প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৯

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৯
আদ্রিতা নিশি

সারহান অরিত্রিকার রুমের বাহিরে কিছু সময় দাঁড়িয়েছিলো। ইফার বলা কথা শুনে আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। ছাদের দিকে পা বাড়ালো সে। সিঁড়িঘর পেরিয়ে ছাদে পা রাখলো সারহান।পড়ন্ত বিকেল,মনোরম পরিবেশ, মৃদু হাওয়া সব মিলিয়ে মন মাতানো পরিবেশ।আর কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে ধরণীতে। সারহান ধীর পায়ে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো আবহাওয়া অনেকটাই শীতল।সারহান নয়ন তালুকদারের কাজকর্মে অতিশয় বিরক্ত। কিছুক্ষণ আগেই আবির তাকে কল করে জানিয়েছে নয়ন তালুকদার তার লোক দ্বারা ঝামেলা বাঁধিয়েছে রাজশাহী কর্পোরেশন এরিয়াতে। সেখানে সকল দায়ভার সারহানের দলের ওপর চাপিয়েছে।

এসব শুনেই মাথায় দপদপ করে জ্বলছে রাগে। মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেছে। বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও হলো না। নয়ন তালুকদার এমন অনৈতিক কাজ করতে থাকছে সেও আর ছাড় দিবে না। কিভাবে শ/ত্রুকে বশে আনতে হয় তার ভালো করেই জানা আছে। সারহান ফোন উঁচিয়ে সময় দেখে নিলো।ছয়টা বাজে। সে টাউজারের পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রাস্তায় মানুষের ব্যস্ততম জীবনের সাক্ষী হলো। শহরে রাস্তায় বেড়োলেই অলিগলিতে কতশত অসহায় মানুষের দেখা মিলে। তাদের জীবনটা খুবই ক/ষ্টের।পৃথিবীতে চলমান ধারা হলো সাধারণ মানুষগুলোর ওপরই অন্যায় করা হয়। পৃথিবীতে যারা নিম্ন শ্রেণীর মানুষ আছে তারা সবসময় উচ্চ শ্রেণীর মানুষের দ্বারা শোষণ হয়। এটা চিরসত্য আর বাস্তবচিত্র।মানুষের এমন ভেদাভেদ না থাকলে মানব জীবন আসলেই সুন্দর হতো। সারহান কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো।দেখলো আফ্রিদি দাঁড়িয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান টাউজারের পকেটে দুহাত দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আফ্রিদিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো ~ কিছু বলবে?
আফ্রিদি সারহানের হঠাৎ করা প্রশ্নে নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। সে মুখে হাসির রেখে টেনে বললো~ তেমন কিছু না।
সারহান সরু চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললো~ মি/থ্যে ও ঠিকঠাক বলতে পারো না দেখছি।
আফ্রিদি একটু হচকচিয়ে গেলো। সারহান কিভাবে বুঝলো সে তার সাথে কথা বলতে এসেছে?সে সারহানকে অরিত্রিকার রুমের সামনে দেখেছে।সারহান যখন ছাদের দিকে রওনা হয় সে তখন অরিত্রিকার রুমের বাহির থেকে ইফার কান্নার শব্দ পেয়েছে। বোনের কান্না তার সহ্য হয়নি। সে এই নিয়েই সারহানের সাথে কথা বলতে এসেছে। সারহানের তীক্ষ্ণ চোখে আফ্রিদিকে পর্যবেক্ষণ করছে।
সারহান আফ্রিদির কোনো উত্তর না পেয়ে বললো~ এতোটা অস্বস্তিতে পরতে হবে না। যা বলতে এসেছো বলে ফেলো।

আফ্রিদির মাঝে মাঝে সারহানকে ভ/য় লাগে। বেশীরভাগ সময়েই মুখ গম্ভীর করে রাখে।সে সাহস সঞ্চার করে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো~ ব্রো ইফা খুব কান্না করছে।
ইফার কথা শুনে সারহানের মুখ কঠিন হলো। সারহান বুঝলো আফ্রিদি কেনো এসেছে। মুখশ্রী কঠিন থাকলেও স্বাভাবিক কন্ঠেই সারহান বলে উঠলো~ তুমি বলতে চাইছো তোমার বোনকে আমি বিয়ে করি?
আফ্রিদি অস্বস্তিতে পরে গেলো। টপিকটাই ভিন্ন ধাঁচের মনে হলো তার কাছে।এভাবে কথা বলাটাও কেমন বেমামান ঠেকছে। সে অস্বস্তি নিয়ে বললো~ আমি আমার বোনকে ভীষণ ভালোবাসি।ওর চোখের অশ্রু আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার মনে হয় ইফা তোমাকে পছন্দ করে।এই কারণে বেশী ক;ষ্ট পাচ্ছে।
সারহান সহসা জবাব ছুঁড়ে বললো~ ক্ষণিকের ক/ষ্ট সয়ে যায় কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ক/ষ্ট ভোলা খুবই কঠিন। সারাজীবন কষ্ট নিয়েই অতিবাহিত করতে হয়।আমি তোমার বোনকে বিয়ে করলে সে হয়তো খুশি হবে কিন্তু আমি? আমি তো তাকে বোনের নজরে দেখেছি। নিজের কাছে অকয়ার্ড ফিল হবে।আমি ইফার ফিলিং সে রেসপেক্ট করি বাট আমার মনে হয় এটা তার ভালোলাগা। তুমি বুঝিয়ে বললে হয়তো বুঝবে। অল্প কিছুদিন হয়তো খারাপ লাগবে পরে ঠিক হয়ে যাবে।

আফ্রিদি সারহানের বলা কথাগুলো বুঝলো। ভাইয়ের মন তবুও মানতে নারাজ যেনো। সে কখনো ইফাকে এইভাবে কান্না করতে দেখেনি অথচ আজ অল্প সময়ের পরিচিত একজনের জন্য এখনো কান্না করেই চলেছে।
সারহান আবারও রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সে অদূরে তাকিয়ে আফ্রিদির উদ্দেশ্যে বললো~ রাজনীতিতে জড়ালেই নিজের নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে দিতে হয়। সাহসী হতে হয়। কারণ আমাদের তো শত্রু/র অভাব নেই কখন কে পেছন হতে ছুড়ি ঢুকিয়ে দেয়।প্রিয়জন,আত্নীয় সবাইকে নিয়ে টেনশনে থাকতে হয়।আমারও একই অবস্থা নিজের পরিবারের সকলকে নিয়ে টেনশনে থাকি।তাদের যথেষ্ট প্রটেক্ট করার চেষ্টা করি। আমার কিছু হলেও তেমন যায় আসবে না তবে পরিবারের কোনো সদস্যর যদি কোনো ক্ষ/তি হয় সেটা আমি মেনে নিতে পারবো না।ভাবতেই নিজের কাছে অবাক লাগে এই একটা জায়গাতেই আমার মতো কঠিন মানুষ খুব দুর্বল। একটা কথা জানো এমন অদ্ভুত জীবনে নতুন করে কাউকে জড়াতে ভয় হয়।আমি যদি না থাকি তখন তার কি হবে বুঝতে পারছো?
আফ্রিদি সারহানের কথার শুনে বললো~ মানুষ কি একা সারাজীবন কাটাতে পারে?

সারহান তার চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে জবাব দিলো~ আমার অনিশ্চিত জীবনে যে সাদরে পদার্পণ করবে তাকে আমি আমার জীবনসঙ্গীনি রূপে গ্রহণ করবো।
আফ্রিদি সারহানের কথা শুনে মলিন হেসে বললো~ তোমার বলা কথাগুলোর গভীরতা পরিমাপ করলাম। আসলেই রাজনীতিতে জড়ালেই জীবন অনিশ্চিত।যে পথটা বেছে নিয়েছো, সফলতা অর্জন করো এন্ড ফিউচার লাইফের জন্য অল দ্যা বেস্ট।
সারহান চক্ষুদ্বয় বন্ধ রেখেই বললো~ থ্যাংকস।
আফ্রিদি আর কথা না বাড়িয়ে ছাদ থেকে চলে যাবে এমন সময় অরিত্রিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।তখনি মলিন মুখ স্বাভাবিক করলো সে। অরিত্রিকা সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। আফ্রিদি মুখশ্রী স্বাভাবিক রেখেই জিজ্ঞেস করলো~ এই সন্ধ্যায় ছাদে কেনো এসেছো অরি?

অরিত্রিকা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে। হঠাৎ আফ্রিদির কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেলো সে।সারহানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো আফ্রিদি দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্রিকা কিছুটা ধীর কন্ঠে বলে উঠলো ~ আমি আপনাকে ডাকছে তাই বলতে এসেছি।
~ ওহহ আচ্ছা।আমি তো এখনই যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় একা ছাদে যেও না। নিচে চলো।
অরিত্রিকা মুখ ফসকে বলে উঠলো ~ আমি একা কোথায়? সারহান ভাই তো আছেই। উনি থাকলে সমস্যা নেই।
অরিত্রিকা কথাটা বলতেই জিভ কাটলো। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে।সে চোরা চোখে আফ্রিদির দিকে তাকালো। আফ্রিদি একবার সারহানের দিকে তাকিয়ে অরিত্রিকাকে স্বাভাবিক ভাবেই বললো~ ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

আফ্রিদি তেমন কিছুই না বলেই চলে গেলো। আফ্রিদি যেতেই অরিত্রিকা হাঁপ ছেড়ে বাচলো।যদি ভুল বুঝতো তাহলে তো আজ সবাই তার মনের খবর জেনে যেতো। ভাবতেই দম আঁটকে আসছে তার। কথাটা সিরিয়াসলি নেয়নি এতেই শান্তি। অরিত্রিকা সব জায়গায় মনে কথা বলবি না। এটা বলে নিজেকে মনে মনে বোঝাতে লাগলো। তারপর সে পা টিপে টিপে সারহানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সুঠাম দেহী, সুদর্শন মানুষটার কাছে নিজেকে ছোট মনে হলো।সে মেপে দেখলো সারহানের থেকে অনেকটা ছোট। কাঁধের নিচে পরে আছে সে। নিজেকে সারহানের সামনে লিলিপুট মনে হচ্ছে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে চারিপাশ। অরিত্রিকা আড় চোখে অবলোকন করলো সারহানের মুখ।দেখলো মুখটা গম্ভীর।সে অনেকক্ষণ আগেই ছাদে এসেছে। আফ্রিদি আর সারহানের সকল কথা সে শুনেছে। মনের মাঝে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গেছে।এমন গম্ভীর, কাঠখোট্টা মানুষেরও যে কোনো কিছুতে ভয় কাজ করে আজ জানলো।জেনেই সে বিস্মিত হয়েছে। এমন ঝটকায় যেনো সে হেলে গেছে কিছুটা।
সারহান চক্ষুদ্বয় মেলে অরিত্রিকার দিকে না তাকিয়েই শান্ত কন্ঠে শুধালো~ নিচে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?

অরিত্রিকা শান্ত কন্ঠ শুনে শিউরে উঠলো।দ্রুততার সহিত অন্যদিকে তাকালো সে। এমন হা করে তাকিয়ে ছিলো জানলেই আবার কথা শুনিয়ে দেবে। অরিত্রিকা মিহি কন্ঠে বলে উঠলো ~ আপনি একা দাঁড়িয়ে আছেন তাই।
সারহান অরিত্রিকার উত্তর শুনেও নিশ্চুপ।অরিত্রিকা কিছুটা অবাক হলো। অন্য সময় হলে এতোক্ষণ কথা শুনিয়ে দিতো অথচ আজ চুপচাপ। তার মন বলছে সারহান ভাই হয়তো কোনো কারণে আপসেট হয়ে আছে। অরিত্রিকা আবারও তাকালো সারহানের দিকে। সুমিষ্ট স্বরে ডেকে বললো~ সারহান ভাই! আপনার কি আজ মন খারাপ?
সারহান এবার অরিত্রিকার দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলে তাকালো।কিছুটা নড়বড়ে অনুভূতি তার। তবুও শান্ত সে। সারহান বললো~ এমনটা কেনো মনে হলো তোর?
অরিত্রিকা ঠোঁট উল্টে বললো~ মনে হলো তাই বললাম।
সারহান তা শুনে বললো~ মন খারাপ নয়।
~ আপনার কি ইফা আপুর জন্য খা/রাপ লাগছে?

সারহান চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বললো~ এতোক্ষণ তো দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছিস। তাও এমন ষ্টুপিডের মতো কথা বলছিস কেনো?
সারহানের কথায় অরিত্রিকা কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। তারমানে সে যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তা সারহান খেয়াল করেছে। সে ধীরে বললো~ আপনি আমায় খেয়াল করেছেন?
অরিত্রিকা যখন ছাদে এসেছে তখনই সারহান খেয়াল করেছে। অরিত্রিকার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো~ জ্বর আছে এখনো?
~নাহ নেই।
~ তাও ভালো। জ্বরের ঘোরে তো গোপন কথা উগরে দিয়েছিলি কাল রাতে।এতোসব গোপন কথা নিয়ে ঘুমাস কি করে?

অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেলো।কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। কোন গোপন কথা বলে দিয়েছে সে? পেটে তো অনেক কথায়ই চেপে রেখেছিলো। এখন কি হবে? কি করবে সে। অরিত্রিকার মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।করুণ চোখে তাকালো সারহানের দিকে। তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো~ কোন কথার বলছেন সারহান ভাই?
সারহার নিরব দৃষ্টিতে অরিত্রিকার ভীতু মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো~ কিছু অনুরাগ মিশ্রিত বাণী,অভিমান, রাগ, ভালোলাগা নিয়ে কথাগুলো জ্বরের ঘোরে বলেছিস।আরেকটা কাজও করেছিস। থাক ওটা আর না বললাম। বুঝতে শিখেছিস বাস্তবতা। কোনো ভুল কিছু করে বসিস না যার কারণে তুই সকলের কাছে খা/রাপ হয়ে যাস।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৮

অরিত্রিকা একটু দবগে গেলো। তার চোখে দ্বিধাদন্ডিত প্রশ্নের সমাহার। সে মস্তিষ্কে চাপ দিলো।রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলো।অতিশয় চেষ্টা করেও কিছু সে মনে করতে পারলো না। সারহান অরিত্রিকাকে কিছু একটা ভাবতে দেখে গম্ভীরমুখে বললো ~থাক আর ভাবতে হবে না। আমি চললাম।
সারহান সিঁড়ি ঘর পার করে চলে গেছে অল্প সময়েই।অরিত্রিকা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি পরেছে। সে বুঝতে পারছে না কোন কথাটা বলেছে সে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২০