প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৩

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৩
আদ্রিতা নিশি

সারহান লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই দেখল পাত্রসহ তাদের পরিবারের আরও তিনজন বসে আছেন। অপর পাশে আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব বসে গল্প করছেন। সারহান গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে শাণিত পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। সারহানকে দেখে পাত্র উঠে দাঁড়ায়। সৌজন্যে রক্ষার্থে মৃদু হেসে বলল ;
“ হ্যালো। ”
সারহানের মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল। ভরাট কন্ঠে প্রতিত্তোর করল ;
“ আসসালামু আলাইকুম। ”
পাত্রের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা চুপসে গেল। একটু অপমানিত হলো বোধ হয়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আশে পাশে তাকিয়ে পরখ করল। হাসার ভাণ করে বলল ;
“ ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”

সারহান আরশাদ সাহেবের পাশে বসল রাজকীয় ভঙ্গিতে। পাত্র নিজ স্থানে মুখ ভার করে বসল। আরশাদ সাহেব পাত্রের বাবা নুরুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“ আমার বড় ছেলে সারহান। গত নির্বাচনে এমপি হয়েছে চেনেন নিশ্চয়ই। ”
নুরুল ইসলাম নড়েচড়ে উঠলেন। হালকা হেসে বললেন ;
“ হ্যা চিনি। রাজশাহীতে আপনার ছেলের নাম ডাক অনেক। তো, কেমন আছো বাবা? ”
শেষোক্ত কথাটি সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল। সারহান দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো ;
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন আংকেল। ”
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরশাদ সাহেব সারহানকে পাত্রের ব্যাপারে বললেন। পাত্রের নাম রাহাত বিন মর্তুজা। পেশায় কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার। পাশাপাশি বাবার বিজনেসের দেখাশোনা করে। নুরুল ইসলাম হলেন আরশাদ সাহেবের বিজনেস পার্টনারের বড়ভাই। নুরুল ইসলাম এবং নাহিদ ইসলাম ভিএসটি কোম্পানির মালিক। এক কথায় রাহাতের বাবারা নামীদামী বড়লোক মানুষ। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো। সবমিলিয়ে পারফেক্ট । ছেলের পরিবার সম্পর্কে আরও বেশ কিছু কথা বলল সারহানকে। সারহান চুপচাপ শুনল কিন্তু কিছু বলল না। বড়দের মাঝে কথা বলার ইচ্ছে নেই। রাহাতের ফ্যামিলি থেকে আরও তিনজন এসেছে। রাহাতের মা, ছোট ভাই রাফি এবং চাচাতো বোন রোদ।
রাফি বারবার নড়ছে এবং এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লিভিং রুমে তখন মেয়েটা এসেছিল তাকে হয়তো খুঁজে চলেছে। কিন্তু সেই অচেনা মেয়েটির দেখা নেই। সারহান তা দেখে সরাসরি জিজ্ঞেস করল ;

“ অ্যানি প্রবলেম রাফি। ”
রাফি স্থির হয়ে যায়। ক্যাবলা মার্কা হেসে বলে ;
“ নাহহ। কোনো প্রবলেম নেই। ”
“ এদিক ওদিক তাকাচ্ছো ভাবলাম কোনো সমস্যা হয়েছে। ”
“ আসলে একটু গরম লাগছে। ”
“ এসি চলছে তাও গরম লাগছে? ”
সারহানের কথা শুনে রাফি থতমত খেল। আড় চোখে সারহানের দিকে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে স্থির ভাবে বসে রইল। রোদ বারবার আড় চোখে সারহানের দিকে তাকাচ্ছে। যতবার মানুষটাকে দেখছে ততবার মুগ্ধ হচ্ছে। প্রথম যখন লিভিং রুমে শুভ্র পাঞ্জাবি পড়ে উপস্থিত হয় তখনি তার হৃদপিণ্ড যেন থমকে গিয়েছিল। এতো হ্যান্ডসাম ছেলে চোখের সামনে দেখে খেই হারিয়ে ফেলে। প্রথম দেখায় প্রেম যেমনটা হয় ঠিক তেমন। বেহায়ার মতো চোখদুটো শ্যামমানবটির দিকে যাচ্ছে। চাচাতো ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসে পাত্রীর বড় ভাইকে পছন্দ হয়ে গেল ব্যাপারটা অদ্ভুত। এতো ইয়াং এমপি চোখের সামনে বসে আছে ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছে। মন বলছে, এই যে মিস্টার আমার দিকে তাকান। কিন্তু ছাতার কপাল! ইয়াং এমপি তো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ধ্যাত! এর মাঝে সাদাত এসে উপস্থিত হয়। রোদকে হা করে তাকিয়ে থাকে দেখে অদ্ভুত চোখে তাকায়। বিরক্তির সহিত বিরবির করে বলে ;
“ ওইদিকে নজর দিয়ে লাভ নেই সিনিয়র আপু। আপনি পাত্তা পাবেন না। আমার দিকে নজর দিন তাহলে পাত্তা পেতেও পারেন। ”

অরিত্রিকা আর ইশরা উপর তলা থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে লিভিং রুমে চলমান দৃশ্য দেখছে। একে একে পরখ করছে সবাইকে। প্রথমেই ইশরার চোখ পড়ল সাদাতের দিকে। সাদাত একধ্যানে অচেনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই রাগ উঠে গেল মাথায়। অসভ্য ছেলে একটা। অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ দেখ, সাদাত হা করে ওই মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে চোখের ভেতর মরিচের গুড়া ঢেলে দেই। ”
অরিত্রিকাও তাকাল সাদাতের দিকে। কিন্তু দৃষ্টি স্থির হলো না সেথায়। পাশে সোফায় বসে থাকা মেয়েটির ওপর দৃষ্টি পড়ল। কেমন হা করে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে। মনে হচ্ছে গিলে খাবে। একটু রাগ লাগলো তার। জীবনে কী ছেলে দেখেনি মেয়েটা! বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকার কোনো মানে হয়?
অরিত্রিকা কটমট করে মেয়েটির দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ;
“ সাদাতের দিকে না তাকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকা ইশু। দেখ কেমন বেহায়ার মতো সারহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে একদম। ”

“ সত্যি তো। ”
“ এই মেয়ের মতিগতি ভালো লাগছে না। নিশ্চিত সারহান ভাইকে দেখে টাস্কি খেয়েছে। ”
“ মেয়েটার দোষ কোথায়? আমাদের ভাইয়েরা সবগুলো হ্যান্ডসাম তাই তো মেয়েরা তাকিয়ে থাকে। ”
অরিত্রিকার একটু ভালোভাবে খেয়াল করল সারহানকে। নাহ! যন্ত্রমানবটা হ্যান্ডসাম আছে। কিন্তু এসব মনে আনা চলবে না। ইয়ে মার্কা চিন্তা করে লাভ নেই। আকস্মিক কিছু একটা মনে পড়তেই চাপা স্বরে বলে উঠল ;
“ তোর ভাই যে প্রেমে পড়ছে সেই খবর রাখিস? ”
ইশরা হতবাক হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল ;
“ বলিস কি? আমি তো জানিনা। ”
“ আজ ইরফান ভাই নিজে আমাকে বলেছে? ”
“ মেয়ের সম্পর্কে কিছু বলেছে?”
“ নাহ। আমি যে তোকে ইরফান ভাইয়ের সিক্রেট বললাম এটা কিন্তু কাউকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাস না।”
“ আচ্ছা। ”

“ আমরা দুজন জীবনে কী করলাম বলতো? শুধু মানুষের প্রেম দেখতে দেখতে বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। ”
“ সত্যি বলেছিস বইন। আমাদের দ্বারা এ জীবনে কিছু হলো না।”
দুজন হতাশার সুর টেনে কথাগুলো বলল। মুখ বেজার করে লিভিং রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। এর মাঝেই রাফি নামক ছেলেটি পুনরায় উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগল। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি থেমে গেল উপরের করিডোরে লুকিয়ে থাকা রমণীর দিকে। রাফিকে হঠাৎ তাকাতে দেখে হচকচিয়ে গেল অরিত্রিকা আর ইশরা। নিজেদের কোনো মতো আড়াল করে তড়িঘড়ি করে রুমের ভেতর চলে গেল। রাফি নিঃশব্দে হাসল।
কিছুক্ষণ পরে ইসমা বেগম অরিনকে নিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করল। সার্ভেন্ট চেয়ার এনে রাখল বসার জন্য। অরিন সেখানে চুপচাপ বসল নত মস্তকে। চক্ষুদ্বয়ে ছলছল করছে অশ্রু। টুপটাপ করে গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মনের ভেতরের দগ্ধ সত্তায় নিষ্পেষিত হচ্ছে। তবুও নিশ্চুপ হয়ে আছে। লিভিংরুমের সবাই চুপ হয়ে গেল। রাহাত সকলের অগোচরে দেখল অরিনকে। একপলক দেখেই আওড়ালো মাশাল্লাহ। পাত্রের মা অরিনকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করলেন।

দেখতে আসলেই কী বিয়ে হয়ে যায়? কথাটা লোকমুখে প্রচলিত হলেও অরিনের ক্ষেত্রে তা মিলে গেছে। বিয়ে হয়নি কিন্তু দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছে। পারিবারিক ভাবে ছোট পরিসরে আংটি পরিয়ে রাখা হয়েছে আজ। তিনদিন পরে আকদ করে রাখা হবে এবং মাসখানেক পরে বড় করে রিসেপশন করা হবে। রাহাতের আর মাত্র চারদিন আছে ছুটি। এর মাঝে বড়পরিসরে বিয়ের অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। তাই বড়দের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাত্র পক্ষ খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে চলে গেছে। যাওয়ার আগে রাহাত এবং অরিন একান্তে কথা বলেছে। নিজেদের ভালোলাগা খারাপ লাগা গুলো একে অপরকে জানিয়েছে।

পড়ন্ত দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছে। গোধূলির অম্বরে সাদা -নীলচে মেঘ জমেছে। সূর্য অস্তমিত প্রায়। পাখিরা কলরব করে নিজেদের নীড়ে ফিরছে। ছাঁদের রেলিঙ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। মলিন মুখশ্রীতে নীলচে অম্বরের পাণে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। খোলা চুলগুলো হালকা বাতাসে নড়ছে। পরনের শাড়ির আঁচল অবহেলায় লুটিয়ে আছে ছাঁদের বক্ষে। সেদিকে খেয়াল নেই মেয়েটির। সে তো নিজের মনের গহীনের অদৃশ্য ঝড় থামাতে ব্যস্ত। আজ তার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। পরিবারের কথা ভেবে চুপচাপ সবটা মেনে নিলো। সে কী চেয়েছিল তার অমতে নিজের জীবনে অন্য এক অচেনা পুরুষ আসুক? চায়নি তো। তবে কেন এমন হলো। রাহাতের সাথে একান্তে কথা বলার সময় সে ছিল নির্বাক। আসলে ইচ্ছে হয়নি কথা বলতে। সৌজন্য বজায় রাখতে দুই একটার জবাব দিয়েছে। মেয়েদের বুঝি এটাই জীবন! যাকে চায় তাকে পায় না। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সারাজীবন কাটানোর সে হয়ে যায় অচেনা। এসব ভেবে চক্ষু বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। আজ মনে মেঘ জমেছে সেই মেঘ কবে কেটে যাবে?

“ শুনেছি, সন্ধ্যাবেলায় চুল ছাড়া দিয়ে রাখলে ভূতে ধরে! ”
পরিচিত কারো কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিন চমকে যায়। কান্না থেমে যায় তৎক্ষনাৎ। নীলচে অম্বর হতে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকায়। আবির বক্ষে দুহাত গুঁজে ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন একটু থতমত খেয়ে যায়। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ;
“ আপনি? ”
আবির হাসল ;
“ হ্যা আমি। আংকেল তোমার এনগ্যাজমেন্টে ইনভাইট করেছিল তাই দাওয়াত কবুল করতে চলে আসলাম। ”
“ ওহহ। ”
অরিন ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল।সারহানের বন্ধু হওয়ার সুবাদে চৌধুরী নিবাসে অনবরত যাওয়া আসা লেগে থাকত। দুজনের বন্ধুত্বের বয়স প্রায় বিশ বছর হবে। অরিনকে সে দীর্ঘ সময় ধরে চেনে। তেমন একটা কথা হয় নি তাদের। জাস্ট দেখা হলে দুই একটা কথা হয়েছে সৌজন্য বজায় রাখতে। অরিন যেহেতু বয়সে তার থেকে ছোট তাই তুমি বলে সম্বোধন করে আবির। কিন্তু গত দুইবছর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি তাদের।

“ বিয়ের খুশিতে এখনি কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছো? ”
আবির মজারছলে বলল কথাটি। অরিন দুচোখ হাত দ্বারা মুছে নেয়। নিস্পৃহ ভাবে বলে উঠে;
“ বিয়ের খুশিতে নয় শোকে কান্নাকাটি করছি। ”
আবির একটু অবাক হলো। পরক্ষণে ভাবল হয়তো মজার ছলে উত্তর দিয়েছে। মৃদু হেসে বলল;
“ নিশ্চয়ই টেনশন করছো ফিউচারে কী হবে? আরে চিল ছেলে ভালো আছে। তোমায় একদম রাজরানী করে রাখবে। ”
“ আমি তো রাজরানী হতে চাইনি। শুধু একটু উনার জীবনে ঠাই চেয়েছিলাম। সেটুকু পেলাম না।”
“ কে বলেছে ঠাই পাওনি। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল অথচ তুমি কীসব বকে চলেছো? মাথা কি বিয়ের আগেই খারাপ হয়ে গেছে? ”

অরিনের চোখে অশ্রু টইটম্বুর করছে। গলদেশ হতে কথা বের হচ্ছে না। নিজেকে কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো লাগছে। মলিন হেসে বলে ;
“ আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি। আমি যাকে ভালোবাসি তার কথা বলছিলাম কিন্তু আপনি তো রাহাত সাহেবকে এর মাঝে টেনে আনলেন। ”
আবির একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। এই মেয়ে বলছে কী! বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড ছিল? তাহলে কেন বিয়েতে রাজী হলো। ফ্যামিলির সবাইকে তো জানাতে পারতো। কিন্তু তা না করে কান্নাকাটি করছে! উফ সব গোলমেলে লাগছে। অরিন কে সে ভালোমতো চেনে। মেয়েটা খারাপ নয়। থমথমে গলায় বলল ;
“ বয়ফ্রেন্ড ছিলো তাও বিয়ের জন্য রাজি গেলে? এখন আবার ওই বয়ফ্রেন্ডের জন্য কাঁদছো? কী সময় এলো মাইরি বিধি তুমি বলে দাও আমি কার এমন সিন চলছে মনে হচ্ছে। ”
“ আমি মোটেও বয়ফ্রেন্ডের জন্য কাঁদছি না। ”
“ তা তো নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। সারহানকে বলতে পারতে বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবে। এখন কান্নাকাটি করে কী লাভ। ”

“ ভালোবাসলে বোধ হয় মানুষ বোকা হয়ে যায়! যেমন আমি বোকা হয়েছিলাম। মানুষটা আমার অনুভূতি নিয়ে খেললো তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। ”
অরিন আর কিছু বলতে পারে না। হুহু করে কেঁদে উঠে। ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। কন্দনরত কন্ঠে আওড়ায় ;
“ তুমি আমায় কেন ভালোবাসলে না শখের পুরুষ? কেন ভালোবাসলে না? আমি তো তোমায় ভালোবেসেছিলাম কিন্তু তুমি ঠকিয়ে দিলে, আমায় নিঃস্ব করে দিলে। তুমি যদি আমায় ভালোই না বাসতে কেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে তোর রাণী করে নিয়ে যাবে? তুমি প্রতারক আমার শখের পুরুষ, তুমি বেইমান। ”
অরিন অঝোর নয়নে কেঁদে বিলাপ বকছে। কোনোভাবেই নিজের ভঙ্গুর মনের আহাজারি থামাতে পারছে না। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে তার। আবির বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে। এই মুহুর্তে কী করা দরকার সে বুঝল না। চোখের সামনে একটা মেয়ের আহাজারি সহ্য হলো না।
আবির হাঁটু গেড়ে বসে অরিনের সামনে। উদ্বেগ ভরা কন্ঠে বলে ;

“ অরিন রিলাক্স। নিজেকে একটু শান্ত করো। ”
“ নিজেকে শান্ত করতে পারছি না। নিজের হাতে জীবনটা শেষ করে দিলাম৷ ভুল পথে কেন পা বাড়ালাম! আফসোস হচ্ছে ভীষণ। ”
“ এতোটা ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে? ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো, তা বুঝতেও পেরেছো। এখন এসব চ্যাপ্টার ক্লোজ করে রাহাতকে নিয়ে ভাবো। তার সাথে কথা বলো, নিজেদের মাঝে বন্ডিং তৈরী করো। তাহলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
অরিনের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। ভেজা নেত্রপল্লব মেলে তাকায় আবিরের মুখপানে। সে চোখে শুধু বিসম্য়ভাব। আবির শান্ত কন্ঠে বলে ;

“ অতীত নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে ভাবো। ছোট্ট একটা ভুলের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়। তুমি তো ছেলেটাকে সত্যি ভালোবাসতে কিন্তু সে তোমায় ঠকিয়েছে। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। সত্যি বলতে ভাগ্যে যাকে সৃষ্টি কর্তা আগেই ঠিক করে রেখেছে সে ছাড়া অন্য কেউ নিশ্চয়ই কারো জীবনে থাকবে না। তোমার ভাগ্যে রাহাত ছিল তাই ওর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
অরিন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আবির উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে দিল অরিনের দিকে। অরিন একটু ইতস্ততবোধ করল কিন্তু তা উপেক্ষা করে আবিরের হাত না ধরে উঠে পড়ল। আবির হাসল শুধু।
অরিত্রিকা চিলেকোঠার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে। চক্ষুদ্বয়ে ছলছল করছে অশ্রু। এতোক্ষণ ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা সে নিজ চোখে দেখেছে। বড় বোনের এমন ভঙ্গুর অবস্থা কখনো দেখেনি। আর অরিন যে কাউকে ভালোবাসতো তা ঘুনাক্ষরে টের পায়নি। অরিত্রিকা আর অরিনের কাছে গেল না। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছুটলো রুমের দিকে। রুমে যাবে এমন সময় পথিমধ্যে সারহানের সাথে দেখা হয়ে যায়। অরিত্রিকা থেমে যায়। অশ্রু ভেজা চোখে তাকায় সারহানের মুখপানে। সারহান সামনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে সরু চোখে তাকায়। অরিত্রিকার লালচে চোখ এবং ভেজা নেত্রপল্লব দেখে বিচলিত হয়ে যায়। বিভ্রান্ত হয়ে যায় কিছুটা। অশান্ত কন্ঠে শুধায় ;

“ কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? ”
অরিত্রিকার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সারহানের মন আরও অশান্ত হয়ে যায়। বিচলিত হয়ে এগিয়ে আসে কিছুটা। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ;
“ বল কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে? ”
অরিত্রিকা নতমস্তকে মাথা নাড়িয়ে না বলল। সারহান বলল ;
“ কাহিনী কি তাহলে? ”
অরিত্রিকা ভেজা কন্ঠে বলে উঠে;
“ ভালোবাসার মানুষটা কেন ভুল হয় সারহান ভাই? সেই ভুল মানুষটার জন্য কেন সকলের অগোচরে কাঁদতে হয়, কষ্ট পেতে হয়? ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২২

সারহান মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। উৎকন্ঠিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মনের মাঝে একটা প্রশ্ন হঠাৎ উদয় হলো ফাইরুজ কী কাউকে ভালোবাসে? মুহুর্তেই দিশেহারা হয়ে গেল। অরিত্রিকা সারহানের থেকে কাঙ্খিত উত্তর না পেয়ে দৌড়ে চলে গেল রুমে। সারহান নিবিড় চাহনিতে তাকিয়ে রইল সেই দিকে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৪