প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৪
আদ্রিতা নিশি
“ ভাই আমি তো মজা করে নাম্বার চাইলাম আর তুই আমার চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি দিলি? ”
রাহিম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না জানের টুকরা বন্ধু তাকে হুমকি দিলো। সাদাত সরাসরি তাকায় রাহিমের দিকে। কাঁধ চাপড়ে শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ তুই মোটেও মজা করে বলিসনি এটা আমি জানি। ”
রাহিম থতমত খেয়ে যায়। নজর লুকায় সাদাতের থেকে। মুখ চুপসে ছোট হয়ে যায় । তুহিন খানিকটা অবাক হলো। কিছুটা সন্দেহ জাগল মনে। কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করে ;
“ কাহিনি কি মামা? ”
সাদাত অদ্ভুত হেসে বলল ;
“ নাথিং। ”
“ মনে হচ্ছে কাহিনী আছে। ”
“ কোনো কাহিনি নেই। ভুলভাল ভাবা বাদ দে। ”
সাদাত স্বাভাবিকভাবে বলল। তুহিন এবং রাহিম সন্দিহান দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। তাদের মনে সন্দেহ জেগেছে। তারা জানে বন্ধু সহজে কাউকে নিয়ে এতোটা সিরিয়াস হয় না। কিন্তু এবার কাহিনী ভিন্ন। সাদাত দুজনের দৃষ্টি পরখ করে বলল ;
“ চল ওরা কোথায় গেল দেখে আসি। ”
তুহিনের ভাবনায় ছেদ পড়ে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল ;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ চল। ”
তারা তিনজন ইশরারা যেখানে গিয়েছে সেখানে গেল।
রাতের গভীরতা বাড়ছে। টি বাঁধে লোক সমাগম কমে আসছে। এর মাঝে দীর্ঘক্ষণের আড্ডা শেষ করে রাহিম, তুহিন, সুনয়না ও তিহা প্রস্থান করেছে সেখান থেকে। সাদাত এবং ইশরাও বাইকে রওনা দিয়েছে চৌধুরী ভিলার দিকে।দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে আছে।
“ সাদাত? ”
ইশরা শান্ত কন্ঠে ডাকল। ব্যস্ত রাস্তায় নজর রেখে সাদাত স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো ;
“ বল। ”
ইশরা একটু সাহস পেল। কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল ;
“ ওই দুই আপুর মধ্যে তোর গার্লফ্রেন্ড কোনটা?”
সাদাতের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না তৎক্ষনাৎ। সে নিশ্চুপ হয়ে রইল। ইশরা একটু উদ্বিগ্ন হলো। সাদুর বাচ্চা রেগে গেল নাকি? পুনরায় শুধায় ;
“ কোনটা বল। ”
সাদাতের শান্ত,শীতল কন্ঠস্বর শোনা গেল;
“ ওরা দুজনে আমার ক্লাসমেট।”
“ ওহহ। আমি ভাবলাম হয়তো দুজনের মধ্যে কেউ একজন তোর গার্লফ্রেন্ড। ”
“ ওরা সবাই কি তোকে দেখে ভেবেছে জানিস?”
“ কী ভেবেছে? ”
“ ভেবেছে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড। ”
সাদাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল। ইশরা ভীষণ লজ্জা পেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে এদিক ওদিক তাকাল। সাদাত বাইকের মিররে দেখল দৃশ্যটা। মৃদু হাসল। মেয়েটা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে।
“ তুই এবং তোর চুলগুলো এতো অসভ্য কেন রে? ”
সাদাতের দৃঢ় কন্ঠস্বর। ইশরা থতমত খেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না কেন এমন কথা বলল সাদাত? ভ্রুযুগল কুঁচকে বলল ;
“ মানে? ”
সাদাত বাঁকা হেসে বলল ;
“ তুই এবং তোর চুল আমায় ভীষণ জ্বালাচ্ছিস। ”
ইশরা বিস্মিত হয়ে তাকায় সাদাতের দিকে।অতঃপর বাতাসে উড়ো চুলগুলো একহাতে গুছিয়ে নেয়।কিন্তু বিস্ময় ভাব কাটে না। সে কখন জ্বালালো? আজ তো তেমন কোনো কিছু সে করেনি তবুও তাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে বেয়াদব ছেলে কোথাকার। মুখ ভার করে গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ আমি তোকে কখন জ্বালালাম? ”
সাদাত পুরূ কন্ঠে বলল;
“ বেজায়গায় হাত দিয়ে বলছিস কখন জ্বালিয়েছিস? হাত ঠিক কর। ”
ইশরা হতবিহ্বল হয়ে গেল৷ তৎক্ষনাৎ হাত টা ভালোভাবে সাদাতের কাঁধে রাখল। মুখখানা চুপসে গেল। এভাবে অপমান? বেজায়গায় হাত ছিলো না অথচ অপবাদ দিলো বদমাশ ছেলে কোথাকার।
“ আজকে তোকে দেখতে ঝাক্কাস লাগছিলো। ভালো হয়েছে রাহাতের সাথে অরিন আপুর বিয়ে হয়নি। নয়তো রাফির বাচ্চা ভাইয়ের বিয়েতে এসে তোকে পটানোর ধান্দায় থাকতো।”
সাদাত শব্দ করে হেসে বলল। ইশরা কটমট করে তাকাল। চাপা স্বরে বলল ;
“ একদম বাজে কথা বলবি না। ”
“ আচ্ছা বলবো না। উম আগামীকাল ভার্সিটিতে যাবি?”
“ হ্যা যাবো। ”
“ ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমাদের ভার্সিটিতে আসিস। ”
“ কেনো? ”
“ প্রোগ্রাম আছে। ”
“ আমি তোদের ভার্সিটিতে যাবো না। ”
ইশরা রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলে উঠল। সাদাত ত্যাড়া স্বরে বলল ;
“ থাক তুই তোর ভাঙাচোরা বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি নিয়ে। তোকে আসতে হবে না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।”
ইশরা তেতে উঠে সাদাতের পিঠে কিল বসিয়ে বলল ;
“ একদম বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটিকে ভাঙাচোরা বলবি না। ”
সাদাত ব্যথায় মৃদু চিৎকার দিল। ধমকে বলল ;
“ ত্যাড়ামো করলে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যাব টমেটো। ”
ইশরা সংকোচভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সাদাতের দিকে। বিপরীতে আয়নাবন্দি সাদাত দেখল ইশরার অদ্ভুত অভিমানী মুখাবয়ব রাগ মিশে আছে যেন মৃদু ভগ্ন হৃদয়ের ছায়া। ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে চাপা হাসি দিল সে একান্তই নিজের জন্য। ইশরা টের পেল না সে হাসি। তার চোখের দৃষ্টি তখনো সাদাতের অবয়বেই নিবদ্ধ।সাদাত আবারও দৃষ্টি ফেরাল পথের দিকে। বাইকের গতি খানিকটা বাড়িয়ে দিল।রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। সময় বারোটা বেজে পনেরো মিনিট। নিস্তব্ধতা নামতে চাইছে নগরীর চেনা পথঘাটে। তবুও কিছু প্রানহীন বাতাস ছুটে চলেছে নিশীথ নিস্তব্ধতা ছুঁয়ে। মানুষ ও মানবী ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে একটি দু’চাকার বাহনে একসাথে অথচ দুটি ভিন্ন চিন্তায় নিমগ্ন। বাতাস নরম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে তাদের চিবুকে, এলোমেলো করছে চুল।
সাদাত হঠাৎ স্বর নিচু করে অচেনা সুর তুলল গভীর রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে সেই সুর ছুঁয়ে গেল ইশরার কানে। বিস্ময়ের ছায়া নেমে এলো তার চোখে। এই সাদাত গান গায়? হয়তো এই মুহূর্তে রাতের নীরবতার চেয়েও অবাক করার মতো কিছুই ছিল না তার কাছে!
“ চলো বলে ফেলি কতো কথা কলি
জন্মেছে তোমায় বলতে, তোমাকে চাই….
ঝলসানো রাতে এ পোড়া বরাতে
তুমি আমার অন্ধকার আর রোশনাই.….
কার্ণিশে আলতা মাখানো
দিনেরা ঢলে পড়ে রাতে…..
তারপর রাত্রি জাগানো
বাকিটা তোমারি তো হাতে
জেগে জেগে আমি শুধু ঘুমিয়ে পড়তে চাই
থেকে থেকে সেই মেঘেতে, যাই বেড়াতে যাই
তোমাকে পাই……”
রাত্রির আবরণ সরিয়ে সোনালি আভায় ভরে উঠেছে ধরিত্রী। নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর চোখ মেলে চাওয়ার মুহূর্ত এটি যেন নতুন দিনের আলিঙ্গন। পূর্ব দিগন্তে সূর্য লালিমা ছড়িয়ে ঘোষণা করছে ঊষার আবির্ভাব। শিশিরবিন্দুতে রৌদ্রের ঝলক লেগে উঠছে মুক্তোর দ্যুতিতে। বাতাসে এখনও রাতের শেষ স্নিগ্ধতার স্পর্শ।অথচ ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে নিস্তব্ধ প্রকৃতি। নতুন সকালের আলোয় ধরণী সেজে উঠেছে নবজীবনের প্রত্যয়ে।
সকাল নয়টা দশ।
অরিত্রিকা কাঁধের ব্যাগ আঁকড়ে ভার্সিটির প্রধান ফটক পেরোল। চঞ্চল দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল চারপাশে। ক্যাম্পাসের বাতাসে পরিচিত ব্যস্ততা।শিক্ষার্থীরা দলে দলে ক্লাসের পথে ছুটছে, কেউবা আবার আড্ডায় মগ্ন। সাজসজ্জার বাহুল্যও চোখে পড়ল তার।মনে পড়ল আজ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে কোনো অনুষ্ঠান আছে। তাদের বন্ধুমহলও ঠিক করেছে ক্লাসের পর সেখানে যাবে।ধীর পায়ে হেঁটে প্রায় সাত মিনিটের মাথায় নিজের ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল অরিত্রিকা। ক্লান্ত চোখের কোণে তখনও রাত জাগার ধকলে জমে থাকা ঘুমের ছাপ। গতরাতটা নির্ঘুম কেটেছে অস্থির ভাবনায়, ফেলে আসা কথার প্রতিধ্বনিতে।সারহানের বলা প্রতিটি বাক্য যেন মনের বক্ষপিঞ্জরে দাগ কেটে আছে। সারারাত জেগে ভেবেছে সে সারহানকে এবং তার কথাগুলোকে আর অজানা অনুভূতির তোলপাড়কে।
“ এমপি সাহেবের বিবিজান থুক্কু বান্ধবী কেমন আছিস? ”
উক্ত সম্বোধনে আচমকা কেউ ডাকায়া অরিত্রিকা চমকে যায়। চমকিত নয়নে তাকায় সামনে। রাহা ও তিশা হাস্যরত মুখে এগিয়ে আসে। দুজনে মিটিমিটি হেসে চলেছে। অরিত্রিকা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে ;
“ এসব কি বলছিস? মাথা ঠিক আছে? ”
তিশা মুখ বেঁকিয়ে বলে ;
“ ঢং বাদ দে। কাহিনী যা বোঝার অরিন আপুর হলুদের দিন বুঝে গিয়েছি। ”
“ কীসের কাহিনী? ”
“ যদি রাজি হোস…..
রাহা দাঁত কেলিয়ে গেয়ে উঠল গানটা। অরিত্রিকা থতমত খেল। তারমানে অসভ্যগুলো বুঝতে পেরেছে। এখন পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলে ছড়িয়ে দেবে। থতমত খেয়ে বলল ;
“ গানটা উনি আমার জন্য গায়নি। উনার ইচ্ছে হয়েছিল তাই গেয়েছে। ”
রাহা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল ;
“ আমরা কখন বললাম এমপি সাহেব তোর জন্য গান গেয়েছে?”
“ এখনি তো বললি। ”
“ আমি তো এমনি গান গেয়েছি অথচ তোর উনার কথা মনে পড়ে গেল। বাহ! কত্তো ভালোবাসা। ”
অরিত্রিকার লজ্জা লাগল।অস্বস্তি ও হচ্ছে ভীষণ। বাদরগুলো ঠিক ধরে ফেলেছে। এবার সারাদিন জ্বালাতন করবে তাকে। তিশা তাল মিলিয়ে বলল ;
“ যেদিন অরিত্রিকার বুলেট লেগেছিল সেদিন আমি এমপি সাহেবের ভাবভঙ্গিতে এবং বিচলিতভাবে বুঝেছিলাম উনি তোকে ভালোবাসে কিংবা পছন্দ করে। শিউর ছিলাম না বিষয়টা। অতঃপর অরিন আপুর হলুদের রাতে ক্লিয়ার হয়ে গেল বিষয়টা। ”
অরিত্রিকা মুখ কাচুমাচু করে বলল ;
“ ধ্যাত তোরা এক লাইন বেশী বুঝেছিস।”
রাহা এক গাল হেসে বলল ;
“ হ্যা আমরা এক লাইন বেশী বুঝি। এবার বল প্রেম কতো দূর এগোলো আর বিয়ের দাওয়াত পাবো কবে? ”
“ তোরা কিন্তু বেশী বাজে বকছিস। উনার সাথে প্রেম প্রশ্নই উঠে না। ”
“ তাহলে এমপি সাহেবের নাম তোর হাতে লেখা কেন? ”
“ কোথায়?”
অরিত্রিকা হাত লুকিয়ে হাসার ভাণ করে বলল। তিশা ত্যাড়া কন্ঠে বলল ;
“ হাত লুকিয়ে লাভ নেই বইন। আমরা দেখে ফেলেছি। ”
অরিত্রিকা আমতা আমতা করে বলল;
“ ক্লাসে চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে। ”
উক্ত কথাটি বলে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংয়ের দিকে ছুট লাগালো। তিশা ও রাহা পিছু পিছু ছুটল।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর অরিত্রিকা ও তার বন্ধুমহল ডিপার্টমেন্টের সামনের সবুজ ঘাসে বসে পড়েছে। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে কেউ কেউ কথা বলছে, কেউবা নীরবে চারপাশ দেখছে।ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা কেউই আর যায়নি। হয়তো ইচ্ছের অভাব, কিংবা অন্য কোনো অজানা কারণে।অরিত্রিকার ফোন বেজে উঠেছিল কিছুক্ষণ আগে সাদাতের কল। ওর স্বভাবসুলভ স্বরে বলেছিল,
“চলে আয়, অন্তত একবার দেখে যা প্রোগ্রামটা।”
অরিত্রিকা নিষ্প্রভ কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল,
“না, থাক। আমার ইচ্ছে নেই।”
সাদাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল,
“ঠিক আছে, যেমন তোর ইচ্ছে।”
অরিত্রিকা আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে। আশেপাশে কি হচ্ছে তার খেয়াল নেই। মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। রুদ্র হঠাৎ ডেকে ওঠে;
“ অরিত্রিকা? ”
অরিত্রিকার ভাবনা ছেদ হয়। সে ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকায় রুদ্রের দিকে? প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলল ;
“ কিছু বলবি? ”
“ হ্যা। একটা কথা বলার ছিলো। ”
“ ফটাফট বলে ফেল। ”
“ আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের সবাইকে ফলো করছে। ”
রুদ্র চাপা স্বরে বলল। অরিত্রিকার কপালে ভাজ পড়ল। সে আশে পাশে নজর বুলালো। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে পেল না। রুহান, তিশা ও রাহা তিনজন চারদিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখল। তেমন কেউ নেই। রুহান বলল ;
“ আমাদের কে ফলো করবে? ”
রুদ্র বিরক্তিবোধ করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল ;
“ মনে নেই দুইমাস আগের কথা?
“ ও হ্যা। মনে পড়েছে। আমাদের কেউ ফলো করে। সেই মানুষটা আবার ফলো করা শুরু করে দিয়েছে?”
“ আমার তাই মনে হচ্ছে। আমরা এখানে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন হঠাৎ নজর যায় দূরের আমগাছের দিকে। সেখানে কেউ একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ”
“ আমার মনে হয় কেউ অরিত্রিকার পেছনে লেগেছে। কোনো শ’ত্রু হয়তো জানতে পেরেছে অরিত্রিকা এমপি সাহেবের কাজিন। ”
রাহা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে শব্দ উচ্চারণ করল। তার কণ্ঠস্বরে অজানা সংশয়ের উপস্থিতি। বাকিরাও কথাটির গভীরতা অনুধাবন করে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।অরিত্রিকার মনের কোণে অস্বস্তির শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুকের ভেতর হঠাৎই কেমন যেন শূন্যতা অনুভূত হলো। স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে ভেসে উঠল কিছু ধূসর মুহূর্ত অতীতের দুঃসহ অভিজ্ঞতা। গলা শুকিয়ে এলো। মনে হলো যেন প্রতিটি শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কপালের ওপর টপটপ করে ঘামের কণা জমতে শুরু করল, হৃৎপিণ্ডের তাল ধরা ধরা ভাব।তবে কী… তবে কী আবারও সেই ভয়াবহ ঘটনা পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে?প্রথমবার নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়েছিল সেই ভয়ংকর সময়, সেই লড়াইয়ের মাধ্যমে। কিন্তু যদি এবারও একই পরিণতি সামনে আসে, তবে কী সত্যিই আর ফিরে আসা সম্ভব হবে? নাকি এইবার জীবন তাকে নিঃশেষ করে দেবে?
তিশা অরিত্রিকার অদ্ভুত ব্যবহার দেখে ভয় পেয়ে গেল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ অরিত্রি তুই ঠিক আছিস?”
অরিত্রিকার উত্তেজিত ভাব বাড়ল। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা প্রায়। সকলে তা দেখে ভয় পেয়ে গেল। রাহা দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢাকনা খুলে অরিত্রিকার হাতে দিলো। অরিত্রিকা পুরো বোতলের পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিল। মাথা এলিয়ে দিল তিশার কাঁধে। ধীর কন্ঠে বলল ;
“ আমায় কেউ বাতাস দে। ”
রুদ্র,রাহা ও রুহান নিজেদের ব্যাগ হতে খাতা, বই বের করে বাতাস দিতে লাগল।অরিত্রিকা নিজেকে শান্ত করতে চোখ বন্ধ করল।
অরিত্রিকা ভার্সিটির প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শরীর আগের তুলনায় খানিকটা ভালো অনুভব হচ্ছে, তাই ক্যাম্পাসে আর সময় না কাটিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এক হাতে কাঁধের ব্যাগ ঠিক করতে করতেই চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে।কিছুক্ষণ আগে সাদাতকে কল করেছিল সে। জানতে চেয়েছিল, সে ফ্রি আছে কি না।সাদাত স্বভাবসুলভ স্বরে বলেছিল,
“হ্যাঁ, ফ্রি আছি। কেন?”
পরমুহূর্তেই অরিত্রিকা বলেছিল,
“তাহলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি? বাইকে করে?”
সাদাত হালকা হেসে বলেছিল,
“ঠিক আছে, ভার্সিটির গেটে দাঁড়া আমি আসছি।”
ফোন রেখে অপেক্ষায় থাকল সে। বাতাসের মৃদু দোলা যেন সামান্য ক্লান্ত দেহে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ পাশের কারো উপস্থিতি অনুভব করল অরিত্রিকা। একটা চাপা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। কৌতূহলী হয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল পাশে আর সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ময়ের আবরণ ছড়িয়ে গেল দৃষ্টিতে।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে গেল। অবিশ্বাস মিশ্রিত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলে উঠল,
“আপনি?”
“ কেমন আছেন মিস অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী? ”
মানবটি মৃদু হেসে শুধায়। অরিত্রিকা আরেক দফা অবাক হয়। কৌতুহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে;
“ আপনি আমার পুরো নাম কিভাবে জানলেন মিঃ ইলহাম? ”
ইলহাম হাসে;
“ আপনার পরিচয়, নাম সবকিছু জানি মিস। এবার বলুন কেমন আছেন?”
অরিত্রিকা অন্যত্র দৃষ্টি স্থির করে ধীর কন্ঠে বলল ;
“ ভালো আছি। ”
“ সারহান কেমন আছে? বহুদিন ব্যাটার খোঁজ খবর নেওয়া হয়না। এমপি হয়ে বোধ হয় আমায় ভুলে গেছে। কিন্তু কোনো ব্যাপার না খুব শীঘ্রই আমাদের মুলাকাত হবে।”
“ আপনি সারহান ভাইকে কীভাবে চেনেন? ”
অরিত্রিকা চমকিত নয়নে তাকিয়ে বলল। ইলহাম ওষ্ঠ এলিয়ে হাসল। রহস্যময় হেয়ালি কন্ঠে বলল ;
“ রাজশাহীর এমপি বলে কথা এক নামে সবাই চেনে। ”
“ আমার মনে হচ্ছে আপনি সারহান ভাইকে আপনি পার্সোনালি চিনেন। ”
“ হয়তো পার্সোনালি চিনি। ”
অরিত্রিকার মনে কেমন যেন অজানা সন্দেহ দানা বাঁধল। তবে সে আর কোনো কথা বলল না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। বাতাসের মৃদু দোলায় চুলের একগোছা সামনে এসে পড়ল। সে হাত বাড়িয়ে তা সরিয়ে নিল।চোখ নামিয়ে নিল এবং দৃষ্টি স্থির করল অন্যদিকে।ইলহাম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মেয়েটা এমন মায়াবী কেন? এমন কোমল সৌন্দর্য যার দিকে তাকালে যে কেউ এক মুহূর্তের জন্য হলেও হারিয়ে যাবে!আর সে? সে তো সত্যিই হারিয়ে গেছে।আটাশ বছরের জীবনে কখনো এমন অনুভূতি হয়নি তার।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৩
কখনো কাউকে দেখে এমন মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায়নি হৃদয়কে। অথচ এই মেয়েটিকে প্রথমবার দেখার পর থেকেই কিছু যেন বদলে গেছে। রাত জেগে ভেবেছে তাকে নিয়ে, তার কণ্ঠস্বর, তার হাসি, এমনকি তার ক্ষণিকের অভিমানও!কিন্তু অরিত্রিকা কিছুই জানে না।
সে জানে না, কত রাত ইলহাম তার নাম ভেবে নির্ঘুম কাটিয়েছে। জানে না, তার এক ঝলক দৃষ্টি কীভাবে কারো পুরো পৃথিবী ওলট-পালট করে দিতে পারে।