প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬০
আদ্রিতা নিশি
গোধূলী লগ্ন বহু আগেই পার হয়েছে। অম্বরে অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছে।দিনের আলোর ক্ষীণতা মিলিয়ে গিয়ে রাত তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে মত্ত হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুর দিকে নজর দেবার অবকাশ নেই চৌধুরী পরিবারের কয়েকজন সদস্যের।চৌধুরী বাড়ির দুই কর্তা আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেব ছাদে বসে বিয়ের খাবার ও ডেকোরেশনের সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ওয়েডিং প্ল্যানারের টিমকে বসিয়ে ঘরোয়া ও অভিজাতপূর্ণ আয়োজনের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন তারা। যেহেতু অল্প মানুষকেই দাওয়াত করা হয়েছে সেহেতু বাহুল্য পরিহার করে ব্যক্তিগত, স্নিগ্ধ পরিবেশেই অনুষ্ঠান আয়োজন করাই স্থির হয়েছে।
অন্যদিকে কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির মহিলারা শপিং সেরে ফিরেছেন। অরিত্রিকা, ইশরা, অরিন সহ সবার কেনাকাটা শেষ। সাথে আবির, সাদাত আর ইরফানের পাঞ্জাবি, কুর্তা-পাজামাও সংগ্রহ করা হয়েছে। যদিও ইরফান নিজে শপিংমলে যায়নি। তার জন্য ইশরা ও সাদাত মিলে সুন্দর পছন্দসই পাঞ্জাবি পছন্দ করে এনেছে।তবে ব্যতিক্রম একমাত্র সারহান। আজ তার শপিং করার কথা থাকলেও, প্রাক্তন এমপির সঙ্গে জরুরি এক রাজনৈতিক মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারেনি। সে জানিয়েছে, আগামীকাল সকালে তার আকদের আউটফিট কিনতে বের হবে। সারহানের এই অনুপস্থিতিতে বাড়ির সবাই একটু হতাশ হলেও কেউ কিছু বলেনি।কারণ তারা জানে সারহান দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। সে যা করে তা ভেবেচিন্তেই করে।সন্ধ্যা মিলিয়ে এখন রাত। প্রস্তুতির ব্যস্ততায় চৌধুরী বাড়িতে মধুর উত্তেজনায় পরিপূর্ণ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরিত্রিকা নিজের রুমে বসে উচ্ছসিত ভাব নিয়ে আকদের জন্য কেনা শাড়িটি দেখছে। টকটকে লাল গোলাপের রঙের ন্যায় শাড়ি। শাড়িতে ছোট ছোট সোনালী সুতোর কারুখন্ডিত কাজ। বেনারসী শাড়িটি এক কথায় অসাধারণ। এই শাড়িটি পছন্দ করেছে তানিয়া বেগম নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন। শাড়ি বাদেও স্বর্ণের গহনা কিনে দিয়েছেন। অরিত্রিকা সেসব বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দেখছে। সেই কাহিনী এক গালে হাত দিয়ে বসে দেখছে ইশরা। প্রায় এক ঘন্টা যাবত এক ধ্যানে কেউ শাড়ি, জুয়েলারি দেখে? সে একটু বিরক্ত হয়। নিরবতা ভেঙে অধৈর্য হয়ে বলে উঠে;
“আর কতোক্ষণ শাড়ি, জুয়েলারির দিকে রাক্ষসীর মতো তাকিয়ে থাকবি? সারহান ভাই যদি এসে তোর এমন উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে তাহলে বিয়ে করা বাদ দিয়ে পালাবে।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় ছোট করে কটমট করে তাকায় ইশরার দিকে। মুখ বাঁকিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বলে;
“তোর তাকানো উজবুকের মতো। তাই তো কোনো ছেলে তোকে পছন্দ করে না।”
“কে বলেছে আমায় কেউ পছন্দ করে না?জানিস, কতো ছেলে আমার পেছনে ঘোরে?”
“খেয়েদেয়ে ছেলেগুলোর কাজ নেই তোর মতো উজবুক মার্কা মেয়ের পেছনে ঘুরবে।”
“তুই আমাকে ইনসাল্ট করছিস?”
“আরেহ সোনা! তোকে আমি ইনসাল্ট করতে পারি?তুই তো আমার উজবুক দোস্ত।”
অরিত্রিকা ইশরার গাল টেনে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল। ইশরার মুখখানা প্রশংসা শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তা যেন ধপ করে কালো হয়ে গেল। চক্ষুদ্বয় গরম করে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। কন্ঠে গুমোট নিয়ে বলল;
“আকদের আগেই আমায় পর করে দিচ্ছিস? একটা প্রেম করতে পারিনি তাই ইনসাল্ট করছিস?”
অরিত্রিকার মুখখানা অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেল। ইশরার নাক টেনে দিয়ে ম্লান হেসে বলল;
“তুই আমার জানের জিগার দোস্ত। তুই আকদের আগে কিংবা পরে কখনো পর হবি না। সারাজীবন আমার প্রাণপ্রিয় বোন হয়ে থাকবি আর প্রেম করতে পারিসনি কে বলেছে? প্রেম করিসনি তাই প্রেমিক হয়নি।”
ইশরার মনটা কেমন যেন করে উঠল। সে আবেগাপ্লুত হয়ে অরিত্রিকাকে জড়িয়ে ধরল। ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠে বলল;
“তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অরিত্রি।”
অরিত্রিকাও আবেগে ভেসে নাকের পানি চোখের পানি এক করে বলল;
“ কাঁদিস না ইশু। বিয়ে হলেও আমরা একই বাড়িতে থাকব। আগের মতো মজা করবো, নাচবো, গাইবো, ঘুরবো।”
“সেজন্য কাঁদছি না আমি।”
“তাহলে কেনো কাঁদছিস? কি হয়েছে বল।”
“আমি যার বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি হয়েছি সেই মানুষটা কই রে? খুঁজে এনে দে বইন। তোর বিয়ে করা দেখে আমারও বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে।আমি বিয়ে করব।”
“বেয়াদব মাইয়া! আমি ভাবছি তুই আমার বিয়ে হওয়ার শোকে কাঁদছিস। ছাড় আমায় অসভ্য মেয়ে।”
ইশরা অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। বুঝতে দিলো না মন খারাপের কারণটা। চোখ মুছে হাসার ভাণ করে বলল;
“তোর অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে কাঁদতাম। কারণ তুই এ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে সারাজীবনের মতো চলে যেতিস। এক হিসেবে সারহান ভাইকে বিয়ে করে তোর ভালোই হবে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারবি। কিন্তু আমার বিয়ে হলে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আহ! কতো কষ্ট।”
অরিত্রিকা অদ্ভুত চাহনিতে তাকাল। অতঃপর সিরিয়াস ভাবে বলল;
“আমার মতো কোনো কাজিন ব্রোকে বিয়ে করে ভাইয়া থেকে ছাইয়া বানিয়ে ফেল তাহলে কষ্ট পেতে হবে না।”
“আমার ফুপাতো ভাইদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বাচ্চাও আছে।”
“তাহলে আর কি মামাতো বা চাচাতো ভাইকে বিয়ে কর। আইডিয়া,তুই সাদাতকে বিয়ে করে নে। তাহলে আমি আর তুই একই বাড়িতে থাকতে পারব। তোর কষ্টও পেতে হবে না।”
“আমি ম*রে যাব তাও সাদুর বাচ্চাকে বিয়ে করব না।”
“ভেবে দেখতে পারিস। সাদাত আর তোর টম এন্ড জেরির জুটি কিন্তু দারুণ মানাবে।”
অরিত্রিকা চোখ টিপ মে*রে শাড়ি ও গহনা গুছাতে গুছাতে বলল। ইশরা এহেন কথায় একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কথাগুলো যেন হঠাৎ করে মনে করিয়ে দিল সেই বৃষ্টিস্নাত রাতের কথা। সেই সেই রাতে যখন প্রবল বজ্রপাতের শব্দে চমকে উঠে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাদাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সে। আজও ভেবে লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে তার। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, হওয়াও উচিত ছিল না।সেই ঘটনার পর থেকে সাদাতের সামনে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে সে। কথা-বার্তায়, চোখের দৃষ্টিতে, হাসির ভঙ্গিতে সব জায়গাতেই যেন এক ধরনের সূক্ষ্ম অভিনয় জড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে নিজেকে যতটাই সংযত আর স্বাভাবিক দেখাক, মনের গভীরে অদ্ভুত অনুভূতি বারবার উঁকি দিয়ে যায়।এই অনুভবটা ঠিক কী বোঝা বড্ড দায়। ভয়? লজ্জা? দুর্বলতা? না কি অন্যকিছু?ইশরা নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শব্দের ভাণ্ডারে এর কোনো নির্দিষ্ট নাম মেলে না। কেবল একটা অচেনা টান, একরাশ ভাবনা আর এক ধরনের নীরব বেদনার মতো কিছু ভেতরে জমে থাকে। সে জানে না এ অনুভবকে কী নামে ডাকা যায় কিন্তু এটুকু জানে এই অনুভবটাই তাকে আর আগের মতো করে রাখে না।
“আমরা যাকে অপছন্দ করি তাদের প্রেমে বেশীরভাগ সময় পড়ি। কারণ অপছন্দের মানুষটাকে নিয়ে অকারণে অধিক সময় ভাবি।”
অরিত্রিকা হঠাৎ বলে উঠল। ইশরা হতবাক হয়ে গেল। আসলেই কী এমনটা সম্ভব? সে গভীর ভাবে ভাবতে থাকে।
“আবির ভাইয়া ইশুকে কিভাবে ইউনিক উপায়ে প্রপোজ করা যায় আইডিয়া দাও।”
আবির ও সাদাত বসে আছে পার্কিং প্লেসের বাহিরে রাখা একটা বেঞ্চে। লিভিং রুমে বসেছিল দুজনে অথচ কয়েকজন লোক সেখানে ডেকোরেশন করতে থাকায় তারা বাহিরে বসে মুক্ত অম্বরের নিচে বসে শীতল হাওয়া গায়ে মাখছে আর গল্প করছে। আবির মাত্রই দুইদিন আগে কিভাবে বিরোধী পক্ষের হামলার শিকার হয়েছিল তা গল্প করে অরিনের কথা ভাবছিল। এমন সময় অপ্রত্যাশিত কথা শুনে খুক খুক করে কেশে উঠল। বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল সাদাতের দিকে। সাদাত এহেন চাহনিতে ভড়কে গেল। থতমত খেয়ে বলল;
“ভাইয়া এমন করে তাকিয়ে আছো কেন? তোমার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে লুঙ্গি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছি।”
আবির নড়ে চড়ে উঠল। মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করে স্বাভাবিক করল। ভরাট কন্ঠে বলল;
“বয়স কতো তোমার?”
সাদাত এক গাল হেসে বলল;
“একুশ বছর একদিন।”
আবির সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল;
“এইটুকু বয়সে পড়াশোনা না করে কিভাবে প্রপোজ করতে হয় সেসব মাথায় ঘুরছে।”
“পড়াশোনার পাশাপাশি ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে রাখাও জরুরী।”
“বাহ, বাহ! বড় ভাইয়ের থেকে একদম এগিয়ে আছো দেখছি।”
“ভাইয়ের থেকে কোথায় এগিয়ে থাকলাম ভাইয়া? ভাই তো ঠিকঠাক মতো প্রেম না করে সরাসরি বিয়ে করছে আর আমি? আমি তো ইশুকে মনের কথা বলতেও ভয় পাচ্ছি।”
“কবে প্রপোজ করবে?”
আবির সরাসরি জানতে চাইল। সাদাত সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে রাখ ঢাক না করে বলল;
“আগামীকাল। ভাইয়ের আকদের পরে।”
আবির আচমকা শব্দ করে হেসে বলল;
“একই দিনে দুই ভাই ছক্কা মা*রার চেষ্টা করছো?”
সাদাত তাল মিলিয়ে হাসল;
“ভাগ্য যদি সহায় থাকে তাহলে ভাইয়ের আকদের পর আমার আকদ হতেও পারে।”
“এক লাফে তালগাছে না ওঠা ভালো শালাবাবু! আগে ইশরাকে তোমার মনের কথা জানাও তারপর যা হবে দেখা যাবে।”
“তা ঠিক বলেছো। তাহলে আমায় প্রপোজ করার আইডিয়া দাও।”
“জানো, সারহান কিন্তু অরিত্রিকাকে মনের কথা বলার জন্য আয়োজন করে প্রপোজ করেনি। সে তার মনের অব্যক্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে অরিত্রিকার সামনে ব্যক্ত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কতোটা ভালোবাসে সে মেয়েটাকে। আমার মনে হয়, সারহানের অবলম্বন করা প্রন্থা তোমার অবলম্বন করা উচিত।”
“তারমানে প্রপোজ করার আইডিয়া ক্যান্সেল?”
সাদাত কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল। আবির মৃদু হেসে বলল;
“হ্যা ক্যান্সেল। আপাততঃ তুমি ইশরাকে না বলে বোঝানোর চেষ্টা করো তুমি ওকে ভালোবাসো।”
সাদাত মাথা চুলকে হতাশ হয়ে বলল;
“না বলে কিভাবে বোঝাবো?”
“না বলেও ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় সাদাত। তুমি চেষ্টা করো পারবে।”
“না বলে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে! আমি পারবো না।”
“সারহানের থেকে আইডিয়া নিতে পারো।”
“বিয়ের আগে ভাইয়ের হাতে ম*রতে চাই না আমি।”
সাদাত মুখ ভার করে বলল। আবির উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সাদাতের বয়স সবে একুশ। এই বয়সে যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা, ক্যারিয়ার কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে।সেখানে সাদাত একেবারে ভিন্নরকম। বইখাতা সরিয়ে রেখে উদ্ভট সব চিন্তাভাবনায় মগ্ন সে। কখনো গভীর দর্শন, কখনো অদ্ভুত স্বপ্ন আর কখনো নিছক অলস কল্পনা।আবির সাদাতের মতো বয়সে এতটা ভাবুক ছিল না। তখন সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সিনেমা কিংবা রেস্টুরেন্টের বেঞ্চে বসে হাসি-ঠাট্টায় দিন কাটাতো।অরিন এদিকে অনেকক্ষণ ধরে আবিরকে খুঁজছে। বাড়ির প্রতিটা রুম, ছাদ এমনকি রান্নাঘর পর্যন্ত দেখে ফেলেছে। কোথাও নেই আবির। শেষে এক সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল আবির নিচে পার্কিং এর সামনে বেঞ্চে বসে সাদাতের সাথে গল্প করছে।খবরটা শুনেই নিচে নেমে এলো সে।
সদর দরজা পেরিয়ে সোজা পার্কিং এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল সাদাত আর আবির পাশাপাশি বসে গল্প করছে।অরিন একটু দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ঠিক আবিরের সামনে।হঠাৎ পায়ের শব্দে চমকে তাকাল আবির। সামনে অরিন দু’হাত কোমরে গুঁজে অভিমানী ও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বউয়ের এই ভঙ্গিমা দেখে আবির বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে বুঝে গেল কোনো কারণে অরিন রেগে আছে। হয়তো অনেকক্ষণ খুঁজেও না পেয়ে বিরক্ত হয়েছে। কিছু বলার আগেই তার চোখে চোখ পড়তেই আবির নিজের অবস্থাটা বুঝে গেল। কথার দরকার নেই, অরিনের অভিমানী চোখই সব বলে দিচ্ছে।। সে শুকনো ঢোক গিলল। আমতা আমতা করে বলল;
“তুমি এখানে কি করছো?”
অরিনের রাগ লাগল। মানুষটা এমন কেন? হাতের অবস্থা খারাপ। নিয়ম বেঁধে তিন বেলা ঔষধ খেতে হবে অথচ এখানে এসে সেসব কথা ভুলে বসেছে মহাশয়। সে কপাল কুঁচকালো। গমগমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“কয়টা বাজে এখন?”
আবির প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখল। সাড়ে আটটা বাজে। ভদ্র ছেলের মতো উত্তর দিলো;
“সাড়ে আটটা বাজে।”
অরিন গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“আটটার সময় আপনার ঔষধ খাওয়ার কথা ছিল অথচ আপনি এখানে এসে বসে আছেন। নিজের প্রতি অবহেলা করেন কেনো?”
“বউ আছে তাই অবহেলা করছি।অপেক্ষা করছিলাম কখন এসে তুমি আমায় ভালোবেসে ডাকবে ঔষধ খাওয়ার জন্য।”
“আপনি চরম লেভেলের অসভ্য। সাদাতের সামনে কিসব বলছেন?”
“খারাপ কি বলেছি?”
“আপনি আজেবাজে কথা না বলে চলুন।”
অরিন আবিরের হাত ধরে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল। আবির ও বউয়ের কথা মতো উঠে দাঁড়াল। সাদাতকে উদ্দেশ্য করে হতাশার সুর টেনে বলল;
“শালাবাবু! যতদিন বউ ছিল না ততদিন আমি ছিলাম মুক্ত পাখি। এখন ঘরে বউ এসেছে আমি হয়েছি বন্দী পাখি। বিয়ে মানেই জীবন বরবাদ।”
সাদাত হেসে ফেলল। অরিন আবিরের হাত ধরে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। সাদাত শুধু শুনতে পেল অরিন ও আবিরের মিষ্টি ঝগড়াঝাঁটি।
চৌধুরী বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রাহা। সন্ধ্যার একটু পরেই ইশরার ফোন পেয়েছিল অরিত্রিকাকে মেহেদি দিয়ে দিতে হবে তাই তাকে আসতে বলেছে। তবে তারও আগে অরিত্রিকা নিজেই ফোন করে জানিয়েছিল সে আর তিশাকে যেন একসাথে চলে আসে। কিন্তু তিশার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষমেশ একাই আসতে হলো তাকে।হাতে ছোট্ট একটা মিনি লাগেজ। ধীরে ধীরে পা ফেলে বাড়ির ভেতরের পথে এগোচ্ছে রাহা। তার মুখের গাম্ভীর্য, চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তির রেখা।সব মিলিয়ে বুঝতে বাকি নেই ভেতরে তীব্র রাগ জমে আছে।রাগের কারণটা অটোওয়ালা লোকটা। কী বেয়াদব আচরণ! একা মেয়ে দেখেই এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে। দৃষ্টির মধ্যে ছিল অশালীনতা আর শরীরী ভঙ্গিমা ছিল আরও কুৎসিত। রাহার খুব ইচ্ছে করছিল নিজের জুতাটা খুলে ছুড়ে মারতে লোকটার মুখে। কিন্তু রাস্তাঘাটে এই ধরনের অসভ্য লোকজনের কাছে প্রতিবাদ করাও অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। ভয় করছিল। সত্যি, এই শহরে রাতের রাস্তাগুলো মেয়েদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।তবুও ভয়কে পাশ কাটিয়ে সাহস জড়ো করে পৌঁছে গেছে সে এই পর্যন্ত।অটোতে বসে থাকতে থাকতে বারবার মনে পড়ছিল ইরফানের সেই পরিচিত সাবধানবাণী;
“রাহা রাত হলে একা বের হয়ো না। কোনো দরকারে হলে কাউকে সঙ্গে নিও।”কথাগুলো এখন বুকের মধ্যে একটা অনুচ্চারিত ব্য*থার মতো বাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহা। মাথার ভেতর এলোমেলো ভাবনারা ঘুরপাক খেতে থাকে। আনমনা হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সে। অসাবধনতাবশত চলাচলের রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের সাথে লেগে উষ্টা খায়। লাগেজটা ছেড়ে নিজেকে সামলে নিতে তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না। ঠাস করে পড়ে যায় নিচে। পড়ার সাথে সাথে মৃদু চিৎকার করে উঠে ব্যথায়। কোমড়ে লেগেছে তার। ব্যথার মাত্রা বাড়ছে ধীরে ধীরে। শেষমেষ বান্ধবীর বাড়িতে এসে কোমড় ভাঙল। এখন কি করবে সে ভেবেই মুখখানা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। দুই হাতে ভড় করে ওঠার প্রয়াস চালালো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। সে অসহায় মুখে সামনে তাকাল সাহায্যকারীর আশায়। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল সাদাতকে দৌড়ে আসতে। সে স্বস্তি পেল।
“আর ইউ ওকে রাহা?”
সাদাত রাহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। রাহা ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে বলল;
“উহু।কোমড়ের ব্যথা পেয়েছি। দাঁড়াতে পারছি না।”
সাদাত চিন্তিতভাব নিয়ে বলল;
“তারমানে অবস্থা গুরুতর।উঠতে হেল্প লাগবে?”
“জি। আমি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি আপনি আমার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করুন।”
“আমি পণ করেছি আমি যাকে ভালোবাসি তাকে ছাড়া অন্য মেয়েকে কখনো ছুঁবো না।”
সাদাত শিরদাঁড়া শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল। রাহার মেজাজ বিগড়ে গেল। একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে অথচ সাহায্য না করে পণ করার কথা বলা হচ্ছে? এই ছেলের বিষয়ে অরিত্রিকা অনেক গল্প করেছে। শুনেছে সাদাতের অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল। হঠাৎ এতো ভদ্র আচরণ তার অস্বাভাবিক লাগল। ভাবনার মাঝে কর্ণকুহরে প্রবেশ করল সাদাতের কন্ঠস্বর;
“আমি অরিত্রিকাকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
এতটুকু বলে সাদাত দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। রাহা ব্যথা ভুলে হতভম্ব হয়ে সেখানে পড়ে রইল। স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। মিনিট একেক পর দেখা পাওয়া গেল ইরফানের। মাত্রই বাইক নিয়ে গেট পেরিয়ে প্রবেশ করেছে ভেতরে। কিছুটা পথ বাইক নিয়ে আসতেই দেখল কেউ একজন পার্কিং প্লেস থেকে খানিকটা দূরে একদম চলাচলের রাস্তার মাঝখানে লাগেজ সমেত পড়ে আছে। পেছন থেকে মেয়েলী অবয়ব দেখে সে অনায়াসে চিনে ফেলল মেয়েটিকে। সে বাইক থামিয়ে দ্রুত বাইক পাশে সাইড করে রেখে তড়িঘড়ি করে দৌড়ে রাহার সামনে দাঁড়াল। আচমকা কারো উপস্থিতি পেয়ে দৃষ্টি উঁচিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল ইরফানকে। অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হওয়ায় অস্ফুটস্বরে বলে উঠল;
“আপনি?”
ইরফান তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“হ্যা আমি। মাঝরাস্তায় এভাবে পড়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি উঠো, আমি বাইক পার্কিং করব।”
রাহা পাংশুটে মুখ করে বিরস কন্ঠে বলল;
“উঠতে পারছি না আমি। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছি।”
ইরফান তপ্ত শ্বাস ফেলল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনার মাথার তার কি ছেঁড়া আছে? কাউকে ডাকলেই তো সে এসে আপনাকে হেল্প করতে পারে।”
“চেয়েছিলাম হেল্প। কিন্তু আমাকে হেল্প না করেই চলে গেছে।”
“কার থেকে হেল্প চেয়েছিলে?”
“সাদাত।”
রাহা মুখ ভার করে বলল। ইরফান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। সে সাদাতকে চেনে। নিশ্চয়ই রাহাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে চম্পট দিয়েছে। তবে একটা জিনিস এই প্রথমবারের মতো মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করল রাহার সাথে আকস্মিক ভাবে দেখা হয়ে যাওয়া। পূর্বে কখনো এমন আচানক দেখা হয়নি কারোর সাথে। তবে কেন এই মেয়ের সাথে দেখা হচ্ছে। ভাবনাটা দমীয়মান রাখল মনে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো রাহার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“দ্রুত উঠে দাঁড়াও।”
রাহা চমকালো। বিস্মিত আঁখিযুগল ঝাপটালো। কেন যেন অবিশ্বাস্য লাগল ইয়ারফোন ভাইয়া তাকে সাহায্য করছে। মনে মনে খুশি হলো কিন্তু প্রকাশ করল না। ফটাফট পুরুষালী হাতটা সে তার মসৃণ হাত দিয়ে ধরল। ইরফান সময় ব্যয় না করে রাহাকে টেনে তুলল। তখনি রাহা কোমড়ের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে আর্তনাদ করে উঠল। ইরফান ভড়কে গেল। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“কোথায় লেগেছে?”
রাহা ওষ্ঠকামড়ে কোনোমতে বলল;
“কোমড়ে।”
“আমার হাত ধরে হেঁটে ভেতরে যেতে পারবে?”
“হ হাঁটতে পারবো না আমি।”
ইরফান পড়ল চরম ফ্যাসাদে। কি করবে ভাবতে লাগল। নিরবতায় কেটে গেল কিয়ৎ সময়। ইরফান হঠাৎ রাহাকে কোলে তুলে নিলো। রাহা নিজের শরীরের তাল সামলাতে না পেরে চোখ মুখ খিঁচে দুহাতে আঁকড়ে ধরল মানবটির শার্ট। শার্ট ধরতেই দুটো বাটন ছিড়ে নিচে পড়ে গেল। রাহা ভয় পেয়ে গেল। সে ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকাল গৌড় বর্ণের মানবটির দিকে। তাকাতেই ইরফানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে খানিকটা কেঁপে উঠল। বিব্রতবোধ করল। অস্বস্তি, লজ্জায় মিইয়ে গেল। দৃষ্টি নত করে অনুতপ্ততার রেষ নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল;
“স্যরি।”
ইরফান পুরূ কন্ঠে বলল;
“ইটস্ ওকে।”
রাহার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ইরফানের সান্নিধ্যে আসায় সে কাঁপতে লাগল। কোনো পুরুষের এতোটা সন্নিকটে আসেনি সে। এই প্রথম কারো সন্নিকটে এলো। এতো কাছ থেকে কোনো পুরুষের হার্টবিট শুনলো। এই অভ্যন্তরীণ ধ্বনি যেন তাকে দিশেহারা করে তুলল অথচ ইরফান স্বাভাবিক। সে রাহার কাঁপন বুঝতে পারল। তবুও কোনো কিছু না বলে এগিয়ে গেল চৌধুরী বাড়ির দিকে।
ইশরা আর অরিত্রিকা সাদাতের মুখ থেকে রাহার পড়ে যাওয়ার কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখল ইরফান রাহাকে কোলে করে নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। এই দৃশ্য দেখে দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের পা দুটো থেমে গেল সহসা। তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম ডাইনিং রুম থেকে বেড়িয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করেছিলেন। বাড়ির ছেলের কোলে মেয়ের বান্ধবীকে দেখে এক প্রকার ভড়কে গেলেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দুই জা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। ইরফান সামনে তাকাতেই একেকজনের ভাবভঙ্গি তার নজরে আসলো। সেসব পরোয়া না করে এগিয়ে এসে রাহাকে সোফায় বসিয়ে দিলো। অতঃপর সবাইকে একপলক দেখে কোনো কথা না বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। উপস্থিত ডেকোরেশনের লোকজন কাজ রেখে সেই দৃশ্যের সাক্ষী হলো ও নিজেদের মাঝে বলাবলি করে মুচকি হাসতে লাগল।
রাহা লজ্জায়, অস্বস্তিভরা মুখখানা নিচু করে আছে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। ইচ্ছে করছে কোথাও মুখ লুকিয়ে বসে থাকতে। তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম এগিয়ে এলেন। নিবিড় চাহনিতে পরখ করতে লাগলেন। দুজনেই হয়তো বোঝার চেষ্টা করলেন আসল ঘটনা কি। অরিত্রিকা ও ইশরা এগিয়ে আসলো। দুজন ঘটনাটা স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। মনকে বুঝিয়েছে, রাহা হয়তো হাঁটতে পারছিল না তাই জাস্ট হেল্প করেছে। অরিত্রিকা বড়মা আর মায়ের মনে চলমান ভাবনা বুঝে রাহার পাশে বসল। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“রাহা কোমড়ে বেশী ব্যথা পেয়েছিস?”
রাহা লজ্জা আড়াল করে মুখ উঁচিয়ে আশে পাশে তাকাল। তানিয়া বেগম ও সাথী বেগমকে অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হচকচিয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল;
“আমি হাঁটতে পারছি না ব্যথায়। দশ মিনিট ধরে পড়েছিলাম তোদের বাড়ির সামনে। সাদাতকে বলেছিলাম হেল্প করতে কিন্তু সে হেল্প না করে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে তোদের ডাকতে আসলো। ডাকতে এসে হারিয়ে গেল। ভাগ্য ভালো ইরফান ভাইয়া আমায় হেল্প করেছে নয়তো ওখানেই পড়ে থাকতে হতো।”
সাথী বেগম বিচলিত হয়ে গেলেন এ কথা শুনে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন;
“আমি ডাক্তারকে কল করে আসতে বলছি।”
তানিয়া বেগম বললেন;
“আমি রসুন আর সরিষার তেল গরম করে নিয়ে আসছি।”
কথাটা বলে দুজনে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
অরিত্রিকা মন খারাপ করে বলল;
“আমার জন্য তোর এমন অবস্থা।”
রাহা হেসে বলল;
“তোর জন্য না। যা হওয়ার হয়ে গেছে এসব ভেবে লাভ নেই। এবার বল মেহেদীর ডিজাইন সিলেক্ট করেছিস?”
“করেছি।”
“গুড। আমাদের জিজু কোথায়?”
“জিজু বলা বাদ দে।”
“তাহলে কী বলবো দুলাভাই? ”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৯
রাহা দুষ্টুমি করে বলল। অরিত্রিকা লাজুক হাসল শুধু। ইশরা রাহার ওপর পাশে বসে মজার ছলে বলল;
“তোমাকে ভাইয়ের কোলে দেখে আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।নানাবিধ ভাবনা মাথায় ঘুরছিল। পরক্ষণে মনে পড়ল তোমার কোমড়ে লেগেছে। তাই হয়তো ভাইয়া হেল্প করেছে। তবে তোমাদের দুজনকে কিন্তু দেখতে অসাধারণ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, রোমিও জুলিয়েটকে কোলে করে এগিয়ে আসছে। আহা! কত্তো রোমান্টিক।”
অরিত্রিকা শব্দ করে হাসল। রাহা দুহাতে মুখ ঢাকল লজ্জায়। লাজুক হেসে বলল;
“এসব কথা বলো না প্লিজ! লজ্জা পাচ্ছি।”