প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৭
আদ্রিতা নিশি
গোধূলী লগ্ন পেরিয়েছে অনেক আগে। এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হচ্ছে। চৌধুরী বাড়ির সকল সদস্য আজ ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসেছে। শুধু উপস্থিত নেই সারহান, আবির এবং ইরফান। সারহান ও আবির বাড়িতে থাকলেও জরুরী মিটিংয়ে ব্যস্ত দুজন। ইরফান এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বিরাজ করছে আমোদিত ভাব। আজমল আর আরশাদ সাহেব আজ অফিস থেকে দ্রুত ফিরেছেন। কারণটা মূলত আবিরের বাবা মায়ের আসার কথা ছিল। কিন্তু তারা আসেননি আগামীকাল আসবেন।
দুই ভাই জমিয়ে খাচ্ছেন আর নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছেন।তানিয়া বেগম আর সাথী বেগম সবাইকে খেতে দিচ্ছেন। ইসমা বেগম অসুস্থ অনুভব হওয়ায় কিছুক্ষণ আগে রুমে গিয়েছেন। সাদাত আর ইশরা নিজেদের মাঝে নিরব ঝগড়া করছে আর খাচ্ছে। এদিকে অরিত্রিকার টেনশনে খাওয়া আসছে না।খাবার মুখে নিলেও গলা অব্দি নামছেনা।সে বার বার চোখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মাথায় ঘুরঘুর করছে বিকেলের কাহিনি। সারহানের বলা প্রতিটি কথা তাকে ভাবাচ্ছে। অরিত্রিকার বিশ্বাস আছে সারহান ভাই তাকে ব্যতিত অন্য কাউকে ভালোবাসে না। সে নিজ থেকে উপলব্ধি করেছে ও মানুষটার প্রতিটি কথা, চোখের চাহনি এবং ভাবভঙ্গি বলে দিয়েছে শ্যামমানব তাকে ভালোবাসে। বারবার মনে হচ্ছে সারহান জানে চিরকুটের মালিক সে। এতটুকু ভেবে গলা শুকিয়ে এলো। নিজেকে মনে মনে গালমন্দ করতে শুরু করল। কেন যে মানুষটাকে হয়রানী করেছে সে। যদি জানতো সারহান ভাই তাকে দীর্ঘ দিন ধরে ভালোবাসে তবে কখনো এমন দুঃসাহসিক কাজ করতো না। সে ভাবে, রাজনীতিবিদরা ও এতো নিখুঁত অভিনয় করতে পারে? কাউকে ভালোবেসে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা কীভাবে অর্জন করে? এদের কঠোর মনে ভালোবাসা কীভাবে স্থান পায়?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাথী বেগম আজমল সাহেবের প্লেটে ভাত তুলে দেওয়ার পর খেয়াল করলেন অরিত্রিকা খাওয়া বাদ দিয়ে চুপ করে বসে আছে। তিনি মেয়েকে পরখ করলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ;
“অরিত্রিকা খাওয়া বাদ দিয়ে চুপচাপ বসে আছিস কেনো? ”
সাথী বেগমের কথা শুনে সকলে কৌতুহলী ভাব নিয়ে অরিত্রিকার দিকে তাকালো।অরিত্রিকা হঠাৎ এহেন প্রশ্নে হচকচিয়ে গেল। দ্রুত সিঁড়ির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল;
“ আম্মু আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
“ কেনো খেতে ইচ্ছে করছে না? শরীর সুস্থ আছে তোর?”
অরিত্রিকা মুখ ভার করে বসে রইল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। পেট ক্ষিধেতে চুচু করছে কিন্তু টেনশনে খাবার গলা দিয়ে নামছে না। এরমাঝে ইরফানের কন্ঠস্বর শোনা গেল ;
“ ছোট মামী প্লেটে খাবার দাও আমি হাত ধুয়ে আসছি। ”
সাথী বেগম দেরী না করে ইরফানের কথা শুনে খাবার প্লেটে সাজিয়ে অরিত্রিকার পাশে খালি জায়গায় রাখলেন। সেখানে চেয়ার ফাঁকা রয়েছে।
অরিত্রিকা উসখুস করতে লাগল। এই মুহুর্তে কেন যেন ইরফান তার পাশে বসুক এমনটা মেনে নিতে পারছে না। তার অবচেতন মন বলছে ইরফান তোকে পছন্দ করে অরিত্রি অথচ তুই আস্ত গাধী তা বোঝার চেষ্টা করছিস না। সে মুখ গোমড়া করে মায়ের দিকে তাকাল। বিরবির করে বলল;
“ আরো দুটো চেয়ার ফাঁকা আছে সেগুলো কী চোখে দেখো না? আমার পাশের চেয়ারটায় দেখতে পেলে? ”
তানিয়া বেগম অরিত্রিকাকে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখে বললেন ;
“ কী হয়েছে তোর? মুখ গোমড়া করে আছিস কেন? খাবার স্বাদ হয়নি? ”
অরিত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে তানিয়া বেগমের দিকে তাকায়। ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিলো সে। উত্তর দিবে এমন সময় হঠাৎ পাশের চেয়ারে ধপ করে কারো বসার আওয়াজ পেলো।অরিত্রিকা উত্তর গিলে নিলো। তার ছোট্ট সত্তা চমকিত হলো।সে চকিত নয়নে দ্রুত ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকালো। পাশে পূর্ণ নজর মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো তার কল্প পুরুষ নামক শ্যামমানবকে। কিছুটা খুশি হলো সে। তবে তা মনের মধ্যে চাপা রাখল। সারহান গম্ভীরমুখে বসে আছে। দৃষ্টি সামনে খাবার সাজানো প্লেটের দিকে। কিছু একটা ভেবে প্লেট হাত বাড়িয়ে অপর পাশে সরিয়ে রাখল।
তানিয়া বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন ;
“ ভাত দেবো?”
সারহান তানিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ সবজি, সালাদ আর রুটি দাও। ”
তানিয়া বেগম একটু অবাক হয়ে বললেন;
“ ভাত খাবি না?”
“ নাহ।”
তানিয়া বেগম ছেলেকে আর কিছু বললেন না। তিনি প্লেটে রুটি,সবজি, সালাদ সাজিয়ে দিলেন। সারহান আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে খেতে লাগল। অরিত্রিকা বেশ অবাক হলো। মানুষটা তার দিকে একবারও তাকাল না কেন? ছোট্ট মন অভিমানে জর্জরিত হলো। সে মন খারাপ করে ভাত নাড়তে থাকল কিন্তু ভাত মুখে তুলল না। সারহানের আসার পরপরই আবির খেতে এসেছে। সে গিয়ে শ্বশুর এবং বউয়ের মাঝ বরাবর বসে কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে। আজমল সাহেব একটু বিরক্তবোধ করলেন এহেন কান্ডে। অরিন আড় চোখে তাকায় আবিরের দিকে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে আবির তার বাবাকে জ্বালানোর জন্য মাঝখানে বসেছে। সে হতাশ হয় শ্বশুর, জামাই দ্বন্দ্বে। ইরফান ফুরফুরে মেজাজে এসেছিল খাবার খেতে। ভেবেছিল অরিত্রিকার পাশে বসবে কিন্তু তা আর হলো কোথায়? সারহান আগে এসে বসে পড়ল সেথায়।
সাথী বেগম ইরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন ;
“ ইরফান দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? সারহানের পাশে এসে বস।”
ইরফান হাসার ভাণ করল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ধপ করে বসলো। কারো দিকে না তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে খাবার খেতে লাগল। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় ছোট করে কিছু একটা ভাবতে লাগল।
সাদাত এতোক্ষণ দূর থেকে সম্পূর্ণ কাহিনী দেখেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তার ভাই ইচ্ছাকৃত অরিত্রিকার পাশে বসেছে। ছোট মানুষ হয়ে তার চোখে তিনজনের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী চোখে পড়ছে অথচ বাড়ির লোকজন যেন অন্ধ হয়ে আছে। সাদাত খাওয়া থামিয়ে ত্যাছড়া ভাবে বলল;
“ কীরে অরিত্রি তোর আর ভাইয়ের আজ কী হয়েছে বলতো? দুজনেই মুখ তোবলা করে আছিস?”
সাদাতের কথ শ্রবণ হতেই সারহান খাওয়া থামিয়ে দেয়। কপাল কুঁচকে সরাসরি তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার মুখপাণে।অরিত্রিকা মাত্রই সারহানের দিকে তাকিয়েছিল।সারহান তাকানোতে সে হচকচিয়ে গেল। দ্রুত দৃষ্টি নত করল।
সাথী বেগম আবিরকে প্লেটে ভাত তুলে দিয়ে বললেন;
“তোদের দুজনের আজ কি হয়েছে?একজন পনেরো মিনিট ধরে মুখ ভার করে ভাত নেড়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে তুলছে না। আরেকজন খাবার সময়ও মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। ”
“ শাশুড়ী আম্মা এদের কাহিনী আপনি বুঝবে না। দুজনের দুই রোগ হয়েছে। ”
আবির ভাত চিবুতে চিবুতে মশকরা করে বলল। তানিয়া বেগম বললেন ;
“ এদের রোগ ভালো হওয়ার নয়। ”
সাথী বেগম সায় দিয়ে বললেন ;
“ ঠিক বলেছেন ভাবী। ”
ইরফান কথোপকথন শুনলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নির্বিকার মুখে চুপচাপ ভাত খেতে লাগল। কিন্তু তার মনে অস্থিরতা কাজ করছে।অরিত্রিকার ওপর যেন একটু রাগ হলো তার। মেয়েটা কেন এত অবুঝ?তার ভেতর এক দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিল। না আর দেরি করা চলবে না!অরিত্রিকাকে সে আর অজ্ঞাত অন্ধকারে রাখবে না। তাকে জানাতে হবে সত্যিটা।দ্রুত আজমল সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ছোট মামুকে বুঝিয়ে বলতে হবে তার ও অরিত্রিকার বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে যেন বিয়েটা দ্রুত হয়ে যায়। যদি না মানে তাহলে বলবে আকদ করিয়ে রাখতে পরবর্তীতে রিসিপশন করে বিয়ে উঠিয়ে দিতে। এতোদিন দুজন দুজনকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে।আর অরিত্রিকাকে?
তারও জানা উচিত যে অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী ইরফান তাহমিদ শেখের হবু বউ! পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে বড়রা ঠিক করে রেখেছে দুবছর আগে। সে মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছে সেটা সত্যি হওয়ার আগে তার প্রেয়সীকে নিজের করে নিতে হবে। দেরী হলে সে অরিত্রিকাকে হারিয়ে ফেলবে এটা কখনো হতে দেবে না।
সাদাত গলা খাঁকড়ি দিয়ে এক গাল হেসে বলল;
“ অরিত্রিকা কবে তার বিয়ে হবে, বউ সেজে ছবি তুলবে সেসব ভাবনায় ডুবে মনে হয় না খেয়ে মুখ ভার করে আছে। কিন্তু ভাই, তুমি কেন গম্ভীর মুখ করে আছো? বিয়ে করবে নাকি গার্লফ্রেন্ড ছ্যাকা দিয়েছে? যদি বিয়ে করতে চাও আমায় বলতে পারো আমি বড়দের সাথে কথা বলবো আর যদি গার্লফ্রেন্ডের ছ্যাকা খাও তাহলে মন খারাপ করো না। তুমি আমার হান্ডু ভাই দেখবে এক ঘন্টায় আরেকটা গার্লফ্রেন্ড পটে গেছে। ”
অরিত্রিকা সাদাতের এহেন কথা শুনতেই কটমট করে তাকালো।রাগে নাকের পাটাতন ফুলছে তার। ইচ্ছে করছে মাথায় বারি দিতে। সাদাত দেখল অরিত্রিকার জ্বলন্ত চাহনি। তবে তার কিছু যায় আসলো না। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পানি খেতে লাগল।
সারহান অরিত্রিকার দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে সাদাতের দিকে তাকাল। ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ মুখে বুলি ফুটেছে? গালটা এদিকে এগিয়ে দে দুই চারটা থাপ্প*ড় মে’রে মুখ বন্ধ করে দেই। ”
সাদাত পানির গ্লাস টেবিলে রেখে আমতা আমতা করে বলল ;
“ আমি তো এমনি মজা করে বললাম আর তুমি সিরিয়াস ভাবে নিয়ে নিলে? ”
“ আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করা বাদ দে নয়তো তোর গোপন খবর পাবলিক হয়ে যাবে। সো, আমার পার্সোনাল বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করবি না। ”
“ ভাই তুমি কিসের কথা বলছো? আমার তো কোনো গোপন খবর নেই। ”
“ তাই! গতকাল রাতে কাউকে না বলে বাইক নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? ”
সারহান বাঁকা হেসে বলে।সাদাত উক্ত কথাটি শোনা মাত্র বিষম খেলো।জোরে জোরে কাশতে লাগলো।তানিয়া বেগম দৌড়ে ছেলের কাছে গিয়ে পিঠ নেড়ে দিতে লাগলেন। সাদাত আড় চোখে তাকাল ইশরার দিকে। ইশরার মুখ চোখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে। ইশরা শুকনো মুখে অসহায় ভঙ্গিতে চুপ করে বসে আছে। মনে হচ্ছে চুরি করে ধরা পড়েছে। গতকাল রাতে সে আর সাদাত বাইক নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল সেটাই সারহান ভাইয়ের কানে পৌঁছে গেছে।এখন যদি সারহান ভাই সবাইকে বলে দেয় তাহলে তাদের দুজনের খবর আছে। কেন যে সাদাত সারহান ভাইকে খোঁচা মে*রে কথাটা বলল ভেবেই রাগ উঠল।
আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলেন না। আরশাদ সাহেব ধমকে বললেন
“এসব কি শুরু করেছো দুজনে? এটা খাবার জায়গা নাকি মাছের বাজার? ”
সারহান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ;
“ চৌধুরী ভিলার মাছের বাজার। ”
আরশাদ সাহেব ছেলের এহেন কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি সরু চোখে তাকালেন বড় ছেলের দিকে। সারহান আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো। সাদাত চুপসে যাওয়া মুখ লুকিয়ে খেতে শুরু করল। তানিয়া বেগম দীর্ঘ শ্বাস টানলেন। আজমল সাহেব খাওয়া শেষ করে সারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“ সারহান তুমি নিশ্চয়ই শুনেছো রাহাতকে গতকাল বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ”
সারহান খেতে খেতে নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলো;
“শুনেছি সকালে।”
“ আমি ভেবেছিলাম রাহাত অরিনকে বিয়ে করবে না তাই পালিয়েছে। কিন্তু রাহাতের বাবা কল করে জানালো রাহাতকে কারা যেন কিড ন্যাপ করেছে। তিনি আমায় অনুরোধ করলেন রাহাতের নামে যেন কোনো কেস ফাইল না করি। ”
“ আর কি বলেছে? ”
“ রাহাতের বাবা কিড ন্যাপারের ভয়ে পুলিশকে বলতে পারছে না। তিনি অনুরোধ করে বলেছেন তুমি তোমার পরিচিত ইন্সপেক্টরকে গোপনে এ বিষয়ে বলো এবং রাহাতকে খুঁজে বের করতে তোমার পার্সোনাল সিক্রেট এজেন্টকে বলো। ”
আজমল সাহেব কোনো মতো বললেন কথাটা। সারহান একপলক সকলের দিকে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল;
“ঠিক আছে।আমি আমার লোকদের বলে খোঁজ নিতে বলছি। আপনি উনাকে বলুন আগামীকাল সকালের মধ্যে রাহাত উনাদের বাড়িতে থাকবে। ”
আজমল সাহেব আর কিছু বললেন না। তিনি হাত ধোঁয়ার জন্য বেসিনের দিকে চলে গেলেন। বাড়ির সকলে ইতোমধ্যে জেনে গেছে রাহাত আকদের দিন দুপুরে বাড়ির বাহির হতে কিড’ন্যাপ হয়েছে। রাহাতের বাবা আজ সকালে জানিয়েছেন বিষয়টা। কারণ রাহাতের বাবাকে কিড ন্যাপার হুমকি দিয়েছিল রাহাতের বিষয়টা যেন পাবলিক না হয়। যদি পাবলিক হয়তো রাহাতকে শেষ করে দিবে। তবুও বিজনেস পার্টনারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে গোপনে জানিয়েছে। আবির ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করল সারহানকে। সারহান তা লক্ষ্য করে শুধু ওষ্ঠ বাঁকিয়ে ক্ষীণ হাসল
অরিত্রিকা সারহানের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য চাহনিতে সারহানের মুখপাণে তাকালো। যে মানুষটা গতকাল অব্দি রাহাতের ওপর রেগে ছিল। সামনে পেলে খু*ন করবে এমন অবস্থায় ছিল আজ সে মানুষটা রাহাতকে খুজে দেবে বলে স্বীকার করল। কী আশ্চর্যের বিষয়! খেয়াল করল আবির এবং সারহানের নিঃশব্দে চলমান কথোপকথন। তা দেখে অবাক হলো বটে। কেন যেন মনে হলো রাহাতের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে সারহান ভাইয়ের কোনো কারসাজি আছে। এই মানুষটাকে তার বিশ্বাস নেই।
“ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে না থেকে ভাত খা কাজে লাগবে। ”
সারহান রুঢ় গলায় বলল। অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেল। সে দৃষ্টি সরিয়ে ভাত খেতে লাগল। সারহান বিরক্তিসূচক চাহনিতে তাকিয়ে রইল অবোধ মেয়েটার দিকে।
“ অরিত্রিকা এক কাপ কফি বানিয়ে দে। ”
অরিত্রিকা রুমে বসে ধীরে ধীরে হাতের ব্যান্ডেজ খুলল। ক্ষতস্থানে সামান্য যন্ত্রণা টের পেলেও তাতে যেন তার ভ্রুক্ষেপ নেই। কোমল হাতে লেভিকে কোলে তুলে নিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই কানে এলো ইরফানের গম্ভীর আদেশসূচক কণ্ঠস্বর।মুহূর্তেই তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। ওষ্ঠকোণে অসন্তুষ্টির স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল।মেজাজ বিগড়ে গেল তার!
ধপধপ পা ফেলে এগিয়ে এলো সে। একদম ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ইরফান সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। আয়েশ করে বসে আছে সোফায়। অথচ দৃষ্টি নিবদ্ধ কেবল এক জায়গায়অরিত্রিকার মুখপানে!সে গভীর নিবিড় চাহনিতে পর্যবেক্ষণ করছে মেয়েটিকে। অরিত্রিকারঅভিব্যক্তি, চোখের ভাষা, এমনকি নিঃশ্বাসের সামান্য ওঠানামাও যেন লক্ষ্য করছে মনোযোগ দিয়ে।আর তার মনের গহীনে চলছে অসংখ্য জল্পনা-কল্পনার খেলা, যার কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা সে নিজেও হয়তো জানে না!
অরিত্রিকা মাথা ঠান্ডা করে স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ সার্ভেন্টদের কাউকে বললে কফি বানিয়ে দেয়। তাদের কাউকে বলুন। ”
ইরফান অপলক চেয়ে রয়। ভাবলেশহীন ভাবে বলে ;
“ তোর হাতের কফি খেতে ইচ্ছে করছে। ”
অরিত্রিকার মেজাজ পুনরায় বিগড়ে গেল। বলতে ইচ্ছে করল ‘ ইরফান ভাই আমার হাতে কী মধু আছে? ’ কিন্তু বলল না। বয়সে বড় তাই সম্মান দিচ্ছে অন্য কেউ হলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিতো। সে জানে, ইরফান কেন এমন করছে। ইরফান তাকে পছন্দ করে এই সন্দেহ যেন দৃঢ় হয়। তার দিকে কেমন হা করে তাকিয়ে আছে। উফ এই চাহনি দেখে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। মেজাজ যেন তুঙ্গে উঠে যাচ্ছে। থমথমে গলায় বলল ;
“ সারহান ভাই নিজে কফি বানিয়ে খায়। আপনি কফি বানাতে পারেন না ইরফান ভাইইই…?”
অরিত্রিকা ইচ্ছে করেই ‘ভাই’ শব্দটার স্বর দীর্ঘায়িত করল যেন প্রতিটি অক্ষর ইরফানের মনে আলাদা করে ধাক্কা দেয়।ইরফানের মুখ মুহূর্তেই শুকিয়ে গেল।কি বিচ্ছু মেয়েরে বাবা!
সে শুধু এক কাপ কফি চেয়েছিল, হবু বউয়ের হাতে কফি খাওয়ার সামান্য একটা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল অথচ সে কিনা উল্টো কফি বানানোর দায়িত্ব দিয়ে দিল!মনের ভেতর একরকম অসহায় হাসি ফুটে উঠল, তবে তা মুখে প্রকাশ করল না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“কফি আমিও বানাতে পারি। কিন্তু তোর হাতের কফি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল।”
শব্দগুলো যতটা সহজ শোনায়, তার চেয়ে অনেক গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে তাতে।অরিত্রিকা কি তা বুঝতে পারল?
“ আপাতত আমি কিচেন যাওয়া থেকে বিরত আছি। ”
“ কেনো? ”
“ ওমা আপনি জানেন না দুইদিন আগে হাত পুড়িয়েছি। এই যে দেখুন। ”
অরিত্রিকা পোড়া হাত উঁচিয়ে দেখাল। ইরফান সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল বিচলিত ভঙ্গিতে অরিত্রিকার হাত ধরল। পোড়া স্থানে চোখ বুলিয়ে অশান্ত ভঙ্গিতে বলল ;
“ শুনেছিলাম কিন্তু কাজের প্রেশারে ভুলে গিয়েছিলাম। এন্টিসেপটিক লাগিয়েছিলি? ”
অরিত্রিকা ইরফান হঠাৎ হাত ধরায় অস্বস্তিতে হাস ফাঁস করে উঠল। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে অপ্রস্তুত হলো। সে দ্রুত হাত ছাড়িয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল। অস্বস্তি ভাব নিয়ে বলল ;
“ হ্যা লাগিয়েছিলাম। ”
“ দেখেশুনে কাজ করবি। ”
অরিত্রিকা কিছু বলল না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরফান হয়তো বুঝল অরিত্রিকা তার হাত ধরাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। সে একপলক অরিত্রিকার অস্বস্তি ভরা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল ;
“ সরি অরিত্রিকা। ”
অতঃপর গটগটিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। অরিত্রিকা সেদিকে এক পলক দেখল। দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফেলল। দোদুল্যমান মন নিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। মনের মাঝে নিঃশব্দ দ্বন্দ্ব চলছে। ইরফান ভাই তাকে পছন্দ করে এই বাক্যটুকু মস্তিষ্কে যেন দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। বক্ষে অজানা আতংক, ভয় জর্জরিত করে তুলল। সে শুকনো ঢোক গিলে। অস্থির মনে কল্পপুরুষকে নিয়ে ভাবতে থাকে।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৬
কোনো কিছু ভাঙার শব্দে অরিত্রিকা চমকে সামনে তাকায়। সেখান থেকে করিডোর স্পষ্ট দৃশ্যমান। সারহান চিবুক শক্ত করে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চক্ষুদ্বয় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। অরিত্রিকা থমকায়। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সারহানের মুষ্টিবদ্ধ হাতে। হাত হতে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। তা দেখে বিচলিত হলো অরিত্রিকার অন্তঃকোণ। সে লেভিকে ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে ডেকে ওঠে। কিন্তু সারহান তা শোনার প্রয়োজন বোধ করল। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে গজগজ করতে করতে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। অরিত্রিকা ব্যথিত হলো। চক্ষুদ্বয় হঠাৎ ছলছল করে উঠল। নিঃশব্দে চক্ষুদ্বয় হতে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুকণা। মেয়েলী মন আজ সারহান ভাইয়ের এহেন আচরণ মানতে পারল না। সারহান ভাই কেন নিজেকে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করল? তবে কী ইরফান আর তাকে নিয়ে ভুল বুঝল?