প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫২

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫২
আদ্রিতা নিশি

রাত আটটা বেজে দশ মিনিট। লিভিং রুমে বসে আছেন আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব। তারা কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরেছে। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে ইরফানের সাথে জরুরী কথা বলার জন্য বসেছেন। ইরফান ওপর পাশের সোফায় চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। সে বুঝতে পেরেছে কেন জরুরী তলব করেছে তাকে। নিশ্চয়ই বলবে অরিত্রিকার বিয়ে তোমার সাথে দেব না! সে তাচ্ছিল্য হাসে। জীবনটা অদ্ভুত কেন?
আজমল সাহেব উসখুস করছেন। কি বলবেন! কিভাবে কথাটা শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ছেলেটা যদি ভুল বুঝে? তিনি নিরবতা ভাঙলেন। গলা খাঁকড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ;

“ তুমি আজ অফিসে যাওনি কেনো?”
ইরফান দৃষ্টি স্থির করল আজমল সাহেবের দিকে। স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো ;
“ শরীর ভালো ছিল না তাই যাইনি।”
আরশাদ সাহেব বুঝতে পারলেন ছেলেটা মিথ্যা বলছে। আজমল সাহেব মৌন থেকে প্রতিক্রিয়াস্বরুপ বললেন ;
“ সকালে বলোনি কেন? ”
ইরফান শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ ভুলে গিয়েছিলাম ”
“ ওহহ। চার পাঁচদিন বাসায় বসে রেস্ট নাও। অফিসে যাওয়ার দরকার নেই।”
“ কেনো ডেকেছিলেন মামু? ”
“ আসলে… ”
“ আমি জানি আপনি কি বলতে চাইছেন। তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজমল সাহেবের মন বিষন্ন হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন ভাব ফুটে উঠল মুখে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ;
“ গতকালের ঘটনা নিশ্চয়ই শুনেছো। অরিত্রিকা এবং সারহান একে অপরকে পছন্দ করে। সারহান হুমকি দিয়েছে আগামী শুক্রবার যেন আকদ করিয়ে রাখা হয়। বুঝতে পারছিনা কি করা উচিত আমার। ”
ইরফান বক্ষস্থল অশান্ত হয়ে উঠল। চিনচিনে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে উঠল ভেতরটা। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে কাঁপল অন্তঃকোণ। লাজ সরম ভুলে গেল নিমিষে। ওষ্ঠ ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলে জাহির করল মনের কথা ;
“ আমি অরিত্রিকাকে ভালোবাসি মামু। ”

আজমল সাহেব যেন চরম হতাশায় নিমজ্জিত হলেন। তিনি এমন কিছু হবে রাতেই আশঙ্কা করেছিলেন। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত, ওয়াদা করা সব যেন অসহনীয় যন্ত্র*ণার সাগরে ডুবিয়ে দিল। পরিস্থিতি ভীষণ জটিল। বাড়ির দুই ছেলের কারো পক্ষে কথা বলতে পারছেন না। আরশাদ সাহেবের মন বেজার হয়ে গেল। ইরফানের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। ছোট ভাই এবং ছোট বোনের নির্বুদ্ধিতার খেসারত সন্তানসম ছেলেটাকে দিতে হচ্ছে।
“ ইরফান পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো। অরিত্রিকা তোমাকে বিয়ে করতে চায় না। কারণটা তুমি ভালো করে জানো। জেনেশুনে যদি বিয়ে করার চিন্তা করো তবে তোমার মতো নির্বোধ কেউ নেই। বিয়ে শব্দটা ছোট হলেও ভারটা অনেক বেশী। বিয়ে হলো সারাজীবনের জন্য পবিত্র এক বন্ধন। যদি বিয়ের পর বন্ধন ছিন্ন হয় এবং সম্পর্কে নানা জটিলতা দেখা দেয় তখন কী হবে? কি বোঝাতে চেয়েছি নিশ্চয়ই বুঝেছো? ”

আরশাদ সাহেব বোঝানোর স্বার্থে কথাটি বললেন। আজমল সাহেব সম্মতি জানিয়ে বললেন ;
“ ভাইসাব ঠিক বলেছে ইরফান। বিয়ে হলো সারাজীবনের ব্যাপার। তুমি অরিত্রিকাকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও। কিন্তু অরিত্রিকার তা চায় না। দুজনের মতের কোনো মিল নেই। আমি চেয়েছিলাম তোমার এবং অরিত্রিকার বিয়ে দিতে কিন্তু একটা ভুল সিদ্ধান্তে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। আমাকে ক্ষমা করো ইরফান।”
ইরফানের হৃদয় যেন লুপ্তপ্রায় নগরী। যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি অলিগলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হৃদয়ের প্রাচীন প্রাসাদ আজ ভেঙে পড়ে আছে ধূলিধূসরিত। সে বুঝতে পারে সেই অরিত্রিকা যাকে আপন হৃদয়ের প্রতিটি শিরায় বহন করেছিলো সেই মেয়েটাএখন আর তার নয়। অন্য এক ভুবনের অন্য এক হৃদয়ের অধিকারিণী হয়ে গেছে সে।ভগ্ন হৃদয়ের অন্তঃশ্বাস ছুটে ওঠে —”বসন্তিকা, তুমি তো আমার হয়েও আমার রইলে না!” অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, নামহীন, অমোচনীয় সম্পর্কের এমন করুণ পরিসমাপ্তি যেন স্বপ্নভঙ্গের শব্দে অম্বর কেঁপে ওঠে। যাকে পাওয়ার জন্য সে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অপেক্ষায় থেকেছেন সেই বসন্তিকা আজ তার সমস্ত বসন্তকাল ছাই করে বিদায় নিচ্ছে।

বক্ষের গভীরে এক উচাটন বিষাদের বর্শা বিদ্ধ হয়ে থাকে। নিঃশব্দ আর্তনাদের মাঝে ডুবে যায় তার অস্তিত্ব। চোখ দু’টি জ্বলছে। বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যথা আর অসহায়ত্বের ছাপ। মুখাবয়বে তীব্র শঙ্কা আর ফ্যাকাসে বিষণ্নতা। দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয় ইরফান যেন বুকভরা হাহাকারকে প্রশমিত করতে। অথচ জানে, এই ক্ষরণ আর কোনো দিন থামবে না। কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসে। মস্তিষ্ক অচল প্রায়। বুকভরা হাহাকার নিয়ে কোনো মতো আওড়ায় ;
“ অরিত্রিকা সারহানকে বিয়ে করে সুখী হয় তবে তাই হোক। অরিত্রি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। আপনারা আগামী শুক্রবার আকদের ব্যবস্থা করুন আর খেয়াল রাখবেন কোনো কিছুতে যেন কমতি না থাকে। ”
কথাটা শেষ করে হাসে ইরফান। হৃদয় ভাঙার সেই মলিন, বিষাদে ভরা হাসি। মানুষটার কন্ঠনালী বোধ হয় কেঁপেছে। নিজের মনে কষ্ট চাপা রেখে কথা বলা মোটেও সহজ নয়। সে এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। অবর্ণনীয় কষ্ট আড়াল করে থেমে থেমে বলে ;

“ আপনারা আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমার জন্য ওদের দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যা হবে না। আমি আসছি। ”
কথাটা বলে ইরফান এলোমেলো পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সদরদরজা দিয়ে বের হয়ে বাহিরে চলে যায়। আরশাদ সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। মন খারাপ করে বললেন ;
“ তোমাদের দুজনের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ইরফানকে দেখেছো? ছেলেটা অরিত্রিকাকে ভালোবাসে। ”
আজমল সাহেব মাথা নিচু করে ফেললেন। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অনুতপ্ততার রেষ। ইসমা বেগম যদি ছেলের জন্য অরিত্রিকাকে না চাইতো আজ এমন জঘন্য পরিস্থিতি তৈরী হতো না। একটা ভুল যেন পরিবারের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। তিনি দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন হলে।কন্ঠে অনুতাপ ফুটিয়ে বললেন ;
“ ভাইসাব, বাবা কখনো তার সন্তানের খারাপ চায় না। তেমন আমিও অরিত্রিকার খারাপ চাইনি। কিন্তু এমন কিছু হবে বুঝতে পারিনি। আমি অরিত্রিকা, সারহান এবং ইরফানের কাছে অপরাধী হয়ে গেছি ভাইসাব। বাচ্চারা আমায় ভুল বুঝলো। ”
আরশাদ সাহেব শান্ত কন্ঠে বললেন ;

“ ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহন করা উচিত আজমল। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই অনেকে। এবার এসব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে বেয়াই হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। ”
আজমল সাহেব মাথা উঁচিয়ে তাকালেন। আরশাদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন ;
“ কি হলো জোয়ান বেয়াই পছন্দ হয়নি? ”
আজমল সাহেব শব্দ করে হাসলেন ;
“ আপনি মশকরা করছেন ভাইসাব? ”
“ নতুন বেয়াইয়ের সাথে মশকরা করা যায়। ”
“ ভাবতেই অবাক হচ্ছি আপনি আমার বেয়াই হবেন। ”
আরশাদ সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন৷ আজমল সাহেবও তাল মিলিয়ে হাসলেন।

ইশরা নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। প্রায় একসপ্তাহ যাবত পড়াশোনা থেকে অব্যহতি নিয়েছিল সে। গতকাল রাতে মেসেঞ্জারের ডিপার্টমেন্ট গ্রুপে মেসেজ এসেছে একমাস পরে অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। ব্যস ঘুম যেন তখন থেকে কোথাও হারিয়ে গেছে। এতোদিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে আরামসে ঘুমিয়েছে, ঘুরেছে আজ থেকে সবকিছু সমাপ্তি ঘটিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারল না। প্রায় একঘন্টা ধরে পাঁচ পৃষ্ঠা পড়েছে সে। মন বইয়ের দিকে নেই। অসভ্য মন পড়ে আছে অরিত্রিকার রুমে। অরিত্রিকা এবং অরিত্রিকার বান্ধবীরা আড্ডা দিচ্ছে আর সে রুমে শুয়ে পড়ছে কিন্তু শান্তি মতো পড়তে পারছে না। সে ঠাস করে বই বন্ধ করে রেখে হুরমুড়িয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। সোজা গিয়ে থামল লিভিং রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ বুলিয়ে নিলো আশেপাশে। কাউকে দেখতে পেল না। এসময় রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে সবাই। হঠাৎ শুনশান পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় একটু খটকা লাগল। সে চপল পায়ে এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে। উঁকি দিয়ে দেখল কেউ নেই। পুরো কিচেন মানুষ শূন্য।

“ কিচেনে চোরের মতো উঁকি ঝুঁকি করছিস কেন? ”
সাদাতের ঘুমু ঘুমু গম্ভীর কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ভড়কে গেল ইশরা। দ্রুত পেছনে ফিরে তাকাল। দেখল সাদাত ভ্রুযুগল উঁচিয়ে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখাবয়ব হালকা ফোলা। চক্ষুদ্বয় অস্বাভাবিক লাল। হয়তো ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। অসময়ে কে ঘুমায়?সাদাতের মেজাজ বিগড়ে গেল। পূর্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করল ;
“ কি করছিস এখানে? ”
ইশরা দৃষ্টি সরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ বড় মামী, ছোট মামী ও মা কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? ”
সাদাত এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে হাটা ধরল লিভিং রুমে। সোফায় ঠাস করে শুয়ে পড়ল। অতঃপর চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে বলল ;
“ আবির ভাইয়ার বাড়িতে গিয়েছে সবাই। ”
ইশরা অবাক হলো। এতো রাতে আবির ভাইয়ার বাড়িতে কেন যাবে সবাই? নিশ্চিত কোনো কিছু হয়েছে। সে দ্রুততার সহিত এগিয়ে যায় সাদাতের। ধপ করে বসে পড়ে সাদাতের মাথার দিকটায়। কোতুহলী ভাব নিয়ে বলে ;
“ হঠাৎ কেন আবির ভাইয়ার বাড়িতে গেল? ”
“ বিরোধী পক্ষের ছেলেপুলেরা পার্টি অফিসের সামনে ভাইয়ের ছেলেদের ওপর হাম*লা করেছিল বিকেলে। আবির ভাইয়া সেখানে উপস্থিত ছিল। ওদের মোকাবিলা করতে গিয়ে পাল্টা হাম*লায় আবির ভাইয়া সহ আরো কয়েকজন আ*হত হয়। ”

“ বলিস কি? এখন কি অবস্থা উনার? ”
“ এখন ভালো আছে। হসপিটাল থেকে বাড়িতে নিয়ে গেছে শুনলাম। সেই সংবাদ পেয়ে বাড়ির বড় রা আবির ভাইয়ের বাড়িতে গেছে।”
সাদাত চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে বলল। ইশরা কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল;
“ অরিন আপু আবির ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছে? ”
সাদাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ তুই আসলে মাথামোটা টমেটো। আবির ভাইয়ের ওমন অবস্থার কথা শুনে আপু কি বাসায় বসে থাকবে?”
ইশরা নিজের বোকামিতে বিরক্ত হলো। সত্যি তো কথায় লজিক আছে। নিজের মনের ভাব লুকিয়ে মিনমিন করে বলল ;
“ তাও ঠিক। আমাদের কেন নিয়ে গেল না? ”
সাদাত তড়িৎ বেগে উঠে বসে সোফায়। চক্ষুদ্বয় সংকুচিত করে তাকায় ইশরার দিকে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলে ;
“ তোর মামুদের জিজ্ঞেস কর। ”
“ রেগে যাচ্ছিস কেন? ”
“ তোর উল্লুক মার্কা কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ”
ইশরা খেয়াল করল সাদাতকে খানিকটা অন্যরকম লাগছে। চক্ষুদ্বয় পূর্বের তুলনায় অধিক লাল হয়ে যাচ্ছে। সে উদ্বিগ্ন হয়। কিঞ্চিৎ উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করে ;

“ সাদাত কি হয়েছে তোর? চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে কেন? ”
সাদাত হাত দ্বারা মাথা চেপে ধরল। ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিল ;
“ মাথা ব্যথা করছে তাই হয়তো চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ”
“ ঔষধ খেয়েছিস? ”
“ হ্যা। সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে প্যানিক করিস না ইশু। ”
“ মিথ্যা কথা বলছিস তুই। তোর কথা শুনে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর তুই ঔষধ খাসনি। ”
ইশরা গমগমে কন্ঠে বলল। সাদাত ওষ্ঠ এলিয়ে হাসল ;
“ আমার কথার ধরন শুনে মিথ্যা বলেছি বুঝতে পারলি অথচ আমার মনে কি চলছে তুই বুঝতে পারিস না! আফসোস। ”
ইশরার কপাল কুঁচকে গেল। সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল ;
“ তোর মনে কি চলছে আমি কেন বুঝতে যাব আজব! এই বলতো তুই আমার থেকে কি লুকচ্ছিস। ”
“ কিছু লুকাচ্ছিলো না। ”
“ সত্যি করে বল বলছি। ”
সাদাত যেন শুনেও শুনল না। খানিকটা ঘুরে বসে ঠাস করে মাথা রাখল ইশরার কোলে। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে শান্ত কন্ঠে বলল ;

“ মাথা টিপে দে ইশু! ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। ”
ইশরা থমকে দাঁড়িয়ে গেল সাদাতের এহেন কান্ডে।
অপ্রত্যাশিত ঘটনার অভিঘাতে তার সমস্ত সত্তা থরথর করে কেঁপে উঠল।নিঃশব্দে, নিঃস্পন্দ দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে সাদাতের মুখপানে। বিস্ময়, শঙ্কা ও অবিশ্বাসের অপূর্ব মিশ্রণ চক্ষুদ্বয়ে ফুটে ওঠে।শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎখণ্ডের ন্যায় শিরশিরে স্রোত বয়ে যায়।জিভ অবশ, কণ্ঠ রুদ্ধ।
সাদাত শীতল কন্ঠে পুনরায় বলে উঠল ;
“ ইশু! ”
ইশরা অস্ফুটস্বরে বলল ;
“ হু!”
“ মাথা টিপে দে দোস্ত। ”
“ উমম আচ্ছা। ”
ইশরা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। জড়তা, আড়ষ্টতায় নেতিয়ে পড়ল। মনের দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল সাদাতের কপাল। সযতনে সাবধানে মাথা টিপে দিতে লাগল। সাদাত অনুভব করল ইশরার স্পর্শ। বিরবির করে বলল ;
“ কবে বুঝবি ইশু আমার অনুভূতি? ”

কিছুক্ষণ পূর্বে বাড়িতে ফিরেছে সারহান। নয়ন তালুকাদের সাথে মুলাকাত করে এবং দলের আহত ছেলেপুলেদের হসপিটালে দেখতে গিয়ে রাত হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরে বাবা ও চাচাকে আবিরের আ*হত হওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে সরাসরি নিজের রুমে চলে এসেছে। রাত প্রায় গভীর সবে গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো সে। দক্ষ হাতে তোয়ালে দিয়ে ভেজা এলোমেলো চুলে থাকা অবশিষ্ট পানি মুছতে মুছতে নিজের রুমে প্রবেশ করে। তীক্ষ্ণ চাহনিতে পুরো রুম পরখ করে এগিয়ে গেল ডিভানের দিকে। তোয়ালে দ্বারা ভেজা চুল মোছা থামিয়ে দিয়ে ডিভানে গা এলিয়ে বসল সে। হাতে থাকা তোয়ালে অবহেলায় ছুড়ে ফেলল ডিভানের কোণায়। সামনে ছোট টেবিলের ওপরে থাকা ফোন হাতে নেয়। ফোন লক খুলে ইনানের নাম্বারে টেক্সট করে।

আগামী বুধবার দলীয় জরুরী মিটিং রয়েছে। সেখানে প্রাক্তন এমপি মহোদয়সহ আরও অনেক নেতা-কর্মীরা আসবেন এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন । কে. ফাউন্ডেশনের ট্রাজেডিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত প্রকাশ করবেন।সারহান ইনানকে টেক্সট দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি দেখছিল ।যেগুলো নয়ন তালুকদার এবং বিরোধী দলীয় কিছু নেতাদের বিরুদ্ধে প্রমান স্বরুপ।প্রমাণাদি একে একে পরখ করছিল। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি ছবিতে। ছবিটি এক তরুণীর মৃত, নিথর দেহের। গলায় সাদা মোটা দড়ি শক্ত করে প্যাঁচানো। গলদেশের চামড়া বিবর্ণ, কালচে বর্ণ ধারণ করেছে শ্বাসরুদ্ধ মৃ*ত্যুর চিহ্নে।চোখদুটি উল্টে গেছে আতঙ্ক আর অসহায়তার নি*র্মমতায়।জিভ খানিকটা বেড়িয়ে রয়েছে যেন শেষ মুহূর্তের আর্তচিৎকার স্থবির হয়ে ঝুলে আছে ঠোঁটের কিনারে।শরীরটি এলিয়ে পড়েছে সাদা টাইলসের মেঝেতে প্রাণহীন, নীরব । গোটা অবয়বে ফুটে আছে অবর্ণনীয় য*ন্ত্রণার ছাপ।প্রতিটি রেখায় প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন মূর্ত হয়ে আছে নিষ্ঠুরতার নীরব ইতিহাস। সারহান সেথায় দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। ছবিটা স্ক্রোল করে উপরের দিকে ঠেলে দিল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো। বন্ধ দরজার বাহির হতে ভেসে এলো করাঘাতের শব্দ। তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। ফোন স্কিনে নজর রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;

“ কাম ইন। ”
অরিত্রিকা অনুমতি পেয়ে দরজা খুলে গুটি গুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করল সাহসী ভঙ্গিমায়। হাতে গরম কফির কাপ আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল ডিভানের দিকে। সরাসরি হেটে গিয়ে সারহানে সম্মুখে দাড়িয়ে গেল। হাতে ধরে রাখা কফি মগটা বাড়িয়ে দিবে এমন সময় সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেই অরিত্রিকার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে স্তব্ধ হয়ে মুর্তির ন্যায় চুপচাপ দাড়িয়ে গেল। নির্বাক হয়ে পলকহীন চোখে থম মে*রে রইল কিয়ৎ সময়। বেহায়া নজর আটকে গেল সারহানের অদ্ভুত অবতারে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পানি বিন্দু জমেছে। কৃষ্ণ বর্ণের সিল্কি চুল গুলো অযত্নে – অবহেলায় কপালজুড়ে লেপ্টে আছে।কুচাকানো ভ্রুযুগল গম্ভীর মুখশ্রীতে শ্যাম পুরুষকে অসম্ভব সুদর্শন এবং স্নিগ্ধ লাগছে।
হঠাৎ উন্মুক্ত শরীরের দৃশ্য দেখে অরিত্রিকার ভিতরটা কেঁপে উঠল।অজান্তেই ঢোক গিলে নিল সে।শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরশিরে স্রোত বয়ে যেতে লাগল।গলা শুকিয়ে এঁটে আসে হাত-পা কাঁপতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সমস্ত চেতনা। নিজেকে দিহেশারা মনে হলো। সে এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাল। ধীরে ধীরে ঘোর কাটতে শুরু করেছে।

অরিত্রিকা কয়েকবার পলক ফেলল। দ্রুত চোখের ঝাপসা কাটিয়ে আবার তাকাল সামনে।সারহানের এমন অবতার সামনে পেয়ে হঠাৎই গাল লাল হয়ে উঠল লজ্জায়।গরম হয়ে আসা মুখ লুকোবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল সে।জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগল
তবুও খেয়াল করল তার বক্ষ আজও অবিরাম কাঁপছে।হৃদপিণ্ডের ধুকপুক ধ্বনি যেন শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।কাঁপা কাঁপা গলায় নিঃশব্দে নিজেকে সংহত করার ব্যর্থ প্রয়াসে মগ্ন হলো অরিত্রিকা। সে দ্রুত দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে কম্পনরত কন্ঠে সারহানের উদ্দেশ্যে বলল ;
“সারহান ভাই আপনার কফি।”

কম্পনরত মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সারহান ফোন স্ক্রল করা বন্ধ করে দেয় তৎক্ষনাৎ। ভ্রুযুগল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকায়। নজেরে পড়ে অনাকাঙ্খিত এক মানবীর। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে অরিত্রিকা। মুখশ্রীতে অস্বস্তি, লজ্জা স্পষ্ট। তার রুমে আকস্মিক আগমনে বিস্মিত হয়। কপাল জুড়ে ভাজ পড়ে।অরিত্রিকা এখানে কি করছে?আর মাথা নিচু করে আছে কেনো? সারহান সন্দেহবাতিক কন্ঠে শুধাল ;
“ তুই আমার রুমে কি করছিস?”
অরিত্রিকা খানিকটা কেঁপে উঠল। মিনমিনে গলায় জবাব দিলো ;
“ আপনার জন্য কফি এনেছি। ”
“ তোকে কফি আনতে বলেছি?”
“ নাহ। ”
“ তাহলে কেন এনেছিস? ”
সারহান দৃঢ় কন্ঠে শুধাল। অরিত্রিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“ বাহিরে থেকে ফিরে আপনার কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। আজ বড় মা বাড়িতে নেই তাই ভাবলাম আমি কফি বানিয়ে আপনাকে দিয়ে আসি। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫১

সারহান খানিকটা অবাক হলো। পুরূ কন্ঠে বলল ;
“ এখনি আমার বিবিজানের মতো নজর রাখা শুরু করেছিস? আ’ম ইমপ্রেস ফাইরুজ। ”
অরিত্রিকা লজ্জা পেলে। নিজের অজান্তেই ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। সারহান তা খেয়াল করে বাঁকা হাসল। অতঃপর ডিভান থেকে উঠে গিয়ে কাবার্ড থেকে শুভ্র রঙা শার্ট বের করে ফটাফট পড়ে নিলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সরাসরি দাঁড়াল অরিত্রিকার সামনে। হাত বাড়িয়ে কফির মগটি অরিত্রিকার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে নিলো হঠাৎ। আকস্মিক এহেম কান্ডে অরিত্রিকা চকিত নয়নে তাকালো সারহানের মুখপানে। তখনকার দৃশ্য মনে পড়তেই লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল সে।সারহান বাঁকা হাসল। হিম শীতল কন্ঠে বলল;
“মুখ নিচু করে থাকতে হবে না এবার তাকাতে পারিস।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৩