প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৮
আদ্রিতা নিশি
গভীর রাত। সময়টা এগারোটার ঘরে। গভীর রাত হলেও মানুষের আনাগোনা হাসপাতালে অনেক বেশী।হাসপাতালের ভেতরে ফিনাইলের উগ্র গন্ধে চারিপাশ ভারী হয়ে আছে। আলো বাতাসের অস্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর।পরিবেশটাও কেমন গুমোট ভাব, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।কেমন সব অদ্ভুত অনুভূতি। সারহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে সন্ধ্যার পরে। আরশাদ সাহেব চাননি মেডিকেলে সারহানের চিকিৎসা হোক। মুলত সেখানকের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর নয়।ডাক্তারও খামখেয়ালি ভাব নিয়ে চিকিৎসা করে। নার্সও তেমন রোগীর যত্ন করে না।
সারহানকে দেখার জন্য তানিয়া বেগম,সাথী বেগম,ইসমা বেগম,সাদাত,অরিত্রিকা ও ইশরা এসেছে সন্ধ্যার পরই।সকলের মন অসম্ভব খারাপ। সবাই বাহিরে নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পরেছে অনেকটাই। আরশাদ সাহেব আর আজমল সাহেব এমপির জানাযায় গিয়েছেন।দলের একজন নেতা অকালে মৃত্যু/বরণ করেছেন যাওয়া জরুরী। তার ওপর বেশ বিশ্বস্ততা ছিলো তাদের সাথে। না গেলে বিষয়টা খারাপ দেখায়।
সাথী বেগম আর তানিয়া বেগম কেবিনের বাহিরে বসে আছেন।তাদের ওপর দিয়ে আজ বিশাল ঝড় বয়ে গেলো। পরিবারের ওপরে বড় কোনো বিপদ আসেনি। এই প্রথম ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করছে সকলে। তানিয়া বেগম সারহানের অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে গেছেন। সাথী বেগমের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন চোখ বন্ধ করা অবস্থায়। প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় শরীর খারাপ লাগছে তার। সাদাত, ইশরা আর অরিত্রিকা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
ইসমা বেগম তানিয়া বেগমের ঝিমিয়ে থাকা দেখে সাথী বেগমকে বললেন~ ভাবী আমার মনে হয় বড় ভাবীর এখানে থাকা ঠিক হবে না। উনার শরীরের অবস্থা খারা/প। হাসপাতালে থাকলে আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। আমি বলি কি ভাবীকে নিয়ে আমি বাসায় যাচ্ছি আপনি থাকুন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাথী বেগমেরও মনে হলো ইসমা বেগম ঠিক বলেছেন। তিনি সায় দিয়ে বললেন~ আমারও তাই মনে হচ্ছে। ভাবীকে বাসায় নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে। খাবার খাইয়ে প্রেশারের ঔষধ খাইয়ে দিও।সাদাতকে সাথে নিয়ে যাও। তোমাদের রেখে আবার এখানে আসবে।
~ ঠিক আছে।
সাথী বেগম তানিয়া বেগমকে ধীরে ডেকে বললেন~ ভাবী আপনি বাসায় যান। আমি এখানে আছি সারহানের খেয়াল রাখার জন্য।
তানিয়া বেগম মাথা উঁচিয়ে সারহানের কেবিনের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন~ আমি যাবো না। সারহানের সাথে আমার একবারও কথা হলো না। ও যদি জেগে দেখে আমি নেই পাশে তাহলে রা/গ করবে।
~ আপনার শরীর খারাপ। সারহান যদি জানে আপনি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন তাহলে রা/গ করবে। আমরা তো আছি চিন্তা করবেন না।
সাদাত মাকে বললো~ মা চাচী ঠিক কথা বলছে। তুমি এই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকতে পারবে না। বাবা এসে দেখলে চোটে যাবে তোমার ওপর।
তানিয়া বেগম অনেকক্ষণ ভেবে বললেন~ ঠিক আছে আমি বাসায় যাচ্ছি। সারহানের খেয়াল রেখো সাথী।
সাথী বেগম বললেন~ ঠিক আছে ভাবী।আপনি চিন্তা করবেন না।
ইসমা বেগম আর সাদাত মিলে তানিয়া বেগমকে ধরে হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
ইশরা অরিত্রিকাকে নিয়ে সাথী বেগমের পাশে বসলো। সাথী বেগম এতোক্ষণ অরিত্রিকার দিকে খেয়াল করেননি। তিনি মেয়ের বিধ্বস্ত রুপ দেখে আঁতকে উঠলেন।অরিত্রিকা নিশ্চুপ বসে আছে অনুভূতিহীন মানুষের ন্যায়। তারমাঝে কোনো হেলদোল নেই।
সাথী বেগম মেয়ের কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত স্বরে বললেন~ জ্বর তো আসেনি। তাহলে মুখ লাল হয়ে আছে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে মা?
অরিত্রিকা সাথী বেগমের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। মূর্তিরন্যায় বসে রইল। সাথী বেগমের কোনো কথা কর্ণগোচর হলো না। তার চোখ সারহানের কেবিনের দিকে স্থির।একধ্যানে কিছু একটা দেখে চলেছে। আশেপাশের কোনো কিছুতে মনোযোগ নেই।
ইশরা দেখলো অরিত্রিকার কোনো হেলদোল নেই। সে উপায় না পেয়ে বললো~ মামী অরিত্রিকার মাথা ব্যথা করছে। তাই এমন দেখাচ্ছে।
~ আগে জানলে তো ভাবীর সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। এমন অসুস্থ শরীরে এখানে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।
~সমস্যা নেই। ঔষধ খেয়ে এসেছে।আমি তো আছি কোনো সমস্যা হলে ওকে নিয়ে বাসায় চলে যাবো।
সাথী বেগম আর কিছু বললেন না। কিন্তু মনে মনে চিন্তিত হয়ে রইলেন। মেয়েটা এই অসুস্থ অবস্থায় না থাকলেও পারতো।
ইশরা অরিত্রিকাকে ফিসফিসিয়ে বললো~ নিজেকে স্বাভাবিক কর। সবার সামনে এভাবে থাকলে তোকে নিয়ে নতুন করে টেনশন শুরু করে দিবে।
অরিত্রিকা কেবিনের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে ইশরার দিকে তাকালো। চক্ষুদ্বয়ে কান্নার আভাস।অশ্রুতে টইটম্বুর অবস্থা। নেত্রপল্লব ঝাপটাতেই অশ্রু গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে গেলো।ইশরারও চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠলো।সে হাত দ্বারা অরিত্রিকার গালে অবশিষ্ট নোনা পানি মুছিয়ে দিয়ে ইশারা করলো কান্না না করার জন্য।
অরিত্রিকা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। চক্ষু সম্মুখে প্রিয় মানুষটি আহ/ত অবস্থায় বেডে শুয়ে থাকতে দেখে কেউ কি ভালো থাকতে পারে? নাহ পারে না। প্রায় ঘন্টাখানেক আগে দুরুদুরু বুকে সাহস নিয়ে কেবিনের বাহির হতে কাঁচের আস্তরণ ভেদ করে একপলক দেখেছে।দেখেই মাথা ঘুরে গেছে তার।নিজ চোখে আর সাহস হয়নি মানুষটিকে দেখার। এখনো ভেসে উঠছে সারহানের মলিন, ক্ষতযুক্ত মলিন, ফ্যাকাশে মুখখানা।র/ক্তশূণ্য অবস্থায় অচেতন নিথর দেহ বেডে পরে আছে।আহ! কতো কষ্টদায়ক দৃশ্য। শখের পুরুষের এমন করু/ণ দৃশ্য অরিত্রিকা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।সেখানেই যেনো থমকে আছে সে। কল্প পুরুষের নিরবতা পীড়াদায়ক।
রাতের প্রায় শেষ প্রহর।পুরো হাসপাতাল এখন নিস্তব্ধ। আশে পাশে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। ঘুমে আচ্ছন্ন সকলে। কিন্তু অরিত্রিকার দুই চোখে ঘুমের কোনো রেষ পর্যন্ত নেই। এখনো চুপচাপ আগের মতোই বসে আছে।মন যেনো পাথর হয়ে গেছে। সে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইশরা,সাথী বেগম, সাদাত তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন। আজমল সাহেব আর আরশাদ সাহেব নামাজের জন্য গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই আযান দিবে।অরিত্রিকা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সুন্দরভাবে মাথায় ওড়না জরিয়ে সে পা বাড়ালো সারহানের কেবিনের দিকে।
কেবিনের বাহির হতে দরজার কাচ ভেদ করে সারহানের দিকে অপলক চেয়ে রইল অরিত্রিকা। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না।চোখ সরিয়ে নিলো সে। শরীর যেনো শিউরে উঠছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে আবারও তাকালো।তাকিয়ে থাকা অবস্থায় দেখলো সারহান কিছুটা নড়ে উঠলো।অরিত্রিকা নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। সারহানকে একপলক কাছে হতে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো সে।একবার মানুষটির হাত ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা জাগলো। অরিত্রিকা আর কিছু ভেবে সময় নষ্ট করার মতো ভুল করলো না।নিজের মনে চলা ভাবনাকে প্রাধান্য দিলো।অরিত্রিকা দরজা খুলে ক্ষীণ পায়ে এগিয়ে গেলো সারহানের দিকে।
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে চেয়ার টেনে সারহানের বেড হতে অল্প দুরত্বে বসলো অরিত্রিকা।বক্ষে অজানা ভয়ে সিঁটিয়ে আছে সে। আতংকে, ভয়ে দরদর করে ঘামছে। বারবার ঢোক গিলছে সে। শরীরও কেমন অসার হয়ে আসছে। অরিত্রিকার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে।অশ্রু ভরা চক্ষুতে সারহানের পাণে তাকিয়ে আছে।অক্সিজেন মাক্স খুলে দেওয়ায় মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।সন্ধ্যার পরে সেন্স ফেরায় অক্সিজেন মাক্স খুলে দিয়েছিলো ডাক্তার। সারহানের পুরো মুখে কাটা ছেঁড়ার অসংখ্য দাগ।কপালের অর্ধাংশ ব্যান্ডেজ থাকলেও কিছু অংশ র/ক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে।অরিত্রিকা আজ মানুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত মানুষটিকে।অন্য সময় হলে সারহান ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে বলতো “আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস কেনো? আগে কি কখনো দেখিস নি?”তবে আজ নিশ্চুপ হয়ে আছে।অরিত্রিকা মনে মনে আকুল গলায় বললো” সারহান ভাই আপনাকে এমন নিশ্চুপ মানায় না। কথা বলুন প্লিজ।”সারহান ভাই কি তার মনের কথা শুনতে পেয়েছে?
অরিত্রিকার হাত মৃদু কাঁপছে। তবুও কম্পনরত হাতে সারহানের শক্ত পোক্ত পুরুষালী হাত নিজ মসৃণ,কোমল হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরলো। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো।শান্ত ঝড় উঠেছে বক্ষে। অরিত্রিকা দু হাতে জরিয়ে রাখা হাত নিজ গালে ঠেকিয়ে এক ধ্যানে সারহানের মুখ পাণে তাকিয়ে রইল।অনুভব করলো সারহানের উষ্ণ হাতের ছোঁয়া।
অরিত্রিকা অপলক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাকালীন ধীর কন্ঠে আওড়ালো~ আপনার এই নিরবতা আমায় ক্ষণে ক্ষণে ক/ষ্ট দিচ্ছে সারহান ভাই। এমন নিশ্চুপ থাকা আপনাকে মানায় না। আপনাকে রাগী,গম্ভীর, যন্ত্র মানব হিসেবে মানায়। আপনি জানেন আজ আবারও আপনার হাত ধরেছি। প্রথম দিন অনিচ্ছাকৃত ভাবে হাত ধরলেও আজ ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত ধরেছি।কিছু বলবেন না?বলুন আজ সবকিছু শুনতে রাজি আমি। আপনার কথায় মন খারাপ করবো না আজ। একটা কথা কি জানেন? আপনি যদি আজ হাত ধরার জন্য অপমান করতেন আমি তবুও ছাড়তাম না।আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতাম। এই হাত ধরে আপনার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই।আপনি আমায় রাখবেন আপনার ওই কঠোর হৃদয়ের মধ্যিখানে?
অরিত্রিকা চোখের নোনা পানি সারহানের হাত ভিজে যাচ্ছে। সে একহাতে গালে গড়িয়ে পরা অশ্রু মুছে নিলো।আস্তে করে সারহানের হাত বেডে যত্ন করে রেখে দিলো।সারহানের গায়ে থাকা সাদা চাদর অনেকটা নিচে নেমে এসেছে। বুকের অপারেশনকৃত স্থানের ব্যান্ডেজটি দৃশ্যমান।ব্যান্ডেজের স্থানে গোলাকৃতি হয়ে র/ক্তে ভিজে উঠেছে। সেই দৃশ্য দেখে অরিত্রিকার বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো। কি অসহনীয় দৃশ্য।এতোক্ষণ তার ধ্যান সারহানের দিকে থাকায় খেয়াল করেনি। ইস! কি ভয়াবহ দৃশ্য। কতোই না কষ্ট পেয়েছে তার শ্যাম পুরুষ!
অরিত্রিকা নিজেকে শক্ত করে ঈষৎ কাঁপা হাতে সারহানের বুকের ব্যান্ডেজ করা স্থানটি ছুঁয়ে দিলো।গভীর চোখে অবলোকন করলো সে। ক্ষ/ত স্থানটি অনেকটাই গভীর। এর জন্যই অতিরিক্ত র/ক্তক্ষরণ হয়েছে।অরিত্রিকা দুই হাতে চাদর টেনে দিলো সারহানের শরীরে। চোখ সরিয়ে কেবিনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে চারিপাশ। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হবে। কেবিন থেকে চলে যেতে চাইলেও মন টানলোনা অরিত্রিকার। সে নিজ হাতে ভর দিয়ে সারহানের দিকে তাকিয়ে রইল।
~ আপনার শরীরের ক্ষত যেনো আপনার থেকে আমায় অধিক পীড়া দিচ্ছে সারহান ভাই। পীড়া থেকে আমায় মুক্তি দিন।
ভয়ংকর রাত পেরিয়ে ধরণীতে সকাল হয়েছে। কিছুটা স্বস্তিকর পরিবেশ। পাখিদের কলরবে মুখরিত চারিপাশ।সূর্যের দেখা না মিললেও হালকা আলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব কেটে আলোকিত হয়েছে।জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে বাহিরের আলো কেবিনে প্রবেশ করছে। মৃদু বাতাসে জানালার পর্দাগুলো নড়ে চড়ে উঠছে। বাতাসে যেনো প্রশান্তির ছোঁয়া বইছে।
সারহানের বাহিরের আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেলো। ধীর গতিতে চোখ খুললো সে। মাথা ব্য/থায় টনটন করছে। পুরো শরীরে অসহনীয় ব্য/থার আবির্ভাব হয়েছে। নড়লেও প্রচন্ড লাগছে। কিছুটা সময়,যেতেই ফিনাইলের তীক্ষ্ণ গন্ধ সারহানের নাকে এসে লাগলো। বিদঘুটে গন্ধ এক নিমিষেই জানান দিলো সে হসপিটালে এডমিটেড। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। তারমানে এখনো বেঁচে আছে সে। গতকাল এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আজই সব শেষ। চোখের সামনে এক মুহুর্তে সব তছনছ হয়ে গেলো তবুও কিছু করার ছিলো না। ভেবেছিলো কখনো পরিবারের কারো মুখ সে দেখতে পারবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় আছে তাই বেঁচে আছে।হাতে কিটকিটে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।হাত নড়াতে চেয়েও শরীরের দুর্বলতায় পেরে উঠলো না।এতটুকুতেই শরীরের শক্তি হারিয়ে গেছে। এন্টিবায়োটিক ঔষধ শরীরে প্রবেশ করলেই শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তার মনে হলে হাতে কিছুর অস্তিত্ব উপস্থিত সেই কারণে অতিরিক্ত ভারী লাগছে।
সারহান অতি কষ্টে মাথা উঁচু করে হাতের দিকে তাকালো। তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে রইল। অরিত্রিকা তার হাতের ওপর মাথা রেখে আরামসে আয়েশ করে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে কত দিন না ঘুমিয়ে আজ ইচ্ছে মতো ঘুমাচ্ছে।
সারহান অসম্ভব ব্যথায় জর্জ/রিত হয়ে হাত অরিত্রিকার মাথার নিচ হতে বের করে নিলো।ব্যথায় খিঁচে এলো তার মুখ। ঠোঁট কামড়ে ব্যথা নিবারণের ব্যস্ত হলো সে। অরিত্রিকার ঘুমের ব্যঘাত ঘটায় কিছুটা বিরক্তির সহিত ঘুমো ঘুমো চোখে তাকালো। এখনো পরিপূর্ণ ঘুম না হওয়ায় বিরক্ত সে।বেড হতে মাথা তুলেই সামনে তাকাতেই সারহানের ব্য/থায় কুঁচকে যাওয়া মুখ দেখলো। দেখেই ভীতু হলো সে।
অরিত্রিকা বিচলিত ভঙ্গিতে বললো~ কি হয়েছে আপনার? কোথায় ব্যথা করছে?
অরিত্রিকার ঘুমো ঘুমো মোহনীয় কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতে সারহান অরিত্রিকার দিকে তাকালো।মেয়েটা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সারহান ব্যথাতুর স্বরে আওড়ালো~ হাতে অস/হ্য পেইন হচ্ছে।
অরিত্রিকা তৎক্ষনাৎ বেশী কিছু না ভেবে বলে উঠলো~ আমি আস্তে আস্তে মাসাজ করে দিবো?
সারহানের দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো।সে কিঞ্চিৎ অরিত্রিকাকে অবাক করে দিয়ে বললো~ দে।তবে সাবধানে।
অরিত্রিকা অবাক হলো বটে। এতো সহজে অনুমতি পাবে ভাবতে পারে নি। তবে ভালো লাগার পরিমাণটা অন্তঃস্থল ছাপিয়ে গেলো। সারহানকে কিছুটা সুস্থ অবস্থায় কথা বলতে দেখে অরিত্রিকা প্রফুল্ল হয়ে গেছে। আবেগী ভাব দমিয়ে অতিকষ্টে স্বাভাবিক আচরণ করছে। অসুস্থ মানুষের সামনে কান্না করা ঠিক নয় এটা জানে অরিত্রিকা। সে আর কিছু না ভেবে পরম যত্নে সারহানের হাত মাসাজ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
সারহান অতি শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো~ কেবিনে কখন এসেছিস?
অরিত্রিকা ধীর কন্ঠে বললো~ ভোরে।
সারহান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো ~ পারমিশন কে দিয়েছে?
~ কেউ দেয়নি। আমি বিনা পারমিশনে কেবিনে এসেছি।
সারহান অতিব আশ্চর্য হলো। অরিত্রিকা কি অবলীলায় সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। যেনো সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত।সারহান অরিত্রিকার লাল টকটকে চোখ,মলিন মুখ,চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল,শরীরও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তা দেখে বুঝলো নিশ্চয়ই ঘুমের গাফিলতি করেছে।নিয়মিত খাবার,শরীরের যত্ন কোনোটাই করেনি।
সারহান রুদ্ধ স্বরে বললো~ এতোটা কেয়ারলেস কেনো তুই? নিজের শরীরের যত্ন, খাওয়া দাওয়া, ঘুম কোনো টাই ঠিক মতো করিসনি। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ কি অবস্থা করেছিস নিজের।
অরিত্রিকা সারহানের কথা কানে তুললো না। সে আদেশসূচক বললো~ আপনার শরীর খারা/প। এই সময় এমন চিল্লানো উচিত না। চুপচাপ থাকুন আর আমার কাজ আমাকে করতে দিন।
সারহানের মুখ হা হয়ে গেলো। এই মেয়ে তাকে আদেশ করছে? সারহানের দৃষ্টি কঠিন। এই কয়েকদিনে সাহস বেড়েছে অরিত্রিকার।
অরিত্রিকা সারহানের দৃষ্টি খেয়াল করে ঠোঁট উল্টে নিষ্পাপ ভাব ভঙ্গির আদল নিয়ে বললো~ আমার দিকে ওমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাবেন না। ওই দৃষ্টিতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। একবার আপনার চোখের অতলে হারিয়ে গেলে নিজেকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবোনা।
সারহানের কপাল কুঁচকে গেলো।সন্দিহান দৃষ্টিতে অরিত্রিকার দিকে সুক্ষ্ম নজরে তাকালো।
অরিত্রিকা সিরিয়াস ভঙ্গিতে সারহানের প্রশ্নের উত্তর দিলো ~ আপনি আমার শরীরের অবস্থা দেখলেন। একটু বকলেন কিন্তু কেনো নিজের অযত্ন করেছি কারণটা জানতে চাইলেন না কেনো সারহান ভাই?আপনি কি আমাকে কখনো বুঝবেন না? আমার মনে চলমান অব্যক্ত কথা কি আপনার চোখে পরে না? যদি একবার আমার আঁখিতে আঁখি রেখে চক্ষুপটে ভেসে ওঠা অব্যক্ত ভাষা পড়তে পারতেন তাহলে আমি হয়তো সবথেকে সুখী রমণী হতাম।
সারহান বিচলিত হলো না।বরং তার দৃষ্টি অধিকতর গাঢ় হলো।অরিত্রিকা শয়নরত সারহানের দিকে তাকালো।সারহানের মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে বললো~ বাদ দিন। শরীর কি খুব খারাপ লাগছে? ডাক্তারকে ডাকবো?
~ দরকার নেই।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ২৭
অরিত্রিকা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।আবারও নিজ কাজে মনোযোগী হলো। আজ হঠাৎ তার কি হলো মানুষটাকে দেখে মনের কথা উগ্রে দেওয়ার ইচ্ছে জাগলো কেনো?এই ভাবনায় বিভোর হলো সে।
সারহান চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধালো~ আমাকে কতোটা ভালোবাসিস ফাইরুজ?