প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৪
আদ্রিতা নিশি
“ সন্ধ্যা হয়ে আসছে! তুমি কি আজকে ছাঁদে একা রাত কাটাতে চাইছো অরিন? ”
অরিনের ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। ভেজা নেত্রপল্লবে আশেপাশে তাকায়। সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। গোধূলী লগ্ন পেরিয়ে আঁধার নেমে আসছে ধরনীতে। ধীরে ধীরে অনামিশায় ছেয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অম্বর মেঘাচ্ছন্ন রুপ ধারণ করেছে হয়তো ঝড় – বৃষ্টি হবে। ফেব্রুয়ারী মাসে শেষের দিকে। এমন সময় ঝড় বৃষ্টির দেখা মেলে ধরনীর বক্ষে। আজও সময়টা তেমনই। হালকা শীতল হাওয়া অরিনের মেয়েলী শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। খোলা চুলগুলো যেন হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে। শাড়ির আঁচল উন্মুক্ত ভঙ্গিতে উড়ছে। অরিন শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নেয় শরীরে। দৃষ্টি ফিরিয়ে সরাসরি তাকায় আবিরের দিকে। ভেজা কন্ঠে বলে ;
“ আপনি নিচে যান। আমি পড়ে যাব। ”
আবির ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ উহু। এখনি নিচে যাও। ছাঁদে একা থাকার কোনো দরকার নেই। মনে হচ্ছে ঝড় বৃষ্টি হবে। ”
“ ছাঁদে থাকতে ভালো লাগছে। আপনি নিচে যান। ”
“ আমি নিচে গেলে বুঝি কান্নাকাটি করতে সুবিধা হবে? সারহানকে ডাকবো?”
“ সারহান ভাইকে কেন ডাকবেন আজব!”
“ সারহানকে ডেকে বলবো তোর বোন একটা ফ্রটের জন্য নাকের জল চোখের জল এক করছে। ”
অরিন হচকচিয়ে গেল। বিস্ময়ভরা নয়নে তাকাল আবিরের দিকে। একটু রাগ হলো কিন্তু তা প্রকাশ করল না। মুখ ভার করে বলল ;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ঠিক আছে নিচে যাচ্ছি। তার আগে আমায় একটা প্রমিজ করুন। ”
আবির দীর্ঘ শ্বাস টানলো। অনাগ্রহী ভঙ্গিতে বলল ;
“ কী প্রমিজ?”
“ আজকে ছাঁদে আমি আপনাকে যা যা বলেছি কাউকে বলবেন না। আমি চাই না এসব কথা আমার পরিবারের কেউ জানুক। ”
“ এখন পরিবারের কথা মাথায় এসেছে অথচ প্রেম করার সময় আসেনি। মেয়ে মানুষ বড্ড অদ্ভুত। ”
“ কথা শোনাচ্ছেন? ”
“ কই কথা শোনালাম? ”
“ এই যে এখন যেসব কথা বললেন সেগুলো কী ছিল? ”
আবির হতাশাপূর্ণ চাহনিতে তাকালো অরিনের দিকে। মেয়েটি যে তার ওপর ভীষণ রেগে গেছে তা বুঝতে সময় নিলো না। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল ;
“ প্রমিজ করলাম তোমার ফ্রট বয়ফ্রেন্ডের কথা কাউকে জানাবো না। এবার খুশি হয়েছে? ”
অরিন ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল;
“ আপনি আবার কথা শোনাচ্ছেন? ”
“ আরে আরে বিয়ের আগেই ঝগড়ার প্র্যাকটিস করছো নাকি? আমার সাথে ঝগড়া না করে তোমার হবু বরের সাথে ঝগড়া করো তাও কাজে লাগবে। ”
“ আপনি একটা বিরক্তিকর মানুষ। ”
“ আর তুমি একটা ঘিলু বিহীন সুন্দরী রমনী। ”
“ আবির…। ”
অরিন ক্রোধে জর্জরিত হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। আবির হুহা করে হেসে উঠল। মেয়েটি আসলেই সহজ সরল। তা না হলে নিজের গোপন কথা অপরিচিত মানুষের কাছে বলে? এতোটা বিশ্বাস এই সময়ে খুব কম মানুষকে করা যায়। অনেকে তো নিজের মানুষদেরও বিশ্বাস করে না। অথচ পাগলী মেয়ে অচেনা একটা ছেলেকে ভালোবেসে ঠকে গেল। এই বেইমানদের দুনিয়ায় সহজ সরল হয়ে লাভ নেই। এরমাঝেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে লাগল মেঘাচ্ছন্ন অম্বর হতে।
আবির মৃদু হেসে বলল ;
“ বৃষ্টি পড়ছে। এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে বৃষ্টিবিলাস করবে? ”
অরিন গজগজ করতে করতে বলল ;
“ আপনি করুন বৃষ্টিবিলাস। আমি চললাম নিচে। ”
অরিন ধপাধপ পা ফেলে চলে গেল রুমের দিকে। আবির অবাক হয়ে বলল ;
“ মেয়েদের মন বোঝা আসলেই মুশকিল। কিছুক্ষণ আগে বলছিল নিচে যাবে না এখন আগেই চলে গেল? আর কত কি দেখব।”
আবির আনমনে হেসে ওঠে। রেলিঙে হাত রেখে অদূরে তাকায়। স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে যায় তার শরীর। কিছু একটা মনে পড়তেই সে ছাঁদে আর দাঁড়ায় না। হাওয়ায় এলোমেলো চুলগুলো হাত দ্বারা ঠিক করতে করতে পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। সারহানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে বাড়িতে ফিরতে হবে দ্রুত। নয়তো বৃষ্টির কবলে পড়তে হবে।
আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব বিজনেস মিটিংয়ে এটেন্ড করতে গিয়েছেন। আসতে রাত গভীর হয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ চৌধুরী নিবাস থেকে বেরোনোর পরে উনারা নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। উনাদের সাথে ইরফান ও গিয়েছে। দুইদিন আগে মামাদের নিজস্ব কোম্পানিতে জয়েন করেছে। আগে থেকে কোম্পানির কাজে অভিজ্ঞ থাকায় আর না করেনি।
ইরফান ঢাকার একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনা শেষ করে ঢাকাতেই একটা কোম্পানিতে জব করতো। মাসের পর মাস পরিবারের মানুষদের থেকে দূরে থাকা খুবই কষ্টকর। তবুও মা আর বোনের জন্য কষ্টটুকু বিসর্জন দিয়েছে। ইরফানের বাবা নেই। পাঁচবছর আগে হঠাৎ স্টোক করে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। ইসমা বেগম স্বামী হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে একা বাড়িতে থাকতেন। স্বামীর জমানো টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে লাগলেন। একসময় সম্বল টুকু শেষ হয়ে গেল। ইরফানের প্রাইভেট ভার্সিটির পড়ার খরচ সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলেন ইসমা বেগম। খাওয়া,জামাকাপড়, পড়াশোনার জন্য তেমন টাকা ছিল না।
এতো কষ্টের মাঝেও ইসমা বেগম ভাইদের কাছে নিজের দুরাবস্থার কথা ভুলেও প্রকাশ করেননি। নিজের মাঝে কষ্টগুলো চাপা রেখে ছেলে মেয়েদের ভালো রাখতে নিজের গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। নারীরা বোধহয় নিজের সন্তানদের ভালো রাখতে সবকিছু করতে পারে। সারহান এবং ইরফান প্রায় সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে তাদের বন্ডিং ছিল অসাধারণ। বাবা মারা যাওয়ার পর ইরফান ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল প্রায়। সেই সময় সারহান টাকা দিয়ে হেল্প করে এবং ফুপুর বাড়িতে চলমান দুরাবস্থার কথা জানতে পারে। যেদিন শুনেছিল সেদিন একমহুর্ত দেরী না করে বাবা এবং চাচাকে বলেছিল। সারহান যেহেতু সেসময় স্টুডেন্ট ছিল তাই একা কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে নি।
আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব পরের দিন ইসমা বেগম ও বাচ্চাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন থেকে ইসমা বেগম, ইরফান এবং ইশরা এই বাড়িতে থাকে।
আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব এসি কোম্পানির মালিক সেইসুবাদে ইরফানকে নিজেদের কোম্পানীতে জব অফার করেন। বাড়ির ছেলে বাহিরে গিয়ে জব করবে তা একটু দৃষ্টিকটু লাগে দেখতে। পড়াশোনা শেষ করে গত একবছর ধরে ঢাকার নামীদামী কোম্পানিতে জব করছিল ইরফান। এসি কোম্পানি থেকে জবের অফার আসতেই সে একসেপ্ট করে নেয় এবং দ্রুত জয়েন করে।
কিচেনে গ্যাসের চুলার সামনে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অরিত্রিকা। চুলার ওপর চা তৈরী করার জন্য পানি গরম করতে দিয়েছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই মেয়েটার আনমনা ভাব নিয়ে কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। এদিকে মাথাব্যথা করছে। বোনের ভালোবাসার দুঃখের কাহিনী শুনে দরজা বন্ধ কর ভ্যা ভ্যা করে প্রায় আধা ঘন্টা কেঁদেছে। হঠাৎ কেন কাঁদল সে নিজেও জানে না। অরিত্রিকাকে কিচেনে আসতে দেখে একজন সার্ভেন্ট বলেছিল চা বানিয়ে দিবে কিন্তু সেসব পরোয়া না করে নিজে নিজে হাত পুড়িয়ে চা বানাচ্ছে।
“ আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে দে ফাইরুজ। ”
সারহানের শান্ত শীতল কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকার ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। চকিত দৃষ্টিতে তাকায় পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। অবাক হয়ে যায় মানুষটিকে দেখে। সচরাচর সারহান ভাইকে কিচেনের আশেপাশে দেখা যায় না। আজ হঠাৎ এক কাপ কফির জন্য সরাসরি কিচেনে পা রাখল!বড্ড আশ্চর্যের বিষয়। সার্ভেন্টদের কাউকে বললে তো কফি দিয়ে আসতো।
অরিত্রিকা নিজের ভাবনা দমিয়ে রেখে মিনমিন করে বলে ;
“ সার্ভেন্টদের কাউকে বললেই তো কফি বানিয়ে আপনার রুমে দিয়ে আসতো।”
সারহান কিচেনের সেল্ফে হেলান দেয়। বক্ষে দুহাত গুঁজে তির্যক দৃষ্টিতে তাকায়। বাঁকা হেসে বলে ;
“ তোর হাতে বানানো কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। ”
অরিত্রিকা চুলার আঁচ কমাতে গিয়েছিল আচানক এহেন কথায় গ্যাসের চুলা অফ করে দিল উত্তেজিত হয়ে। পুনরায় অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। থমথমে গলায় বলল ;
“ এসব কি বলছেন? ”
“ মাথাব্যথা করছে। কথা না বাড়িয়ে প্লিজ কফি বানিয়ে দে ফাইরুজ। ”
“ কফি বানাতে পারবো না। আপনি বানিয়ে নিন। ”
“ ভালোভাবে কথা বলছি সহ্য হচ্ছে না! মনে হচ্ছে থেরাপি দেওয়ার সময় এসে গেছে।”
“ না না আমি আর থেরাপি নিতে চাই না। ”
“ গুড গার্ল। ফটাফট কফি বানিয়ে দে। ”
অরিত্রিকা বিরক্ত হলো বেশ। তবুও বিরক্তিভাব প্রকাশ না করে তটস্থ ভঙ্গিতে অন্য পাত্রে গরম পানি তুলে দিল চুলায়। কফি পাউডার এবং মগ নিয়ে আসল। মগের ভেতর কফি পাউডার, চিনি ও গরম পানি দিয়ে ছোট চামচ দ্বারা জোরে নাড়তে লাগল। মুখ গোমড়া করে একবার কফির মগের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সারহানের দিকে তাকাচ্ছে। আজ কোন ঝামেলায় পড়ল সে।
সারহান শান্ত চাহনিতে দেখছে অরিত্রিকার কর্মকান্ড। মিনিট পাঁচেক পর কফি বানানো শেষ করল। মনে হচ্ছে এতোক্ষণ যুদ্ধ করছিল।
অরিত্রিকা কফির মগটি সারহানের সামনে এগিয়ে দেয়। সারহান হাত বাড়িয়ে কফির মগটি নিয়ে নেয়। চুমুক দেয় উষ্ণ ধোঁয়া ওঠা কফিতে। কফির স্বাদ ভীষণ ভালো হয়েছে। মেয়েটা যে এতো ভালো কফি বানায় জানতো না সে। জানবেই কী করে! দুইবছর তো এই বাড়িতে ছিল না। অরিত্রিকা আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে। কফি কেমন হয়েছে তা শোনার ইচ্ছে পোষণ করছে মনে মনে।
সারহান দ্বিতীয়বার চুমুক দেয় কফিতে। সেটুকু পান করে অরিত্রিকার মুখপানে সতৃষ্ণ নয়নে তাকায়। শান্ত কন্ঠে প্রশংসাসূচক বাক্য বলে ;
“ কফিটা ভালো হয়েছে।”
অরিত্রিকার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। তা দমিয়ে রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলে ;
“ শুধু ভালো হয়েছে? ”
“ হ্যা। ”
অরিত্রিকার আমোদিত ভাব চুপসে যায়। ভেবেছিল সুন্দর একটা কমপ্লিমেন্ট দিবে তা না করে শুধু বলল ভালো হয়েছে। এটা কোন ধরনের প্রশংসার মধ্যে পড়ে! চুলার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে তার জন্য চাই বানানো হয়নি এখনো। যন্ত্রমানবটা এসে তার চায়ের দফা রফা করে দিয়ে। সে পুনরায় চুলার ওপরে রাখা পাত্রের ভেতর নজর দিল। দেখল পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে চুলা অন করে দিল। সারহান কফি খাওয়া শেষ করে মগটি রাখল সেল্ফের ওপর। অরিত্রিকা সারহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল ;
“ কফি খাওয়া তো শেষ দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলল ;
“ আমার বাড়িতে যেখানে ইচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকব তাতে তোর কী?”
“ আমার কিছুই না। দাঁড়িয়ে থাকুন তাহলে।”
অরিত্রিকা রাগান্বিত কন্ঠে বলেই নিজের কাজে মনোযোগী হয়।পানি গরম হয়ে আসতেই চুলা বন্ধ করে দেয়। আড়চোখে সারহানের দিকে একপলক তাকাল। সারহানে সাথে দৃষ্টি মিলিত হতেই হচকচিয়ে যায়। নজর লুকিয়ে তড়িঘড়ি করে গিয়ে ভুলবশত সরাসরি এক হাত দ্বারা গরম পাত্রটি ধরে। পাত্রটি ধরার সাথে সাথে হাতে গরম ছ্যাকা লাগে সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠে এবং গরম পাত্রটি ছেড়ে দেয়। সারহান আতংকিত হয়ে যায়। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে ;
“ কী হয়েছে?”
অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। হাতের দিকে তাকাতেই দেখল আঙুলগুলো লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ব্যথায় হাতের আঙুলের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওষ্ঠ কামড়ে ব্যথা সহ্য করে কোনোমতে বলে উঠল ;
“ হাতের আঙুল পুড়ে গেছে। ”
সারহানের কর্ণকুহরে কথাটা প্রবেশ করতেই একমুহুর্ত দেরী না করে তড়িঘড়ি করে ফ্রিজের কাছে চলে গেল। আইসকিউবের বক্সটা নিয়ে আসল। অরিত্রিকার ওড়নার এককোণায় আইসকিউব জড়িয়ে নিল। অরিত্রিকার পোড়া হাত অন্য হাত দ্বারা ধরে আইসকিউব পোড়া স্থানে চেপে ধরল। অরিত্রিকা ব্যথায়,যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে নিল। সারহান ব্যথায় জর্জরিত শীর্ণ মেয়েলী মুখপানে দৃষ্টি স্থির করল। সযত্নে পোড়া স্থানে আইসকিউব ধরা অবস্থায় দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ মন কোথায় ছিল তোর? ”
অরিত্রিকা ঘাবড়ে যায়। টপটপ করে ঝরে পরা অশ্রুকণা সারহানের হাতের উপরিভাগ স্পর্শ করে। ওষ্ঠ উল্টে ব্যথাতুর কন্ঠে উত্তর দেয়;
“ আপনার দিকে। ”
অরিত্রিকার সহজ সরল স্বীকারোক্তি। সারহানের মুখাবয়ব অতিশয় গম্ভীর হয়ে যায়। ভরাট কন্ঠে বলে উঠে ;
“ আমার দিকে মন পরেও দেওয়া যেতো। আঁড় চোখে আমাকে না দেখে সরাসরি তাকিয়ে দেখলেও কিছু বলতাম না। কিন্তু নাহ!তুই তো অসময়ে আমার দিকে তাকাবি। ফলস্বরূপ হাতটা পুড়ে গেল। ”
অরিত্রিকা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ব্যথায় মলিন মুখশ্রী মেঝেতে নিবদ্ধ করল। সারহান বুঝল অরিত্রিকা লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আইসকিউব আলতো ভাবে পোড়া স্থানে ছুঁইয়ে দিতে লাগল। গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ আর কোনোদিন কিচেনে আসবি না। ”
“ কেনো? ”
“ আজ হাত পুড়িয়েছিস অন্যদিন পুরো কিচেন পুড়িয়ে ফেলতে পারিস। তোর ওপর বিশ্বাস নেই।”
“ আমি মোটেও অকর্মা নই সারহান ভাই। ”
“ তা তো নিজ চোখে দেখলাম। ”
“ আমি মোটামুটি রান্না করতে পারি। দুই বছরে ওই বাড়িতে আম্মুর কাছে শিখেছি। ”
“ ইন্ডাইরেক্টলি বলতে চাইছিস বিয়ের বয়স হয়েছে তোর!”
অরিত্রিকা একটু থতমত খেল। চক্ষুদ্বয় উঁচিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল সারহানের গম্ভীর মুখপানে। সে কখন বলল তার বিয়ের বয়স হয়েছে? সারহান বিচলিত ভঙ্গিতে অরিত্রিকার পোড়া স্থান পর্যবেক্ষণ করছে। মাঝে মাঝে ফু দিচ্ছে। মেয়েটার মাঝের তিন আঙুলে ফোঁসা পড়ে গেছে। লালচে বর্ণ ধারণ করেছে কেমন যেন বিভৎস লাগছে। মেয়েটা একটু সাবধানে কাজ করলে কী হতো!
সারহান উদ্বেগ ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ;
“ ব্যথা করছে এখনো? ”
অরিত্রিকা নিমগ্ন ছিল সারহানের ব্যতিব্যস্ত বিচলিত ভঙ্গিমায় পোড়া স্থানে আইসকিউব লাগানো দেখায়। সেই চাহনি যেন অদ্ভুত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ছিল। মনে গহীনে সঞ্চার হচ্ছিল নানা ভাবনা। সারহান ভাইকে কখনো এতোটা বিচলিত হতে কখনো দেখেনি। মানুষটা তাকে নিয়ে চিন্তা করে। শ্যামমানবটির দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বদন, বিচলিত ভাব অরিত্রিকার মনে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলল। অন্তঃকোণে ভালোলাগার শিহরণ বইয়ে গেল। তাহলে কী সত্যি সারহান ভাই তাকে ভালোবাসে? এতোটুকু ভাবতেই বক্ষ ধরফরিয়ে উঠল। শুকনো ঢোক গিলল সে। নিখুত চাহনিতে পরখ করতে লাগল মানুষটিকে।
সারহান অরিত্রিকার জবাব না পেয়ে ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকায়। পুনরায় শান্ত কন্ঠে শুধায় ;
“ এখনো ব্যথা করছে? ”
অরিত্রিকার ভাবনা ছেদ হয়। চক্ষুদ্বয় সন্তর্পণে নামিয়ে নেয়। লাজে রাঙা বদন নতুন করে বলে ;
“ নাহ। ”
সারহান একটু শান্ত হয়। অরিত্রিকা সাহস সঞ্চার করে মিনমিন করে বলে ;
“ আপনি কী সত্যি আমাকে ভালোবাসেন সারহান ভাই? ”
সারহান স্থবির হয়ে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। লক্ষ্য করে লজ্জায় নেতিয়ে পড়া মুখ। শান্ত কন্ঠে বলে উঠে ;
“ এই প্রশ্নের উত্তর তুই নিজের মাঝে খোঁজ ফাইরুজ। নিজের মনকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস কর।”
অরিত্রিকা সরাসরি তাকায় সারহানের বাদামী বর্ণের তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয়ে। সেই তীরের ন্যায় ধারালো চাহনিতে কিছুটা কেঁপে উঠে তার মনসত্তা। সেই চক্ষুপেয় গহীন গহ্বরে তলিয়ে গেল সে। সেথায় যেন গোলকধাঁধার ভীড়। অজানা কিছু সমাধান ব্যতিত সমীকরণের আনাগোনা। অরিত্রিকা মানুষটার চক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে না। তীক্ষ্ণতা সম্পন্ন চাহনি হতে নজর লুকায়।
সারহান নিঃশব্দে হাসল ;
“ আমার মনে চলমান অনুভূতি জানা এতো সহজ নয়। তবুও নিজের মনের গহীনে চলমান গোপন অনুভূতি তোর সামনে প্রকাশ করলাম। অথচ তুই আমার বলা কথাগুলো অবিশ্বাস করলি। আমি আর কখনো তোর সামনে নিজেকে জাহির করব না। ”
অরিত্রিকা বিভ্রান্ত হলো। এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা তার মস্তিষ্ক ধরতে পারল না। সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে অদ্ভুত হেসে শান্ত কন্ঠে বলল ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২৩
“ বক্ষে নিভৃতে কিছু দ*গ্ধ ক্ষ*ত কত-শত লুকানো স্মৃতি,কিছু অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, ভাঙ্গাচোরা আবাস,নিদ্রাহীন রাত্রি সপ্তদশী কিশোরীর বিরহে পুড়িয়েছে আমায়। তবুও অনুভূতিগুলো তালাবদ্ধ করে রেখেছিলাম সকলের অগোচরে। সেই সপ্তদশী কিশোরীর ভাবনাতেই যেন সুখ নিহিত।নিজের নিভৃতে রেখে গোপনে পোড়াতেই যেন একান্ত পাওয়া আমার।”