প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৫
আদ্রিতা নিশি
সময়টা সন্ধ্যের শেষ লগ্ন। পূর্ব দিকের অম্বরে মেঘের ঘনঘটা। শাঁই শাঁই করে মৃদু শীতল হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। দূর থেকে ভেসে আসছে মেঘের গর্জন। কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। ধূসর কালো – সাদা মেঘে অম্বর মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। সন্ধ্যা ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। অরিত্রিকা এলোমেলো পায়ে ছাদে আসলো। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল রেলিঙ ঘেষে। মন বিষন্ন, নিস্তরঙ্গ। অশ্রুসিক্ত ভেজা নেত্রপল্লব মেলে সন্ধ্যার অম্বরে তাকায়। মেঘপুঞ্জ খেলা করছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে অম্বরের অন্য প্রান্তে।
দেখতে খারাপ লাগছে না। ভালো মন্দ মিশেল সেই অনুভূতি। দুপুরের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সে খাবার স্পর্শ করেনি। খাওয়া দাওয়া যেন এক নিমেষে ভুলে বসেছে তার মন। শরীরে দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত চিন্তায় বুকের ভেতর কেমন যেন অশান্ত লাগছে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একলা নিরবচিত্তে শুনশান নীরবতায় বসে থাকতে ইচ্ছে করছে যদি একটু শান্তুি মিলে সেই আশায়। সাদাত, ইশরা এতোক্ষণ তার মন ভালো করার চেষ্টা করছিল। সে দুজনকে উপেক্ষা করে ছাদে এসেছে। দুজনকে নিষেধ করেছে ছাদে আসতে। দীর্ঘ সময় ধরে মস্তিষ্ক জুড়ে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে তার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সারহান ভাই জানতেন ইরফান ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তবে কেন নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি তো সকলের সামনে বলতে পারতেন “ আমি অরিত্রিকাকে ভালোবাসি। ” কিন্তু বলেননি। সে পিছিয়ে এসে দোলনায় বসে। ভারাক্রান্ত মনে বসে নানাবিধ ভাবনায় মগ্ন হয়। বক্ষস্থলে জেঁকে বসে সারহানকে হারানোর ভয়। তার বাবা একরোখা, জেদি মানুষ। যখন বলেছেন ইরফানের সাথে বিয়ে দিবেন তখন তা করেই ছাড়বেন। হয়তো অতি শীঘ্রই বিয়ের দিন ঠিক করবেন। এমন পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি। কীভাবে মোকাবিলা করবে তা অজানা। প্রথম ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়,অতীত সব মিলিয়ে দিশেহারা সে।
কীভাবে তার বাবা মা, সারহান ভাই সহ সকলকে অতীত সম্পর্কে জানাবে সে? কেন যেন মনে হচ্ছে দুইবছর আগে যে তিক্ত ঘটনার সূচনা হয়েছিল তা এখনো সমাপ্ত হয়নি। নতুনভাবে ঘটনা প্রবাহিত হবে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে আসছে।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে ধরনীতে। দমকা হাওয়া দুলছে অদূরের গাছগুলো। উদাসীন ভঙ্গিতে সেথায় দাঁড়িয়ে রয় অরিত্রিকা। অপলক চেয়ে রয় বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মাঝে। তার চক্ষুদ্বয় দিয়ে উপচে পড়ছে অশ্রু। ব্যথিত হৃদয়ের কষ্ট, অশ্রু যেন বৃষ্টির পানিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা প্রণয়াসুখ দৃঢ় হচ্ছে। দমকা হাওয়ায় প্রকৃতি উত্তাল। বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেছে। অরিত্রিকার পুরো শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। তবুও সে নিঃশব্দে কাঁদতে মগ্ন। তার ভগ্ন হৃদয় ডেকে বলছে “ প্রেমিক পুরুষকে দহনে পুড়িয়েছো মেয়ে, এটা তোমার শাস্তি। যেভাবে তোমার থেকে দূরে থেকে বিরহে উন্মাদ হয়েছে তুমিও উন্মাদ হও, বিরহে দগ্ধ হও। ”
“ ফাইরুজ! উদভ্রান্তের মতো বৃষ্টিতে ভিজছিস কেনো? ”
পুরুষালী বজ্রের ন্যায় কন্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুটা দূর হতে। অরিত্রিকার অবয়ব খানিকটা কেঁপে উঠে আচমকা পরিচিত রুক্ষ কন্ঠস্বর শুনে। সে দ্রুত নাচনরত গাছগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। ভেজা নেত্রপল্লবে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে অবলোকন করে চিলেকোঠার দরজার কাছে দাড়ানো মানুষটাকে। ছাদের চিলেকোঠার বাহিরের দেয়ালের এককোনায় লাগানো বাল্বের। বাল্বের সাদা আলোয় পুরো ছাদ দৃশ্যমান। অরিত্রিকা সেই আলোয় দেখতে পায় সারহানকে। মানুষটাকে দেখে মলিন মুখে হাসল। অবশেষে কল্প পুরুষের দেখা পেল সে। সারহান এক মুহুর্ত দেরী না করে দৌড়ে আসলো অরিত্রিকার সামনে। সামনে এসে দাঁড়াতেই অরিত্রিকা অপ্রত্যাশিত কাজ করে ফেলল। সে সামনে দন্ডায়মান মানবটির পুরুষালী শক্ত- পোক্ত বক্ষে হামলে পড়ল। দুহাতে মানুষটার ভেজা শার্ট আঁকড়ে কেঁদে উঠল। সারহান নিভৃতসুধার এহেন কাজে স্তব্ধ হয়ে গেল। চমকিত নয়নে তাকাল বক্ষে হামলে পড়া মানবীটির দিকে।
“ আমি আপনাকে হারাতে পারবো না সারহান ভাই। আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি আমাকে আবার দূরে সরিয়ে দিবেন না। ভালোবাসি… আপনাকে ভালোবাসি। ”
অরিত্রিকা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের ন্যায় বলতে লাগল। সারহানের উদ্বিগ্ন ভাব কমে এলো। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়েছে এহেন আকস্মিক কাজে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে চাইল অরিত্রিকার দিকে। নিমেষে বিস্ময়ভাব কেটে ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসির রেখা। সে দুহাত দ্বারা আলতো ভাবে মেয়েলী কোমল শরীর আগলে নিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের বক্ষে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে নিচু স্বরে বলল ;
“ তুই শুধু আমার ফাইরুজ । ইউ আর অনলি মাইন সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া। তোকে বিহীন আমি শূন্য। তোকে ছাড়া এখন এক মুহুর্ত বেঁচে থাকা যেন মৃত্যুসম যন্ত্রণার ন্যায়। ”
শ্রবণেন্দ্রিয়ে শব্দগুচ্ছগুলো প্রবেশ করতেই কেঁপে উঠল অরিত্রিকা। শ্যামমানবের শরীরে উষ্ণতায় বিচলিত হলো। কান্নার মাত্রা কিছুটা কমে এলো। কিন্তু মনের ভেতরের তান্ডব কমলো না। সে ক্ষণকাল ভুলে আরো গভীর ভাবে মিশে গেল মানুষটার বক্ষে। অভিমানে জর্জরিত হয়ে অভিযোগ মিশেল কন্দনরত স্বরে বলল ;
“ আপনি কেনো আব্বুকে সেদিন বললেন না আপনি আমাকে ভালোবাসেন। যদি বলতেন তাহলে ইরফান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হতো না। আপনি কেনো চুপ ছিলেন সেদিন? ”
সারহানের মন বিষন্নতায় ভরে উঠল। অরিত্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অশান্ত কন্ঠে বলল ;
“ আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল তোকে নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। সেই ভুলের জন্য ইরফান আর তোর বিয়ে পারিবারিক ভাবে ঠিক হয়েছিল। আমার সামনে তোর এবং ইরফানের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তখন আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আত্মীয়তার সম্পর্ক আমায় বাধ্য করেছিল চুপ থাকতে। ”
“ আপনি কাউকে ভয় পান না। তাহলে সেদিন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ভয় কেনো করেছিলেন? ”
“ তুই বুঝবি না ফাইরুজ কেনো চুপ ছিলাম। শুধু বলবো মায়ের পরে আমি যাকে সব থেকে বেশী বিশ্বাস করেছি সেই মানুষটা আমাকে চুপ থাকতে বাধ্য করেছে। আমিও তাকে কষ্ট দিতে পারবো না তাই আমার অনুভূতি, ভালোবাসাকে সবার থেকে গোপন করেছি। ”
“ আমি ইরফান ভাইকে বিয়ে করবো না সারহান ভাই। আমি উনাকে বিয়ে করবো না। ”
“ আমার না হওয়া বিবিজানকে আমি থাকতে অন্য কেউ বিয়ে করবে আর আমি চুপ করে থাকবো? তা কখনো সম্ভব? আপনার নেতা সাহেব চুপ থাকার মানুষ নয়। শুধু দেখতে থাকুন সামনে কি হয়। ”
সারহান শান্ত কন্ঠে বলল। অরিত্রিকার কান্না থেমে গেল তৎক্ষনাৎ। শ্যামমানব তাকে বিবিজান বলে ডেকেছে! সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। মাথা উচিয়ে ভেজা নেত্রপল্লব মেলে চকিত নয়নে তাকাল সারহানের মুখপানে। বৃষ্টির পানি শ্যামমানবটির মুখ স্পর্শ করছে। কৃষ্ণ বর্ণের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে রয়েছে কপাল জুড়ে। চুল থেকে বিন্দু বিন্দু পানি সরাসরি পরছে তার মুখে। শ্যামমানবটির বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ বিমোহিত রুপ পুনরায় বেসামাল করল তার ছোট্ট মন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ মনে হলো তার কল্প পুরুষকে। পরিচিত পারফিউমের তীব্র সুবাসে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। অনিমেষ পুরুষালি তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয়ের গহ্বরে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস টানল। মুহুর্তেই বাধ্য অনুভূতি অবাধ্য হয়ে ছড়িয়ে পড়ল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অসভ্য মন যেন আবদার করে বসল মানুষটার গালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিতে। নিজেকে সামলে নিলো। দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে পিছিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু পারলো না। মানুষটার শক্ত পোক্ত বাহুতে আবদ্ধ তার শরীর। মস্তিষ্কে ধরা দিল তার দুঃসাধ্য কাজের প্রতিচ্ছবি। নিজের এহেন কাজে হতভম্ব হয়ে গেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নিজেকে ছাড়ানোতে মরিয়া হয়ে উঠল।
সারহান প্রণয়িনীর লজ্জায় লাল হয়ে উঠা মুখশ্রীতে তাকায়। দৃষ্টি স্থির হয় ওষ্ঠযুগলের দিকে। গোলাপী ওষ্ঠযুগল তিরতির করে কাপছে। সেথায় বৃষ্টির পানি সাদাটে আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বৃষ্টিভেজা নিভৃতসুধার অধর যেন তাকে টানছে। সে শুকনো ঢোক গিলে। নিজেকে সামলানো বেগতিক হয়ে যায়। এতোক্ষণ নিষিদ্ধ অনুভূতি আবদ্ধ থাকলেও এখন তা প্রকাশ হওয়ায় মরিয়া হয়ে উঠে। সে আলতো ভাবে অরিত্রিকাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। নেশাতুর কন্ঠে বলে;
“ বৃষ্টিস্নাত রাতে তুই আমার বাহুডোরে আবদ্ধ ফাইরুজ। ইচ্ছে করছে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে।আরো গভীরভাবে আলিঙ্গন করতে। তোর বৃষ্টিভেজা মুখশ্রীতে সারারাত অপলক তাকিয়ে থাকতে কিন্তু আমি তা করতে পারবো না। সেই অধিকার আমার এই মুহুর্তে নেই।
সারহান একটু থামে। অরিত্রিকার কপালে লেপ্টে থাকা চুল আলতোভাবে স্পর্শ করে কানের পাশে গুঁজে দেয়। অরিত্রিকা শিউরে ওঠে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। লাজুক আভা স্পষ্ট হয়ে উঠে মুখশ্রীতে। সে তা পরখ করে। ওষ্ঠে কামড়ে হেসে অতি শান্ত কন্ঠে বলে;
“ খুব শীঘ্রই তোকে আমার বউ বানাবো। বউ হবি আমার? ”
অরিত্রিকা এতোক্ষণ লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছিল। মানুষটার মুখ হতে ওমন কথাগুলো তাকে দিশেহারা করছিল। মনসত্তা বেসামাল হচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। দ্বিধাহীনভাবে বলা কথা গুলোয় তার কান গরম হয়ে আসছিলো। নিশ্চুপ থাকলেও ভেতরে হাসফাস করে উঠছিল।সে শেষোক্ত কথাটি শুনে বিমূঢ় চাহনিতে তাকায় সারহানের দিকে। সে চমকিত, থমকিত। সারহান ভাই তাকে বিয়ের প্রপোজাল দিলো! কীভাবে সম্ভব। হঠাৎ মানুষটা এমন কিছু বলবে তা যেন কল্পনাতীত ছিলো। সে কিছুটা শিউরে উঠল। অবাকতার রেষ নিয়ে থেমে থেমে বলল ;
“ কী বললেন? ”
বৃষ্টির গতি থেমে এসেছে। ছাদে দুজন মানব মানবী বৃষ্টি এবং প্রেম বিলাসে ব্যস্ত। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে পুরো শরীর জবজবে হয়ে গেছে। সারহান অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা
দূরে নিজে অবস্থান করল। ভেজা চুলগুলো একহাতে পেছনে ঠেলে দিয়ে পূর্বের ন্যায় বলল ;
“ এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর বিবিজান হতে রাজি আছেন মিস অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী? না হওয়া বিবিজান থেকে পার্মানেন্ট বিবিজান হবেন আমার? ”
অরিত্রিকার মনের ভেতরের কষ্ট, যন্ত্রণা হাহাকার কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। মন শান্ত হয়ে আসল। এতোক্ষণের সব ভয় মিলিয়ে গেল। ওষ্ঠকোণে সঞ্চার হলো হাসি। সেই মুহুর্তে কিছু একটা ভেবে মুখ ভার হয়ে এলো। মিনমিন করে বলল ;
“ আপনার সাথে চুটিয়ে প্রেম করতে পারলাম না তার আগেই বিয়ের কথা বলছেন? ”
“ সবাই বিয়ের আগে প্রেম করে আমরা না হয় বিয়ের পর প্রেম করলাম।”
“ এটা আমি মানবো না। ”
“ তাহলে আর কি তোর বজ্জাত বাপের কথায় ইরফানকে বিয়ে কর। ”
“ আপনি একটা নিরামিষ সারহান ভাই। ”
“ এই মুহুর্তে আমার আমিষের ডোজ সামলাতে পারবি না ফাইরুজ। ”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলল। অরিত্রিকা নাক মুখ কুঁচকে বলল ;
“ ছিহ, এসব কি বলছেন? ”
সারহান ভ্রুযুগল কুঁচকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ;
“ কী বলেছি? ”
“ কিছু না। ”
“ দ্রুত আমার প্রশ্নের উত্তর দে নয়তো তোর বজ্জাত জেদি বাপটাকে বলে ইরফানের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে দেবো। ”
“ আপনি এতো খারাপ কেনো সারহান ভাই? ”
অরিত্রিকা নাক ফুলিয়ে ওষ্ঠ উল্টে বলল৷ সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ যা বলেছি তার উত্তর দে।”
অরিত্রিকা লজ্জা পেল। মাথা নত করে দৃষ্টি স্থির করল নিচের দিকে। লজ্জায় গাল দুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেল। কীভাবে উত্তর দিবে প্রশ্নের ভেবে আড়ষ্টতায় জমে গেল। অন্য চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে লাজুক ক্ষীণ কন্ঠে বলল ;
“ আপনার বউ এবং নেতা সাহেবের বিবিজান হতে রাজি আমি। ”
সারহান দু কদম এগিয়ে আসে। অরিত্রিকার লাজুক নতজানু মুখ উঁচিয়ে মৃদু হাসে। সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আওড়ায় ;
“ আলহামদুলিল্লাহ। ”
অরিত্রিকা লজ্জায় মুখ লুকায় সারহানের বক্ষে। সারহান পুনরায় আগলে নেয় অরিত্রিকাকে। তার বক্ষস্থলে শীতল শিহরণ বইয়ে যায়। অন্তঃকোণ ভালো লাগায় পরিপূর্ণ হয়ে উলটে। সে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে ধীর কন্ঠে বলে ;
“ ইস্ক মুবারক মাই সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া।”
অরিত্রিকা নিঃশব্দে হাসল। আবেশে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নিরবচিত্তে পড়ে রইল প্রিয় মানুষটির বক্ষে। মন অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠে। বিরবির করে আওড়ায় ;
“ ইস্ক মুবারক কল্প পুরুষ। ”
বৃষ্টির মাত্রা বাড়ে। দমকা হাওয়া ছুঁয়ে যায় মানবীর শরীর। মেয়েলী অবয়ব কেঁপে উঠল শীতল হাওয়ায়।মানবটি তা লক্ষ্য করে দৃঢ় ভাবে আলিঙ্গন করে। ভালোবাসায় সিক্ত হয় তারা। ক্ষণকাল ভুলে নিজেদের মাঝে দ্বিধা ভুলে অনুভূতি প্রকাশে মত্ত হয়। রোমাঞ্চকর প্রকৃতি যেন আজ তাদের সাথ দেয়। বৃষ্টিস্নাত রাত যেন সাক্ষ্য দেয় প্রণয়ের নতুন সূচনার। যেখানে কঠোর খোলসে আবৃত মানব এবং চঞ্চলা নরম মনের মানবীর প্রণয়ের কাব্য লিখতে ব্যস্ত। এই রোমাঞ্চকর মুহুর্ত আরও সুন্দর হয়ে উঠে দূর হতে ভেসে আসা গানে।
“ বেখেয়ালি মনে…. ভেবেছি গোপনে..
বেখেয়ালি মনে… ভিজেছি দুজনে..
আদরে চাদরে দেবো তোকে মুড়ে
বৃষ্টি চাস বারো মাস ভিজি আয়…”
ইশরা এবং সাদাত অরিত্রিকার রুমে বসে অপেক্ষা করছে অরিত্রিকার জন্য। দুজনে বিছানার দুইপাশে বসে আছে আছে। সাদাতের চুপচাপ বসে ভালোলাগছে না তাই ফোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে গেম খেলছে। অপরদিকে ইশরা নির্বাক হয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছে৷ একদিকে সাদাত তার সাথে কথা বলছে না অপরদিকে অরিত্রিকা আসছে না। ঝড়, বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা একা কী করছে ভেবে সে চিন্তিত হয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে যদি অসুস্থ হয়ে যায় তখন কি হবে? অরিত্রিকার দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার ইচ্ছে জাগল। তার ধৈর্য ধারণ করা মুশকিল হয়ে গেল। গোমড়া মুখ নিয়ে আড় চোখে তাকাল সাদাতের দিকে। দেখল গেম খেলছে। সে বেশ বিরক্ত হলো। ছোট বোন ছাদে একা একা কী করছে সেদিকে খেয়াল না করে গেম খেলছে চুপ বদমাশ ছেলে কোথাকার। এই ছেলের আসায় থাকা যাবে না। তাই ধপ করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল রুমের দিকে। গন্তব্য ছাদের দিকে।
“ ইশরা কোথায় যাচ্ছিস? ”
সাদাতের রুক্ষ কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ইশরা থমকে দাঁড়াল রুমের দরজার সামনে। বিস্মিত ভঙ্গিতে পেছনে ফিরে সাদাতের দিকে তাকাল। প্লে বয়টা তাকে নাম ধরে ডাকছে? এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য মনে হলো তার কাছে।
সাদাত ইশরাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো। রুঢ় গলায় বলল ;
“ কী বললাম শুনতে পাসনি?”
ইশরা একটু চমকে যায়। থমথমে গলায় বলে ;
“ ছাদে যাচ্ছি। ”
“ ছাদে যাওয়ার দরকার নেই। ”
“ কেনো? ”
“ ছাদে গিয়ে ভাই আর অরিত্রিকার মাঝে কাবাবের হাড্ডি হওয়ার দরকার নেই।”
“ সারহান ভাই কখন ফিরেছে আর ছাদেই বা কখন গেল? ”
ইশরা অতিব আশ্চর্য হয়ে বলল। সাদাত নিগূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে বলল ;
“ ভাই কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। ”
ইশরা সাদাতের দিকে এগিয়ে আসল। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল ;
“ দুজনে বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কী করছে? ভিজে যাচ্ছে চল ছাতা নিয়ে যাই। ”
“ বৃষ্টিতে ভিজে দুজনে রোমান্স করছে। বড় ভাই আর হবু ভাবীর রোমান্স দেখবি গর্দভ? ”
“ ইয়ে মানে না। কিন্তু তুই কীভাবে বুঝলি দুজনে রোমান্স করছে? ”
“ আমার মতো প্রেমিকরা না দেখেও বুঝতে পারে। ”
সাদাত শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল। ইশরা বিরক্তিসূচক শব্দ করে সেখান থেকে অরিত্রিকার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে দৃশ্যমান বাড়ির পেছনের অংশ। বাড়ির আশেপাশে জমকালো সাদাটে আলোয় বৃষ্টি, দমকা হাওয়ায় দুলে উঠা প্রকৃতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন অম্বর হতে ভেসে আসছে মেঘেদের গর্জন। কিছুক্ষণ পর পর বজ্ররশ্নিতে আলোকিত হয়ে উঠছে চারিপাশ। প্রকৃতির শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। তার মন ফুরফুরে হয়ে যায়। বিরক্তিভাব কেটে ভালোলাগায় মন ভরে উঠে। ওষ্ঠকোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বেলকনির গ্রীলের ফাঁকা স্থান দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখতে থাকে। দূর থেকে ক্ষীণ আওয়াজে ভেসে আসা গান সঙ্গে বৃষ্টিবিলাস যেন অসম্ভব সুন্দর মুহুর্ত হিসেবে ধরা দেয় তার কাছে। কিছুটা সময় সানন্দে কেটে যায়। তখনি অনুভব করে তার পাশে কারো উপস্থিতি। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় তৎক্ষনাৎ। সাদাত নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তখন।
“ গেম খেলা বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস?”
ইশরা ত্যাড়া কন্ঠে বলল। সাদাত কিছুক্ষণ মৌন থেকে শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ তোর সাথে বৃষ্টিবিলাস করতে এসেছি। ”
ইশরা অবাক হয়ে বলল ;
“ সূর্য আজ মনে হয় ভুল দিকে উঠেছিল। তুই আর বৃষ্টিবিলাস! ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছি। ”
“ শুনেছি বৃষ্টির সাথে প্রেম নামে। কথাটা কতোটা সত্য জানা নেই। তবে অনেকদিনের ইচ্ছে যে সবসময় আমার কল্পনায় বিরাজ করে তার সঙ্গে বৃষ্টি বিলাস করব আর অল্প স্বল্প প্রেম নিবেদন করব। সেই ইচ্ছে যেন পূর্ণ হয়েও অপূর্ণ। ”
“ বুঝেছি। তোর প্রেমিকার সাথে ব্রেকআপ হয়েছে তাই বলছিস? ”
“ মাথামোটা কোথাকার। ”
সাদাত বিরক্ত হয়ে বিরবির করে বলল। ইশরা বাহির হতে আসা বৃষ্টির শব্দে শুনতে পেল না। জিজ্ঞেস করল ;
“ কিছু বললি? ”
সাদাত মুখ গম্ভীর করে বলল ;
“ নাহ। কথা না বলে সুন্দর মুহুর্ত উপভোগ কর। ”
ইশরা মুখ ভার করে বাহিরে তাকাল। সাদাত দেখল সেই ভার হয়ে আসা মুখশ্রী। অপলক চেয়ে রইল সেদিকে। বাহির থেকে হাওয়া এসে খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে যেন মেয়েটিকে বিরক্ত করার ফন্দি এঁটেছে। ইশরা অবাধ্য চুলগুলো বারবার কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছে। বেলকনির সাদাটে আলোয় স্পষ্ট অবলোকন করছে সাদাত। এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ওঠে তার মন। সে নিঃশব্দে হাসল। তার ইচ্ছে করল এলোমেলো চুলগুলো নিজ হাতে ইশরার কানের পেছনে সযতনে গুঁজে দিতে।
“ কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস ইশু? ”
সাদাতের কন্ঠস্বর অচেনা লাগল। ইশরা চমকিত নয়নে তাকাল সাদাতের দিকে। কপাল কুঁচকে মুখ ভার করে বলল ;
“ না। ”
সাদাতের ওষ্ঠকোণে বিদ্যমাণ হাসি চওড়া হলো ;
“ কাউকে পছন্দ করিস? ”
“ না। এসব কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো? ”
“ এমনি।”
“ তোর মাথা এসব উদ্ভট ভাবনা কোথায় থেকে আসে বুঝি না আমি। এবার তুই একটা সত্যি কথা বলতো? ”
“ কী? ”
“ তোর কত্তো গুলো গার্লফ্রেন্ড ছিলো। সবগুলোর সাথে টাইম পাস করেছিস। সত্যি করে বল তুই তাদের মধ্যে কাউকে একমুহূর্তের জন্য ভালোবাসিসনি? ”
“ টাইম পাস করেছি ওদের সাথে। ”
সাদাতের দৃঢ় কন্ঠস্বর। ইশরা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ তোর কথায় বোঝা যাচ্ছে তুই কাউকে ভালোবাসিসনি। এতো গুলো মেয়ের মন না ভাঙলেও পারতি সাদাত। ওরা তোর জন্য কতো কষ্ট পেয়েছে। ”
সাদাত অদ্ভুত হাসে ;
“ ওদের কষ্ট হয়েছে কিনা তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না আর কে বলেছে আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি? যাকে ভালোবেসেছি সে হয়তো জানেনা আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। ”
ইশরার চক্ষুদ্বয় বড় হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল ;
“ কাকে ভালোবাসিস তুই আর বলিসনি কেনো?”
সাদাত শান্ত চাহনিতে ইশরার দিকে তাকিয়ে বলে ;
“ আছে কেউ একজন। যাকে ভালোবাসি তাকে যদি আমার মনের কথা বলি সে কখনো বিশ্বাস করবে না আমার কথা। ভাববে আমি তার সাথে টাইম পাস করছি। তাই আমার অনুভূতি তার থেকে গোপনে রাখা শ্রেয় বলে মনে করছি। ”
“ একবার বলে দেখ। ”
“ সে আমায় ভালোবাসে না ইশু। আমায় খারাপ ছেলে ভাবে। হয়তো ক্যারেক্টারলেস ও ভাবে।আমি নম্র ভদ্র মেয়েটাকে ভালোবাসতে চায়নি। তবুও নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেললাম। না পারছি তার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে, না পারছি কাছে নিজের করে নিতে। আমার মতো প্লে বয় ধাঁচের ছেলে কেন ভালো মেয়েটাকে ভালোবাসলো? ”
সাদাতের কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসল। বিমর্ষ নয়নে ইশরার চোখে চোখ রেখে অতি কষ্টে কথাগুলো বলল। ইশরা যেন হতভম্ব হয়ে গেল। সাদাত সত্যি কাউকে ভালোবাসতে পারে? ছেলেটা কী মেয়েটিকে নিজের করে পাবে না তাই কষ্ট পাচ্ছে? তার মন বিচলিত হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠায় অশান্ত হয়ে গেল। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। সাথে সাথে স্বশব্দে বজ্রপাত হলো। ইশরা আচমকা শব্দে ভয় পেয়ে গেল। চোখ মুখ খিঁচে ভয়ার্ত এবং আতংকগ্রস্থ ভঙ্গিতে সাদাতের একবাহু খামচে ধরে বুকে মুখ লুকালো। সাদাত স্তব্ধ হয়ে গেল এহেন ঘটনায়।
বৃষ্টির সাথে সাথে বজ্রপাত হতে থাকল ধরণীতে দূর হতে ভেসে আসছে এখনো সেই গান।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৪
“ আলোর ওই দেশে…
সাত রঙ মিশে…
সেই রঙে তোকে রাঙাবো..
রাত্রি গড়িয়ে বুকে জড়িয়ে..
তোর ভোরেরই ঘুম ভাঙাবো…
আদরে চাদরে নেবো তোকে মুড়ে
বৃষ্টি চাস, বারো মাস ভিজি আয়..
বেখেয়ালি মনে.. ভেবেছি গোপনে.. ”