প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ শেষ পর্ব
আদ্রিতা নিশি
“দোস্ত!আমরা দুজনে বিয়ে করলাম অথচ হানিমুনে গেলাম না। না মানে বিষয়টা কেমন কিপ্টামি, ছোটলোকি কারবার হয়ে গেল না!”
সন্ধ্যার পর সবাই কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাড়ি ফিরেছিল। ফ্রেশ হয়ে ঘরোয়া আয়োজনে নতুন বউকে ঘিরে নাচগান, আনন্দ-আসর জমে উঠেছিল। সবকিছু শেষ হওয়ার পর, নানা আচার মেনে টাকার বিনিময়ে নবদম্পতিকে নিজেদের ঘরে পাঠানো হলো। সেইসব আচার শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। তবে সারহান আর আবির এখনো লিভিং রুমে বসে গল্পে মশগুল। কথোপকথনের ফাঁকে হঠাৎ এক প্রসঙ্গে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল সে। আবির ভড়কে গেল এহেন চাহনিতে। সে দুরত্ব বাড়িয়ে বসল। বলা যায় না কখন তার পিঠে তাল ফেলে। হাসার ভাণ করে বলল;
“আসলে বিয়ের পর সবাই হানিমুনে যায় অথচ তুই আর আমি ব্যস্ততার জন্য যেতে পারিনি। ইয়ে মানে এখন হানিমুনটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, ঘুরতে যাওয়াটা বেশী ইম্পর্ট্যান্ট।”
সারহান গাম্ভীর্য ভাব বজায় রাখল। কিয়ৎ ক্ষণ মৌন থেকে প্রতিত্তোর করল ;
“That’s a cool idea!”
আবিরের চোখ মুখ চকচক করে উঠল। কতোদিন পর বন্ধুর মনে তার বলা কথা ধরল। সে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠল। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলল;
“অবশেষে তোর আমার আইডিয়া পছন্দ হলো। আহা! এবার বা*লের কাজ থেকে বিরতি নিয়ে মাইন্ড ফ্রেশ করতে পারব আমরা। ”
সারহান আবিরের উদ্দীপনা দেখেও নির্বিকার রইল। সে জানে, এসব নিয়ে একটু বেশী আগ্রহ প্রকাশ করলে ব্যাটা মাথায় চড়ে বসবে। তখন নামানো মুশকিল হয়ে যাবে। শরীরটা এলিয়ে দিল সোফায়। দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কোথায় যাবি?”
আবির অবাক হয়ে বলল;
“কোথায় যাব মানে? আমি একা বউ নিয়ে যাচ্ছি না। তুই ও যাবি শালিকাকে নিয়ে।”
“কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে?”
“আমার হানিমুনে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল মঙ্গলগ্রহ কিংবা চাঁদে। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেখানে যাওয়া রিক্স হয়ে যাবে। তাই ভাবছি জাফলং, সাজেক বা কুয়াকাটা যাব।”
“এতোক্ষণে মনে পড়ল তুই বাচ্চার বাপ। আমি তো ভেবেছিলাম নতুন বর।”
“তুই আমায় আবার খোঁচাচ্ছিস সারহান!”
আবির গাম্ভীর্যতা টেনে বলল। সারহান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল ;
“জাস্ট সত্যি কথা বলেছি।”
আবির কটমট করে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“বাচ্চার বাপ হয়েছি তাই কি? কোথাও কি লেখা আছে বাচ্চার বাপ হলে হানিমুন করা যাবে না?”
“বিয়ে হয়েছে তিনবছর আগে আর হানিমুন প্ল্যান করছিস তিনবছর পর।”
“তুই রিসেশনের আগে বাচ্চাদের বাপ হয়েছিলি তাতে কিছু হয়নি আর আমি বিয়ের তিনবছর পর হানিমুন প্ল্যান করলে দোষ?”
“তোকে নিষেধ করেছিলাম ওই টপিক না টানতে অথচ তুই….”
“তুই বল আমার প্ল্যানে সামিল হবি নাকি?”
সারহান কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আবির কথা থামিয়ে দিয়ে সিরিয়াস ভাবে বলল। সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। এ ছেলে হঠাৎ হানিমুন নিয়ে কেন পড়ল? যাই হোক, এর ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। সে কন্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলল;
“উহু! আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।”
আবির রাগত স্বরে বলল;
“বুঝেছি তোকে বলে কোনো কাজ নেই। এ বিষয় নিয়ে শালিকার সাথে কথা বলতে হবে।”
“ওকে কেন টানছিস?”
“কারণ তুই বউয়ের আবদার শুনিস।”
“একদম ফাইরুজের মাথায় ওসব ঢোকাবি না। এমনি দু’বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খায়।”
“তুই আমার প্ল্যানে সবসময় পানি ঢেলে দিস সারহান। তুই আর আমার শ্বশুরআব্বা একই কোম্পানির আলাদা প্রোডাক্ট! শ্লা কোনো ইচ্ছের দাম দিস না।”
আবির বিরক্তিসূচক কন্ঠে বলে উঠল। সারহান ভাইসম বন্ধুর দিকে তাকাল। ইশ! বেচারার মুখখানা দেখার মতো হয়েছে। সে নড়েচড়ে উঠল। ভ্রুযুগল গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“সাজেক ভ্যালি, ইনানীতে গেলে মন্দ হয় না।”
আবির অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“তারমানে তুই রাজি?”
“ভেবে দেখলাম বিয়ের পর হানিমুনে যেতে পারলাম না, এবার না হয় বউ বাচ্চা নিয়ে যাই।”
“আরেহ দোস্ত! ধন্যবাদ। সামনে মাসেই কিন্তু যাব।”
“ওকে। সাজেকে ভ্যালি আর ইনানীতে যাওয়ার সব খরচ আমার।”
“না মানে…. এতো করে যখন বলছিস তাহলে সব খরচ তুই কর।”
আবির হেসে বলল। সারহানের ওষ্ঠকোণ প্রসারিত হলো। আজমল সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতেই দেখলেন দুই জামাই বসে আছে। তিনি ঠাটবাট নিয়ে এগিয়ে এলেন। সোফায় না বসে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন ;
“তোমরা দুজন না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?”
সারহান, আবির তৎক্ষনাৎ সামনে তাকাল। আবির শ্বশুরকে দেখে ভড়কে গেল। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হাসার ভাণ করে বলল;
“কথা বলছিলাম।”
“কি কথা?”
“ইয়ে… ইয়ে।”
“ইয়ে ইয়ে না করে বলো। আমিও শুনি রাত জেগে জামাইরা কি গল্প করছে।”
“ওই আব্বাজান হানি…”
কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়েও বন্ধুর তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে থেমে গেল। আজমল সাহেব কৌতূহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন;
“হানি কি?”
আবির আমতা আমতা করে বলল;
“হানিফের মেয়ে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। দুজনে নাকি বিয়ে করে এখন সাজেক ভ্যালি আছে। এসব সহ্য না করতে পেরে বেচারা অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই আরকি সারহানকে বলছিলাম।”
“হানিফ কে?”
“আমার বন্ধুর চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের ফুপাতো ভাইয়ে ননদের ভাসুরের দুঃসম্পর্কের নানার ফুপাতো শালার ছেলে হানিফ।”
আবির ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে খ্রান্ত হলো। আজমল সাহেব হতভম্ব হয়ে গেল সম্পর্কের সমীকরণ শুনে। এ ছেলে নিশ্চয়ই মশকরা করছে। তিনি বিরক্তিবোধ করলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন;
“তুমি আমার সাথে মশকরা করছো? ”
আবির জিভ কেটে মাথায় হাত দিয়ে কসম কেটে বলল;
“আপনি আমার গুরুজন। আমি কি মশকরা করতে পারি বলুন? যদি বিশ্বাস না করেন সারহানকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
আজমল সাহেব সারহানের দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন;
“দরকার নেই।”
কথাটা বলে আজমল সাহেব পুনরায়,সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলেন। সারহান নির্লিপ্ত চাহনিতে পরখ করল। তার ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। ভাগ্য করে শ্বশুর পেয়েছে যাকে শ্বশুরের চেয়ে শত্রুই বেশি মনে হয়। যদিও আগের মতো তীব্র শত্রুতা আর নেই; এখন তিনি নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। আবির কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ, বন্ধুর সেই তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে যদি সে কথা না ঘোরাতো, তবে নিশ্চিত বেইজ্জত হতে হতো। অথচ কত কষ্ট করে সে শ্বশুরের ভরসার জায়গাটা অর্জন করেছে!
“বিয়ের তিনবছর হয়ে গেল অথচ শ্বশুরআব্বার সন্দেহভাজন, বাঁকা চোখে তাকানোর অভ্যাসটা বদলালো না। মাঝে মাঝে মনে হয়, উনার মেয়েদের আমরা বিয়ে করিনি বরং চু*রি করেছি।”
আবির হতাশার শ্বাস টেনে বলল। সারহান ওষ্ঠ প্রসারিত করে বলল;
“চু*রি না ডা*কাতি করেছি। তাই উনি সারাক্ষণ সিরিয়াস ভাবে থাকেন।”
আবির বলল,
“তা ঠিক। চৌধুরী বাড়িতে সবার অগোচরে কতো কি হয়ে গেছে তা ডাকাতির থেকে কম মনে হয় না। যেমন : তুই আজমল চৌধুরীর ছোট মেয়েকে দিন দুপুরে ডাকাতি করে বিয়েটা করলি। আমিও তেমনটা করে অরিনকে বিয়ে করলাম। দুই মেয়ের এমন বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি।”
“মেনে নিয়েছে। কিন্তু মুখে স্বীকার করে না।”
“একদম ঠিক বলেছিস। ”
“আমি যাচ্ছি।”
“এই কোথায় যাচ্ছিস? আমার এখনো কথা শেষ হয়নি।”
আবির হম্বিতম্বি করে বলে উঠল। সারহান হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিল। সময়টা এগারোটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। সে তির্যক চাহনিতে চাইল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“কি বলবি দ্রুত বল।”
আবির দম ফেলে আমতা আমতা করে বলল;
“প্রাক্তন এমপির মেয়ে আছে না? নামটা ভুলে গেছি। ওই মেয়ে সেদিন আমায় কল দিয়ে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।”
সারহানের মেজাজ বিগড়ে গেল৷ তবুও সংযত কন্ঠে বলল;
“তোর এসব ফালতু কথা শুনতে আমি আগ্রহী নই। ”
“সত্যি দোস্ত! তোর খোঁজ খবর নিচ্ছিল।”
“তোর কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই, সারাক্ষণ বাচালের মতো বকে চলিস।”
“আরে সম্পূর্ণ কথা না শুনে রিয়েক্ট করছিস কেন? শোন, আমি মেয়েটার কথার ধরণ শুনে মনে করেছিলাম তোকে পছন্দ করে কিন্তু পরে জানতে পারলাম…
“পরে জানতে পারলি মিটিং ফিক্সড করার জন্য কল দিয়েছে। অ্যাম আই রাইট?”
“ইয়েস, ইয়েস।”
মেঘাচ্ছন্ন অম্বরের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে অর্ধচন্দ্র। ধূসর-সাদা মেঘপুঞ্জ কখনো তাকে ঢেকে দিচ্ছে, আবার মুহূর্তেই উন্মুক্ত করে দিচ্ছে সেই অর্ধচন্দ্রকে। চর্তুদিকে রোমাঞ্চকর পরিবেশ বিরাজ করছে। শীতল হাওয়ার ছোঁয়া আর দূর থেকে ভেসে আসা বুনো ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে চারপাশ।সারহানের ঘরের বারান্দায় টিপটিপ রঙিন লাইটগুলো জ্বলছে। টবভর্তি ফুলগাছের ডালে ডালে হাওয়ার দোলায় ফুলগুলো কেঁপে উঠছে। এক কোণে রাখা ছোট্ট টেবিল, দু’পাশে পাশাপাশি সাজানো দুটি চেয়ার। টেবিলের ওপরে জ্বলছে একখানা ডিজাইনার মোমবাতি।তার শিখা বাতাসে দুলে দুলে নেচে উঠছে।
ঠিক পাশে রাখা দুটো মগ, গরম কফির ধোঁয়ায় ভরে উঠছে।অরিত্রিকা একপাশের চেয়ারটিতে বসে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় অপেক্ষা করছিল সারহানের। তবে তার আনমনা দৃষ্টি বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে সুদূর অম্বরে ঝলমল করা অর্ধচন্দ্রের দিকেই নিবদ্ধ । সেই দৃশ্যের সৌন্দর্যে মন শান্ত হয়ে এলো। তার ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হলো হালকা হাসিতে, সুশ্রী মুখখানায় ফুটে উঠল প্রাণোচ্ছলতার আভা।ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে তার মনে এক প্রশ্ন জাগল;চাঁদের তো নিজস্ব আলো নেই, তবু সে এত সুন্দর! সূর্যের নিজস্ব আলো আছে, অথচ তাতে এমন মোহ নেই। সূর্যের আলোয়ই চাঁদ আলোকিত হয়, কিন্তু মানুষ সূর্যকে ভুলে গিয়ে চাঁদেরই প্রশংসা করে। আসলে সমীকরণটা অন্যভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়;একজন নারী তার প্রেমিক পুরুষ, তার অর্ধাঙ্গ ব্যতীত অপূর্ণ। আর সেই মানুষটি যদি পাশে থাকে, তবে তবেই সে সত্যিকার অর্থে পূর্ণতা পায়। সে ডাগর আঁখিযুগল ঝাপটালো। এ মনোমুগ্ধকর আবহে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল —
❝জানিনা আমি, জানো কি তুমি
কীভাবে প্রেমেতে পড়েছি আমি
সাদা কালো প্রেম প্রথম প্রথম
ঠোঁটের কোণে হাসি লাজুক নরম
এলোমেলো ভাবনা ভেবে গোবেচারার মন
জেনেশুনে ভীমরতিতে গেছে তখন
বোকা আমি নাকি বোকা এ মন
হৃদয়ে জোরালে আমায় কখন
উনিশ কি কুড়ি সবে আমার তখন
ডুবেছিল তোমাতে এ মন ❞
সারহান রুমে প্রবেশ করতেই দেখল অরিত্রিকা রুমে নেই। বাচ্চারা বিছানায় গভীর ঘুমে মগ্ন। তার কপাল কুঁচকে গেল। মেয়েটা কোথায় গেল। সে বাহিরে পা বাড়াবে এমন সময় গানের ক্ষীণ স্বর ভেসে আসতেই থেমে গেল। তড়িৎ বেগে তাকাল বেলকনির দিকে। দরজাটা খোলা, গুনগুন করে গাওয়া মেয়েলী কন্ঠের গান সেখান থেকে ভেসে আসছে। সে পা বাড়ায়। নিঃশব্দে বেলকনির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির হয় গোল্ডেন কালারের শাড়ি পরিহিত অরিত্রিকার পানে। টিপটাপ লাইটগুলোর আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল আনমনা ভঙ্গিতে বসে থাকা রমনীকে। সেসবকে ছাপিয়ে কানে ধরা দিল মেয়েলী সুমিষ্ট গলার গান। মুহুর্তেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভর করল বিমোহন, মুগ্ধতা। সে বুকের নিচে দুহাত গুঁজে দেয়ালে ঠেস দিয়ে একচিত্তে চেয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় উপভোগ করতে লাগল নিভৃতসুধার গান।
অরিত্রিকার গান শেষ হতেই নাসারন্ধ্রে ভেসে এলো পুরুষালী পারফিউমের গন্ধ। মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে সামনে তাকাল সে। দেখে সারহান দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর অভিমানের ঢেউ জাগল; জাগারই কথা। রাত অনেকটা পেরিয়ে গেছে, অথচ মানুষটা ঘন্টাখানেক দেরিতে এসেছে। এমন বিশেষ মুহূর্তে কেউ কি এভাবে করে? সে অভিমানী মুখখানা নত করে নিশ্চুপ হয়ে রইল।সারহান তার এহেন আচরণে খানিকটা বিস্মিত হলো। তারপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে চেয়ারটিতে বসল। তার দৃষ্টি হঠাৎ স্থির হলো টেবিলের ওপরে রাখা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফির মগগুলোর দিকে। মুহুর্তে আবির ওপর মনে মনে চটলো।ওর জন্য রুমে আসতে দেরী হয়েছে। এ কারণে তার বিবিজান মন খারাপ করেছে।
“ফাইরুজ..”
সারহান নমনীয় কন্ঠে ডাকল। কিন্তু অরিত্রিকা নেতাসাহেবের পানে তাকাল না। মাথা নত করে গমগমে কন্ঠে বলল;
“কয়টা বাজে?”
সারহান ভাবমূর্তি পর্যবেক্ষণ করে বুঝল মেয়েটার মনটা খারাপ।সে তাড়াতাড়ি আসতে চেয়েছিল কিন্তু আবিরের পাল্লায় পড়ে দেরী হয়ে গেছে। সে তপ্ত শ্বাস ফেলল।কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলল;
“একটা বাজে।”
“আজ কয় তারিখ?”
“সেপ্টেম্বর মাসের বিশ তারিখ।”
“আজকের তারিখটা আমাদের জন্য স্পেশাল। আমি ছোট্ট করে সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম অথচ আপনি সব ভুলে গেছেন। এমনটা আপনার থেকে আশা করিনি নেতাসাহেব।”
“আজকের তারিখটা স্পেশাল কেন?”
সারহান আগ্রহী কন্ঠে জানতে চাইল।অরিত্রিকার অভিমান গাঢ় হলো।তার চক্ষুদ্বয়ে ভীড় করল নোনা জলে।তারমানে মানুষটা ভুলে গেছে?ভুলেই তো যাবে।সে নাক টেনে ভেজা নেত্রপল্লব উঁচিয়ে তাকাল।মুখ ভার করে বলল;
“আপনার জানতে হবে না।”
কথাটা বলে অরিত্রিকা রেগেমেগে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সে এক মুহুর্ত দেরী না করে পা বাড়াল রুমের দিকে। বেলকনির দোরগোড়ায় পা রাখতেই আঁচলে টান পড়তেই থেমে গেল।তড়িৎ বেগে তাকাল পেছনে;দেখল সারহান তার শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছে। সে শাড়ির আঁচল ধরে টানতে লাগল। শেষে না পেরে অভিমান মিশ্রিত ভেজা কন্ঠে বলল;
“আমার শাড়ির আঁচল ছাড়ুন।”
সারহান আঁচল ছাড়ল না; বরং হাতের মধ্যে তা পেঁচাতে পেঁচাতে উঠে এসে অরিত্রিকার সামনে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে অন্য হাত বাড়িয়ে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তমার শরীর। নিগূঢ় দৃষ্টিতে নিবিড়ভাবে দেখল তার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী। অরিত্রিকা প্রাণপণ চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে, কিন্তু পুরুষালি শক্তির সঙ্গে পেরে উঠল না। শেষমেশ অসহায় অভিমানে চুপচাপ স্থির হয়ে রইল। সারহান খানিকটা ঝুকে আসলো।মেয়েলী কানের কাছে মুখটা নিয়ে সুগভীর কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল;
“Three years ago, you became my forever. Today, I love you even more than I did on that day. Happy 3rd Anniversary, my Bibijan.”
অরিত্রিকা চকিত নয়নে তাকাল। বিস্ময়াভিভূত হয়ে অস্ফুটস্বরে আওড়ালো ;
“তারমানে আপনার মনে ছিল?”
সারহান হাসল;
“আজকের দিনে যাকে নিজের করে পেয়েছি সেই দিন কীভাবে ভুলে যাই?”
অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলে উঠল;
“আপনি মিথ্যা বলছেন। মনে থাকলে কেউ একটার পরে উইশ করে?”
“সবাই তো বারোটার পরে উইশ করে। আমি একটায় উইশ করলাম।”
“যদি মনে থাকতো তাহলে আমার গিফট কোথায়?”
“আমিই তোর গিফট । অন্য গিফটের প্রয়োজন নেই।”
সারহান ওষ্ঠ প্রসারিত করে অতি সুগভীর কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকা হতবাক হয়ে গেল। এ মানুষটা সত্যি অতি মাত্রায় চালাক। সে নাক ফুলিয়ে অন্যত্র তাকাল। তখুনি শুনতে পেল পুরুষালি অতি শান্ত কন্ঠস্বর—
“The surprise you gave me and the song you sang were the most precious anniversary gifts. They will forever remain in my heart as unforgettable memories.”
অরিত্রিকার অভিমান কমল বোধ হয়। তবুও প্রকাশ না করে বিরবির করে বলল;
“ইংরেজ কোথাকার! আজকের দিন মনে নেই অথচ এমন ভাবে শুভেচ্ছা, প্রশংসা করছে যেন মনে আছে।”
সারহান কিছুটা অস্পষ্ট শুনল। ওষ্ঠ কামড়ে হেসে হঠাৎ অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে রুমের ভেতর চলে গেল। অরিত্রিকা থমকে গেল;মানুষটা এভাবে হঠাৎ চলে গেল কেন? উনি কি তবে রেগে গেলেন? মন খারাপ করলেন? এমন ভাবনার ঘূর্ণিপাকে ডুবে ছিল সে। ঠিক তখনই সারহান ফিরে এলো। এসে বেলকনির সাদা লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। আচমকা সাদাটে আলো চোখে পড়তেই অরিত্রিকা চোখ দু’টো কুঁচকে নিল।
“My beloved Bibijan, here’s a little gift from my heart, just for you.”
অরিত্রিকা ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই মুহূর্তেই থমকে গেল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সারহানের হাতে ধরা গোলাপের তোড়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ফুলের রঙিন সৌন্দর্য ছাপিয়ে তার চোখ আটকে গেল একটা হলদে খামের ওপরে। খামের গায়ে খোদাই করা চেনা নামটি চোখে পড়তেই তার নিঃশ্বাস গলায় আটকে এলো। উত্তেজনায় তার শরীর কেঁপে উঠল, অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। মনে হলো আজকের রাতটা সত্যিই বিশেষ কোনো চমক নিয়ে এসেছে। সে কল্পনাও করেনি মানুষটা এমন অমূল্য উপহার লুকিয়ে রেখেছিল তার জন্য। তারমানে নেতাসাহেব তাদের বিবাহবার্ষিকী ভুলে যায়নি। অশ্রুভেজা চোখে হঠাৎই সে ছুটে গিয়ে আঁকড়ে ধরল সারহানের শরীর।
প্রিয় নিভৃতসুধা,
আমার শুদ্ধ ফুল, আমার সুখ—
‘প্রিয় নিভৃতসুধা’ সম্বোধনটা আমি ভালোবেসে লিখলাম। যদিও তোকে নাম ধরে ডেকেছি, কিন্তু কখনো প্রণয়পূর্ণ ভঙ্গিতে তোকে সম্বোধন করিনি। আশা করি, খুব শিগগিরই সেই দিন আসবে, যেদিন তোকে ‘প্রিয়’ শব্দটি উচ্চারণ করার অধিকার পাব। সেদিন আমি হবো শহরের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আর আমার খুশি হবে সবার থেকে কিছুটা ভিন্নতর, অনন্য।
আজ গভীর রাতের নীরবতায় তোকে অদ্ভুতভাবে মনে পড়ছে। এই নিঃসঙ্গতায় নিজের অন্তর্গত অনুভূতিগুলো চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তাই বিক্ষুব্ধ, অশান্ত, থিতিয়ে ওঠা মন নিয়ে জীবনে প্রথমবার, হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা না বলা কথাগুলো সাদা কাগজে উন্মুক্ত করছি। অদ্ভুত লাগছে, কিন্তু লিখতে হবে। কারণ তোর থেকে দূরে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠছে। এ অব্যক্ত যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে অসহ্য অনুভূতি সাদা পৃষ্ঠায় লিখে অভ্যন্তরীণ সত্তাকে শান্ত করা অতিব জরুরী। জানিস , কত না বলা কথা জমে আছে তোকে বলার। প্রতিটি ক্ষণে তোর স্মৃতি মানসপটে ভাসে, আর আমি হারিয়ে যাই সেই পুরোনো দিনগুলোর মাঝে। তুই সেই সপ্তদশী কিশোরী, যে আমার এ মনে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে অজান্তেই রাজত্ব চালিয়েছিস।
আমায় ক্ষণে ক্ষণে বাধ্য করেছিস তুই নামক গুপ্ত সুধাতে আসক্ত হতে। আসক্ত হয়েছি, অগোচরে প্রণয় সাগরে ডুবেছি, মায়ামোহতে পড়ে নিজের অস্তিত্ব ভুলে বসেছি। এ নির্জন রাতেও তেমনটাই অনুভব করছি। সারাক্ষণ তোকে মনে পড়ে নিভৃতসুধা! শোন, তোকে না জানিয়ে এ নামটা দিয়েছি। পরে যদি জানতে পারিস কিছু মনে করিস না। আমার সম্বোধন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করিস না। নিভৃতসুধা— যে আমার গুপ্ত প্রশান্তি! যাকে মনে পড়লে আমার সব কষ্ট নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। কঠোর মনটা নরম হয়ে আসে। কিছুদিন ধরে আমার মনে অদ্ভুত প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটেছে! আমার মতো পাষান্ড হ্দয়ের যুবক তোর মতো কোমল ফুলের ন্যায় মেয়েকে কিভাবে ভালোবাসলো? কিভাবে অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছি, কিন্তু পায়নি । তুই কি উত্তর দিতে পারবি? কোনে একদিন এ প্রশ্নের সম্মুখীন করব তোকে।
সেদিন উত্তর জানলে জানিয়ে দিস বুঝলি! সময়ের কর্কশ স্রোতে আমার সুখ, হাসি আর আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে অথচ সেসব শোনার মতো কেউ নেই। আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই। নিজেকে ভাঙছি, গড়ছি,কিন্তু দিন শেষে আমি নিঃস্ব। তোকে ছাড়া আমি ছয়মাস কাটিয়ে ফেললাম। তুই হীনা কতো কষ্ট,যন্ত্রণায় আছি তা কি জানিস? উহু জানিস না। কারণ তুই আমার আশে পাশে নেই। সবার খোঁজ খবর নিলেও আমায় ঘৃণা করিস অথচ সেই ঘৃণাকে পরোয়া না করে তোকে ভালোবাসি, আজীবন ভালোবেসে যাব। তোর প্রতি এ নামহীন অনুভূতির নাম কি দেওয়া যায়? একপাক্ষিক ভালোবাসা! যেদিন তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি, সেদিন তোর চঞ্চল হরিণীর ন্যায় দু’চোখে ভেসে উঠেছিল অসহনীয় যন্ত্রণা,তোর হৃদয়ে জন্ম নিয়েছিল ভুল বোঝাবুঝির অনাস্থা। সেই সামান্য ভুল আমাদের পথকে এত দূরে সরিয়ে দিল যে, মনে হলো আর কখনো তোকে পাওয়া সম্ভব নয়। সেই স্মৃতি আজও আমাকে ব্যথিত করে।তোর চোখের অনুপম দৃষ্টি যদি আমার সামনে আসত, হয়তো আমি এভাবে ভেঙে পড়তাম না। তোর শ্রুতিমধুর কথা যদি শুনতে পেতাম, হয়তো আমি এতটা শূন্যতা অনুভব করতাম না। তুই কি ভাবতে পারিস, একজন মানুষ তার পুরো জীবন একটি নামের জন্য উৎসর্গ করে, আর সেই নামই হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের কারণ। আমার অস্তিত্বের কারণ আর সেই নাম ‘তুই ফাইরুজ।’
এই গভীর রাতে আমি শুধু বলবো, যদি কখনো তোর চোখে অতি ঘৃণায় অশ্রু নেমে আসে, তবে জানিস, আমি এখনও কোথাও আছি হয়তো কোনো অলিখিত চিঠির পাতায়। সারাজীবন যদি তুই আমায় ঘৃণা কিংবা অপছন্দ করিস। তবুও আমি সেই ঘৃণা, অপছন্দতে থেকেও তোকে ভালোবাসবো। তুই আমার তকদিরে থাকিস আর না থাকিস, তবুও তোকে আমি পাওয়ার আশা ছাড়তে পারব না। এ দেহে প্রাণ থাকা অব্দি তোকে আমার না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। এই যে আমায় একা চলে গেছিস তবুও তোর অগোচরে খোঁজ খবর নিচ্ছি, গোপনে ভালোবাসছি। ভাবতেই অবাক লাগে ফাইরুজ তোকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে গেছি। সারহান ইদায়াত চৌধুরী তুই হীনা ক্ষণে ক্ষণে মরছে। তবুও শেষ কথা বলবো; ভালোবাসি নিভৃতসুধা, ভালোবাসি ফাইরুজ।
ইতি,
তোর অপেক্ষায় থাকা অপ্রিয় একজন
০১.০৯.২০২১
অরিত্রিকা চিঠিটা বারবার পড়ল। চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত, বিস্ময়ে ভরা!এই চিঠিটা লেখা হয়েছিল তিন বছর আগে। কতটা যত্ন, কতটা আন্তরিকতায় সারহান ভাই তার মনের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল সাদা পাতার প্রতিটি অক্ষরে! অথচ সেই মানুষটিই দিনের পর দিন নিঃশব্দে দহন সয়েছে, নিজেকে পুড়িয়ে এসেছে, তবুও কোনোদিন টের পেতে দেয়নি।ভাবতে ভাবতে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল অরিত্রিকা;কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে গেছে মানুষটা। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে তলিয়ে গেল তার মন। প্রতিটি শব্দ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কাগজে লেখা নয়,তার প্রিয় পুরুষের নিঃশ্বাস ভেজা আর্দ্র কণ্ঠস্বর বাজছে কানে। প্রতিটি বাক্যে অনুভব করাচ্ছিল সেই মুহূর্তের অস্থিরতা, দহন আর গভীর ভালোবাসা।ভাগ্য কেন এতদিন নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে, সে উত্তর খুঁজে পেল না অরিত্রিকা। তবে শেষ পর্যন্ত প্রিয় মানুষকে পেয়েছে এটাই অনেক। চিঠিটা যত্ন করে ভাঁজ করল, আবার পুরোনো হলুদ খামে ভরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তার মনে হলো, জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো এই একটিমাত্র উপহারে,এটাই তার সবচেয়ে অমূল্য প্রাপ্তি।
“সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের এক তারিখ। এই দিনটাকে চিঠি দিবস উপলক্ষে অনেকে উদযাপন করে। আমার মনটা সেদিন ভীষণ বিষন্ন। তাই ভাবলাম মনকে শান্ত করতে আর চিঠি দিবস উপলক্ষে প্রিয় মানুষকে চিঠি লিখলে মন্দ হয় না। আমি কোনো দিন প্রেমিক টাইপের কান্ড করিনি। তবে সেদিন করেছিলাম।”
সারহান বিমুগ্ধ নয়নে অরিত্রিকার পানে তাকিয়ে অতি শান্ত কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা নেত্রপল্লব তুলতেই পূর্ণ দৃষ্টিতে ধরা দিল প্রিয় পুরুষটির অবয়ব। বাইরে তখন দমকা হাওয়ার ঝাপটা, শীতল বাতাস হুরহুর করে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে দু’টি হৃদয়কে। হাওয়ার সেই ছোঁয়ায় মেয়েলী দেহ কেঁপে উঠল, অজানা অনুভূতিতে ভিজে গেল তার সত্তা।মুহূর্তেই উপলব্ধি করল কতটা গভীর সেই কথাগুলো, কতটা সত্য সেই আবেগ! কারণ সে জানে, এক গম্ভীর মানুষ সহজে মনের কথা প্রকাশ করে না; কিন্তু তার নেতাসাহেব আজ সেই কঠিনটুকু ভেঙে হৃদয়ের গভীরতা উন্মোচন করেছে।চিঠিটা টেবিলের ওপর রাখা ফুলেল বুকের পাশে রাখল অরিত্রিকা। তারপর নিঃশব্দে দু’পা এগিয়ে গেল সারহানের দিকে।
“যদি বুঝতে পারতাম আপনি আমাকে এতোটা ভালোবাসেন, তবে আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার মতো সাহস করতাম না আমি।”
অরিত্রিকা কথাগুলো বলে নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। সারহান দু’হাতে আগলে নিলো মেয়েলী শরীরটা। দৃঢ় ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল। এক হাত খোলা চুলের ভাঁজে আলতো করে ডুবিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল;
“আজকের দিনে কেউ কাঁদে?হুম!”
অরিত্রিকা পুরুষালি প্রশস্ত বুকে মাথাটা মিশিয়ে ভেজা কন্ঠে থেমে থেমে বলল;
“আচ্ছা কাঁদব না।”
“চিঠি পড়ে কেমন অনুভব করলি?”
“আপনার ভালোবাসা কতটা গভীর, তা আমি পুরোপুরি অনুভব করতে পেরেছি।”
অরিত্রিকা লাজুক ক্ষীণ কন্ঠে বলল। সারহান চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে দিল। সেই চুলের মন মাতানো সুবাসে যেন ঘোরে আচ্ছন্ন হলো তার সমগ্র অস্তিত্ব। তার অমসমণ হাতের অবাধ্য স্পর্শ ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে লাগল অরিত্রিকার মেদহীন কোমরে। গভীর সেই ছোঁয়ায় অরিত্রিকা কেঁপে উঠল বারবার; দু’হাতে আঁকড়ে ধরল সারহানের সুঠাম দেহ, শুভ্র পাঞ্জাবির ভাঁজে লুকোতে চাইলো তার অস্থিরতা। মুহূর্তেই দু’টি সত্তা হয়ে উঠল অবাধ্য, অনিয়ন্ত্রিত। হঠাৎ করেই সারহান তাকে কোলে তুলে নিল। ভয়ে অরিত্রিকার চোখ মুখ কেঁপে উঠল, গলা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে যেন না ধরলে পড়ে যাবে। পুরুষালি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে এল তার সুশ্রী মুখপানে; সেই দৃষ্টি ছিল নিগূঢ়, সম্মোহনী আর ঘোরে ভরানো। সেই চাহনি অরিত্রিকার ভেতরে অজানা কাঁপন তুলল।
“আর?”
সারহান জানতে চাইল।অরিত্রিকা কাজল কালো আঁখি তুলে তাকাতেই তার সর্বাঙ্গে কাঁপনের মাত্রা বাড়ল। কি জবাব দিবে তা নিমেষে ভুলে গেল। গভীর নদীর মতো সেই নয়নপল্লবে চোখ রাখতেই সারহানের বেখেয়ালি মন সম্মোহনের আবেশে হারিয়ে গেল। তার নিগূঢ় চাহনি স্থির হলো অরিত্রিকার কম্পমান গোলাপি ওষ্ঠে। কেন যেন তা আফিমের ন্যায় টানল।সে বেসামাল মন নিয়ন্ত্রণ না করে ধীরে ঝুঁকে এসে গাঢ় উষ্ণ ছোঁয়া দিল গোলাপী ওষ্ঠদ্বয়ের ভাঁজে। মুহূর্তেই অরিত্রিকার শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো শিহরণ বয়ে গেল, রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেগে উঠল অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির জোয়ার। সেই ছোঁয়া স্থায়ী হলো দীর্ঘক্ষণ।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৫
মেয়েলী দেহখানা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠল আবেগে। কিছু সময় পর সারহান মুখখানা সরিয়ে চোখ তুলে লাজে নত অরিত্রিকার দৃষ্টি একঝলক অবলোকন করল, অতঃপর ধীরপায়ে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। মেয়েলী লাজে রাঙা মুখে সতৃষ্ণ চাহনি স্থির রেখে হঠাৎ আবেশিত দৃঢ় কন্ঠে বলল;
❝সব রূপে, সর্বক্ষণ, সারাজীবন— আমি সারহান ইদায়াত চৌধুরী তোকে ভালোবাসব, ভালোবেসে যাব।তুই আমার জীবনের পূর্ণতা, আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোর নাম লেখা।আমি যতদিন বেঁচে থাকব এই হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন শুধু তোর জন্যই ধ্বনিত হবে, নিভৃতসুধা।❞