প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৮
আদ্রিতা নিশি

সারহান নিজের রুমের বিছানার এককোণে মাথা নিচু করে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। হাতের তালুর ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ধীর গতিতে গড়িয়ে পড়ছে টাইলস যুক্ত মেঝেতে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বদমেজাজি, রগচটা মানুষটার। সে এখন নিজের মাঝে চলমান নিরব দ্বন্দ্বের বেড়াজাল থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছে। ক্রোধে জর্জরিত তার সমগ্র সত্তা। তবুও ক্রোধ সংবরণ করে চলেছে। একদিকে ইলহাম তালুকদার অপরদিকে ইরফান এই দুজনের জন্য জীবনে শান্তি হারাম হয়ে যাচ্ছে। দুইদিকের টেনশন ও কল্লোল ফাউন্ডেশনের ইস্যু নিয়ে কয়েকদিন ধরে বেশ চিন্তিত ছিল। পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের গ্যারাকলে যে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।

এতোদিন পরিবারের সকলে ইরফান এবং অরিত্রিকার বিয়ের বিষয় নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তবে এখন দেখাচ্ছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আজ দুপুরে ইরফান এ বিষয়টা নিয়ে কথা তুলেছে বা ইসমা বেগমকে দিয়ে আজমল সাহেবের সাথে কথা বলিয়েছে। সারহান নিশ্চিত ইরফান হয়তো তার ফিলিংস সম্পর্কে অবগত। তাই এতো তাড়াহুড়ো করে করছে অরিত্রিকাকে ফিলিংস বোঝাতে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো শোনা যাবে ইরফান এবং অরিত্রিকার বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হবে। সারহান ক্রূর হাসে। সবকিছু কী তারাহুরো করে করা সম্ভব? সম্ভব নয়। সামনে দৃশ্যমান ঘটনার অন্তরালের সত্যি যখন সামনে আসবে তখন কীভাবে পরিবারের ভীত শক্ত থাকবে তাকে ভীষণ ভাবায়। যে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে তাকে অরিত্রিকার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটা বোধ হয় সামনে আসতে চলেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যে পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে এতোদিন গুনগান করতো সে সম্পর্ক হয়তো মুখ থুবড়ে পরবে।
অরিত্রিকা সারহানের রুমের সামনে ভীতিগ্রস্ত বদনে দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চল মন অস্থির হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি স্থির মেঝেতে বিন্দু বিন্দু র*ক্তের ফোটার দিকে। মানুষটা যেদিক দিয়ে হেঁটে গেছে সেদিক দিয়ে র*ক্তবিন্দু গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে বক্ষে দোদুল্যমান তিক্ত অনুভূতির সংস্পর্শে কিছুটা দিশেহারা হয় মন। ভয়, আতংক কেন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। চক্ষুদ্বয় এখনো অশ্রুত। ওষ্ঠ কামড়ে নিজের মনে চলমান কষ্ট নিবারণ করার প্রয়াস চালায়। দ্বিধায় জড়ানো চক্ষুদ্বয় দরজার দিকে স্থির করে অরিত্রিকা। রুমে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধায় ভোগে। অবশেষে ভীত মনে সাহস সঞ্চার করে বাঘের গুহায় পা রাখার জন্য প্রস্তুত হয়। গলার দুপাশে ঝুলিয়ে রাখা ওড়না দ্বারা মাথা আবৃত করে নেয়। অতঃপর কিছু একটা বিরবির করতে করতে দরজা নক না করে রুমের ভেতরে নিঃশব্দে প্রবেশ করে। পা টিপে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যায়। ভীতিগ্রস্ত লোচনে সতর্কতার সহিত সারহানের উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে।

“ আমার রুমে উইদাউট পারমিশনে কেনো ঢুকেছিস?কোনো মেলোড্রামা হওয়ার আগে বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে। ”
অরিত্রিকা কয়েক কদম এগোতেই রাশভারী গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল। তৎক্ষনাৎ থেমে গেল সেথায়। অকস্মাৎ শব্দগুচ্ছের তীক্ষ্ণতা ছিন্ন করল তার ভয়াতুর মনসত্তা। আশার ক্ষীণ প্রদীপটুকু ধপ করে নিভে গেল। সে হচকচিয়ে গেল সে। শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা শ্যামানবের দিকে। স্তম্ভিত ব্যথিত মুখশ্রীতে স্পষ্ট হয়ে উঠল তার। দৃষ্টি স্থির হলো সারহানের র*ক্তে ভিজে যাওয়া হাতের দিকে। মনের অন্তঃস্থলে অদৃশ্য ব্যথা অনুভব হলো। ডাগর আঁখিদ্বয় ভরে উঠল অশ্রুতে। কিন্তু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল না। অক্ষিকোটরে বাঁধা প্রাপ্ত হলো যেন। অরিত্রিকা আতংকিত ভঙ্গিতে শঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ সারহান ভাই আপনার হাত বেয়ে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে অথচ আপনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন? ব্যথা লাগছে না আপনার? ”

সারহান অরিত্রিকার দিকে তাকায় না। পূর্বের ন্যায় মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রাখে। রুদ্ধস্বরে প্রতিত্তোর করল ;
“তোর সান্নিধ্যে এসে হৃদয় ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। হাতের সামান্য ক্ষ*ত হৃদয়ের ক্ষ*তের কাছে অতি তুচ্ছ। আমাদের মতো অনুভূতিহীন মানুষের ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট কোনোটাই গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে না।”
“ আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন সারহান ভাই। ”
“ তোর আর আমার মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সম্পর্ক আছে ফাইরুজ? ”
সারহান ভরাট তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল। অরিত্রিকা স্তব্ধ হয়ে গেল এহেন কথা শুনে। সে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল সারহানের কাঠিন্যতায় জর্জরিত মুখপানে।

সারহান কাঠিন্যতা এটে অনড় ভঙ্গিতে বসে আছে বিছানায়। টিশার্ট এবং টাউজারে র*ক্তের ছিটেফোঁটা দৃশ্যমান। মানুষটার বলা ধারালো তাচ্ছিল্যের ন্যায় নিষ্ঠুর বাক্য যেন আমলে নিয়েও নিল না অরিত্রিকা। নিজের মাঝে স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলন্ত দহন যেন ঠিকরে পড়তে লাগল বক্ষ মাঝারে। নিদারুণ যন্ত্রণা আড়াল করল মেয়েলী মন। অশান্ত দিশেহারা মন সব কিছু মুহুর্তের জন্য ভুলে বসলো। এক মুহুর্ত দেরী না করে উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে বিচলিত ভঙ্গিতে সারহানের নিকট ছুটে গেল।সারহানের কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো ছুটে আসার পদধ্বনি। তা শুনেই মাথা উঁচিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। দেখতে পেলো মলিন শঙ্কিত মুখশ্রীতে ছুটে আসছে অরিত্রিকা। তৎক্ষনাৎ কপালের মধ্যাংশে ভাজ পড়ল। কিছু বলার আগেই অরিত্রিকা দৌড়ে সারহানের কাছে এসেই সরাসরি তার হাত ধরে পরখ করতে লাগলো ক্ষ ত স্থানটি। র ক্তে ভিজে লাল হয়ে হাতের তালু।কাচের গ্লাসের ভাঙা কাচে অনেকটা কেটে গেছে। কি ভয়ংকর লাগছে দেখতে। শিউরে উঠল সে। হাত কাঁপতে লাগল তবুও নরম তুলতুলে মসৃণ হাতে আঁকড়ে ধরে রাখল সারহানের হাতটি যেন হাত ছেড়ে দিলে কোথাও হারিয়ে যাবে মানুষটা।
অরিত্রিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে সারহানের মুখপানে তাকিয়ে করুণস্বরে বলল ;

“ আমার ওপর রাগ করে কেন নিজের হাত ক্ষ*তবি*ক্ষত করলেন সারহান ভাই? দেখুন, আপনার বেয়ে কতো র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে?”
অরিত্রিকার গাল বেয়ে টুপটাপ করে অশ্রুকণা গড়িয়ে সারহানের হাতে পড়ল। তবুও পাষান মানুষটার কোনো দোলাচল লক্ষ্য করা গেল না। অরিত্রিকা ওষ্ঠ কামড়ে কান্না থামানোর প্রয়াস চালাল। ব্যতিগ্রস্থ ভঙ্গিতে নিজের ওড়নার একপাশ দিয়ে সারহানের হাত পেঁচিয়ে দিল যেন র*ক্তক্ষরণ কম হয়। সারহান অরিত্রিকার হঠাৎ হাত ধরাতে কিঞ্চিৎ স্তম্ভিত হলো।সে গম্ভীর ভাবমূর্তি বজায় রেখে তীক্ষ্ণ বিস্ময় মিশেল চাহনিতে তাকালো অরিত্রিকার শঙ্কিত মুখপানে। মেয়েলী মুখাবয়ব আতংক, ভয়ে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অরিত্রিকা কখনো তার হাত ধরার দুঃসাহস করেনি। বছর তিন আগেও রাজনৈতিক কারণে এমন আ হত অবস্থায় বাড়িতে আসতো তখন অরিত্রিকা দূর হতে লুকিয়ে দেখত কিন্তু কখনো কাছে আসতো না। পূর্বের সময় হতে তাদের দুজনের মাঝে কেমন যে অদৃশ্য দেয়াল ছিল। বাড়িতে থাকলেও কেউ কারো সাথে ভুলেও কথা বলতো না।তবে আজ কি হলো মেয়ের? সরাসরি তার হাত স্পর্শ করার সাহস দেখালো। তবে কী তার নিভৃতসুধা তাকে নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন?
অরিত্রিকা সারহানের এমন নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গি যেন সহ্য হলো না। অধৈর্য হয়ে কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে বলল ;

“ কথা বলছেন না কেনো? ”
সারহানের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। বিস্মিত হলো অরিত্রিকার এহেন আচরণে। তার নিভৃতসুধা তাকে প্রশ্ন করছে? সে অরিত্রিকার মুঠোবন্দি হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। অন্যত্র তাকিয়ে রুঢ় গলায় বলল;
“ আমার জন্য চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই তোর। ”
“ কেনো চিন্তিত হবো না? একশবার চিন্তিত হবো বুঝেছেন? ”
“ হঠাৎ এতো চিন্তিত হওয়ার কারণ কী? ”

সারহান প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলল। অরিত্রিকা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কাঠখোট্টা মানুষটার প্রশ্ন উপেক্ষা করে ফার্স্টএইড বক্স খোজায় উদ্যত হলো। বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটার ওপরে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে চক্ষুদ্বয় চকচক করল। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বক্সটি হাতে নিয়ে সংকোচহীন ভঙ্গিতে সারহানের পাশে শব্দ করে বসল। সারহান আড় চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল অরিত্রিকার ভাবমূর্তি। মেয়েটা আজ একটু বেশী সাহস দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে। অরিত্রিকা সারহানের তীক্ষ্ণ চাহনি দেখল কিন্তু পরোয়া করলো না। শুকনো ঢোক গিলে সাহস জুগিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে। হাতে থাকা ফার্স্টএইড বক্স খুলে তুলো বের করল। অতঃপর বক্সটি বিছানার ওপর রেখে পুনরায় সারহানের পুরুষালি অমসৃণ হাত ধরল। তুলো দ্বারা সযতনে ক্ষ*তস্থানের আশেপাশের র*ক্ত পরিষ্কার করতে লাগল।
“ তোকে বলেছি আমার হাতের র*ক্ত পরিষ্কার করতে? ”
সারহান দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল। অরিত্রিকা চমকালো বোধ হয় তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগল। সারহান বিস্মিত হয়ে গেল কিন্তু প্রকাশ করল না। পূর্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করল ;
“ কী বললাম শুনতে পাসনি? ”

অরিত্রিকা এবার মুখ খুলল। তুলো দিয়ে র*ক্ত পরিষ্কার করতে করতে ক্ষীণ কন্ঠে বলল ;
“ চুপচাপ বসে থাকুন সারহান ভাই। আমার কাজ আমাকে করতে দিন। ”
সারহানের ক্রোধ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। সে আশ্চর্যিত হলো উক্ত কথাটি শুনে। ভীতু মেয়েটা তাকে চুপ করে থাকতে বলছে? অবাকতার রেষ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল মুখাবয়বে। এসবের মাঝে অরিত্রিকার উদ্বিগ্ন,চিন্তিত ভাব, যত্ন অন্তঃকোণে শিহরণ বইয়ে দিল। অশান্ত মন শান্ত করে দিল নিমেষে।
“ ইরফান ভাই তখন আমাকে কফি বানাতে বলেছিলেন। আমি উত্তর দিয়েছিলাম কফি বানাতে পারবো না কারণ কিচেনে যাওয়া থেকে বিরত আছি। উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন? আমি হাত উঁচিয়ে হাতের পোড়া আঙ্গুলগুলো দেখিয়ে বলেছিলাম হাত পুড়ে গেছে তাই। ব্যাস, তারপর উনি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার হাত ধরে দেখতে থাকেন পোড়া স্থান। আমি বিব্রতবোধ করি এবং হাত ছাড়িয়ে নেই। অথচ আপনি সম্পূর্ণ বিষয় না জেনে রেগেমেগে হাত জখম করলেন। ”

অরিত্রিকা সারহানের হাতের র*ক্ত পরিষ্কার করা সম্পূর্ণ করে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে মলিন কন্ঠে বলল। সারহান সম্পূর্ণ কথা শুনলো। প্রতিক্রিয়া স্বরুপ দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ তোর থেকে কিছু জানতে চাইনি আমি। ”
অরিত্রিকা ব্যান্ডেজ পেঁচাতে পেঁচাতে ধীর কন্ঠে বলল ;
“ আপনি জানতে চাননি কিন্তু লিভিং রুমের বিষয়টা নিয়ে আমার ওপর রেগে আছেন। তাই পুরো কাহিনি আপনাকে বললাম। আমি চাই না আপনি আমাদের নিয়ে আপনার মনে ভুল ভাবনা পোষণ করুন। ”
“ আমার স্থানে পরিবারের কেউ থাকলে তারা বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতো ফাইরুজ। ”
“ স্বাভাবিক ভাবে কেনো নিতো? ঘটনাটা স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার মতো ছিল না। ”
অরিত্রিকা পূর্ন দৃষ্টি মেলে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল। সারহান কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল ;

“ সময় হোক সবটা বুঝতে পারবি। ”
“ কিন্তু..”
“ ব্যান্ডেজ করা সম্পূর্ণ করে নিজের রুমে যা ফাইরুজ। এই মুহুর্তে বিরক্তিকর টপিক নিয়ে কথা বলার মুড নেই আমার। ”
সারহান শান্ত কন্ঠে বলল। অরিত্রিকার কেমন যেন সন্দেহ হলো। সারহান ভাই কী তার থেকে কিছু লুকালো? সে একটু ভাবুক হলো। দ্রুততার সহিত সারহানের হাতের ব্যান্ডেজ করা শেষ করল। সারহান এক মুহুর্ত দেরী না করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। সরাসরি গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। অরিত্রিকা হতবুদ্ধির ন্যায় দেখল শুধু। এটা কী হলো? এমন আজব ব্যবহার করছে কেনো? এখনো কী রেগে আছে সেজন্য ইগনোর করছে? এসব ভেবে মন খারাপ হলো তার। মন বেজার করে ফার্স্টএইড বক্সে ঔষধ, তুলো শব্দ করে রাখতে লাগল।

“ ফার্স্টএইড বক্সের ওপর রাগ না দেখিয়ে যার ওপর রাগ করেছিস তার ওপর রাগ দেখা।”
সারহান চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে। অরিত্রিকা সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে ;
“ আপনার ওপর নিজের রাগ দেখাই আর আপনি আমায় থাপ্পড় মা*রুন । এসময় আপনার ওপর রাগ দেখিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ”

অরিত্রিকা ফার্স্টএইড বক্সটি গুছিয়ে বিছানা থেকে উঠে যথাস্থানে রাখল। ভেবেছিল সারহান তাকে আরও কথা শোনাবে কিন্তু তেমন কোনো কিছু না হওয়ায় বিস্মিত হয়েছে অনেক। আনমনে ভাবনার মাঝে কিছু একটা মনে পড়তেই নজর বুলালো আশেপাশে। টেবিলের ওপরে রাখা টিস্যু বক্স থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে মেঝেতে বিন্দু বিন্দু র*ক্তের দাগগুলো মুছতে লাগল। কিন্তু তেমন পরিষ্কার হলো না। বিছানা হতে রুমের দরজা পর্যন্ত কোনো রকম দাগগুলো পরিষ্কার করল। সে নোংরা টিস্যুগুলো ডাস্টবিনে ফেলে সারহানের দিকে তাকাল। দেখল মানুষটা চোখ বন্ধ করে আছে। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গেছে এতোক্ষণে। সে পা টিপে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমে হাত ধোঁয়ার জন্য। মিনিট দেড়েক পর নিঃশব্দে বেড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিলো সারহান আসলেই ঘুমিয়েছে কি না দেখার জন্য। দূর থেকে তেমন বুঝতে পারল না। সে কৌতুহলী ভাব নিয়ে এগিয়ে গেল সারহানের মাথা বরাবর। চক্ষুদ্বয় ছোট ছোট করে তাকাল। বদমেজাজি মানুষটার নিঃশ্বাস ভারী শোনাল। সে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রুমে এসি চলছে তবুও ভয়ে, চিন্তায় বিন্দু বিন্দু ঘাম নিঃসরণ হচ্ছে কপালে। এতোক্ষণ অতি কষ্টে সামলেছে সবকিছু। নিজের মধ্যিখানের চলমান ঝড়ো হাওয়ার আচ বুঝতে দেয়নি। কীভাবে নিজেকে এতোক্ষণ শান্ত এবং স্বাভাবিক রেখেছে শুধু নিজে জানে। কঠিন আবরণ ছাপিয়ে হঠাৎ নরম, কোমল হয়ে আসলো মনসত্তা। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল বক্ষপিঞ্জর। চক্ষুদ্বয় মুছে বিরসমুখে মেঝেতে বসল অরিত্রিকা। দৃষ্টি স্থির করল সারহানের হাতে। ব্যান্ডেজ করা থাকলেও র*ক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। কি অসহনীয় দৃশ্য। মেয়েলী মন কেমন যেন অবাধ্য হলো। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নরম হাতে ছুঁয়ে দিলো ক্ষ*তস্থান।

“সারহান ভাই, আপনি সত্যিই এক পাষাণ মানুষ! রাগের বশে নিজেকেই আঘাত করলেন, অথচ একবারও ভাবলেন না এই আঘাতের যন্ত্রণা আপনাকে ছাপিয়ে আমার হৃদয়ে আরও গভীরভাবে বিধতে পারে।”
অরিত্রিকার কাতর কন্ঠস্বর। চক্ষুদ্বয় হঠাৎ ছলছল করে উঠল। সে হাত নামিয়ে নিলো।বক্ষে চিনচিনে ব্য*থা অনুভব হচ্ছে। কয়েক লহমায় কাউকে ভালোবাসা যায়? প্রণয়ের সুত্রপাত হয়? তবে কী মনের মাঝে চেপে রাখা অনুভূতি গাঢ় হচ্ছে? হয়তো অনুভূতি নিজেদের ইচ্ছেমতো উড়ুক্কু হয়েছে। কোনো পুরুষের প্রতি এতোটা টান অনুভব হয়নি আগে। তবে এই সময় যেন সাক্ষী দিচ্ছে প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এই মুহুর্ত থেকে প্রতিটি ক্ষণ কেবল কল্প পুরুষে বিমোহিত হবে মন। প্রথম যাকে মনে স্থান দিয়েছে তাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর সংকল্প সঞ্চারিত হলো তার মাঝে।
অরিত্রিকা সারহানের মুখপানে তাকিয়ে মলিন হাসল ;

“দুই বছরেরও বেশি দূর থেকে আমাকে ভালোবেসে গেলেন অথচ আমি একজন বোকার মতো আপনার সেই ভালোবাসার গভীরতা কখনো বুঝতে পারলাম না, অনুভবও করতে পারলাম না। যখন কাছে এসে ভালোবাসলেন তখন আপনার ভালোবাসার পরিধি অনুধাবন করে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলাম। কেন সেদিন আমায় আটকালেন না, সারহান ভাই? কেন একবারও বলেননি’তোকে ভালোবাসি, ফাইরুজ’? অন্তত ভালোবাসার দোহাই দিয়েও তো আটকে রাখতে পারতেন!”
অরিত্রিকার গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। সে থামল। ওষ্ঠ কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করল। মনের মেঝে তীব্র হলো কষ্ট। কম্পনরত কন্ঠে পুনরায় বলল ;

“ দূরে থেকেও আমায় আগলে রেখেছেন, খোঁজ খবর রেখেছেন কিন্তু কখনো বুঝতে দেননি। আপনি নিজেকে আমার সামনে কঠিনসত্তায় আবৃত করে রেখেছেন, ইচ্ছাকৃত দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এমনটা কেন করেছেন সারহান ভাই?এই প্রশ্নের উত্তর আমি আপনার মুখ থেকে শুনবো একদিন। ”
অরিত্রিকার মন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে। কিয়ৎ সময় আগে আবিরের বলা কিছু কথা তাকে আজ উন্মাদ বানিয়েছে। ভালো তো সেও বাসছে কিন্তু শ্যামমানবের মতো করে ভালোবাসতে পারেনি। একটা মানুষ কীভাবে ইচ্ছাকৃত প্রণয়ের দহনে পুড়ে ছারখার হয়? শুধু কী পরিবার নাকি অন্য কোনো সত্যি?
“ চৌধুরী ভিলা থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে সরে যাইনি আমি। সকলের কথা ভেবে বাধ্য হয়েছি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। এই মুহুর্তে আমার সাহস নেই পরো সত্যিটা বলার। তবে খুব শীঘ্রই বলবো। ভয় হয় সত্যিটা জানার পর আপনি আমায় ভালোবাসবেন তো? ”

অরিত্রিকা নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। তিক্ত অতীতের রোষানলে পড়ে দুবছর কলুষিত অতীতের স্মৃতি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। কতো শত রাত সকলের অগোচরে কেঁদেছে। কিন্তু কেউ ঘুনাক্ষরে টের পায়নি। পুরো সত্যিটা যখন সারহান ভাই জানবে তখন তাকে ঘৃণা করবে? আর ভালোবাসবে না? এতটুকু ভেবে আঁতকে কেঁপে উঠে সে। বক্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল কাউকে হারানোর হাহাকার। অরিত্রিকা ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটালো। দুহাত দ্বারা আলতোভাবে স্পর্শ করল সারহানের হাত। ভেজা নেত্রে একপলক ঘুমন্ত কল্প পুরুষের দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়াল ব্যান্ডেজের উপরিভাগে। তখনি চক্ষুদ্বয় হতে গড়িয়ে পড়ল উষ্ণ নোনা জল। ভেজা কন্ঠে বিরবির করে বলে উঠল ;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৭

“ ভালোবাসি সারহান ভাই।”
কিয়ৎ থেমে উদ্বিগ্ন ভাব কমিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল ;
“ ভালোবাসি নেতা সাহেব। আপনার না হওয়া বিবিজান আপনাকে ভালোবাসে।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩৯