প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৪

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৪
আদ্রিতা নিশি

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা,মেঘাচ্ছন্ন আকাশ,দমকা হাওয়ায় শহুরে পরিবেশ আজ মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে।প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে।ভেপসা পরা গরম থেকে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধরনীতে অনেক আগেই।শহুরে মানুষগুলো ব্যস্ততা কমিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছে।আকাশে মাঝে মাঝে বজ্রপাতের আওয়াজ আর বজ্ররশ্নির দেখা মিলছে।

চারদিকে মন মাতানো পরিবেশ থাকলেও একজনের মনে আজ মেঘ জমেছে। মন খা/রাপ আজ প্রিয় সঙ্গী হয়েছে তার। অরিত্রিকা উদাস মনে ছাঁদের রেলিঙ ঘেষে অদূরে দৃশ্যমান দমকা হওয়ায় নাচনরত গাছপালার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাচ্ছে সে। তবুও জেনো সেদিকে খেয়াল নেই। প্রতিনিয়ত তার কানে যেনো একই কথা বেজে যাচ্ছে “সারহানের বিয়ে ইফা আপুর সাথে।”ভাবতেই চক্ষুদ্বয় হতে উপচে পরছে অশ্রু। বৃষ্টির পানি আর অশ্রু মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বক্ষে যেনো চিনচিন করে ব্য/থা অনুভুত হচ্ছে।শ্বাস আঁটকে আসছে কেন যেনো! দিশেহারা লাগছে। এমনটা কেনো হচ্ছে তার। আগে তো কখনো এমন কিছু অনুভুত হয়নি তবে আজ কেনো হচ্ছে? সারহান ভাইয়ের যেখানে বিয়ে হোক, যার সাথে বিয়ে হোক তার কিছু যায় আসে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু মন কেনো মানতে চাইছে না?!অনুভূতিরাও তার সাথে যেনো ছলনা করছে।এতোটা অসহায়, হতাশা,ক/ষ্টতে সে কখনো পরেনি।এই প্রথম যেনো কোনো সমুদ্রের অতলে দিশা হারিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে।সারহানকে তো কখনো আগে অন্য কোনো নজরে দেখেনি। সারহান তার থেকে অনেকটা বড় হওয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।অরিত্রিকা সারহানকে সম্মান করলেও শ/ত্রুর নজরে দেখে কারণটা সারহান প্রায়ই তাকে অপ/মান করে।তবে কিছুদিন যাবৎ নিজের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। কিছুটা হলেও সারহানের প্রতি তার ভালোলাগা কাজ করে এখন। তবে সে প্রকাশ করেনি। মনের গহীনে চেপে রেখেছে। সে চাইনি মনের এই অব্যক্ত প্রণয়াসুখের কথা কেউ জানুক। সে জানে সারহান তাকে কখনো তাকে অন্য চোখে দেখেনা।সারহান তো তার দিক থেকে পারিবারিক ভাবে সম্পর্ক মেনে চলেছে। এই কারণে তার সুপ্ত অনুভূতিকে দমিয়ে রেখেছে।ভালোলাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছে। ঝড়ো হাওয়াতে চারিদিক উত্তাল। অরিত্রিকার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। হীম শীতল বাতাস যেনো ছুঁয়ে যাচ্ছে অরিত্রিকার শরীর। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে চক্ষুদ্বয় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পা দুটোও নিশ্চল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে রাতের আধার নামছে ধরনীতে। প্রকৃতিকে আঁধারে গ্রাস করছে।

অরিত্রিকার শরীর কেমন টলছে। মাথা ঘুরে চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। সে রেলিঙের কাছ হতে পিছিয়ে আসতে নিলেই পরে যেতে লাগলো তখনি কেউ একজন অরিত্রিকার হাত ধরে টান দিলো। অরিত্রিকা শরীরের ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে সেই ব্যক্তিটির শক্ত-পক্ত পুরুষালী বক্ষে আছড়ে পরলো। দুহাত দ্বারা ব্যক্তিটির শার্ট খামচে ধরলো নিজেকে বাঁচাতে। অরিত্রিকা মাথা ঝিমঝিম করতে করছে। চোখে অন্ধকার দেখছে সে।কিছুটা শান্ত হয়ে চুপ করে থাকলো সে বক্ষে।ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে পরিচিত পারফিউমের গন্ধ পেতেই অরিত্রিকা বিচলিত হলো।এই ঘ্রাণ যেনো তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হতে লাগলো।সে বক্ষ হতে মাথা উঁচিয়ে চকিত নয়নে তাকালো ব্যক্তিটির পাণে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শ্যাম মানব টির মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালে। অগ্নি ঝরা চাহনি যেনো ছোট্ট সত্তা নাড়িয়ে দিলো।চুলের পানি চুইয়ে চুইয়ে অরিত্রিকার মুখে পরছে। অরিত্রিকার ব্যক্তিটিকে স্নিগ্ধ পুরুষ মনে হচ্ছে। বাজের হালকা আলোয় কিছুটা মুখের অবয়ব বুঝতে পারছে সে। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর পুরুষ মনে হতে লাগলো।সে দুর্বল চোখে অপলক তাকিয়ে রইল।

~আর ইয়্যু ইডিয়েট? উদভ্রান্তের মতো বৃষ্টিতে ভিজছিস কেনো?
তখনি ভেসে এলো ব্যক্তিটির মুখ হতে বজ্র কন্ঠের বানীটি। অরিত্রিকা ভালোলাগা ভুলে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো যেনো।তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে নিলো। সারহানের মুখশ্রী কঠিন। চোখে যেনো আগুন ঝরছে। চোয়াল শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার দিকে।মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছে হাত।রাগে ফুসছে সে। তখনি বজ্রপাত হলো।অরিত্রিকা আরও ভয় পেয়ে গেলো।
সারহান এখনো অরিত্রিকার হাত ধরে আছে। অরিত্রিকার শরীর ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। এতে যেনো সারহানের রাগের মাত্রা বাড়লো।নিশ্চয়ই সন্ধ্যা হতে উদভ্রান্তের ন্যায় ভিজে চলেছে। এতোটা নির্বোধ কেনো এই মেয়ে? এসব ভেবে আর মেজাজ হারাতে চাইলো না সে। ধৈর্য নিয়ে রাগ সংবরণ করতে লাগলো।
সারহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো~ নিচে চল।

অরিত্রিকা সারহানের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। ভয়ে আর সারহানের দিকে তাকালো না।সারহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো অরিত্রিকার দিকে।তাকালেও পরে তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।অরিত্রিকার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে,মাথা ঘুরছে, চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে।সেই অবস্থায় পা বাড়ালো নিজের রুমে যাওয়ার জন্য। দু কদম যেতেই মাথা ঘুরে গেলো তার।শরীর নেতিয়ে পরে যাওয়ার আগেই সারহান ধরে ফেললো।অরিত্রিকা সারহানের হাতের শরীরের ভাড় ছেড়ে দিলো।ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। অরিত্রিকা ঘোলাটে চোখে সারহানের অন্ধকারে আবছা গম্ভীর মুখ দেখলো শুধু। অরিত্রিকাকে হঠাৎ মাথা ঘুরে পরে যেতে দেখে সকল রা/গ নিমেষেই পানি হয়ে গেলো। স্তম্ভিত হয়ে তাকালো অরিত্রিকার দিকে। হালকা করে গাল চাপড়ে অরিত্রিকাকে উঠানোর চেষ্টা করলো সে।কিন্তু অরিত্রিকা উঠলোনা।চোখ বন্ধ করে আছে ।সারহান উপায় না পেয়ে অরিত্রিকাকে কোলে তুলে নিলো।সে লক্ষ্য করলো অরিত্রিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।শরীরও হীম হয়ে গেছে।সে দ্রুত অরিত্রিকাকে কোলে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।

অরিত্রিকা নিস্তেজ শরীরে কম্বল মুড়িয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজেই জ্বরের কবলে পরেছে। চোখ, মুখ শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে।সাথী বেগম মেয়ের কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন চিন্তিত হয়ে। এতো বড় মেয়ে হয়েছে তবুও হুশ বুদ্ধি হয়নি। তানিয়া বেগম অরিত্রিকার জন্য স্যুপ বানাতে গেছেন।ইফা মন খারাপ করে অরিত্রিকার পাশে বসে আছে।সে তো অরিত্রিকাকে ছাদ থেকে আসার জন্য ডেকেছিলো কিন্তু আসেনি। এখন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে।সারহান একধ্যানে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার দিকে। তার নজর তীক্ষ্ণ। সে ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে এসেছে।অরিত্রিকা অসুস্থ হওয়াতে তার খা/রাপ লাগার পাশাপাশি রাগও লাগছে। সে যদি সন্ধ্যার সময় এসে ইশরাকে অরিত্রিকার কথা না জিজ্ঞেস করতো তাহলে নিশ্চয়ই ছাদেই জ্ঞান হারিয়ে পরে থাকতো!
সাথী বেগম সারহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন~ দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো চেয়ার টেনে।
সারহান সাথী বেগমের কথায় শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করলো~ সমস্যা নেই দাঁড়িয়ে ই কম্ফর্টেবল ফিল করছি।
সাথী বেগম আর কিছু বললেন না। সারহান কিয়ৎ চুপ থেকে বললো~ ডাক্তারকে কল করেছিলাম। এসে পরবে।

~ এতোক্ষণ তো সময় লাগে না আসতে।
~ বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ো বাতাসও বইছে। এই কারণেই হয়তো আসতে দেরী হচ্ছে।
~ হতে পারে।তোমার চাচাকে কল দিয়েছিলে?
~ দিয়েছিলাম।বৃষ্টিতে আঁটকে পরেছে এসে যাবে।টেনশন করতে নিষেধ করেছে।
~ এই আবহাওয়ায় অরিন,ভাবী,ইফা,সাদাত আর আফ্রিদি বাহিরে গিয়েছে। ওদের যে কি অবস্থা!
~ সাদাত কল দিয়েছিলো আসতে লেট হবে।
সাথী বেগম ইফাকে বললো~ ইফা আমি একটু নিচে থেকে আসছি তুই অরিত্রিকাকে জলপট্টি দিতে থাক।
ইফা বললো~ ঠিক আছে মামী।
সাথী বেগম রুম থেকে প্রস্থান করতেই সারহান চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসলো। ইশরা অরিত্রিকার মাথায় জলপট্টি দিতে ব্যস্ত।সারহান দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ইশরাকে জিজ্ঞেস করলো ~ জ্বর কি খুব বেশী?
ইশরা সারহানকে বললো~ জ্বি ভাইয়া।

সারহান ইশরাকে কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো~ অরিত্রিকার কি কোনো কারণে মন খারাপ ছিলো? মন খারাপ হলেই তো বৃষ্টিতে ভিজে অথবা গান গায়! বিকেলে কি কারো সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছিলো?
ইশরা কিছুটা ভেবে বললো~ কারো সাথে ঝামেলা হয়নি। অরিত্রিকার তো মেজাজ ফুরফুরে ছিলো।সবাই বিকেলে ছাদে অনেক মজা করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে অরিত্রিকার কি হলো বুঝলাম না। কোনো কিছু নিয়ে হয়তো আপসেট হয়ে গেছিলো।আমরা নিচে আসার জন্য ডেকেছিলাম কিন্তু অরিত্রিকা আসেনি।আমাদের সকলকে বলেছিলো একটু পরে আসবে। আমরা আর জোর করিনি। বৃষ্টি হচ্ছিলো আমি ভেবেছি হয়তো অরিত্রিকা ছাদ থেকে নেমে এসেছে।
সারহান মনোযোগ দিয়ে শুনেও কিছু সুরাহা করতে পারলো না। অরিত্রিকার মাঝে মাঝে এই মেয়ের কি হয় সারহান বুঝে উঠতে পারেনা।বৃষ্টিতে ভিজে তারও মাথা ব্যথা করছে। গুলাতেই কেমন খুসখুস করছে।সারহান ইশরাকে বললো~ এক কাপ কফি নিয়ে আসতে পারবি?
ইশরা ভাবলো যাবে কি যাবে না? গেলে অরিত্রিকাকে কে দেখবে? আর বড় মানুষের কথা অমান্য করা খারাপ দেখায়।মুখের ওপর না বলা যায় না। অন্য কেউ হলে বলতো যেতে পারবেনা কিন্তু সারহানকে না বলা যাবে না। যদি ধমক দেয়?

ইশরাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে বললো~যাবি?
ইশরা বললো~ যাচ্ছি।
ইশরা রুম থেকে বেরিয়ে সারহানের জন্য কফি আনতে গেলো।সারহান টাউজারের পকেট হতে ফোন বের করে ডাক্তারকে কল দিলো।ফোন বন্ধ বলছে। সারহান এতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিপদের সময় এমনই হয়। কাউকে কলে পাওয়া যায় না।সে ফোন আবারও পকেটে পুরলো।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৩

অরিত্রিকা জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।কিছু একটা বিরবির করে জপে চলেছে। অনেকটা ধীরে বলার কারণে সারহানের কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।সারহান মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো শুনতে। অরিত্রিকার হয়তো জ্বর বেড়েছে সে কারণেই বিলাপ বকছে। সারহান স্বাভাবিক ভাবে জ্বর দেখার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে জলপট্টি সরিয়ে অরিত্রিকার কপালে হাত রাখলো।রাখতেই চমকে উঠলো সে। এতো জ্বর? জ্বরে মনে হচ্ছে ভাপ বের হচ্ছে। সারহান বিচলিত ভঙ্গিতে কাপড় ভিজিয়ে অরিত্রিকার কপালে রাখলো।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৫