প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৫

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৫
আদ্রিতা নিশি

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা পেরিয়ে সময়টা এখন গভীর রাত। বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৈশাখ মাসের সমাপ্তি ঘটলেও ঝড়,বৃষ্টি যেনো আজ নিজ ইচ্ছেমতো ধরণীতে পদার্পণ করছে।রুমের জানালা খোলা থাকায় শীতল হাওয়ায় জানালার পর্দাগুলো তাল মিলিয়ে নড়ছে।সারহান দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বসে অরিত্রিকার রুমে৷ কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। দৃষ্টি তার অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটা জ্বর নিয়েও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা অনুভূত হওয়ায় নড়ে চড়ে উঠছে। সারহান ছোট টেবিলে রাখা পানির বাটিতে কাপড় ভিজিয়ে অরিত্রিকার কপালে সুন্দরভাবে মেলে দিলো। এর মাঝেই সে ডাক্তারকে অনেকবার কল দিলেও বারবার ফোন বন্ধ বলছে। হয়তো নেটওয়ার্ক প্রবলেম।

বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই আঁটকে গেছে কোথাও। সারহানের মাথাব্যথাও বেড়ে চলেছে। সে ধৈর্য্য নিয়ে সহ্য করছে। ইশরাও এখনো কফি নিয়ে আসে নি।সাথী বেগম আর তানিয়া বেগমেরও কোনো দেখা নেই। সারহান রুমের জানালা ভেদ করে বাহিরে দৃষ্টি ফেললো। আবহাওয়া আরও খা/রাপ হয়ে গেছে। ঝড়,বৃষ্টির গতি বেড়েছে। শো শো করে বাতাসের ধ্বনি ভেসে আসছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান অরিত্রিকার কপাল থেকে কাপড় সরিয়ে আবারও হাতের উল্টোপাশে দিয়ে কপাল স্পর্শ করে দেখলো জ্বর কমেছে কিনা? সে অনুভব করলো জ্বর আগের থেকে অনেকটা কম।এতে কিছুটা স্বস্তি পেলো সে। প্রথমে জ্বরের তাপ বেশি – থাকায় সারহান আতংকিত হয়ে গিয়েছিলো।সে কখনো কাউকে অসুস্থ হলে সেবা করনি। এই প্রথম এতোটা যত্নে কারো সেবা করলো। এই অনুভূতিটা মোটেও মন্দ নয়। তাকে যদি বাহিরের এই জলপট্টি দিতে দেখতো নিশ্চয়ই অনেক অবাক হতো? হওয়ারই কথা। রাজনীতিতে যুক্ত কাঠখোট্টা মানুষ কখনো কি এসব কাজ করে? হয়তো করে তবে খুব কম সংখ্যক।অরিত্রিকা শীতল কিছু কপালে অনুভব হতেই নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমাচ্ছান্ন মুহুর্তকে বিদায় দিয়ে পিটপিটিয়ে চাইলো সে।শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। জ্বরে যথেষ্ট কাবু করে ফেলেছে বুঝলো সে। তন্দ্রারাচ্ছন্ন চোখে দুর্বল চিত্তে তাকাতেই সামনে আবিষ্কার করলো সারহানকে।তাকিয়েই কয়েকবার নেত্রপল্লব ঝাপটালো সে। সারহান অরিত্রিকা জাগার সাথে সাথে নিজের হাত গুটিয়ে নিলো।অরিত্রিকা বোঝার চেষ্টা করলো আসলেই কি সারহান তার সামনে বসে আছে কি না? বোঝার আগেই অ/সহ্য মাথার যন্ত্রণায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো তার। সে এক হাতে তার মাথা চেপে ধরলো।

~ মাথা ব্য/থা করছে?
অরিত্রিকার কানে ভেসে এলো শান্ত কন্ঠস্বর। সে আবারও সামনে বসা সারহানের দিকে চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকালো।মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে।এটা কি আদৌও সম্ভব?! ” সারহান তার রুমে প্রয়োজন ছাড়া কখনো আসে না। গুটিকয়েক বার এসেছে হয়তো। তাও বকাঝকা করতে। রুমে এসে বসে থাকবে এটা যেনো অরিত্রিকার কাছে স্বপ্ন মনে হলো।ঘোলাটে চোখে বেশ কয়েকবার তাকিয়েও ভ্রম কিনা তা বুঝতে পারলো না।আবারও সেই অস/হ্যকর কথাগুলো মনে পরে গেলো। এতেই চোখে অশ্রু ভীড় করলো অরিত্রিকার। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সারহান অরিত্রিকার কান্না করা দেখে শুধালো ~ কান্না করছিস কেনো? মাথা ব্য/থা করছে কি?
অরিত্রিকা বাচ্চার ন্যায় ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো~ নাহহ।

~তাহলে?
অরিত্রিকার একটু অভিমান হলো। সে কেনো কান্না করছে যন্ত্র মানব টা বুঝে পারছে না কেনো?অরিত্রিকা অভিমানী কন্ঠে উত্তর দিলো ~ আপনাকে বলবো না আমি।
সারহান ভ্রু কুঁচকে বললো~ তাহলে কাকে বলবি?
অরিত্রিকা চুপ হয়ে গেলো। চক্ষু হতে নির্গত নোনা পানির ফোয়ারা থেমে থেমে গাল বেয়ে পড়ছে। অরিত্রিকার মস্তিষ্ক ধরে নিয়েছে সামনে দন্ডায়মান ব্যক্তিটি তার মনের ভুল। মানুষটি তো তাকে আশে পাশেও ঘেষতে নিষেধ করেছে ভেবেই মলিন হাসলো। ভ্রম হয়েছে তো কি হয়েছে কথা তো বলতে পারছে সে।অরিত্রিকা ঝিমিয়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে উত্তর দিলো ~ যে আমায় বুঝবে তাকে বলবো।আপনাকে কখনোই বলবো না। কারণ আপনি আমায় বুঝেন না।

অরিত্রিকার মুখে এহেন কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো সারহান। তার অধরযুগল কিছুটা ফাঁক হয়ে গেলো?সে বিস্মিত নয়নে অরিত্রিকার দিকে তাকালো।অরিত্রিকা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারহান কিয়ৎ চুপ থেকে স্বাভাবিক স্বরে জানতে চাইলো ~ কি হয়েছে বল। বললে আজ থেকে তোকে আর বকবো না।
অরিত্রিকা শুয়ে থাকা অবস্থায় নিজের হাত দ্বারা চোখ মুছলো।চোখ মুছে করুণ স্বরে সারহানকে বললো~ আপনি বিয়েটা করবেন না সারহান ভাই।

বিয়ে নামক শব্দটা শুনতেই সারান অবাক হয়ে গেলো।সে অবাকতার রেষ কাটিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে অরিত্রিকার কান্নায় বিধ্বস্ত মুখ পাণে তাকালো।এতোটুকু সময়ে কান্নাকাটি করে চোখ,নাক লাল করে ফেলেছে। আর বিয়ে? বিয়ের কথা আসছে কেনো?বিয়ে নিয়ে তো আপাতত সে ভাবছে না।সারহান থমথমে মুখে বললো ~ আমার বিয়ের কথা আসছে কেনো? আর বিয়ে করলে তোর কি সমস্যা?তুই নিষেধ করছিস কেনো?
অরিত্রিকা সারহানের কথা শুনে আ/ঘাত পেলো মনে। বক্ষে যেনো নিরব ঝড় বেয়ে গেলো। তারমানে সারহান ভাই ইফা আপুকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? জ্বরের ঘোরে অরিত্রিকার যেনো সব এলোমেলো লাগছে।রাগে, দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে আর সহ্য না করতে পেরে শয়নরত অবস্থায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।অরিত্রিকাকে কাঁদতে দেখে সারহান ভড়কে গেলো।সে বিচলিত ভঙ্গিতে বললো ~ কাঁদছিস কেনো আবার?
অরিত্রিকা রাগাশ্রয়ী মুখে বললো~ আপনি খুব খা/রাপ সারহান ভাই।

সারহান বুঝলো অরিত্রিকা জ্বরের ঘোরে এসব আবোলতাবোল বকে চলেছে। সে অরিত্রিকার কান্না থামাতে বললো~ আচ্ছা আমি খারাপ। ভালো হতে হলে কি করতে হবে বল?
অরিত্রিকা সারহানের কথা শুনে কান্না করা বন্ধ করে দিলো।কিছুটা শান্ত হয়ে দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো সে।নিজের কম্পনরত হাত দ্বারা সারহানের পুরুষালি শক্ত-পক্ত হাত নিজ নরম মোলায়েম দু’হাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো। সারহান অরিত্রিকার এমন কাজে চমৎকৃত। বিস্ময়ে নির্বাক সে। সরু চোখে তাকালো অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা কিছুটা শক্ত করে পুনরায় মুঠোবন্দী করলো। হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় এবার সারহানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।চমকিত হলো মন।

~ জানেন? আপনি আসলেই একটা যন্ত্র মানব। এই কারণেই তো আপনি কারো চোখের ভাষা পড়তে পারেন না।সেই মানুষটির মনে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি টের পান না। সবসময় অবহেলা করেন। আপনাকে হারানোর ভয়ে সে মূর্ছে যাচ্ছে।অথচ আপনি বুঝতে পারছে না। নিজের সুপ্ত ভালোলাগাকে দমিয়ে রাখতে চাইলেও পারেনি। ভালোলাগার মানুষটি অন্য কারো হয়ে যাবে শুনে চুপচাপ থাকতে পারেনি। আপনি বিয়েটা করবেন দয়া করে।আপনাকে অন্য কারো হতে দেখলে সে সইতে পারবে না বিরহে জ্বলে যাবে তার হৃদয়।আপনিই বলুন জীবনে প্রথম ভালোলাগা কখনো ভুলতে পারা যায়?

অরিত্রিকা মলিন স্বরে অন্যমনষ্ক হয়ে বাক্যগুলো আওড়ালো।বক্ষে তার অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্বাস নিতে ক/ষ্ট হচ্ছে। নরম হাতে পুরুষালী হাতের অস্তিত্ব যেনো জানান দিচ্ছে অরিত্রিকা এটা তোর ভ্রম নয়! সত্যি মানুষটা তোর সামনে বসে আছে। তোর সকল কথা মনো যোগ দিয়ে শুনছে। তোর সকল কথার মর্ম বোঝার চেষ্টা করছে। তোর জন্য চিন্তা করছে কিন্তু অরিত্রিকা তখনও সারহানকে তার কল্পনায় আসর হতে বাস্তবে অনুভব করতে ব্যর্থ হলো।সারহান আশ্চর্য হয়ে গেছে। এসব কি বলছে? কিছুই যেনো সে ঠাওর করতে পারলো।
সারহান ওষ্ঠযুগল গোল করে শ্বাস ফেললো। বুকের মাঝে সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় আছড়ে পরলো সুপ্ত অজানা শিহরণ।কাহিনী যে এতো দুর গড়িয়েছে সে বুঝতেই পারেনি।আবেগ, ভালোলাগা এগুলো সকলের আছে তবে। বয়স ভেদে কম, বেশী। অরিত্রিকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই বোকা মেয়ে যে একটু কেয়ার,সুন্দর ভাবে কথা বলা কে এতোটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিবে সে বুঝতে পারে নি। সে তো তেমন কোনো ইনটেশন নিয়ে এগুলো করেনি।আর কিছু ভাবতে পারলো না সারহান। মাথা কাজ করছে না এখন। সে সবকিছু বুঝেও অরিত্রিকার মুখ হতে নামটা জানতে চাইলো। সারহান নিজেকে ধাতস্ত করে শান্ত স্বরে শুধালো~ মেয়েটা কে?

অরিত্রিকা অসহ্য লাগছে সবকিছু তবুও মলিন হেসে বললো~ আপনার আশেপাশেই আছে খুঁজে নিন।
সারহান নিজের মাঝে অস্থিরতা অনুভব করছে।এতোটা বিচলিত কেনো তার মন?জোরে কয়েক বার শ্বাস টেনে নিলো সে। সারহান তার হাতে বেশ গরম অনুভব করলো।অরিত্রিকার হাতও কাঁপছে। সারহান বুঝলো অরিত্রিকার জ্বর আবার বেড়েছে। সে অরিত্রিকার মুঠোবন্দি হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।ব্যস্ততার সহিত আবারো জলপট্টি দিলো সে। অরিত্রিকার চোখ নিমেষেই বুজে এলো।সে আর তাকিয়ে থাকতে পারলোনা।

তানিয়া বেগম স্যুপ হাতে অরিত্রিকার রুমে প্রবেশ করলেন। দেখতে পেলেন সারহান অরিত্রিকাকে যত্ন সহকারে জলপট্টি দিচ্ছে।ছেলের এমন রুপ দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন তিনি। তবে ভালোও লাগছে। যে ছেলে অরিত্রিকাকে বকাঝকা করে সে নিজেই সেবা করছে! সারহান কারো পায়ের শব্দে সামনের দিকে তাকালো ।তানিয়া বেগমকে দেখে অস্বস্তিতে পরে গেলো সে। অস্বস্তি লুকিয়ে সারহান তার মাকে স্বাভাবিক ভাবে বললো~ এতোক্ষণ কি করছিলে বলোতো? এদিকে অরিত্রিকার জ্বর কমছেই না। খাবার খাইয়ে বাড়িতেই তো ঔষধ আছে আপাতত খাইয়ে দাও। আবারও কাপুনী দিয়ে জ্বর এসেছে। ডাক্তার কখন আসবে বলা যাচ্ছে না।

তানিয়া বেগম এগিয়ে আসতে আসতে বললেন~ আমার ছেলের যে এই গুন টাও আছে আজ জানলাম।
সারহান মায়ের কথা শুনে অপ্রস্তুত হলো।সে মুখ গম্ভীর করে বললো~ তুমি তো জানো আমি কেমন তা সকলকে দেখাতে চাই না। আমি আমার রুমে গেলাম ইশরা কফি নিয়ে আসলে আমার রুমে পাঠিয়ে দিও।
~ ঠিক আছে।
সারহান চেয়ার থেকে উঠে কয়েক কদম গিয়ে পিছু ফিরে অরিত্রিকার দিকে তাকালো। অরিত্রিকার বলা কথাগুলো মনে পরতেই চোখ সরিয়ে নিলো সেদিক থেকে।নানা ভাবনা যেনো মস্তিষ্কে চেপে ধরেছে। সে পা গলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে।চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির কলরব মুখরিত পরিবেশ। বৃষ্টি থেমেছে রাতের তৃতীয় প্রহরে। ভোরে হালকা আলোয় প্রকৃতি দৃশ্যমান হচ্ছে ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে আছে শীতলতা।মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে বেলকনিতে বসে থাকা গম্ভীর পুরুষটির শরীর। দৃষ্টি তার অদূরে। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন সারহান। সারারাত না ঘুমিয়ে এখানেই বসে আছে বেলকনিতে। ঘুম যেনো চক্ষু হতে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়েছে। মাথা ব্য/থায় গুমরে ঔষধ খেলেও চক্ষু পটে ঘুমের হাতছানি পায়নি। রাত হতে মস্তিষ্কে অরিত্রিকার বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। অরিত্রিকা কথাগুলো জ্বরের ঘোরে বললেও সত্যতা আছে তা সারহানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি একটুও। তার প্রতি যে অরিত্রিকার ভালোলাগা কাজ করে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৪

সারহান ভাবনার মাঝেই তার হাত চক্ষু সম্মুখে তুলে ধরলো।অরিত্রিকা তার হাত মুঠোবন্দী করেছিলো। ভাবতেই বক্ষে অন্তঃকোণে অন্য রকম শিহরণ বয়ে গেলো। বক্ষে মৃদু অস্থিরতা অনুভব করলো।সহসা চোখ বন্ধ করলো সারহান। তখনি ভেসে উঠলো জ্বরে কাতর হয়ে যাওয়া মলিন মেয়েলী মুখশ্রীর অবয়ব।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৬