প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৭
আদ্রিতা নিশি
সারহান শান্ত চাহনিতে অরিত্রিকার ফর্সা গালের দিকে অপলক চেয়ে রইল। থাপ্পড় দেওয়ার কারণে ডান গালে আঙুলের ছাপ ফুটে উঠেছে। সেই স্থান লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কিছু স্থানে রক্ত জমে গেছে। দেখতে কেমন যেন বিভৎস লাগছে। সারহান সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে গভীর চাহনিতে। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে। অতপর চক্ষু মেলে সযতনে ওষ্ঠ কোণের ক্ষতস্থানে এবং গালে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দেয়। কার্য সম্পূর্ণ করে অ্যান্টিসপেটিক ঔষধ ফার্স্ট এইড বক্সে রাখল।
পুনরায় বক্সটি যথাস্থানে রেখে বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিল হতে টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু নিলো। নিগূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে টিস্যু ভাজ করে আলতো হাতে নিঃশব্দে অরিত্রিকার মুখশ্রী মুছিয়ে দিতে লাগল। কান্নার ফলে মুখে নোনা পানির বিন্দু শুকিয়ে গিয়েছিল সেগুলো পরিষ্কার করার প্রয়াস চালালো। সারহান ডান গালে টিস্যু স্পর্শ করতেই অরিত্রিকা ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েছে। মৃদু আর্তনাদ করল চক্ষু বন্ধ অবস্থায়। কিছুটা নড়েচড়ে অন্যপাশ ঘুরে শুয়ে পড়ল। সারহান নিরব চাহনিতে দেখল শুধু। গুটিয়ে নিলো তার হাত। হাতের মুঠোবন্দী টিস্যু পিষ্ট করে মেঝেতে ফেলল। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অদ্ভুত হাসল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ সে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ষ্টুপিড মেয়েটার জন্য মায়া দেখিয়েছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। এসব দরদ, সহানুভূতি তার ধাঁচে নেই। কিন্তু মনুষ্যত্ব হয়তো বেঁচে আছে তার মাঝে। এই জন্যই হয়তো তার মতো মানুষের মনে একটু হলেও সহানুভূতি জন্মেছে। সে থাপ্প*ড়টা মা*রতো না কিন্তু অরিত্রিকার গলা উঁচিয়ে তাকে অপমান করার জন্য প্রাপ্য হিসেবে থা*প্পড় দিয়েছে। তার মাঝে মোটেও এসব নিয়ে অনুশোচনা হচ্ছে না। সারহান রুমের লাইট অফ করে দেয় এবং ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুমের বাহিরের দিকে। দরজার কাছে এসে হঠাৎ থেমে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় আবার অরিরিকার দিকে।অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে বাহির হতে হালকা আলো জানালার গ্লাস ভেদ করে আসছে। সে আলোয় মেয়েটার আবছা প্রতিবিম্ব পরিলক্ষিত হলো। দৃঢ় চাহনি ফেলে শান্ত কন্ঠে আওড়ালো ;
“ দৃষ্টির আয়তনে থাকলেও কিছু সত্য চিরকাল অদৃশ্য থেকে যায়। আর সে অদেখা সত্যগুলো আড়ালেই থাকাই শ্রেয়। কারণ প্রকাশ পেলেই তা আমাদের অন্তরে নিঃশব্দ আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যা প্রতিনিয়ত পুড়িয়ে ছাই করে অনুভূতির গভীরতম স্তর।”
সারহান আর দাঁড়ায় না সেথায়। নিঃশব্দে পা বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় দ্রুত। সাদাত তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু চক্ষুদ্বয় মেলে সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় আসতেই কারো উপস্থিতি পেলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরে হঠাৎ কারো আগমনে বেশ ভয়ও পেল। কিন্তু তা প্রকাশ না করে দ্রুত সিঁড়ি ডিঙিয়ে এসে চারপাশে তাকাল। হালকা আলোয় সারহানকে অরিত্রিকার রুমের সামনে থেকে হেঁটে আসতে দেখ আশ্চর্যিত হলো। আগ বাড়িয়ে পেছন থেকে ডাকল সে।
“ ভাই? ”
সাদাতের কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই তৎক্ষনাৎ থেমে যায়। কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু বাঁকিয়ে পেছনে তাকায়। তীক্ষ্ণ একজোড়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকায়। সাদাত চঞ্চল পায়ে এগিয়ে যায় ভাইয়ের দিকে। গলা ঝেড়ে প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠে ;
“ ভাই তুমি এতো রাতে কী করছো এখানে? ”
সারহান একমুহুর্ত দেরী না করে ভরাট কন্ঠে উত্তর দেয় ;
“ আমি কি করছিলাম সেসব বাদ দে। এবার বল তুই এতো রাতে না ঘুমিয়ে উপর নিচ ছোটাছুটি করছিস কেনো?”
সাদাত হচকচিয়ে যায়। সে কী করে বলবে লিভিং রুমে বসে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলো। এটা বললে ঝাড়ি খেতে হবে এটা সে খুব ভালো করে জানে। হাসার ভাণ করে বলল;
“ আসলে ভাই লিভিং রুমে বসে টিভিতে খেলা দেখছিলাম। ”
“ খেলা দেখছিলি নাকি অন্য কিছু করছিলি? ”
“ সত্যি ভাই খেলা দেখছিলাম। ”
“ কারেকশন কর এন্স্যারটা। টিভিতে খেলা দেখছিলি না বরং ফোনে মেয়েদের মন নিয়ে খেলছিলি। ”
সাদাতের মুখ হা হয়ে গেছে। এই মানুষটার থেকে নিজের কর্মকান্ড লুকালেও ঠিকই ধরা পরে যায়। তারমানে ভাই তার পেছনে স্পাই লাগিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে শান্তি নেই, বাহিরে শান্তি নেই সে যাবে কোথায়? দুই বছর আগে সব ভার্সিটিতে এডমিশন দিয়েছিল। ভেবেছিলো দূরে কোনো ভার্সিটিতে টিকে গেলে সারহানের তীক্ষ্ণ নজর থেকে বাঁচতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টো রাজশাহী ভার্সিটিতে শুধু চান্স পেলো আর বাকিগুলাতে ডাব্বা। একেই বলে ঘরের মুরগী বাহিরে গিয়ে ডিম পারতে পারে না। একরাশ বিরক্তিতে মুখ ভার হয়ে এলো।
“ ভাই এবার অন্তত শান্তি মতো প্রেমটা করতে দাও। একটু তো বোঝো তোমার ছোট্ট ভাই এখন বড় হয়ে গেছে। আর কয়েকমাস পরে বিয়ের বয়স পড়বে। ”
সাদাত মুখ ভার করে ধীর কন্ঠে বলে উঠল। সারহান তা শুনে মুখাবয়ব অতিশয় শক্ত করলো। গমগমে কন্ঠে বলল;
“ এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনা ভালোভাবে কর। এবার যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে তোর শখের বাইকের চ্যাপ্টার ক্লোজড করে দেবো। ”
সাদাত চমকে উঠে। আহারে তার শখের বাইকের ওপর তার ভাইয়ের কুটিল নজর পড়েছে। এবার ভালোভাবে পড়াশোনা করে রেজাল্ট ভালো করতে হবে নয়তো বাইক শেষ। সে তড়িঘড়ি করে বলল;
“ আচ্ছা ভাই এবার ডিপার্টমেন্টে টপ করে দেখাবো। তুমি প্লিজ আমার শখের বাইক টার দিকে নজর দিও না। ”
“ গুড। ”
“ ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“ কর।”
“ তুমি কী অরিত্রিকার রুমে গিয়েছিলে? ”
“ তুই আমাকে রুমে ঢুকতে দেখেছিস?”
“ নাহ।”
“ তাহলে এমন বেহুদামার্কা কথা বলার সাহস কিভাবে হলো তোর? ”
সারহানের কন্ঠস্বর কঠিন এবং দৃঢ়। সাদাত ভয়ে ঢোক গিললো। কীভাবে বড় ভাইকে এমন কথা জিজ্ঞেস করে ফেললো। সে জানে সারহান কেমন ধরনের মানুষ। নিজের মাঝে অনুতাপ হলো। মাথা অনুতপ্তার রেষ এঁটে বলল ;
“ সরি ভাই।”
সারহান নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। সেদিকে যেতে যেতে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ নিজের রুমে যা। ”
সাদাত মন খারাপ করে সেথায় দাঁড়িয়ে সারহানের দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের আবরণ সরিয়ে সূর্যের সোনালি আলো ধরণিকে আলিঙ্গন করেছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখিরা ডানা মেলে ছুটেছে নিজ নিজ গন্তব্যের পথে। নরম রোদের কোমল ছোঁয়ায় শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে, আর ঘুমঘোর কাটিয়ে মানুষজন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞে।শান্ত নগরী কয়েক ঘণ্টা আগেও ছিল নিশ্চুপ ও নিথর। তা আবারো গুঞ্জনে মুখরিত হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির সরব উপস্থিতি পথচারীদের তাড়া, বিক্রেতাদের ডাক সব মিলিয়ে শহর যেন নতুন দিনের কোলাহলে সজীব হয়ে উঠেছে এবং অনিবার্য ছন্দে প্রবাহিত হচ্ছে জীবনের গতি।
চৌধুরী নিবাসে সকাল থেকে হইহই রইরই অবস্থা। অরিত্রিকা হঠাৎ জ্বরের কবলে পড়ায় গুঞ্জন রটেছে বাড়ির সকলের মাঝে। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব অফিসে না গিয়ে বাড়িতে রয়েছেন। তানিয়া বেগম আর সাথী বেগম অরিত্রিকার যত্ন নিচ্ছেন সকাল থেকে। অরিনের ইমপোর্টেন্ট ক্লাস থাকায় বোনকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে ছুটেছে কলেজে। ইশরা এবং সাদাত কেউ তাদের ভার্সিটিতে যায় না। দুজনের ভীষণ মন খারাপ। ইসমা বেগম এবং ইরফান বাড়িতে নেই। তারা দুজনে গতকাল সন্ধ্যায় বগুড়াতে গিয়েছেন একটা কাজে।
অরিত্রিকা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। পুরো শরীরে কম্ফর্টার জড়ানো। একঘন্টা আগেও জ্বর কম ছিল কিন্তু জ্বরের প্রকোপ পুনরায় বেড়েছে। শরীর অধিক দুর্বল হয়ে গেছে।পুরো শরীরে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রতিটি অঙ্গ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। মুখাবয়ব মলিন এবং ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। ইশরা মন খারাপ করে অরিত্রিকার পাশে বসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে রাতে তো অরিত্রি সুস্থ ছিলো তবে হঠাৎ করে জ্বর কীভাবে আসলো। আর ঠোঁট আর গালে আঘাতের চিহ্ন! সাদাত মেঝেতে ছোট একটা কার্পেট বিছিয়ে বসে লেভিকে ক্যাটফুড খাওয়াতে ব্যস্ত।
“ এই অরিত্রিকা সত্যি করে বলতো তোর ঠোঁট কাটলো কী করে? আর গালে এমন লালচে ভাব কীভাবে?”
অরিত্রিকা পাংশুটে মুখে তাকায় ইশরার দিকে। চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ।কণ্ঠস্বরে একরাশ অবসাদ। মলিন মুখে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
“বললাম তো, গালে মশা মারতে গিয়ে হয়েছে।”
“ আমার তোর কথা হজম হচ্ছে না। নিজের থাপ্পড়ে কারো গালে এমন র’ক্ত জমে যায়? ”
ইশরা চক্ষুদ্বয় ছোট করে সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকার মনে পড়ে গেল রাতের কাহিনী। মনে পড়তেই শিউরে উঠল। মিনমিন করে বলল ;
“ তোরা মামাতো – ফুপাতো ভাই বোনগুলো এতো জিজ্ঞাসাবাদ করিস কেন বলতো? ”
“ মানে? ”
“ কিছু না। ”
“ মামাতো – ফুপাতো ভাইবোন মানে কী বোঝাতে চাইছিস? আমাদের মধ্যে কেউ কি কিছু বলেছে? ”
“ নাহ। ”
“ সারহান ভাই কিছু বলেছে? ”
সারহানের কথা শ্রবণেন্দ্রিয়তে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকার মুখশ্রী অস্বাভাবিক ভার হয়ে গেল। মলিন ভাব ছুঁয়ে গেল তার মুখে। তিক্ততায় বিষিয়ে উঠল মন। ওষ্ঠ কামড়ে নিজেকে সামলে নিতে লাগল। চক্ষুদ্বয়ে অশ্রুর ভীড় জমলো হঠাৎ। ভেজা কন্ঠে বলে উঠল ;
“ উনি আমায় কিছু বলেনি। ”
ইশরা পরখ করে বুঝলো অরিত্রিকা তার থেকে ইচ্ছাকৃত কিছু লুকাচ্ছে। সে আর ঘাটলো না বিষয়টা। পরে যদি মন ভালো হয় পেটে থাকা গোপন কথা এমনি বলবে। এখন তার কাজ অরিত্রিকার মন ভালো করা। সে একগাল হেসে চাপা স্বরে বলল;
“ গালের দাগের কথা বাদ দিলাম এবার বলতো ঠোঁটের কোণে ক্ষত কীভাবে হলো? ”
“ লেভির গলার বেল্টে লেগে কেটে গেছে। ”
“ উহু উহু আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে। ”
“ কী?”
“ সত্যি করে বল তো কে কিসমিস করেছে?”
ইশরা দুষ্ট স্বরে খিলখিলিয়ে হেসে বলল। অরিত্রিকা কটমট করে তাকাল। অসভ্য মেয়ে একটা। যেখানে সেখানে যা তা বলে ফেলে। সে সতর্কতার সহিত দৃষ্টি ঘুরিয়ে সাদাতের দিকে তাকায়। সাদাত একমনে লেভিকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত। পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে আগের মতো ইশরার দিকে তাকাল। খিঁচে আসা মেজাজে বিরবির করে বলল;
“ সারহান ভাইয়ের লোহার মতো শক্ত হাতের থাপ্পড় নামক কিসমিস রাতে খেয়েছি। উনার হাত নাকি লোহা? বাপরে এক থাপ্পড় খেয়ে জ্বর বাবাজি এসে হাজির হয়ে গেছে। আমার এতো সাধের গালে লাল স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে বজ্জাত লোক কোথাকার। ”
“ কিরে কিছু বললি? ”
“ নাহ। ”
অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে বলে উঠে। ইশরা হাত দিয়ে অরিত্রিকার কপাল স্পর্শ করে শরীরের তাপমাত্রা কেমন দেখে নেয়। আগের তুলনায় তাপমাত্রা কম। সাদাত ইতোমধ্যে লেডিকে খাবার খাওয়ানো শেষ করেছে। সে লেডিকে কোলে নিয়ে অরিত্রিকা উদ্দেশ্য করে বলল ;
“ তোর বাচ্চাকে নিয়ে গেলাম। আজ সারাদিন আমার কাছে থাকবে। ”
অরিত্রিকা ধীর কন্ঠে বলল ;
“ আচ্ছা নিয়ে যা। সাবধানে রাখবি, খেয়াল রাখবি লেভি যেনো তোর জল্লাদ ভাইয়ের রুমে না যায়। ”
“ ওকে সিস। ”
কথাটা শেষ করে সাদাত লেডিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলেছে।অরিত্রিকা ওয়াশরুম থেকে মাত্র ফ্রেশ হয়ে রুমে প্রবেশ করলো। শরীর ভীষণ দুর্বল তার। একদিনের জ্বরে এমন বেহাল দশায় পৌঁছে যাবে সে ভাবতে পারেনি। এখন জ্বর না থাকলেও মন মেজাজ ভালো নেই তার। ধীর পায়ে হেটে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। বলহীন হাতে ধীরে চুল তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে থেকে। এর মাঝেই ভেসে আসে দরজা নক করার শব্দ। কেউ বারবার দরজা নক করছে।
অরিত্রিকা পিছু ফিরে না তাকিয়ে উচ্চস্বরে ভাঙা কন্ঠে বলল ;
“ দরজা খোলা আছে ভেতরে এসো। ”
এতোটুকু বলেই নিজ কাজে পুনরায় মগ্ন হয় অরিত্রিকা। সারহান দরজা খুলে প্রবেশ করে রুমে। ধীরগতিতে এগিয়ে আসতে থাকে অরিত্রিকার দিকে। প্রতিটি পদক্ষেপে অভিজ্ঞানিক দৃঢ়তা ফুটে উঠছে। চক্ষুদ্বয়ে অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। কাঁধে অতি সূক্ষ্ম দোল, মাথা কিছুটা উঁচু এবং দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনের দিকে। অরিত্রিকা চুল মুছে আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। আয়নায় শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত সারহানের প্রতিবিম্ব দৃশ্যমান। তা থেকে অল্প খানিকটা দুরত্ব। বিস্মিত নয়নে হন্তদন্ত হয়ে পিছে তাকায়। সরাসরি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সারহানের কঠিন মুখাবয়বে। মানুষটাকে দেখে ক্রোধ জন্মে মনের মাঝে। তা প্রকাশ না করে শান্ত কন্ঠে বলে উঠে ;
“ আপনি এখানে কেন এসেছেন? ”
সারহান এহেন কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। উল্টো স্বাভাবিক ভাবে শুধায় ;
“ শরীর কেমন আছে তোর?”
অরিত্রিকা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল শ্যামবর্ণ মানুষটার দিকে। আজ সারহানকে অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক আর শান্ত লাগছে এ কাহিনী কী?মনে মনে রাগ ধরে গেল তার। গতকাল বিনা কারণে চড় কষিয়েছে, আর আজ কিনা এসে শরীরের খবর নিচ্ছে? কত বড় সাহস!মুখ বাঁকিয়ে ঠোঁট চেপে রাগ চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না। গলায় জমে থাকা ক্ষোভ শেষমেষ গমগমে কণ্ঠে বেরিয়ে এলো;
“থাপ্পড় মেরে আবার দরদ দেখাতে এসেছেন?”
কথাটা তীক্ষ্ণ শোনাল। যেন বিষ মেশানো ধাতব শব্দ।সারহান শান্ত দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এক মুহূর্তের জন্যও ভ্রু কুঁচকাল না, চোখের গভীরতা এতটুকু বদলাল না।
“ দরদ আপনজনদের জন্য দেখাতে হয়। তুই কি আপন? ”
সারহান দৃঢ় এবং শান্ত কন্ঠে বলে উঠে। অরিত্রিকা থতমত খেয়ে যায়। দৃষ্টি নতুন করে মুখ ভার করে বলে ;
“ আপনার আপন হতে আমার বয়ে গেছে। আমার রুম থেকে যান। আমি ডিস্টার্ব ফিল করছি? ”
“ অসুস্থ হয়েও তোর ত্যাড়ামো কমলো না। ”
“ আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার। চলে যান প্লিজ। ”
সারহান অরিত্রিকার রাগাশ্রয়ী মুখপানে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল;
“ আমারও তোর মতো বেয়াদবের সাথে কথা বলা ইচ্ছে নেই। কিন্তু কিছু দেখানোর ছিলো? ”
অরিত্রিকা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ;
“ কি? ”
“ আগে আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দে। ”
“ আপনার দাবাং মার্কা থাপ্পড় খেয়ে এখনো অসুস্থবোধ করছি। জ্বর আপাতত নেই। ঠিকঠাকমতো খেতে পারছিনা। ব্যথায় মুখে স্নো দিতে পারছিনা, ঠোঁটে লিপবাম দিতে পারছি না, মাথা ঝিমঝিম করছে আর….”
সারহানের ভ্রুযুগল বেঁকে গেল। গমগমে কন্ঠে বলে উঠল ;
“ স্টপ। ”
অরিত্রিকা চুপ হয়ে গেল। অবুঝের ন্যায় বিরক্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে রইল। সারহান দ্রুততার সহিত পকেট হতে ফোন বের করল। ফোন স্কিনে আঙুল বুলিয়ে গ্যালারি থেকে একটা পিক বের করে গাম্ভীর্যের সহিত বলে উঠল ;
“ এদের চিনিস? ”
অরিত্রিকা একপলক দন্ডায়মান মানবটির দিকে তাকিয়ে ফোন কৌতুহলবশত ফোন স্কিনে তাকাল। দৃষ্টি স্থির করতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। নেত্রপল্লব কেপে উঠল। শিউরে উঠল তার শরীর। হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। কি বিভৎস সেই দৃশ্য। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। সারহান নির্লিপ্ত, অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৬
অরিত্রিকা নিজেকে সামলে কম্পনরত কন্ঠে আওড়ালো ;
“ এরা.. এরা তো গতকাল আমাকে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে হ্যারাস করেছিল। এদের শরীরে র*ক্ত, ক্ষত… ”
সারহান ফোন পুনরায় পকেটে পুরে নেয়। চওড়া হেসে বলে ;
“ ওদের কৃতকর্মের শাস্তির চিহ্ন ওগুলো। এখনো শাস্তি শেষ হয়নি আরও বাকী আছে।”