প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৩
আদ্রিতা নিশি
“ অরিত্রিকা কী হয়েছে তোর? ছাদে উন্মাদের মতো কাঁদছিলি কেনো? কেউ কিছু বলেছে? ”
অরিত্রিকা থম মেরে বসে আছে নিজের ঘরের মেঝেতে। সে নীরব, নিথর, নির্বাক। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝের অদৃশ্য বিন্দুতে। কতক্ষণ ধরে এমনভাবে বসে আছে সে, কেউ জানে না। মুখশ্রী কান্নায় লাল হয়ে উঠেছে, চোখদুটো ফুলে গিয়ে লালচে আভা ধারণ করেছে।ছাদ থেকে ইশরা ও সাদাত তাকে ধরে টেনে-হেঁচড়ে নয়। বরং গভীর মমতায় ধীরে ধীরে নামিয়ে এনেছিল নিচে। রুমে এসে বিছানার কাছে এসে হঠাৎ করেই ধপ করে বসে পড়ে অরিত্রিকা। তারপর থেকে সেই একই স্থানে বসে আছে। নড়েনি, চড়েনি কোনো কথা বলেনি।ঘরের এক কোণে লেভি চুপচাপ বসে আছে।ছোট্ট প্রাণীটির চোখে ভয় আর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। তার অবোধ মনটিও বুঝে ফেলেছে কিছু একটা খুব খারাপ ঘটেছে।ইশরা ও সাদাত কিছুটা দূরে বসে আছে। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অরিত্রিকার অনড় অবস্থা লক্ষ্য করছে। চিন্তা আর উদ্বেগ তাদের দুজনকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বারবার ডাকলেও কোনো সাড়া না মেলায় অস্বস্তি বেড়ে চলেছে।এ যেন নিঃশব্দ হাহাকারের প্রতিচ্ছবি। একটা মন ভাঙনের মুহূর্ত এটা। যেখানে শব্দ নেই শুধু ভারী নিস্তব্ধতা। দুজনে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ইশরা পুনরায় উৎকন্ঠিত ভাব নিয়ে শুধায় ;
“ অরিত্রিকা বল কী হয়েছে? তোর নিশ্চুপতা দেখে আমাদের ভয় লাগছে। প্লিজ বোন বল কী হয়েছে?”
সাদাত ও তাল মিলিয়ে অস্থির হয়ে বলল ;
“ অরিত্রিকা বল কী হয়েছে? ”
অরিত্রিকা নির্জীব, প্রাণহীন দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ইশরা ও সাদাতের দিকে। সেই চাহনিতে ছিল না কোনো অভিযোগ ছিল না কোনো উষ্মা।শুধু নিঃসীম বিষণ্ণতা। তার মৃতবৎ দৃষ্টি। যেখান অভিযোগ, কষ্ট আর নীরব কান্নার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মুখশ্রী ফ্যাকাসে, ওষ্ঠযুগল শুকিয়ে খসখসে হয়ে উঠেছে। চোখে জল নেই কিন্তু মন যেন জলমগ্ন।ইশরা ও সাদাতের চিন্তিত মুখাবয়ব দেখে তার হৃদয় ভার হয়ে উঠল। তারা তাকে ভালোবাসে। অগাধ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাদের। এ ভালোবাসার কোনো নাম হয় না প্রয়োজনও পড়ে না নামকরণের। ছোটবেলার খেলার সাথী দুজন। যারা তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছিল অবিচল।তাদের সঙ্গে সে কেটেছে কত শত মুহূর্ত। স্কুলের সকাল, বিকেলের দৌড়ঝাঁপ, লুকোচুরি খেলা, অভিমান আর মিটমাটে ভরা শৈশব। ঝগড়া হয়েছে, মান-অভিমান হয়েছে কিন্তু সেই সম্পর্কের বন্ধন কখনো ছেঁড়া যায়নি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ, এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে তাদের মুখে সে আবার খুঁজে পেল সেই পুরোনো স্নেহ, সেই অকৃত্রিম বন্ধন। হয়তো এটিই রক্তের সম্পর্ক। তবুও এই সম্পর্ক র*ক্তের সম্পর্কের চেয়েও গাঢ় হৃদয়ের গভীর থেকে আসা বন্ধুত্ব।এই নিঃশব্দ মুহূর্তে সে ঠিক বুঝে গেল সবকিছু ভেঙে পড়লেও এই দুটো মানুষ তার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবে।
সাদাত অরিত্রিকাকে অপলক চুপচাপ চেয়ে থাকতে দেখে রেগে গেল। রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলল;
“ তুই যদি না বলিস তাহলে ভাইকে কল করবো। কল করে বলবো — ভাই তোমাকে দেখতে না পেয়ে অরিত্রিকা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভাই তখন এসব শুনে প্রেস ব্রিফিং ছেড়ে তোর কাছে ছুটে আসবে। ”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটালো। ওষ্ঠপুট কেঁপে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালালো। লম্বা শ্বাস টেনে নিলো দ্রুততার সহিত। কিয়ৎ সময় পর কম্পিত ভেজা কন্ঠনালী হতে ভেসে আসলো অপ্রত্যাশিত বাক্য ;
“ ইরফান ভাই আমাকে ভালোবাসে। ”
উক্ত কথাটি শোনা মাত্র স্তব্ধ হয়ে গেল সাদাত এবং ইশরা। দুজনে চক্ষুদ্বয় বড় করে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। অভাবনীয় চমকপ্রদ কথা শুনে দুজনে নির্বাক হয়ে গেল। পিনপিনে নিরবতা ছড়িয়ে পড়ল রুমে। কারো মুখে কোনো কথা উচ্চারিত হলো না।
“ এসব কী বলছিস তুই? আমার ভাই তোকে ভালোবাসে? ”
নিরবতা ছিন্ন করে ইশরা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। অরিত্রিকা কেঁপে উঠল। পাশেই বসে থাকা সাদাতও চমকে উঠল। চোখের পলক ফেলতে ফেলতে যেন তার ঘোর কাটল। সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল।কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।কেন জানি বিষয়টা এখন তার কাছে আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।মাত্র দুমাস আগে তানিয়া বেগম নিজেই তাকে ডেকে জানিয়েছিলেন ইরফান ও অরিত্রিকার বিয়ের কথা। সে সময় মা তাকে কড়া স্বরে নিষেধ করেছিলেন এই বিষয়ে যেন অরিত্রিকাকে কিছু না জানায়।ছেলে হয়ে সে বাধ্য সন্তান হয়েই ছিল নীরব থেকেছিল।
কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে যখন চোখের সামনে তার ছোটবেলার সাথী, প্রিয় বন্ধু এতটা ভেঙে পড়েছে তখন তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল মনে হচ্ছে। হয়তো জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। হয়তো কিছু একটা বদলে দেওয়া যেত।কিন্তু এখন তো শুধু হতাশা আর অপরাধবোধ। অকথিত, অপাপবিদ্ধ এক বোঝা হয়ে বুকের ওপর চেপে বসে আছে।
সাদাত পরিস্থিতি সামাল দিতে শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ ইশরা হাইপার হোস না। ”
ইশরা উদ্বিগ্ন হয়ে পুনরায় বলল ;
“ হাইপার কেনো হবো না? ইরফান ভাই নাকি ওকে ভালোবাসে? ভাই তো আমাকে কিংবা মাকে কিছু বলেনি এ বিষয়ে। ”
“ থাম তুই। অরিত্রিকার সাথে আমাকে কথা বলতে দে। ”
“ সারহান ভাই অরিত্রিকাকে ভালোবাসে। ইরফান ভাই ও যদি অরিত্রিকাকে ভালোবাসে.. আমি আর ভাবতে পারছি না সাদাত। ইরফান ভাই কি ওকে নিজের মুখে বলেছে? ”
“ তুই চুপ করবি। আমাকে কথা বলতে দে। ”
সাদাত ধমকে বলল কথাটা। ইশরা চমকে উঠল তখনি। মুখ ভার করে চুপ হয়ে গেল। দ্বিধা মিশ্রিত চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা আড়ষ্টতায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কি বলবে কী করবে বুঝতে পারছে না। সাদাত অরিত্রিকাকে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে ;
“ ইরফান ভাই নিজে বলেছে তোকে? ”
অরিত্রিকা মাথা উপর নিচ করে নিঃশব্দে হ্যা বলে। ইশরা আরেকদফা অবাক হয়। তার ভাই এটা কী করল? সাদাত তপ্ত শ্বাস ফেলল। কাহিনী যে সকলের অগোচরে এতো দূর গড়িয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। হয়তো সারহান বুঝেছিল এমন কিছু কাহিনী ঘটবে তাই অরিত্রিকার ওপর নজর রাখতে বলেছে। সে ভেবে পায় না এ ভালোবাসার পরিণয় কী হবে। পুনরায় বলে ;
“ আর কি বলেছে? ”
অরিত্রিকা নড়ে উঠল। ঝিমিয়ে যাওয়া অগোছালো ভঙ্গিতে বলল ;
“ ইরফান ভাই আমায় বলেছেন, উনি নাকি আমায় দেড় বছর আগে থেকে ভালোবাসে। ”
“ দেড় বছর আগে থেকে?”
“ রাজশাহী কলেজে বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়ে দেখে…। ”
“ তোরা মেয়েরা শাড়ি পরিস কেনো বলতো? তোদের শাড়ি পড়া নিষিদ্ধ করা হোক। তোরা শাড়ি পড়িস আর ছেলেরা তোদের দেখে প্রেমে পড়ে। সব দোষ তোদের। সারহান ভাই, ইরফান ভাই, আ.. না মানে দুজনেই শাড়ি পড়া দেখে প্রেমে উষ্ঠা খেয়েছে। ”
“ সিরিয়াস সময়ে মজা করবি না সাদাত। ”
“ আরে রাগিস কেনো? মজা করলাম তো। আচ্ছা বাদ দে। এবার বল কী করবি তুই? ”
“ আমি জানি না ভাই। এসব থেকে আমাকে বাঁচা। ”
অরিত্রিকা করুণ স্বরে বলল। সাদাত নিশ্চুপ ভঙ্গিতে কিছু ভাবতে লাগল। ইশরা মন খারাপ করে বলল ;
“ এখন কী করবি? একদিকে সারহান ভাই আরেকদিকে আমার নিজের ভাই। ”
অরিত্রিকার বিষন্ন মন। বিরসমুখে বলে ;
“ যাকে ভালোবাসি তার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। আমি সারহান ভাইকে চাই। ”
“ ভীষণ খারাপ লাগছে আমার ভাইয়ের জন্য। অন্তত আমায় বা মাকে যদি বলতো তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এমন হতো না। ”
“ ইরফান ভাইয়ের পাগলামি দেখেছি আমি। উনি হয়তো সত্যি ভালোবাসেন আমায়। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি উনাকে বলে দিয়েছি সারহান ভাইকে ভালোবাসি। ”
“ তারপর কী বলেছে ভাই? ”
“ আমাকে বিয়ে করতে চায়। পরিবারের সম্মতিতে খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে চায়। ”
অরিত্রিকার কন্ঠনালী কেঁপে উঠল। শুকনো ঢোক গিলল। ইশরা হতভম্ব হয়ে গেল। তার ভাই এসব করেছে? অরিত্রিকা অতঃপর ছাদের পুরো ঘটনা খুলে বলল। তা শুনে সাদাত এবং ইশরা অবাকতার শীর্ষে পৌঁছে গেল যেন। ইরফানের উগ্র, উদভ্রান্তের ন্যায় ব্যবহার যেন অধিক বিস্মিত করল। এর মাঝে সাদাতের ফোন বেজে উঠল। সে দ্রুততার সহিত পকেট থেকে ফোন বের করে না দেখে রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে ভেসে আসলো মেয়েলী কন্ঠস্বর ;
“ হেলো জান, কি করছো? ”
সাদাতের মেজাজ বিগড়ে গেল। সিরিয়াস সময়ে গার্লফ্রেন্ডের ন্যাকা স্বর যেন আগুন ধরিয়ে দিল শরীরে। বিরক্তির সহিত বলল ;
“ ন্যাকু রাণী তোর জান এখন বিজি আছে। ফোন রাখ বা*ল। ”
“ সাদাত তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারলে? মাম্মা তোমার হবু জামাই আমায় বকছে। ”
“ চুপ কর ঢেঁড়স। আমি তোকে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে? ”
মেয়েটি রেগে বলল ;
“ তুমি আমার সাথে ব্রেকআপ করবে? আমাকে বিয়ে করবে না? ”
সাদাত দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করে বলল ;
“ ব্রেকআপ করলাম। তোকে বিয়ে করে জীবন বরবাদ করে লাভ নেই। আমার সাথে একদম যোগাযোগ করবি না। আসছে কোন দেশের ন্যাকু রাণী! কোনো কিছু হলেই — মাম্মা.. রাবিশ। ফোন রাখ ঢেঁড়স। ”
মেয়েটি কল কেটে দিলো। সাদাত ফোনটা পকেটে পুরে বিরবির করে বলতে লাগল ;
“ এসব বা*ল ছালের জন্য জীবন শেষ। এতোদিন পর মুক্তি পেলাম। ”
“ তোর গার্লফ্রেন্ড কল দিয়েছিলো? ”
ইশরার সন্দেহবাতিক স্বর। সাদাত মাথা দুলিয়ে বিরক্তিরস্বরে প্রতুত্তর করল ;
“ এক্স গার্লফ্রেন্ড। ব্রেকআপ করলাম শুনতে পাসনি?”
ইশরা চোখ মুখ কুঁচকে বলল ;
“ হ্যা শুনেছি। তুই কোনো দিন ভালো হবি না তাই না? প্লে বয় একটা। ”
সাদাত আর একটাও কথা বাড়ালো না। ইশরাও চুপ হয়ে গেল। ভেতরে জমে থাকা একরাশ বিরক্তি যেন ঘোলা হয়ে উঠল তার চোখেমুখে।
এই ছেলের মুখের কথা আর কাজের কোনো মিল নেই।আজ একজন, কাল আরেকজন। যে কোনো দিন হুট করে নতুন একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলবে। ভাবতে ভাবতে ইশরার মুখ বিষণ্ন হয়ে ওঠে।মাঝেমধ্যে সত্যি সত্যিই চিন্তা হয় তার এমন এক প্লে বয়ের ভবিষ্যৎ স্ত্রী কেমন হবে? আদৌও কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে তো? আর যদি বা হয় তবে নিশ্চিত মেয়েটার কপাল পুড়বে।
এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোস করতে থাকে সে অচেনা সেই মেয়েটির জন্য। যে হয়তো একদিন এই বেখেয়ালি, দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেটির জীবনে আসবে।কি দুঃখময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে মেয়েটার জন্য।
“ এই সাদাত? ”
অরিত্রিকা সাদাতকে ডেকে উঠল। সাদাত গম্ভীর কন্ঠে বলল ;
“ কী? ”
অরিত্রিকা কৌতুহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ ইরফান ভাই আমাকে কেনো তার বাগদত্তা বললো? তুই কী কিছু জানিস? ”
সাদাত কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল অরিত্রিকার ফ্যাকাসে মুখশ্রীতে। সেই নিস্তব্ধ চোখজোড়ায় জমে থাকা দুঃখের আবছা ছায়া তাকে ছুঁয়ে গেল গভীরভাবে। ইচ্ছে করল না এই মুহূর্তে মেয়েটার হৃদয়ে আরও একটা পাহাড় ভাঙার মত সত্যি চাপিয়ে দিক।অথচ জানা কথাটা না বললেও চলছে না। অন্ধকারে রাখলে একদিন না একদিন ভেঙেই পড়বে সবকিছু। চাচা আজমল সাহেব যে ইরফান ভাইয়ের সঙ্গে অরিত্রিকার বিয়ে ঠিক করেছেন সেটা আর গোপন রাখার মানে হয় না।সে ঠিক করল সবটা জানাবে এখনই। মুখ খুলতে যাবে ঠিক তখনই লিভিং রুম থেকে আজমল সাহেবের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তীব্র, ধমকের সুর। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এলো ইরফান, ইসমা বেগম এবং সাথী বেগমের চিৎকার।তিনজনই চমকে উঠল। মুহূর্তেই পাল্টে গেল পরিবেশের মেজাজ।
চোখাচোখি করে নিঃশব্দে একে অন্যকে দেখল যেন অনুমান করতে চাইলো কি হতে পারে।
কোনো কিছু না ভেবেই নিঃশব্দ চপলতায় তারা উঠে দাঁড়াল।কৌতূহল আর উদ্বেগ মিশিয়ে তড়িঘড়ি করে তারা ছুটে চলল সিঁড়ি বেয়ে নিচতলার দিকে।
“ মামুজান আমি আর শুভ কাজে দেরী করতে চাই না। আজকে রাতের মধ্যে অরিত্রিকাকে বিয়ে করতে চাই। ”
ইরফান ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলে উঠল। আজমল সাহেব আশ্চর্য হলেন ইরফানের এহেন উগ্র আচরণে। আচানক এমন ব্যবহারের কারণটা তিনি বুঝতে পারলেন না। একদিন আগে বাড়ির বড়দের সামনে তিনি বলেছিলেন ইরফান এবং অরিত্রিকার কথা বিয়ে পাঁচ ছয় মাস ভেবে দেখবেন। ইরফান সেই কথায় সায় জানিয়েছিলো তাহলে একদিনের মাঝে হঠাৎ কেনো এতো পরিবর্তন? আচমকা বিয়ের কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। তার ছোট মেয়েটা এসব বিষয় থেকে অনেক দূরে। গোপনকৃত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত নয়। বাচ্চা মেয়েটা যদি হঠাৎ বিয়ের কথা শোনে তাহলে কান্নাকাটি করবে। রেগে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে দিবে। তাদের সাথে কথা বলবে না। এর চেয়ে অধিক পরিস্থিতি বিগড়ে যেতে পারে।
“ ইরফান তুমি শান্ত হও। আমি এবং বড়ভাইসাব বলেছিলাম তোমায় পাঁচ ছয় মাস পর তোমাদের বিয়ের বিষয়ে ভেবে দেখবো। এটা বলার পরে তুমি হঠাৎ কেনো বিয়ে নিয়ে উত্তেজিত হচ্ছো। ”
আজমল সাহেব গমগমে কন্ঠে বলল। ইসমা বেগম ছেলের হাত ধরে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে আছেন। তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত ছেলেটা কেনো হঠাৎ বিয়ে পাগল হয়ে উঠল বুঝতে পারছে না। লাজ শরমের মাথা খেয়ে মামার সামনে গলা উঁচিয়ে বিয়ের কথা বলছে। এতোদিনের মান সম্মান ধুলোয় মিশে গেল তার। ইরফান উচ্চস্বরে বলল ;
“ কারণ আছে মামুজান। কিন্তু আমি সেসব কথা তুলে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। আপনার সময় এসেছে নিজের ওয়াদা রাখার। অরিত্রিকা এবং আমার বিয়েটা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন দয়া করে। ”
আজমল সাহেব কিছুটা রেগে গেলেন। কিছুটা এগিয়ে গেলেন ইরফানের দিকে। সংযত গলায় বললেন ;
“ ওয়াদা রাখার সময় এখনো আসেনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পাঁচ ছয় মাস পরে তোমাদের বিয়ে হবে, সেসময়েই হবে। এটা নিয়ে সিনক্রিয়েট করো না। ”
“ আমি অরিত্রিকাকে হারাতে চাই না মামুজান। ”
“ আমার মেয়ে কি পালিয়ে যাচ্ছে?আপা তোমার ছেলেকে বোঝাও পাগলামি না করতে। ”
আজমল সাহেব ভরাট কন্ঠে কথাটি বলে সোফায় বসলেন। স্ত্রীকে ইশারা করলেন পানি আনার জন্য। সাথী বেগম চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন। স্বামীর ইশারা বুঝতে পেরে ছুটলেন কিচেনে পানি আনতে। তানিয়া বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন আজমল সাহেবের সামনে। স্বাভাবিক ভাবে বললেন ;
“ অরিত্রিকাকে না জানিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি তোমার। মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে। তারও বিয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করার হক আছে। অথচ তোমরা দুই ভাই কী করলে? মেয়েটার বিয়ে ইরফানের সাথে ঠিক করে দিলে। এখন যদি অরিত্রিকা না চায় ইরফানকে বিয়ে করতে তখন কী হবে বুঝতে পারছো?
আজমল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ অরিত্রিকা কখনো আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না ভাবি। আমি যদি বলি ইরফানকে বিয়ে করতে হবে, অরিত্রিকা তা মেনে নেবে। ”
তানিয়া বেগম বিদ্রুপাত্মক হেসে বললেন;
“ অরিনের বিয়ের কথা ভুলে গেছো? ভুলে যাওয়াই কথা বিয়েটা তো মন থেকে মানতে পারোনি। যাই হোক, যুগ কিন্তু ডিজিটাল। মেয়েরা এখন নিজস্ব মতামত বিয়ের ক্ষেত্রে দিয়ে থাকে। তোমার মেয়েও তার নিজস্ব মতামত দিবে। যদি হ্যা বলে আলহামদুলিল্লাহ না বললে তুলকালাম বাঁধবে। ”
“ এসব কি বলছেন ভাবী?”
“ সত্যি বলছি। আমার বিয়ের সময় আব্বা আমার মত জানতে চেয়েছিলেন। আমি সম্মতি দিয়েছিলাম তাই তোমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে। অথচ তোমরা আধুনিক যুগে এসেও বাবা হয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত মেয়েদের ওপর চালিয়ে দিচ্ছো। আগেও বুঝিয়েছি এখন শেষবারের মতো বোঝালাম। এখন দেখো কী করবে?”
তানিয়া বেগম অপরপাশের সোফায় গিয়ে বসলেন। আজমল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। আসলেই কী সে নিজের সিদ্ধান্ত অরিত্রিকার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন?
ইসমা বেগম তানিয়া বেগম এবং আজমল সাহেবের কথোপকথন শুনলেন। ছেলের এমন হইচই কান্ডে তিনিও বিরক্ত হয়েছেন। আচমকা বিয়ে করবে বলে কোনো সভ্য ছেলে বাড়িতে হাঙ্গামা করে? তিনি রেগে ইরফানকে বললেন ;
“ তোর আর অরিত্রিকার বিয়ে পাঁচ ছয় মাস পর হবে বলে দিয়েছিল ভাইজান। তবুও নির্লজ্জের মতো বিয়ে করবি বলে বাড়ি মাথায় করলি। শান্ত ভাবে বসে এসব নিয়ে কথা বললে হতো না? ”
ইরফান বিরক্তি প্রকাশ করে বলল ;
“ পাঁচ ছয় মাস পর না আমি এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই। অরিত্রিকার বিয়ের বয়স হয়েছে তবে দেরী করে লাভ কী? ”
“ এসব কী ধরনের কথা? ”
“ অরিত্রিকাকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি হারাতে পারবো না মা। ”
“ চুপ কর নির্লজ্জ ছেলে।”
ইসমা বেগমের হাতের মুঠোয় থেকে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ইরফান রাগে গমগম করতে করতে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। ইসমা বেগম ছেলের অচেনা ব্যবহারে আশ্চর্য হলেন। সাথী বেগম কিচেনে থেকে পানি নিয়ে এসে আজমল সাহেবকে গ্লাসটি দিলেন। আজমল সাহেব পানির গ্লাসটি নিয়ে চুমুক দিলেন পানির গ্লাসে। তখনি শুনতে পেলেন অরিত্রিকার রাগান্বিত কন্ঠস্বর ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪২
“ আমাকে না জানিয়ে ইরফান ভাইয়ের সাথে কেনো বিয়ে ঠিক করলে আব্বু? আমি ইরফান ভাইকে বিয়ে করবো না।”
আজমল সাহেব পানি খাওয়া বাদ দিয়ে হতচকিত দৃষ্টিতে তাকালেন সিঁড়ির দিকে। দেখলেন অরিত্রিকা, ইশরা এবং সাদাত দাঁড়িয়ে আছে।