেখে কিছুটা বিরক্তিও লাগে। নিতি ঠিক দিব্যর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়, কিন্তু দিব্য হঠাৎই নিতির হাত চেপে ধরে।
নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দিব্যও ওর দিকে মুখ ফেরায়। চোখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে একপলক দেখেই জিজ্ঞাসা করে,
-” কথা বলছিস না কেন?”
নিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” আমার কথা বলা বা না বলায় তোমার কিছু আসে-যায়?”
দিব্যর ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি খেলল। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,
-” তোর কী মনে হয়?”
নিতি একদম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” আমি তোমার কেউ নই। তাই তোমার কিছুই যায় আসে না।”
দিব্যর চোখে এক মুহূর্তের জন্য যেন ব্যথা ঝলকে উঠল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে সেই অনুভূতিটা সরিয়ে দিল। নিতির হাতটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে এক আঙুল নাকের ডগায় ঘষল। বলল,
-” তুই আমার কেউ নস? তাহলে আমার মেয়ের মা কে? আই মিন, আমার বউ ক_”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নিতি তীব্র গলায় বলে উঠল,
-” মেয়ের মা তো তোমার চাহিদা থেকে হয়েছি। নট তোমার ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়ায়।”
দিব্যর র/ক্ত যেন মুহূর্তেই টগবগ করে ফুটতে লাগল। চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠল রাগে। শক্ত হাতে নিতির দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিয়ে চিৎকার করে বলল,
-” স্টপ, নিতি.. স্টপ। আর একটাও শব্দ নয়।”
দিব্যর রাগে, চিৎকারে নিতি এতটুকু ভ’য় আজ আর পায়নি। বরং মেয়েটার কণ্ঠে জমে থাকা অভিযোগ গুলো একসঙ্গে উগড়ে এল,
-” একদম চিৎকার করো না! ভালোবাসো তুমি আমায়? থাক, সেটা বাদ দাও।”
এক মুহূর্ত থামল, তারপর আঙুল তুলে মেয়ের দিকে ইশারা করে বলল,
-” মেয়েকে ভালোবাসো? আমার তো তা মনে হয় না! যদি ভালোবাসতে, তাহলে সেই মুহূর্তে একবারও কি ওর কথা মনে পড়ত না? যদি তোমার কিছু হয়ে যেত…”
কথাটা শেষ না করেই নিতির গলা কেঁপে উঠল। চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। তবুও নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা চালায়। দিব্য দাঁত কটমট করে বলল,
-” কী বলতে চাইছিস তুই?”
-” কিছুই না। বাদ দাও।”
-” নিতি, আমি জানি তুই আমাকে খুব বেশিই ভালোবাসিস। আমাকে হারানোর ভয়ে তোর মাথা খারাপ হয়েছে , তাই এমন বলছিস। আজ যদি ইয়ানের জায়গায় নাতাশা থাকত। তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি আমি যেটা করেছি ইভান তাইই করত। আমার যদিও মনে নেই মাম্মা আর দিদুনও বলে; আমার বড়মা আমাকে সেভ করতে গিয়ে প্রাণ হারায়।”
-” আজ বুঝি তারই প্রতিদান দিতে যাচ্ছিলে। আর..আর দুপুরে বলা সব কথা সত্যি করতে যাচ্ছিলে। এই তোমার প্রমিজ ছিলো, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আমার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া।”
দিব্যর রাগ তরতরিয়ে বাড়ল। এক ঝটকায় নিতির কাধ ছেড়ে দেয়। রাগের বশে সেন্টার টেবিলে লাথি মা°রে। টেবিলটা কেঁপে উঠল। উপরে থাকা কাঁচের গ্লাস গড়িয়ে মেঝে নামল। কাঁচ ভাঙার শব্দে নিতি কেঁপে উঠল। ঘুমন্ত নাতাশাও কিছুটা নড়েচড়ে উঠল। দিব্য রাগ দমাতে না পেরে ফের টেবিলে লাথি মা”রার প্রস্তুতি নিল; তবে চোখ পড়ল মেয়ের দিকে। নাতাশার শান্ত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে, এই চিন্তা মাত্র এক নিমেষে দিব্যকে থামিয়ে দিল। পা থেমে গেল। দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে দিব্য। নিতি কথা না বলে পা বাড়ায়। দু’পা ফেলতেই মৃদু আর্তনাদে বেরোয় নিতির ঠোঁটের ফাঁক গলে,
-” আহ্।”
দিব্য তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে দেখে, নিতির পায়ে কাঁচের টুকরো বিঁধে গেছে। সাদা টাইলসে ছড়িয়ে পড়ছে র°ক্তে°র লাল ফোঁটা। এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে, দ্রুত নিতির সামনে বসে। এক মুহূর্তের জন্য নিতির মুখে চোখ রেখেই, তারপর চুপচাপ মেয়েটার ফর্সা পায়ের দিকে নজর দিল। কোনো কথা না বলে, নিঃশব্দে নিতির পা তুলে নিজের হাঁটুর উপর রাখল। একটানে কাঁচের টুকরোটা বের করে দিল। ব্যথায় নিতির চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। নিতির দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দিব্য বলল,
-” মাথার সাথে সাথে তোর চোখটাও দেখছি যাচ্ছে। কোন দিকে তাকিয়ে চলিস, হ্যা।”
নিতি কিছু বলে না। তবে অভিমানের বরফ যেন গলতে থাকে। মেয়েটার চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে। নিতি রাগের বশে কথাগুলো বলে ফেলেছে, তবে অতটাও সেলফিশ নয়। নিতির ইচ্ছে করছে ওভাবে বলার জন্য দিব্যকে স্যরি বলতে। নিতি কিছু বলবে সেই সময় দিব্য আদেশের সুরে বলল,
-” বেডে বস।”
নিতি ঠোঁট উল্টে খুঁড়িয়ে বেডে গিয়ে বসে। দিব্য ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে। প্রথমে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে, তারপর মনোযোগী আলতো হাতের ছোঁয়ায় অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয়। নিতির চোখে, দিব্যর যত্নের প্রতিটি মুহূর্ত স্বর্গীয় সুখানুভূতি দেয়। নিতি আবেগপ্রবণ হয়ে নির্নিমেষ দিব্যর দিকে চেয়ে রয়।
রাত গভীর। আকাশজুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ ঠিক যেন রুপোর থালার মতো ঝলমল করছে। ছাদের চারপাশে সারি সারি বড়বড় ক্যান্ডেল জ্বলছে। আলো-আঁধারির মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে হালকা দুলে উঠছে শিখাগুলো। ধীরপায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজার এপাশে এসে দাঁড়ায় নিতি। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নিতি। হঠাৎ ফোনে কল আসে। ঠান্ডা স্বর,
-” কাম টু দ্য রুফ ইন ফাইভ মিনিটস। দেয়ার্’স আ সারপ্রাইজ। কাম সুন।”
ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই দিব্য কল কা’টে। এখন এখানে এসে নিতির বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। চেয়ারে বসে দিব্য। পরনে নীল রঙের জিন্স আর সাদা শার্ট। চোখদুটো বুজে গিটারে আঙুল চালাচ্ছে। শার্টের উপরের তিনটি বোতাম খোলা, কপালে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। রাতে ক্যান্ডেলের মৃদু আলোয় দিব্যর মুখের ছায়া আর আলো এক অভিনব রূপে মিলেমিশে গেছে। গিটারের টুংটাং শব্দগুলো বাতাসে মিশে স্নিগ্ধ, সফট রোমান্টিক সুরে রূপান্তরিত হচ্ছে। নিতি যেন কোথায় হারিয়ে যায়। পরপর নিজেকে ধাতস্থ করে এগোয়। একপাশে টেবিল, উপরে কিছু রাখা। এত সব আয়োজন দেখে নিতি আর বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। প্রশ্ন করে উঠল,
-” হঠাৎ, এসব কিছু! কিন্তু কেনো?”
দিব্যর আঙুল থেমে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে ধীরসুস্থে গিটারটা চেয়ারে রাখে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একপল নিতির দিকে তাকায় পরপর দৃষ্টি সরিয়ে জ্ব’লন্ত ক্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোকে বলেছিলাম না আজকের পর তোর অভিযোগ আর রাখব না। তারজন্য এসবের আয়োজন।”
নিতি নির্বোধের মতোন চাইল। বলল,
-” মানে?”
দিব্য উত্তর দেয় না। নিতি ফের বলল,
-” এসব কিছু কখন আনলে? আর কেনই বা? আই ডো’ন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।”
-” নো প্রোবলেম, আই’ল এক্সপ্লেইন। বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার আগে হাফিজ সাহেবকে বলে রেখেছিলাম।”
-” হুয়াই?”
দিব্য জ্ব’লন্ত ক্যান্ডেলের শিখায় আঙুল এগিয়ে দেয়। বলে,
-” তোর বড্ড অভিমান, অভিযোগ আমাকে নিয়ে। চাইছিলাম না তোর অভিযোগটা রাখতে, আর না তো বাড়তে দিতে।”
এই বলে দুই আঙুল জ্ব’লন্ত শিখার দু’পাশ দিয়ে চেপে ধরার মত ধরে। দপ করে ক্যান্ডেল নিভে যায়। দু’পা এগিয়ে ফের জ্ব’লন্ত শিখায় দুই আঙুল এক করে ছোঁয়ায়। নিতির বুকটা কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ দিব্যর হাতের উপর হাত রাখে। চোখে ছলছল জল নিয়ে ইশারায় বারণ করে। ভেজা গলায় বলল,
-” স্টপ। স্টপ দিস।”
দিব্যর চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। নিতির চোখের দিকে কিছুপল চেয়ে থাকে। পরপর নিজের হাত ছড়িয়ে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াল। দু’হাত ছড়িয়ে দিলো দু’পাশে। আকাশের দিকে মুখ তুলে পরপর চোখ বুজল। তারপর এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে বলল,
-” আন্ডার দিস ওপেন স্কাই, উইদ দ্য ফ্রি এয়ার অ্যাজ আ উইটনেস, আই সে; ও ওপেন স্কাই অব দ্য নাইট, ও ফ্রি এয়ার, অ্যান্ড দ্য নকটার্নাল ক্রিয়েচার্স। লিসেন! লিসেন….আই লাভ মাই ওয়াইফ সো মাচ! আই লাভ দ্য মাদার অব মাই চিলড্রেন! আই লাভ হার আ লট, আ লট, আ লট!”
দিব্যর কণ্ঠ যেন আকাশকেও স্পর্শ করল। নিস্তব্ধ চারিপাশে শব্দগুলো প্রতিধ্বনি তুলল। ধীরে ধীরে তা বাতাসে মিশে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করল। ঠিক তখনই নিতি পিছন থেকে দিব্যকে জড়িয়ে ধরল। গাল ঠেকল দিব্যর পিঠে। মৃদু কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” লাভিউ টু।”
দিব্য নিতির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। নিতির একটি হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে সেই হাতটি স্বীয় বুকের বাম পাশে রাখে। তারপর, নিতির চোখে চোখ রেখে, এক একটি শব্দ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে,
-” তুই আমার হৃদয়ের সবচেয়ে নরম এক কোণ। তোর ভালোবাসাই আমার অস্তিত্বের কারণ।”
নিতির অনুভূতি যেন মুহূর্তে এক বিস্ময়কর নিরবতার মধ্যে ঢেকে যায়। মন এক টুকরো অমলিন শান্তি ও গভীর ভালোবাসায় ভরে ওঠে। দিব্যের মৃদু স্পর্শ, গা ঘেঁষে থাকা হাত, এবং সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত কোমল কথা, সব কিছু মিলিয়ে নিতির মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হয়। চোখে আলো জ্বলতে থাকে, একটি অবর্ণনীয় সুখের আভা ছড়ায়। নিতি ঝট করে দিব্যর বুকে মাথা রাখে। দিব্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিতিকে। দিব্যর পিছনের শার্ট শক্ত করে পুরে বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ওঠে নিতি। কিছুপল নীরবতা চলে। নীরবতা ভেঙে নিতির মুখটা তুলে ধরে, আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণের পানি ফেলে দেয় দিব্য। নিতি ফুঁপিয়ে বলে ওঠে,
-” স্যরি! আমি তখন ওভাবে বলতে চাইনি। আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই।”
দিব্য মুচকি হেসে নিতির নাকের ডগায় টোকা দিয়ে বলল,
-” নো এক্সপ্লেইন। আই নো। কজ তুই তো একটা পা’গ’লি।”
নিতি হেসে ফেলে। দিব্যর বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,
-” হ্যাঁ, তোমায় ভালোবেসে হয়েছি।”
-” রাইট।”
সাদা টেবিলের উপর রাখা লাভ শেপ কেকটি একটি স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে। কেকটির উপরে গোলাপী ও সাদা আইসিং দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। মাঝখানে উজ্জ্বল স্টাইলে লেখা “Niti, I Love You” মিষ্টি অনুভূতির প্রতীক। কেকের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলো সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দু’জনে একসাথে নাইফ ধরে কেকটি কে’টে, একে অপরকে খাইয়ে দেয়। পরপর টিস্যু দিয়ে হাত আর মুখ মুছে নেয় দিব্য। তারপর, একপাশ থেকে হাতে তুলে নেয় লাল গোলাপের তোড়া। নিতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” তুই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর দামী উপহার। তুই ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।”
নিতি হাসিমুখে হাতে নিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নেয়। দিব্য শীতল কণ্ঠে বলল,
-” আমাদের প্রণয়ের বাঁধন এইভাবেই অটুট থাকুক। আই ওয়ান্ট, এই ভালোবাসা চিরকাল অমলিন আর অবিনশ্বর হোক।”
কথাটা কানে সুরের ন্যায় রিনিঝিনি বাজে নিতির। কয়েক সেকেন্ড পর, কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শুন্যে আবিষ্কার করে নিতি। দিব্য এক ঝটকায় নিতিকে কোলে তুলে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,
-” প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। কালকে রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। এদিকে রাত শেষ হয়ে আসছে। আই নিড রেস্ট।”
নিতি হইহই করে উঠল,
-” আরে..আরে..নামাও। তুমি এমনিতেই অসুস্থ। নামাও আমি হেঁটে যেতে পারব।”
-” দিব্য থাকতে ওর বউ পায়ে ব্যথা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামবে! নো নেভার।”
-” আমার পায়ে সামান্য, এটা কিছুই না। বরং তোমার কপ__।”
-” হুঁশ।”
দিব্য থামিয়ে দেয়। বলে,
-” তোকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি, এর বিনিময় রিটার্ন গিফট পেলে আমি হ্যাপি।”
-” রিটার্ন গিফট! কী?”
দিব্য মাথাটা কিঞ্চিৎ নিতির দিকে ঝুঁকিয়ে একদম স্লো ভয়েজে কিছু বলে। নিতির গাল দুটো রেইনবোর সাত রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দিব্যর বুকে মুখ লুকায়।
সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা মির্জা বাড়িতে চলে আসে। নিতি আর দিব্য ইভানকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, তবে ইভান থাকার পক্ষে ছিল না। অন্যদিকে, নুরজাহান খবর পেয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ফোনে বলেন,” বাড়ির ছেলে-মেয়ে বাড়িতেই থাকুক, এত বড় একটা বিপদ কে’টে গেল!” এমনিতেই নুরজাহান কখনোই জন্মদিন পালন পছন্দ করেন না। তারপর কালকের ঘটনা শুনে ওদেরকে বাড়িতে ফেরার আদেশ করেন। মির্জা বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা ঘরোয়া পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হয়। শিরিনও আর ইভানকে ফোনে চাপ দেয়নি, বরং মনের মধ্যে পরিকল্পনা করেছেন, “বাড়িতে আসুক, এখানেই সবকিছু হোক।”
সময়টা সন্ধ্যার পরে, তনুজা রুমে রেডি হচ্ছে। সাজগোজ প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় ইভান রুমে প্রবেশ করে শুধাল,
-” তনুজা!”
-” হুঁ।”
-” আমার ফোনটা দেখেছো? মনে পড়ছে না কোথায় রেখেছি।”
তনুজা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজে। চোখে পড়ে ওয়ারড্রোবের ওপর ফোনটা রাখা। ফোন হাতে নিয়ে, মিষ্টি হেসে তনুজা বলে,
-” এই তো, এখানে।”
হালকা সাজগোজে তনুজাকে অপ্রতিরোধ্য সুন্দর লাগছে। ইভান শুকনো ঢোক গিলে নেয়। ফোনটি হাতে নিয়ে, মৃদু হেসে বলে,
-” থ্যাংকস, ম্যাডাম।”
তনুজা বিনিময়ে স্নিগ্ধ হাসে। ইভান ফোনটা পকেটে গুঁজে, এক হাত তনুজার কোমড়ে রেখে কাছে টেনে বলে,
-” এই তুমি আজকে কী আমার মাথা ন’ষ্ট করার প্লান করেছো! তোমার কাজলকালো চোখে আমি হারিয়ে যাচ্ছি, তারপর তোমার মুখের স্নিগ্ধ হাসি। আমি তো ক্ষণেক্ষণে ঘা’য়ে’ল হচ্ছি।”
তনুজা দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আরে, ছাড়ুন তো! দরজা খোলা, বাচ্চারা চলে আসবে কেউ।”
ইভান তড়িঘড়ি বাম চোখ টিপল,
-” তাহলে লকড করে আসি!”
তনুজা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
-” ধ্যাত!”
ইভান মৃদু হেসে বলে,
-” কপট রাগটাও ঠিকঠাক করতে পারো না।”
এমন সময়, ইয়ানের মিষ্টি কণ্ঠ শোনা গেল,
-” পাপা!”
ইভান তনুজাকে ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। তনুজা চোখ দিয়ে ইভানকে শাসায়, যেন আরেকটু হলেই লজ্জায় পড়তে হতো। ইভান মাথা চুলকিয়ে, ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” হ্যা, বাবা?”
ইয়ান এগিয়ে এসে বলল,
-” দাদুভাই ডাকছে তোমাকে।”
ইভান ছেলের হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে, পরপর দরজার কাছে ফিরে তাকিয়ে বলে,
-” নিচে অপেক্ষা করছি, দ্রুত এসো।”
মাথা নেড়ে ‘ঠিক আছে’ বোঝায় তনুজা।
চারপাশে বিভিন্ন রঙের বেলুন সাজানো। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা বেলুন নিয়ে ইয়ান আর নাতাশা খেলছে। বাড়িতে আজ মানুষে ভরপুর। শাহারিয়ার মির্জা, নেওয়াজ করীম খোশ গল্প করছেন। নিকট কয়েকজন আত্মীয় স্বজন। শিরিন তাদের সাথে কথা বলছে। তনুজার দাদি এসেছেন। ছেলে গত হয়েছেন পাঁচ বছর খানেক আগেই। ইভানসহ বাড়ির সবাই খাতির যত্ন করছে।
ইয়ান নেভি ব্লু শার্টের উপরে কালো কটি আর অফ হোয়াইট প্যান্টে সজ্জিত। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা, সিল্কি চুল কপালের উপর পরে আছে। মুখে মিষ্টি হাসি। বাচ্চা ছেলেটিকে আজ যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে। নাতাশাকে পিংক কালারের বার্বি ড্রেসে পরিপূর্ণ পরীর মতো লাগছে। নরম মুখাবয়ব যেন এক আদুরে ঝলমলে আভা ছড়াচ্ছে।
নৃত্য এদের দু’জনকে ডেকে বলল,
-” এইযে সোনারা, জলদি আসো। এখন কেক কা’টা হবে।”
বড় কেকটি অর্ডার করা হয়েছে। তবে প্রথমে নিতির হাতে বানানো কেকটা কা”টা হবে। নিতি ভালোবেসে তৈরি করেছে। তনুজা বলেছে প্রথমে নিতির বানানো কেক কাঁ’টা হোক।
ইয়ান আর নাতাশা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, ওদের বাবা-মা পিছনে দাঁড়িয়ে। নৃত্য ইয়ানের হাতে ছু/রি দেয়। ইয়ান কেক কা’টতে প্রস্তুত, হঠাৎ নাতাশা চিল্লিয়ে উঠল,
-” আমি… আমি…”
ইভান আলতো হেসে দু’জনের হাতটা একসাথে করে ছু”রি ধরিয়ে বলল,
-” একসাথে কা”টো কেমন!”
দু’জনেই ঘাড় কাত করে। নাতাশা মুখেও বলে,
-” আততা।”
কেক কাঁ’টা শেষে ইভান-তনুজা একসাথে ইয়ান আর নাতাশাকে কেক খাইয়ে দেয়। তারপর দিব্য-নিতি। নৃত্য এসকল দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করতে থাকে। এরমধ্যে নৃত্য বলল,
-” ইয়ান বাবা নাতাশাকে খাইয়ে দাও তো। একটা ছবি তুলে রাখি।”
ইয়ান বাধ্য ছেলের মত তাই করল। হঠাৎ করেই নাতাশা আঙুলে কেক জড়িয়ে ইয়ানের গালে ছুঁইয়ে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ইয়ানের মুখটা একদম গম্ভীর হয়ে গেল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়। নিতি টিস্যু দিয়ে ইয়ানের গাল মুছতে লাগল। নুরজাহান হঠাৎ মশকরা করে বললেন,
-” অ্যাই নিতি! তোর মেয়ে তো একদম দুষ্টু। এত রাগি, জিদি, দুষ্টু মেয়ে বিয়ে দিলে; তারা এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকাবে আর অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেবে তো?”
নিতি হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,
-” সে কারণেই তো আমি আগে থেকেই জামাই ঠিক করে রেখেছি। জামাই খুবই ধৈর্যশীল। মেয়ের শাশুড়ি নরম মনের, শ্বশুর কম বাবা হবে। তাই মেয়ে নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।”
উপস্থিত সবাই নিতির কথা না বুঝলেও তনুজাসহ বেশ কয়েকজন বুঝে নেয়। তনুজা মিটমিট করে হাসতে থাকে।
আজকের এই মুহূর্তটাকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে ফ্যামিলি ফটো তোলে। কয়েকটা ছবি তোলার পর নৃত্য বলল,
-“এবার মুরব্বি পার্টি বাদ। আমরা ছোটরা একটা সেলফি তুলি।”
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৪১
ইয়ান এবং নাতাশা সামনে দাঁড়িয়ে, পাশে হাটু ভেঙে বসে নৃত্য। পিছনে তনুজা-নিতি দাঁড়িয়ে, ওদের পাশে বররা। তনুজার একটা হাত ইভানের হাতের মুঠোয়। ওদিকে দিব্যর আঙুলের ভাঁজে নিতির আঙুল। এক মুহূর্তে, যেন সময়টাও থেমে গেল! সুন্দর একটি বাঁধনে এই ছোট ছোট সম্পর্কগুলো মিলে এক দারুণ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল।