প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৫
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা ও সাদাত ভার্সিটি থেকে মাত্রই ফিরে এসেছে। ক্লান্ত পদক্ষেপে লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো লিভিংরুমে উপস্থিত সবাই যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। তবে সারহান, আবির, অরিন ও ইশরাকে সেখানে দেখতে পেল না তারা।সামনের দৃশ্য দেখে অরিত্রিকা ও সাদাতের কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হলো। কী বিষয়ে এত গম্ভীর আলাপ চলছে? দ্বিধা ও কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টি বিনিময় করে দুজনেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো।তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মুহূর্তের মধ্যেই বাক্যালাপ স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন তাদের আসার আগেই কোনো অদৃশ্য সমাপ্তি টেনে দেওয়া হলো আলোচনার।
আজমল সাহেব হাসার ভাণ করে মেয়ে ডাকলেন ;
“ অরিত্রিকা আম্মু! আমার পাশে এসে বসো।”
অরিত্রিকা কপাল কুঁচকে গেল। এটা কি হলো? তাদের দুজনকে দেখে হঠাৎ কেন কথোপকথন বন্ধ করে দিলো সবাই? কি নিয়ে আলোচনা করছিল। সে তানিয়া বেগম, সাথী বেগম, আরশাদ সাহেব, ইসমা বেগম এবং ইরফানের দিকে তাকালো। হয়তো কিছু বোঝার প্রয়াস চালালো। কিন্তু অক্ষম হলো বুঝতে। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বসল বাবার পাশে। সন্দেহবাতিক কন্ঠে শুধায়;
“ কি নিয়ে আলোচনা করছিলে তোমরা আর আমরা আসতেই আলোচনা বন্ধ করে দিলে কেনো?”
আজমল সাহেব স্বাভাবিক ভাবে বললেন ;
“ জরুরী একটা বিষয় নিয়ে বাড়ির বড়রা মিলে আলোচনা করছিলাম। তোমাদের আপাততঃ এ বিষয়ে জানার দরকার নেই। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ইরফান ভাই তোমাদের বয়সী হলো কবে? না মানে উনার বয়স তোমাদের তুলনায় অনেক কম তাও আলোচনায় সামিল হয়েছে অথচ আমি শুধু জানতে চাইলাম কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল? সেই প্রশ্নের উত্তর দিলে জানার দরকার নেই। ”
“ ভার্সিটি থেকে ফিরেছো ফ্রেশ হয়ে নাও। ”
আজমল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন। অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করল। শব্দ করে উঠে পড়ল সোফা থেকে। মুখ গোমড়া করে ধপাধপ পা ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করল। সাদাত এতোক্ষণ চুপ ছিল। সে তার বাবার কাছে গিয়ে বসল। আজমল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“ চাচ্চু আই থিংক তোমার অরিত্রিকাকে সবকিছু বলে দেওয়া দরকার আর কতো দিন ওর থেকে বিষয়টা গোপন করে রাখবেন? ”
আজমল সাহেব সরু চোখে তাকালেন সাদাতের দিকে। ভাইয়ের ছোট ছেলেটা ও ভীষণ বুদ্ধিমান। মানুষ হা করলে পেটের নাড়ির খবর পর্যন্ত বোঝার ক্ষমতা রাখে।তিনি জানেন, সাদাত সারহানের মতোই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। তিনি মৃদু হেসে বললেন ;
“ বেশীদিন গোপন রাখবো না। আর মাত্র পাঁচ ছয় মাস। তারপর জানিয়ে দেবো। ”
সাদাত কিছু বলবে তার আগে আরশাদ সাহেব ছেলেকে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ;
“ বড়দের বিষয়ে তোমার কথা বলা উচিত নয়। আমরা সকলে মিলে বিষয়টা হ্যান্ডেল করছি। ”
সাদাত ভদ্র ছেলের মতো মাথা দুলালো। অতঃপর আরশাদ সাহেবকে সতর্ক করতে বলল;
“ পাঁচ ছয় মাস সময়টা কিন্তু অনেক। আমার মনে হয় অরিত্রিকা দ্রুত অবগত করা উচিত। পরে না দেরী হয়ে যায়। ”
“ তেমন কিছু হবে না। ”
সাদাত একপলক ইরফানের দিকে তাকাল। তীক্ষ্ণ সেই চাহনি। ইরফানের মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে উচ্ছসিত ভাব। কেমন যেন আমোদিত ছাপ। মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে ওষ্ঠকোণে। সাদাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। হয়তো সামনে সকলের জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে। সে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। সোফা থেকে উঠে সোজা নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
“ ভাইসাব আমার মনে হয় অরিত্রিকাকে সবকিছু বলে দেওয়া উচিত। ”
সাথী কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন। আরশাদ চিন্তিত হলেন। তবুও বললেন ;
“ আজমল যেহেতু এখন বিষয়টা জানাতে চাইছে না সেহেতু বিষয়টা গোপন থাক। ”
সাথী বেগম দমে গেলেন এহেন কথায়। তানিয়া বেগম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তিনি জানেন এই মুহুর্তে কিছু বলেও লাভ হবে না। ইসমা বেগম বললেন ;
“ সাথী চিন্তা করো না। সময় হলে সবাই সবটা জানতে পারবে। ”
সাথী বেগম কোনো উত্তর দিলেন না। আজমল সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন ;
“ ভাইসাব আজকে আবিরের বাবা মা আসবে সন্ধ্যায় আপনি উনাদের সাথে কথাবার্তা বলে নিয়েন। ”
আরশাদ সাহেব ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন ;
“ মেয়ের বাবা তুমি না আমি? ”
“ আমি। ”
“ তাহলে তাদের সাথে কথা কে বলবে? ”
“ আপনি।”
“ এটা কি ধরনের ব্যবহার আজমল? প্রথমবার বেয়াই বেয়ান আসছে অথচ তুমি ছোট বাচ্চাদের মতো রাগ করে আছো?”
আরশাদ সাহেব গমগমে কন্ঠে বললেন। আজমল সাহেব মুখ ভার করে বললেন ;
“ আবিরকে আমার মেয়ের জামাই হিসাবে পছন্দ নয়। ”
“ আশ্চর্য! এখনো সেসব নিয়ে পড়ে আছো? অরিন এবং আবিরের একে অপরকে যেহেতু পছন্দ তাহলে তোমার মেনে নিতে এতো সমস্যা কেনো? ”
“ কারণ আবির পলিটিক্স করে।”
“ পলিটিক্স করলে কী সমস্যা? ”
“ অনেক সমস্যা ভাইসাব। ”
“ বাড়ির ছেলে পলিটিক্স করলে সমস্যা নেই অথচ বাড়ির জামাই পলিটিক্স করলে সমস্যা। একেই বলে বাঙালী। ”
আরশাদ সাহেব বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন। আজমল সাহেব মুখখানা কাচুমাচু করে বসে রইলেন। সাথী বেগম মুখ বেঁকিয়ে বললেন ;
“ ভাইসাব আপনার ভাই আগে পলিটিক্স করতো তখনকার কথা নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। আপনি মনে করিয়ে দিন। ”
আজমল সাহেব আড় চোখে সাথী বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন ;
“ আহ সাথী তুমি আমার অতীত নিয়ে টানাটানি করছো কেনো? ”
“ আপনি আমার মেয়ের জামাইকে নিয়ে টানাটানি করছেন আর আমি আপনার অতীত নিয়ে টানাটানি করছি হিসাব বরাবর। যদি আবিরকে নিয়ে আর একটা কথা বলেন আপনার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে বলে দিলাম। ”
“ তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো সাথী? আমার অতীতের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছো? আয় আমার কপাল এ কাকে বিয়ে করেছি আমি? ”
আজমল সাহেব হতাশাপূর্ণ কন্ঠে কপাল চাপড়ে বলে উঠলেন। সাথী বেগম কটমট করে তাকালেন স্বামীর এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে। তানিয়া বেগম এবং ইসমা বেগম মুখ টিপে হাসলেন। আরশাদ সাহেব বিরক্ত ভাব নিয়ে বসে রইলেন নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। ইরফান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলে ;
“ মামা – মামী আপনার ঝগড়া কন্টিনিউ করুন। আমি আসছি। ”
কথাটা বলে ইরফান সেখান থেকে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল সেখান থেকে।
“ কল্লোল ফাউন্ডেশনে কিছু অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত দুই বছরে টাকা গড়মিলসহ কিছু মানুষের নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। এটা নিয়ে সরকারের গোপন একটা টিম অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছে। আই থিংক এতো বড় কোম্পানির এমন অসাধু কর্মকাণ্ডের পেছনে কোনো প্রভাবশালী রয়েছে। ”
টানা তিনটি মিটিং শেষ করে পার্টি অফিসের নিজ কক্ষে গম্ভীর মুখে বসে আছে সারহান। ক্লান্তি তার চেহারায় ছাপ ফেললেও দৃষ্টিতে অনড় কঠোরতা।
সামনের চেয়ারে বসে থাকা আবিরের মুখেও গভীর উদ্বেগের ছাপ। তার হাতে ধরা কল্লোল ফাউন্ডেশনের কিছু গোপন নথি।যেগুলোকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই রাজনীতির উচ্চ মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে।পরিস্থিতি এতটাই স্পর্শকাতর যে দলের শীর্ষ নেতারা একের পর এক ফোন করে চলেছে সারহানকে। কেউ ব্যাখ্যা চাইছে, কেউ সতর্ক করছে, আবার কেউ নির্দেশ দিচ্ছে।এই ঝড় সামলানোর পথ খুঁজে বের করতেই হবে!
সারহান হাতে থাকা কলম আঙুল দ্বারা ঘুরাতে থাকে। মৌন থেকে কিছু একটা ভেবে চলেছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ টেবিলের ওপরে রাখা নথিপত্রের দিকে। যেখানে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে কল্লোল ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানের কারচুপির বিস্তারিত তথ্য। প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি বিস্ফোরণ।যা ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় তুলেছে।প্রেস ও মিডিয়া এখন এক মুহূর্তের জন্যও এ ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হচ্ছে অনবরত, আর রাজনৈতিক মহলে চাপা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে।
আগামীকাল রাজশাহীর দলীয় কার্যালয়ে এই বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করবে সারহান। কী বলবে, কিভাবে সামলাবে এই পরিস্থিতি। সেই ভাবনায় যেন তার মস্তিষ্ক জটিল সমীকরণের সমাধান খুঁজছে।
আবির কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে ;
“ কল্লোল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল হাসান এবং তার পরিবারের লোক ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে আর প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা পরিবার সহ উধাও। ”
সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আবিরের দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ;
“ বিরোধী দলের কেউ কল্লোল ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত আছে কিনা এটা জানা জরুরী।এটা জানার ব্যবস্থা কর আর আগামীকাল প্রেস ব্রিফিংয়ের সময়টা বিকাল চারটায় সেট কর। ”
“ ওকে। ”
“ নয়ন তালুকদারের ছেলের নাম কী আবির? ”
“ নয়ন তালুকদারের ছেলের নাম জেনে কী করবি? ”
আবির কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করে। সারহান হাতে থাকা কলম টেবিলের ওপর শব্দ করে রাখল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“ কারণ অবশ্যই আছে। ”
আবির ভাবুক স্বরে বলল ;
“ নাম মনে নেই আমার। মেবি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তোদের ব্যাচে। ”
“ নিশাদের রিলেটিভ। ”
“ মনে পড়েছে। ”
“ তোর স্মৃতিশক্তি কম কেনো? ”
“ ছোটবেলায় কাজুবাদাম কম খেতাম তাই।”
আবির ক্যাবলামার্কা হেসে বলল। সারহান বিরক্তবোধ করল এহেন কথায়। সে কথা না বাড়িয়ে টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রোল করতে লাগল। এরমাঝে দরজা খুলে প্রবেশ করল ইনান। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। সারহানকে ফোন স্ক্রোল করতে দেখে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল ;
“ ভাই, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ”
সারহান ফোন স্কিনে নজর রেখে বলল ;
“ কে দেখা করতে এসেছে?”
“ ছেলেটার নাম ইলহাম তালুকদার। ”
ইনান স্বাভাবিক ভাবে বলল। সারহান ইরানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ ভেতরে আসতে বলো। ”
“ ঠিক আছে। ”
উক্ত কথাটি বলে ইনান বেরিয়ে গেল। সারহান ফোন রেখে দিল টেবিলে। আবিরকে ইশারা করল পূর্ব পাশের চেয়ারে বসার জন্য। আবির উঠে গিয়ে বসল সেথায়।
“ কেমন আছেন নেতা সাহেব? ”
দরজা খুলে প্রবেশ করল ইলহাম। মুখে স্বভাবসংগত সংকীর্ণ হাসির রেখা। বেশ আমোদিত ভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। সারহান তির্যক চাহনিতে পরখ করে। বাঁকা হেসে প্রতিত্তোর করে ;
“ এতোক্ষণ ভালো ছিলাম। তোকে এতোদিন পর চোখের সামনে দেখে মন আরো ভালো হয়ে গেল। ”
ইলহাম হাসে। কয়েক কদম এগিয়ে এসে ধম করে বসে পড়ে চেয়ারটায়। এ শব্দে আবির লাফিয়ে ওঠে। বুকে দুবার ফু দেয়। চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় ইলহাম নামক মানুষটার দিকে। তখনি মনে পড়ে ইলহাম তালুকদার নয়ন তালুকদারের ছেলে। এই ব্যাটা পার্টি অফিসে কোন সুখে এলো?
ইলহাম হাসি বজায় রেখে বলে ;
“ আগের মতো রয়ে গেছিস তুই। ”
সারহানের ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা প্রশস্ত হয়। কোনো প্রতিত্তোর করল না। ইলহাম এহেন নিশ্চুপতায় কিছুটা অবাক হয়। তবুও প্রকাশ করেনা। এলোমেলো চুলগুলো একহাতে ঠেলে জিজ্ঞেস করল ;
“ আমাকে হঠাৎ তোর পার্টি অফিসে কেনো ডাকলি? ”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয় ;
“ লুডু খেলতে। ”
“ মশকরা করছিস? ”
“ নো আ’ম সিরিয়াস। ”
“ এমপি হয়ে উন্নয়নমূলক কাজ না করে লুডু খেলার জন্য পার্টনার খুঁজছিস? মাথা ঠিক আছে তোর?”
ইলহাম কপাল কুঁচকে বলল। সারহানের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়। চিবুক শক্ত হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলে ;
“ আজ কাল ভার্সিটি এরিয়াতে তোকে পরোপকার করতে দেখা যাচ্ছে। পরোপকার করা ভালো বাট নির্দিষ্ট কাউকে নয়। কি বলতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছিস নিশ্চয়ই? ”
ইলহাম এতোক্ষণে কাহিনী বুঝল। তারমানে সারহান অব্দি খবর পৌঁছে গেছে। সে বুঝেও না বোঝার ভাণ করে বলল ;
“ নির্দিষ্ট কাউকে বলতে কাকে বুঝিয়েছিস?”
“স্টে অ্যাওয়ে ফ্রাম হার। আদারওয়াইজ, আই’ল মেক থিংস ওর্স ফর ইউ।”
“ আমায় হুমকি দিচ্ছিস? কী করবি তুই? ”
ইলহাম ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল। সারহান তা দেখে ক্রূর হাসে। হাসি বজায় রেখে অতি শান্ত কন্ঠে বলে ;
“আমি তোকে সময়ের পাতা থেকে ছিঁড়ে ফেলেবো, যেন তোর অস্তিত্ব নিষ্প্রভ স্মৃতির মতো মিলিয়ে বিলীন হয়ে যায়।”
ইলহাম অট্টহাসিতে ফেটে পরে। আবির বুঝতে পারে আসল কাহিনী। এই খাচ্চোর ব্যাটা নিশ্চিত অরিত্রিকার দিকে নজর দিয়েছে। সে কপাল চাপড়ায়। বন্ধুর পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বিরবির করে বলে উঠে ;
“ একদিকে ইলহাম আরেকদিকে ইরফান। এই দুইটার চক্করে আমার বন্ধুটার জীবন তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামলাবে নাকি বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামলাবে? এক দিক দিয়ে বেঁচে গেছি আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। হুট করে কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেছে। ”
সারহান সূঁচালো দৃষ্টি স্থির করে ইলহামের হাস্যরত মুখপানে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে চাপা স্বরে বলল ;
“আই’ম টেলিং ইউ এগেইন স্টে অ্যাওয়ে ফ্রাম ফাইরুজ। ইফ ইউ ডোন্ট লিসেন টু মি, আই ওউন্ট থিংক টোয়াইস বিফোর কিলিং ইউ।”
ইলহাম হাসি থামিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে ;
“ ভালোবাসিস অরিত্রিকাকে? ”
সারহান চিবুক শক্ত করে তাকিয়ে রয়। ইলহাম ওষ্ঠ এলিয়ে হাসে ;
“আই নো ইউ লাভ অরিত্রিকা। ইউ থিংক আই’ম টার্গেটিং দ্য ওয়ান ইউ লাভ, বাট ইউ’আর রং, সারহান। ডু ইউ নো দ্য ট্রুথ? আই লাভ অরিত্রিকা। আই ফেল ফর হার অ্যাট ফার্স্ট সাইট।”
সারহানের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়। ক্রোধে চক্ষুদ্বয় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করে। হিংস্রতা জেগে ওঠে তার মাঝে। টেবিলের ডয়ার থেকে রিভলবার বের করে তাক করে ইলহামের দিকে। আবিরের পিলে চমকে যায়। রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। সে দ্রুত গিয়ে সারহানের হাতে থাকা রিভলবার কেড়ে নেয়। আতংকিত ভঙ্গিতে বলে উঠে ;
“ তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এসব কি করতে যাচ্ছিলি? ”
সারহান নিঃশ্বাস ফেলল গভীরভাবে। কিন্তু তা যেন আগুনের লেলিহান শিখার মতো দাহ্য। রিভলবার হাতছাড়া হতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হলো এতটাই জোরে যে নখ যেন নিজের তালুতেই বিদ্ধ হতে চলেছে।
তার চোখ দুটো লালচে আক্রোশে টগবগ করছে। ইলহামের দিকে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যা বলিহারি শিকারীর মতো ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি দেয়।
সারহান ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি আবিরের দিকে ফেরাল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ভয়ংকর, তিক্ত সেই হাসি। কণ্ঠস্বর গভীর কিন্তু তাতে থাকা শীতলতা হাড়ের গভীর পর্যন্ত শিহরণ জাগায়,
“যা করা উচিত, তাই করতে যাচ্ছিলাম, আবির। তুই কি মনে করিস, ওকে বেঁচে যেতে দেবো?”
ইলহাম হাসি থামিয়ে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। একটা মেয়ের জন্য জান নিতেও পিছ পা হবে সারহান। তবে সে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। ভালোবাসার মানুষকে কেঁড়ে নিলে কেমন কষ্ট হয় তা বোঝাতে চায় সারহানকে।
তবে এই মুহুর্ত এখান থেকে বেরোনো জরুরী। ইলহাম এক মুহুর্ত দেরী না করে দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সারহান তা দেখে বাঁকা হাসে।
অরিত্রিকা থম মে’রে বসে আছে বিছানার ওপর। বিছানার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটা ছবি। ছবিগুলোর অধিকাংশ তার এবং সারহানের। কয়েকটা কাপল ফটো এবং সারহানের গান গাওয়ার সময়ের ছবি। যেখানে দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে এবং মৃদু হাসছে।ছবিগুলো ভীষণ সুন্দর হয়েছে। কিন্তু এই ছবিগুলো যদি অন্য কেউ দেখে ফেলে তার অবস্থা খারাপ করে দেবে। নিশ্চয়ই ফটোগ্রাফার ছবিগুলো পার্সেল করে পাঠিয়েছে। অরিত্রিকা দ্রুততার সহিত ছবিগুলো পার্সেলের বক্সে রাখল। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা ছবিতে। সেই ছবিতে অরিত্রিকা আনমনা ভাব নিয়ে বসে আছে আর তার দিকে ইরফান অপলক চেয়ে রয়েছে। ছবিটা দেখে একটু চমকে গেল। সে ভালোভাবে খেয়াল করল ছবিটা। ইরফান যে তার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝতে সময় নিলো না। সে হলুদের দিন ইরফানের ভাবভঙ্গি, চাহনি খেয়াল করেছে। সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। আগামীকাল থেকে ইরফান ভাইয়ের ভাবভঙ্গি খেয়াল করবে সে। আসল রহস্য উদ্ধার করা জরুরী।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৪
অরিত্রিকা নিঃশব্দে উঠে পার্সেলের বক্সটি আলমারির মধ্যে জামা কাপড়ের মধ্যে সযত্নে লুকিয়ে রাখল। এরপর ফুরফুরে মেজাজে বিছানায় ধম করে শুয়ে পড়ল। দুহাতে মুখ ঢেকে, লাজুক হাসিতে তার ওষ্ঠ কোণে মধুর রহস্য ফুটে উঠল।কাঠখোট্টা, বদমেজাজি সারহান ভাই যে একদিন রোমিওর বেশে আত্মপ্রকাশ করবে তা কে জানতো!তার মতো দৃঢ়চেতা একজন পুরুষ তার মতো ভালোভালা, নিষ্কলুষ একটি মেয়েকে ভালোবাসার জ্বালে এমনভাবে বন্দী করে ফেলেছে।তবে তার ছোট্ট হৃদয় যে এই প্রেমের তোলপাড়ে একেবারে বেসামাল হয়ে উঠছে। এর দায়ভার কে নেবে? অবশ্যই সেই নির্দয় সারহান ভাইকেই দায়ভার নিতে হবে। হুহ্!
অরিত্রিকা মৃদু হেসে নিজেকে পুনরায় একবার ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমার মন কুঠরীতে কল্প পুরুষ নামক মানুষটার আগমন ঘটলো তবে।”