প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩১

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩১
আদ্রিতা নিশি

চৌধুরী নিবাস সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিয়ের আনন্দে উচ্ছসিত এবং আমোদিত ছিল। বাড়ির সদস্য ও মেহমানদের পদাচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল কিন্তু এখন তেমন আবহ আর নেই। সকলের আনন্দ এক নিমেষে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে হয়েছে। কলোরবে মুখরিত বাড়ি নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে একমুহূর্তে। চৌধুরী নিবাসের বড় মেয়ের বিয়ে ভেঙেছে এটা যেন বাতাসের বেগে এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার এমপির চাচাতো বোনের বিয়ে ভাঙার খবর যেন এলাকায় সমালোচিত বিষয়। আকদের অনুষ্ঠান ছোট পরিসরে হলেও এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষ অবগত ছিল। তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলকে জানিয়েছে। অরিনের নামে বিভিন্ন রকমের কুৎসা রটনাচ্ছেন। মেহমানরা বিরস মুখে প্রস্থান করেছেন।

তপ্ত দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছে। গোধূলির অম্বরে সাদা -ধূসর মেঘ জমেছে। মৃদু হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। চৌধুরী নিবাসের পার্কিং প্লেসের অপরপাশে ফুলের বাগান রয়েছে। সেখানে গোলাপ, ডালিয়া, গাদা সহ হরেক রকমের ফুলের গাছ লাগানো। বাগানে ঢুকতে দক্ষিণের দিকে কাঠের বেঞ্চ রাখা। সেথায় বসে আছে বধূ সাজে অরিন। তার মন বিষন্ন, ভঙ্গুর। গাল বেয়ে অনবরত বেয়ে পড়ছে অশ্রুকণা।উদাসীন ভঙ্গিতে ফুলের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ কেঁদে চলেছে। বক্ষে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কেমন যেন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। আশেপাশের সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। ভাগ্যে যে এমন কিছু লেখা ছিল তা কস্মিনকালে ও ভেবে দেখেনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার জীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে সে। জীবনের তিক্ত অনুভূতির শেষ করতে ইচ্ছে করছে। নিজের জীবন নাশ করলে কী এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? অসহনীয় যন্ত্রণায় বক্ষ ফেটে আসছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে নিজের ভেতরে জমা ব্যথার পাহাড় উগ্রে দিতে কিন্তু পারছে। অরিন এসব ভেবে হু হু করে কেঁদে উঠল। যাকে সে মন থেকে চাইল তাকে সে পেল না, যাকে সে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইল সেই মানুষটাও তাকে একা করে দিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ অরিন!”
পুরুষালী শান্ত হীমশীতল পরিচিত কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল। অরিন খানিকটা কেঁপে উঠল। অশ্রসিক্ত চক্ষুদ্বয় উঁচিয়ে মলিন মুখে দৃষ্টিপাত করল সামনে। দন্ডায়মান মানবটির গম্ভীরমুখ পাণে দৃষ্টি স্থির করল। তৎক্ষনাৎ কান্না থেমে গেল। দু’হাতের তালু দ্বারা গাল বেয়ে পড়া নোনা জল মুছে নিল দ্রুত। ভেজা মলিন কন্ঠে বলল ;
“ আপনি! কিছু বলবেন? ”
আবিরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ অরিনের কন্দনরত ফোলা, লালচে মুখপানে। সে বুঝতে পারে মেয়েটি এতোক্ষণ সকলের থেকে দূরে এসে নিজের মাঝে চলমান কষ্ট কেঁদে নিবারণ করছিল। একজন মেয়ের বিয়ে ভাঙলে সমাজের মানুষ কতোটা খারাপ কথা বলে তা জানা সকলের। এসব ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে ;

“ তোমার বাবা ভেতরে ডাকছে। ”
অরিন মলিন কন্ঠে উদ্বিগ্নতার সহিত বলে উঠল ;
“ আম্মু আব্বু ঠিক আছে তো? ”
“ দুজনেই ঠিক আছে। আন্টির অবস্থা আগের থেকে বেটার আছে। আজমল আংকেল তোমার সাথে কিছু কথা বলবেন। ”
সাথী বেগম মেয়ের বিয়ে ভাঙার জন্য অতিরিক্ত চিন্তায় এবং কাঁদার ফলে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল অনেক। ডাক্তার বাড়িতে এসে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। আজমল সাহেব চিন্তিত। তিনি যেন পণ করেছেন মেয়ের বিয়ে আজ দিবেন। তাই সেসব নিয়ে লিভিং রুমে আলোচনা চলছে আর কাজি সাহেবকে একপ্রকার ধমকি দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। অরিন নেত্রপল্লব ঝাপটে ভেজা কন্ঠে শুধায় ;

“ কী কথা বলবে আব্বু? ”
আবিরের সোজাসাপটা উত্তর ;
“ নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। আমি জানিনা কী নিয়ে কথা বলবে। ”
“ আপনি মিথ্যা বলছেন আবির। আপনি সবকিছু জানেন। বলুন কেন ডাকছে। ”
“ সত্যি আমি কিছু জানি না। ”
“ আপনি আব্বুকে গিয়ে বলুন আমি একা থাকতে চাই এখন। আমায় যেন কেউ অযথা ডিস্টার্ব না করে। ”
“ আমি তোমায় ডিস্টার্ব করেছি? ”
আবির বিস্মিত কন্ঠে বলল। অরিন অন্যত্র দৃষ্টিপাত করে ভেজা কন্ঠে বলল ;
“ হ্যা।”
আবির আড়াল করল না কথাটা। স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ আংকেল উনার বন্ধুর ছেলের সাথে তোমার বিয়ে ফিক্সড করতে চাইছেন। হয়তো তোমার থেকে মতামত জানবেন, তুমি রাজি কি না।”

অরিন একটু থমকাল। আবার বিয়ের নাটক শুরু হয়েছে? অসহ্যকর লাগছে। আজকের পরিস্থিতি তাকে স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছে না। জীবন দুর্বিষহ বানিয়ে দিয়েছে একদম। এসব ভেবে টুপটাপ করে অশ্রু কণা গাল বেয়ে পড়ল। আবির লক্ষ্য করল নিষ্প্রাণ ভঙ্গিমায় বসে থাকা ভঙ্গুর মনের রমনীকে। গভীর গাঢ় সেই চাহনি। মন একটু বিচলিত হলো। পরক্ষণে সামলে স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ যদি তুমি রাজি থাকো তাহলে আংকেল আজকে রাতের মধ্যে তোমার ও মিনহাজের আকদ করিয়ে রাখবেন আর কয়েকদিন পর রিসেপশন … ”
আবিরের কথা শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অরিন হঠাৎ নিশ্চল প্রাণহীন কন্ঠে বলে ওঠে;
“ আবির বিয়ে করবেন আমায়? লাল টুকটুকে বউ বানিয়ে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়িতে? আমাকে তিক্ত জীবন থেকে মুক্তি দিবেন? ”

আবির স্তব্ধ এবং নির্বাক হয়ে গেল। চমকিত সত্তা নিয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল অরিনের দিকে। মেয়েটি তার দিকে আকুলতা, আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখশ্রী মলিন, ফ্যাকাসে। পূর্বের সাজগোজ নষ্ট হয়ে গেছে। লিপস্টিক, কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা। তবুও মেয়েটিকে কেন যেন মায়াবী লাগছে। তার অন্তঃকোণ অশান্ত হয়ে উঠে। বিচলিত ভাব বইতে থাকে মনের মাঝে। সেসব ভাবনা চেপে বলে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল ;
“ কীসব বলছো? মাথা ঠিক আছে তোমার? ”
অরিন ওষ্ঠ এলিয়ে হাসে। বিষাদগ্রস্ত সেই হাসি। চক্ষুদ্বয় মুছে হাসি বজায় রেখে বলল ;
“ দুই বার আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি নয়তো যেচে মেয়ে হয়ে একটা ছেলেকে কোন স্বাভাবিক মেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়? ”
আবির নিষ্পলক চেয়ে রয় অরিনের দিকে। মেয়েটা সহজে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে।

“ আমার বন্ধুর ছেলের সাথে আজকেই অরিনের বিয়ে দেবো। আর কোনো কথা শুনতে চাই না কারোর থেকে। ”
সাথী বেগম অসুস্থ। চুপচাপ বসে আছেন লিভিং রুমের সোফায়। বাড়ির সকল সদস্য মন বেজার করে চেয়ারে কেউ বা সোফায় বসে আছে। সকলের মনোযোগ আপাতত বাড়ির ছোট কর্তা কতৃর দিকে। দুজনের মধ্যে রেষারেষি চলছে অরিনের বিয়ে নিয়ে। সাথী বেগম স্বামীর অবান্তর জেদ মোটেও বরখাস্ত করলেন না। অসুস্থ শরীর নিয়ে তেতে উঠলেন ;
“ অরিন শুধু আপনার মেয়ে নয়, আমারও মেয়ে ওর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। আমি যখন বলেছি আমার মেয়েকে আপনার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেবো না। ”
আজমল সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল। গমগমে কন্ঠে বললেন ;

“ আমি যখন একবার বলেছি মিনহাজের সাথে অরিনের বিয়ে দেবো, এ কথার কোনো নড়চড় হবে না। শাহাদতকে বলেছি আজকের ঘটনা তাতে ওর কোনো আপত্তি নেই। অরিন যদি রাজি থাকে তাহলে আজকেই বিয়ে হবে। ”
“ আমার মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিলে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাব। ”
“ বুড়ো বয়সে ছ্যাকা দিও না সাথী। তুমি চলে গেলে আমি আমি কার সাথে ঝগড়া করব। ”
“ নির্লজ্জ লোক। বাড়ির মানুষের সামনে মুখে লাগাম টানুন। ”
সাথী বেগম ঝাঁঝাল কন্ঠে বললেন। আজমল সাহেব একটু বিব্রতবোধ করলেন। আড় চোখে তাকালেন সকলের দিকে। সকলে মুখ হাস্যমুখ ভার করার চেষ্টা করছে যেন কিছু শোনেনি। তিনি গলা খাঁকড়ি দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন ;

“ আমার মেয়ে কখনো আমার কথা ফেলবে না। সাদাত, ইরফান আকদের জন্য যা যা লাগে ব্যবস্থা করো।”
সাদাত এতোক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও এখন পারল না। ত্যাছড়া স্বরে বলল ;
“ চাচা যা যা লাগবে সবকিছু আছে। এখন বলুন বিয়ে কি আদৌও হবে? আপনার জেদ মেয়ের বিয়ে আজকের মধ্যে দিবেন তাই বেচারা কাজি সাহেবকে জোর করে আঁটকে রেখেছেন। মানুষটা আপনার জ্বালায় না পারছে শান্তিতে বসতে না পারছে বাড়িতে যেতে। আর কিছুক্ষণ এখানে কাজি সাহেব থাকলে আপনার এবং চাচির ঝগড়ায় আলু তুলবে। ”

এ কথা শুনে চেয়ারে বসে থাকা কাজি সাহেবের মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলেন। একটু আবেগাপ্লুত হলেন। এতো ঝামেলার মধ্যে কেউ তাকে মনে রেখেছে ভাবতে মন ভালো হয়ে গেল। দুপুর বারোটা থেকে পাঁচ পর্যন্ত একটানা বসে থাকতে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কি ফ্যাসাদে পড়েছেন তিনি! এমপির চাচা এতো ক্ষ্যাপাটে আগে জানতেন না। আজমল সাহেব থমথমে মুখে কাজিসাহেবের দিকে তাকালেন৷ পুনরায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে একরোখা মনোভাব নিয়ে বললেন ;

“ যতোক্ষণ বিয়ে হবে না, ততক্ষণ কাজি সাহেব এখানেই বসে থাকবেন। ”
সাথী বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন ;
“ কাজি সাহেব আমার মেয়ের বিয়ে ওনার পছন্দ করা ছেলের সাথে দেবো না। আপনার নজরে কোনো চল্লিশার্ধো মেয়ে আছে? ”
কাজি সাহেব ভড়কে গেলেন। কৌতুহলবশত জানতে চাইলেন ;
“ কেনো মা? ”
“ উনি যখন বলেছেন বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে যেতে দেবে না। আপনি বরং এক কাজ করুন কোনো পাগলীর সাথে উনার বিয়েটা দিয়ে দিন। ”
সাথী বেগম বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলে উঠলেন। কাজি সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। আজমল সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল। আরশাদ সাহেব রাগ দেখিয়ে বললেন ;
“ তোমরা দুজনে চুপ করো। এতোক্ষণ ধরে দুজনে ঝগড়া করে মতের মিল হয়নি। আমার মনে হয় অরিনের সাথে কথা বলা দরকার। দেখো মেয়েটা কী বলে। ”

আজমল সাহেব এবং সাথী বেগম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ইসমা বেগম ও তানিয়া বেগম আরশাদ সাহেবের কথায় সায় দিলেন। সারহানের ওষ্ঠকোণে রহস্যময় হাসি। চাচার সিদ্ধান্ত যখন নিমেষে ভেঙে যাবে তখন কেমন হবে? মুখখানা দেখার মতো থাকবে তো? সাদাত খেয়াল করল সেই হাসি। অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বাবার অহেতুক জেদে ভীষণ বিরক্ত সে। সে তো জানে অরিনের মনের অবস্থা। দুই প্রতারকের পাল্লায় পড়ে তার বোন একদম ভেঙে পড়েছে। আবার বিয়ের নাটক শুরু। আবির এবং অরিন বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। দুজনে এক সাথে এসে দাঁড়াল লিভিং রুমের মাঝ বরাবর।

আজমল সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। নিমেষেই জেদ যেন পানি হয়ে গেল। বক্ষ কাঁপল, একটু চমকালেন। তার আদরের মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তা বুঝতে পারলেন। অরিনের বক্ষ দুরুদুরু কাঁপছে। বাবাকে কেন যেন ভয় পাচ্ছে নিজের সিদ্ধান্ত কিভাবে পেশ করবে বুঝে উঠে পারছে না। আজমল সাহেব কিছুক্ষণ মৌন থেকে অরিনকে মিনহাজের কথা বলবে এমন সময় বাঁধ সাধল আবির।
“ আংকেল আপনাকে কিছু বলতে চাই। ”
আবির অরিনের ভাবমূর্তি পরখ করে। বুঝতে পারে মেয়েটি তার বাবাকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। মেয়ে হয়ে বাবাকে এমন সিদ্ধান্ত জানানো দৃষ্টিকটু। তাই নিজে সাহস সঞ্চার করে বলল। আজমল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ;

“ কি বলতে চাও? ”
আবির সরাসরি রাখঢাক না করে দৃঢ় শক্ত কন্ঠে বলল ;
“ আমি অরিনকে বিয়ে করতে চাই। ”
চৌধুরী বাড়ির সকলে আরেক দফা চমকে গেল। সকলের বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আবিরের মুখপানে তাকিয়ে রইল। আজমল সাহেব এহেন কথায় রেগে গেলেন। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার ছেড়ে বললেন ;
“ তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলার? ”
আবিরের মাঝে কোনো দলাচলন দেখা গেল না। পূর্বের ন্যায় সাহসিকতা দেখিয়ে বলল ;
“ আপনার মেয়ে সসম্মানে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আমি চাই না আমাদের দুজনের বিয়ে আপনাদের দোয়া ছাড়া হোক। ”
“ কী বললে? এতো বড় সাহস তোমার। ”

“ সাহস আছে তাই আপনাদের সকলের সামনে অরিনকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছি। কাপুরুষ হলে লুকিয়ে বিয়ে করে হঠাৎ একদিন এ বাড়ির জামাই হওয়ার অধিকার নিয়ে হাজির হতাম। ”
“ তোমার মতো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছেলের সাথে আমার মেয়েকে কখনো বিয়ে দেবো না। ”
আজমল সাহেব ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলে উঠলেন৷ ইচ্ছে করছে এই ছেলেকে থাপ্পড় দিতে। বেয়াদবের মতো তার সাথে কথা বলছে। চৌধুরী বাড়ির সকলে হতবাক হয়ে গেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একে ওপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। তারা কেউ বুঝতে পারছে না হঠাৎ আবির কেন এমন প্রস্তাব রাখল। সারহানের ওষ্ঠকোণে কুটিল হাসি চওড়া হয়। বক্ষে দুহাত গুজে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাহিনী দেখতে থাকে।
“ বাবা আমি মিনহাজকে নয় আবিরকে বিয়ে করতে চাই। ”

অরিন সাহস সঞ্চার করে কম্পনরত কন্ঠে বলে উঠল। সাথী বেগমের বিস্ময়ভাব কেটে গেল। তিনি অবাক হলেন মেয়ের সাহস দেখে পরক্ষণে মেয়ের সিদ্ধান্তে মৃদু হাসলেন। আবির ছেলেটাকে তিনি ছোট বেলা থেকে চেনেন। ছেলেটা ভীষণ ভালো মনের। তানিয়া বেগমের উদ্বিগ্ন ভাব কেটে গেল। মনটা শান্ত হলো। অরিত্রিকা, ইশরা হা করে তাকিয়ে আছে। একমুহূর্তে এতোগুলো ধাক্কা যেন মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করেছে। সাদাতের মুখে আমোদিত ভাব ফুটে উঠেছে। ইরফান হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতোক্ষণের ঝামেলার সুরাহা হলো তবে।
আজমল সাহেব মেয়ের এমন সিদ্ধান্তে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। যে মেয়ে তার কথার নড়চড় করে না সেই মেয়ে নিজের সিদ্ধান্তে জানাচ্ছে? নিশ্চয়ই আবিরের কারসাজি এগুলো। তিনি গমগমে কন্ঠে বলে উঠলেন ;

“ নিশ্চয়ই এই ছেলে তোমায় ফোর্স করেছে। ”
অরিন নতমস্তকে ধীর কন্ঠে বলল ;
“ আমায় আবির ফোর্স করেনি। ”
“ রাজনীতি করে বেড়ানো ছেলে পছন্দ নয়। ”
“ সারহান ভাই রাজনীতি করে তাকে কি অপছন্দ করো আব্বু?”
মেয়ের এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলেন আজমল সাহেব। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ;
“ বাড়ির ছেলেকে অপছন্দ কেন করব? ”
আরশাদ সাহেব ভরাট কন্ঠে বললেন ;
“ তাহলে আবিরের ক্ষেত্রে কি সমস্যা? ছেলেটাকে আমরা কখনো বাইরের ছেলে বলে মনে করিনি। যথেষ্ট নম্র, ভদ্র। অরিনের যেহেতু মত আছে সেহেতু বিয়ে দিয়ে দাও। ”
আজমল সাহেব বড় ভাইয়ের কথা ভাবলেন। চুপচাপ কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর আবিরের দিকে তাকিয়ে কাঠিন্যতা এঁটে বললেন ;

“ অরিনের কথা ভেবে শুধু রাজি হলাম। আমার মেয়েকে যদি কষ্ট দাও তোমাকে আমি শূলে চড়াবো বলে রাখলাম। ”
আবির ভ্রু যুগল কুঁচকে স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ আপনার মেয়েকে কখনো কষ্ট দেবো না। এতটুকু ভরসা রাখুন আমার ওপর। ”
আজমল সাহেব একটু শান্ত হলেন। বাড়ির সকলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। সকলের ওষ্ঠকোণে হাসি দেখা গেল। অরিত্রিকা এবং ইশরা আনন্দ দৌড়ে এসে অরিনকে জড়িয়ে ধরল। সাদাত এবং ইরফান হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে এসে আবিরকে শুভকামনা জানাতে লাগল। কাজি সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এখন বিয়েটা দিয়ে পগারপার হতে হবে। আরশাদ সাহেব এগিয়ে গেলেন কাজি সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য।
সারহান শাণিত পায়ে এগিয়ে আসল। এসে দাঁড়াল আজমল সাহেবের সম্মুখে। ক্রুর হেসে বলে উঠল ;
“রাজনীতি করে এমন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবেন না বলেছিলেন অথচ ভাগ্যক্রমে রাজনীতিবিদের সাথে বিয়ে হচ্ছে আপনার মেয়ের। এখন কেমন অনুভব করছেন চাচা? ”
আজমল সাহেব গম্ভীরমুখে তাকালেন সারহানের দিকে। তা দেখে সারহানের হাসি চওড়া হয়।

চৌধুরী বাড়ির লিভিং রুমের উষ্ণ আলোয় বসে আছে দু’টি নীরব অস্তিত্ব আবির ও অরিন। পাশে বসে থাকলেও অদৃশ্য দূরত্ব যেন এখনো তাদের আলাদা করে রেখেছে। চারপাশে চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, প্রত্যেকের চোখে অমোঘ প্রত্যাশা। সাদাত ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারের ওপারে দাঁড়িয়ে মুহূর্তগুলো বন্দি করছে। কারণ কিছু স্মৃতি কেবল হৃদয়ে নয়, চিরস্থায়ী হতে হয় ছবির ফ্রেমেও।
কাজি সাহেব পবিত্র উচ্চারণে বিয়ের খুতবা শুরু করলেন। কক্ষজুড়ে নেমে এলো নিবিড় নীরবতা। প্রতিটি শব্দ যেন অদৃশ্য সুরের মতো গুঞ্জরিত হলো।যা শুনে অরিন এবং আবিরের হৃদয়ের স্পন্দন মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল।
অরিনের চোখ নিচের দিকে নিবদ্ধ। হাতের আঙুলের ডগা কাঁপছে মৃদু। হয়তো নতুন জীবনের অজানা আশঙ্কা, হয়তো একটি সম্পর্কের দায়ভার কে জানে! আবির একবার পাশে তাকাল। মেয়েটির মুখের রেখায় কী যেন লেখা আছে পড়তে পারল না সে।

“ মা কবুল বলুন?”
কাজি সাহেবের কণ্ঠ যেন সমগ্র ঘরের নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর করল।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবির। তার চোখে কিছু আবেগ দোল খেয়ে উঠল। যেগুলোর ব্যাখ্যা সে নিজেই জানে না। অরিনের চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। সে মাথা উঁচিয়ে পরিবারের সবাইকে একপলক দেখে নিল। অতঃপর কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“কবুল।”
কিছুক্ষণ মৌন থেকে দুবার উচ্চারণ করল “ কবুল।”
কাজি সাহেব সহ সকলে একযোগে আলহামদুলিল্লাহ বলল। কাজি সাহেব আবির কে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“ বাবা এবার আপনি বলুন। ”
আবির আড়চোখে সারহানের দিকে তাকায়। সারহান ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসে। চক্ষু নাচিয়ে ইশারা করে কবুল বলার জন্য। আবির মৃদু হাসে। অরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে কিছুক্ষণ মৌন থেকে তিনবার কবুল উচ্চারণ করল। অতঃপর কাজি সাহেব দোয়া করলেন নবদম্পতির জন্য।
দোয়া শেষ করে বললেন;

“এগারো লক্ষ এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া রফিক ইসলামের একমাত্র পুত্র আবির ইয়াশফির সঙ্গে আজমল চৌধুরীর বড় মেয়ে অরিন চৌধুরীর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হইল।”
বিবাহের এই পবিত্র বন্ধনে দুই পরিবার মিলিত হইল আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। সাক্ষী ছিলেন আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা, যাহাদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হইল একটি নতুন জীবনের সূচনা।
আল্লাহ তাহাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় ও বরকতময় করুক। আমিন।”
কাজি সাহেব পবিত্র বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কাবিন নামা সামনে রাখলেন।
“আপনারা দু’জন কাবিন নামায় স্বাক্ষর করুন,” বললেন কাজি সাহেব। তার কণ্ঠে দায়িত্বের ভার।
আবির কলম হাতে তুলে নিল। তার আঙুলের মাঝে শক্ত হয়ে থাকা ধাতব কলমটি যেন আজ একটি সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করতে চলেছে। চোখ স্থির, মনেও স্থিরতা। কাগজের সাদা অংশে নামের জায়গায় প্রথম দাগটা টানল সে;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩০

“আবির ইয়াশফি”।
তারপর অরিনের দিকে কলম এগিয়ে দেওয়া হলো। মেয়েটির নরম হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, কিন্তু আঙুলের ডগায় কাঁপুনি। নতুন জীবনের পথে এই এক টুকরো কাগজই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। সে কলম ধরে রাখল এক মুহূর্ত, চোখ নামিয়ে আনল কাগজের দিকে, তারপর ধীর হস্তে দৃঢ়ভাবে লিখল;
“অরিন চৌধুরী”।
সাদাত তার ক্যামেরায় প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখছে। লেন্সের ওপাশ থেকে দেখলে বোঝা যায়। এই মুহূর্তটুকু শুধু একটি কাগজে স্বাক্ষর নয়, এটি দুটি মানুষের জীবনে স্থায়ী হয়ে থাকার অমোঘ ছাপ।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩২