প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬১

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬১
আদ্রিতা নিশি

রাহা এখন অনেকটাই স্বস্তিতে। ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে কোমরের যন্ত্রণাটা বেশ খানিকটা কমেছে। যদিও শরীর এখনো ক্লান্ত। তবু চারপাশের চাঞ্চল্যে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে।চৌধুরী বাড়ির লিভিংরুম একেবারে বিয়েবাড়ির আবহে ভরে উঠেছে। চারপাশে হাসি, গল্প আর আয়োজনের ব্যস্ততা। অরিত্রিকা হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি পড়ে বসেছে সোফায়। ইশরা একপ্রকার জোর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, এনগেজমেন্ট যেহেতু হয়েছে মেহেন্দি ও হলুদও ঘরোয়া ভাবে হবে। আচানক এমন কথায় সবাই দ্বিমত করেছিল। পরক্ষণে ইশরা, অরিন ও সাদাতের জোরাজুরিতে না পেরে রাজি হয়ে গেলেন সবাই।

অরিত্রিকা সোফায় বসে আছে। পাশে রাহা বসে বান্ধবীর হাতে মেহেদী দিচ্ছে। আরেকপাশে অরিন ও ইশরা বসে ফোনে মেহেদির ডিজাইন সিলেক্ট করছে। অপরপাশের সোফায় সাদাত আর আবির অনবরত সারহানকে অনবরত কল করে চলেছে অথচ কল রিসিভ করছে। তারা দুজনে ভীষণ চিন্তিত। সেসবের মাঝে লিভিং রুমে আগমন ঘটল ইনানের। দুহাতে চারটি শপিং ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে প্রবেশ করে। দ্রুত পায়ে এসে বাড়ির পাশে ব্যাগগুলো রেখে শব্দ করে বসে পড়ে। সাদাত ও আবির সারহানকে কল দিতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ শব্দ হওয়ায় দুজনে চমকে গেল৷ চকিত চাহনিতে তাকাল পাশে। তাকাতেই দেখতে পেল ক্লান্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকা ইনানকে।
“ইনান তুমি এখানে? সারহান কোথায়? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবির সময় ব্যয় না করে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল। ইনান আবিরের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো;
“আমি জানি না। ভাই আমাকে শপিং ব্যাগগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল এগুলো বাসায় পৌছে দিতে। তাই কাজ বাদ দিয়ে দিতে আসলাম।”
আবিরের কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো ;
“সারহান বেড়িয়েছে পার্টি অফিস থেকে?”
“সন্ধ্যার পরেই পার্টি অফিস থেকে বেড়িয়েছে।”
“তোমাকে জানায়নি কোথায় যাচ্ছে? ”
“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাইকে। তিনি জবাবে বললেন, কোনো জরুরী কাজে যাচ্ছেন।”
“ওহ।”

আবির ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করে সাদাতের থেকে ফোনটা নিয়ে কাউকে কল করল। কিন্তু অপরপাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ করল না। আবির আরও বেশী চিন্তাগ্রস্ত হয়ে গেল। সাদাতের ও একই অবস্থা। হঠাৎ করে তার ভাই কাউকে না বলে কোথাও উধাও হয়ে গেল? অরিত্রিকা নিশ্চুপ থেকে এতোক্ষণ সবার কথোপকথন শুনছিল। মন মেজাজ আনন্দ ও ভালো লাগায় সিক্ত ছিল। কিন্তু সারহানের কল রিসিভ না, কাউকে না বলে উধাও হয়ে যাওয়া যেন তাকে দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন করল। বক্ষস্থল ধক করে উঠল। খারাপ আর আজগুবি ভাবনায় বিভোর গেল। অজানা আতংকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো ললাটে। মেহেদী দেওয়া বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোনো মতে এগিয়ে এসে সরাসরি ইনানকে কম্পনরত কন্ঠে শুধালো,

“আমার সারহান ভাই কোথায়?”
ইনান ভড়কে গেল। লাফিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল;
“আমি জানিনা ভাই কোথায়?”
“আপনি মিথ্যা বলছেন ভাইয়া। আমি জানি আপনি সারহান ভাইয়ের খবর জানেন। বলুন উনি কোথায়?”
“আমি জানিনা।”
“আপনি জানেন না?”
“নাহ।”
আবির নজর লুকিয়ে কোনোমতে মিথ্যাটা বলল। অরিত্রিকা তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে তা অবলোকন করল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনি আমাদের সত্যটা বলছেন না। দয়া করে লুকোচুরি বন্ধ করুন সারহান ভাই কোথায়, সেটা স্পষ্ট করে বলুন। আপনি যদি না বলেন, আমি একা রাতের অন্ধকারে তাঁকে খুঁজতে বের হবো। আর যদি ওঁকে খুঁজতে গিয়ে আমার কিছু হয়, আমি কোনো বিপদে পড়ি। তাহলে তার সমস্ত দায়ভার আপনার। কারণ আপনি জানতেন তিনি কোথায়, তবু ইচ্ছে করে কিছুই বলেননি।”

ইনান হতচকিত দৃষ্টিতে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে টুপ করে গিলে খাবে। সে মুখ কাচুমাচু করে নিরব রয়। সারহান তাকে বারবার নিষেধ করেছে সে কোথায় গেছে তা কাউকে না জানাতে। হুমকি দিয়েছে যদি কাউকে জানায় তাহলে ক্র*সফায়ারে দিবে। আবির ও সাদাত উঠে গিয়ে মুখ গম্ভীর করে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ইনানের দিকে। রাহা সোফায় বসে অবুঝের মতো তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে অরিন ও ইশরা ফোনে মেহেদী ডিজাইন দেখা বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
“আপনি কিছুই বলবেন না, তাই তো? ঠিক আছে, থাকুন আপনি।আমি একাই সারহান ভাইকে খুঁজে বের করব। কী পেয়েছেন উনি? আমায় শান্ত স্বভাবের মেয়ে ভেবে যা খুশি তাই ব্যবহার করবেন? আগামীকাল আকদ অথচ আজ উনি এমন আচরণ করছেন যেন আমি তার অচেনা। আগে তাকে সামনে আসতে দিন। তারপর দেখিয়ে দেব আমি কে। যেভাবে আমায় কষ্ট দিচ্ছেন। তার শাস্তি দেব তাকে। আমি বিয়ে করব না এমন একজন অসভ্য মানুষকে। শুধু কষ্টই দিয়ে যান।”

কথাটি বলতে বলতে অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় হতে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। অভিমানে জর্জরিত হয়ে গেল অন্তঃস্থিত মন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বাকী সবার দিকে এক নজর বুলিয়ে জেদে এক হাতে অসমাপ্ত মেহেদী নিয়ে হাঁটা ধরল সদর দরজার দিকে। তখনি অরিন অন্য হাত চেপে ধরল। ধমকে বলল;
“অরিত্রি তুই পাগল হয়ে গেছিস?”
অরিত্রিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অরিনকে জড়িয়ে ধরে কন্দনরত কন্ঠে বলল;
“আমি সত্যি পাগল হয়ে গেছি। আপি সারহান ভাই কোথায়? উনাকে আসতে বল।”
অরিন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল;
“শান্ত হো। সারহান ভাই হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে।”
“উহু। আমার মন বলছে উনার কিছু হয়েছে।”
“একদম আজেবাজে কথা বলবি না।”
আবিরের মাথা গরম হয়ে গেল। ইনানকে উদ্দেশ্য করে রাগত স্বরে বলল;
“সারহান কোথায়?দ্রুত বলো।”
ইনান চমকে গেল। উপায়ন্তর না পেয়ে মাথা নিচু করে বলল;

“ভাই হসপিটালে আছে। তাজিয়ার ফ্রেন্ড নাসিয়ার ওপর হা*মলা হয়েছে। মেয়েটাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। তাই ভাই দেখতে গিয়েছে।”
আবির হতবিহ্বল হয়ে গেল। মৃদু চিৎকার করে বলল;
“হোয়াট?তাজিয়ার ফ্রেন্ড? নয়ন তালুকদার তো জেলে তাহলে কে হামলা করিয়েছে আর কেন হাম*লা করেছে?”
ইনান বলল;
“পুলিশ ধারণা করছে, নাসিয়া হয়তো তাজিয়া হ*ত্যাকান্ড সম্পর্কে কিছু জানতো তাই নয়ন তালুকদারের লোক হামলা করেছে। আপাতত কিছু জানা যায়নি। ”
একটু থেমে অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে সোফায় রাখা শপিং ব্যাগগুলো দেখিয়ে বলল;
“ভাবী ভাই আপনার জন্য ওগুলো পাঠিয়েছে। সেগুলো পছন্দ হয়েছে কিনা দেখুন।”
এতটুকু বলে ইনান ছুটলো বাহিরে। অরিত্রিকার কান্না বন্ধ হয়ে গেল। সে ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শপিং ব্যাগগুলোর দিকে। আবির বেজায় চটে গিয়ে বলল;
“এদের জ্বালায় জীবন বরবাদ।জীবনে একটা বন্ধু আর একটা টাকলা শত্রু আগমন ঘটেছে। দুজনের চক্করে পড়ে ঘুম আর শান্তি দুটোই উধাও।”

কথাটি বলে আবির অরিনকে ইশারায় ডেকে সেখান থেকে প্রস্থান করল। অরিন অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে আবিরের পিছু পিছু গেল। সাদাত মাথা থেকে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পুনরায় বসলো। আকদ না হওয়া অব্দি কতো কি যে দেখতে হবে। অরিত্রিকা মুখ ভার করে এগিয়ে আসলো। সূক্ষ্ম চাহনি স্থির করল সোফায় রাখা ব্যাগ গুলোতে। রাহা কৌতূহল মেটাতে বলল;
“ইশরা তুমি শপিং ব্যাগগুলো খুলে দেখো। অরিত্রিকার হাতে মেহেদী ও খুলতে পারবে না।”
ইশরা অরিত্রিকাকে বলল;
“খুলবো ব্যাগগুলো।”
অরিত্রিকা শক্ত কন্ঠে বলল;
“খোল।”

ইশরা চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে তৎপর হয়ে পড়ল শপিংব্যাগগুলো খুলতে। একের পর এক ব্যাগ খুলে ব্যাগের ভেতরে থাকা জিনিসগুলো বের করতেই উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে গেল। ইশরা সবার ভাবমূর্তি লক্ষ্য করে উচ্ছসিত ভাব নিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল;
“সারহান ভাই হবু বউয়ের জন্য আকদের শপিং করেছে। ভাইয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে।”
সাদাত অবাকতার রেষ কাটিয়ে ফটাফট জবাব দিলো;
“আমার ভাইয়ের চয়েজ অলওয়েজ বেস্ট।”
ইশরা একগাল হেসে তাল মিলিয়ে বলল;
“একদম ঠিক। সারহান ভাইয়ের পছন্দ বেস্ট তাই তো অরিত্রিকাকে পছন্দ করেছে।”
রাহা মৃদু হেসে বলল;
“অরিত্রিকার চয়েজ ও বেস্ট। তাই তো নেতাসাহেবের মতো হ্যান্ডসাম পুরুষকে ভালোবেসে বিয়ে করছে।”
ইশরা গলা খাঁকড়ি দিয়ে মজার ছলে বলল;

“কন্ট্রোল রাহা। হ্যান্ডসাম নেতা সাহেব বলো না। অরিত্রিকা কিন্তু জেলাস ফিল করবে।”
“জেলাস ফিল করুক। আমি তো বলবোই।”
“অরিত্রিকার জন্য খয়েরী বেনারসি, হালকা গোলাপী জামদানী কিনেছে আর ভাই নিজের জন্য অফ হোয়াইট সিম্পল ডিজাইনের পাঞ্জাবী কিনেছে। সবগুলোই দেখতে সুন্দর। কিন্তু বড় মামী অরিত্রিকার জন্য লাল বেনারসি কিনেছে সেটার কি হবে?”
“আহা! বুঝো না কেন? বউকে নিজে পছন্দ করা শাড়ি পড়াতে চাইছে।”
“বুঝতে পেরেছি।”
কথাটি বলে ইশরা অরিত্রিকার পানে চাইল। অরিত্রিকা তখনো বিস্মায়াবিষ্ট চাহনিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে শাড়ির দিকে। চোখে মুখে আশ্চর্যতার ছাপ। চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে কারুখজিত বেনারসি আর জামদানী শাড়িটির দিকে। সেগুলো দেখা বাদ দিয়ে পাশে রাখা পাঞ্জাবী দেখছে। গতকাল রাত থেকে যেন সারপ্রাইজ পাচ্ছে সে। ইশরা অরিত্রিকার হাত টেনে বসাল। তারপর ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল;
“পছন্দ হয়েছে?”
অরিত্রিকা জবাব দিলো না। সে এখনো ঘোরের ভেতর আছে। এর মাঝেই লিভিং রুমে উপস্থিত হলেন বাড়ির দুজন গিন্নি। সোফায় মেলানো শাড়ি পাঞ্জাবী দেখে অবাক হলেন। তানিয়া বেগম বিস্মিত কন্ঠে বললেন;
“একি শাড়ি – পাঞ্জাবী কে কিনলো? আমি তো অরিত্রিকার জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছি।”
সাদাত হা হুতাশ করে বলল,

“তোমার বড় ছেলে কিনেছে। মা, ভাই তোমার পছন্দ করা শাড়ি অরিত্রিকাকে পড়তে দেবে না। তুমি বরং শাড়িটা আমার বউয়ের জন্য রেখে দাও। আমি তোমার ভালো ছেলে। কথা দিচ্ছি ওই শাড়ি পরিয়ে আমার বউকে বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসব।”
“শয়তান ছেলে। ভাইয়ের বিয়ে দেখে তোর মাথাতেও বিয়ের ভূত চেপেছে।”
“আমি তোমার ভালো ছেলে। মা আমার কিন্তু বিয়ের বয়স হয়েছে।”
“বিয়ে করে বউকে কি খাওয়াবি?”
“আমি যা খাই তাই খাওয়াবো।”
সাদাত অতিব আশ্চর্য হয়ে বলল। তানিয়া বেগম কটমট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন;
“পড়াশোনা শেষ করে চাকরী কর। তারপর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববো।”
সাদাত মন খারাপ করে বলল;
“ততদিনে আমি বুড়ো হয়ে যাব। আমার মতো বুড়োকে কে বিয়ে করবে?”
“তোর মতো বুড়োকে বুড়ি বিয়ে করবে।”
“ধ্যাৎ ভালোলাগে না।”

তানিয়া বেগম আর সাদাতের কথোপকথন শুনে সবাই হেসে উঠল। তানিয়া বেগম বড় ছেলের প্রশংসা করে বললেন;
“বাহ!আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। সাথী শাড়ি দুটো কেমন লাগছে তোমার কাছে?”
সাথী বেগম হেসে বললেন;
“অনেক সুন্দর।”
আরও কিছু মন্তব্য করে তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম ছাদে উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেবকে রাতের খাবার খেতে ডাকতে গেলেন। অরিত্রিকা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসলো অন্য হাতে আলতো ছুঁয়ে দেখল শাড়ি গুলো। সহসা মস্তিষ্কে ধরা দিলো শপিংমলে তানিয়া বেগম সারহান ভাইয়ের কথা বলার সময়টা। তিনি কল দিয়েছিলেন। অতঃপর জানতে চেয়েছিলেন বেনারসি কেনা হয়েছে কিনা? কি রঙের কিনেছে। তানিয়া বেগম ছেলেকে জানিয়েছিলেন লাল টকটকে বেনারসি কিনেছে। সারহান তখন শান্ত,সাবলীলভাবে বলেছিল;
“অরিত্রিকাকে শুধু খয়েরী রঙা বেনারসিতে মানাবে।”
তানিয়া বেগম বলেছিলেন;
“তাহলে বেনারসি ফেরত দেবো?”
“দরকার নেই ফেরত দেওয়ার।”

এতটুকু বলে কল কেটেছিল। সে আরেকদফা থমকাল। সারহান ভাই কি তবে জানতো তার খয়েরী রঙ প্রিয়? হয়তো জানে।কিভাবে জেনেছে মানুষটা! পূর্বে কখনো এ বিষয়ে বলেছে কিনা জানা নেই। তবে স্পষ্ট মনে আছে ইশরা ও তার বান্ধবীরা ছাড়া পছন্দের জায়গা,রঙ,ফুল এসব সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। তার মনের ইচ্ছে ছিল খয়েরী রঙা বেনারসি পড়বে বিয়েতে। এটা ইশরা ছাড়া আর কেউ জানেনা। তবে কি ইশরা সারহান ভাইকে বলেছে? এ ভাবনায় বিভোর হলো। সে মাঝে মাঝে ভাবে, এমন নির্লিপ্ত, ভ্রুক্ষেপহীন থেকেও প্রিয় মানুষের ভালোলাগা খারাপ লাগার খেয়াল রাখে কি করে মানুষটা? এতোক্ষণের অন্তঃকোণে জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল। মনের মাঝে ভালোলাগার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় সিক্ত হয়ে আসলো। ভাবল,
“ নিশ্চুপ থেকেও ভালোবাসা যায়। যেমনটা সারহান ভাই তাকে ভালোবাসছে।”
অরিত্রিকা আনমনা হাসল। সেই হাসি সবার চক্ষুগোচর হলো না। বরং উপস্থিত সবাই দেখল। ইশরা মজা করে টেনে টেনে বলল;
“আজ সিঙ্গেল বলে কেউ ভালোবেসে শাড়ি পছন্দ করে দেয় না।”
অরিত্রিকা হাসি থামিয়ে চক্ষুদ্বয় ছোট করে তাকাল ইশরার দিকে। অতঃপর মুখ বাঁকিয়ে বলল;
“ঢং কম কর।”
ইশরা হেসে ফেলল। অরিত্রিকা সেখান থেকে উঠে গিয়ে রাহার পাশে বসল। রাহা পুনরায় অরিত্রিকার হাতে মেহেদী দেওয়া শুরু করল। হাতের তালুর মধ্যখানে ইংরেজী অক্ষর দিয়ে সারহানের নামটা লিখল। অরিত্রিকা সেদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর কল্পপুরুষ সারাজীবনের জন্য একান্তই তার হবে।

রাত গভীর। ঘড়িতে একটা বেজে বিশ মিনিট। অরিত্রিকার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর সারহানের কথা ভেবে চলেছে। মানুষটা কি বাড়িতে ফিরেছে? সে চিন্তিত বদনে বিছানায় উঠে বসে দুপাশে চোখ বুলায়। তার দুপাশে ইশরা আর রাহা ঘুমে মগ্ন। নিশ্চিন্তে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। সে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ধীরে শব্দহীন পায়ে এগিয়ে গেল রুমের দরজার দিকে। অতঃপর দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে গেল।
সারহান প্রায় ঘন্টাখানেক আগে বাড়িতে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ আগে রুমে এসে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছে। রুম জুড়ে কৃত্রিম আলোর ছটাক। নিরব, নিস্তব্ধ রুমে খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া ভেতরে প্রবেশ করছে। জানালার পর্দাগুলো থেমে থেমে নড়ছে। সেই শীতল, নির্মল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে সারহানের উন্মুক্ত সুঠাম দেহী পুরুষালী শরীর। তার চক্ষুদ্বয় বন্ধ। শরীর এলিয়ে দিয়েছে সোফায় নিরবচিত্তে বসে আছে সোফায়। ভাবমূর্তি যেন ভীষণ ছন্নছাড়া। কিঞ্চিৎ দ্বিধায় জড়িয়ে যাওয়া সত্তা। মন মানসিকতা নড়বড়ে ও এলেমেলো। হঠাৎ কেন এমন পরিবর্তন!

অরিত্রিকা সারহানের রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল দরজা হাট করে খোলা। সে অতিব আশ্চর্য হলো। সে এসেছিল সারহান এসেছে কিনা তা দেখতে। তার মনে কৌতূহল জাগল। মানুষটা কি তবে ঘুমাইনি? সাহস সঞ্চার করে বেশ কয়েকবার ডাকল অথচ ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেলো না। অনুমতি না নিয়ে সরাসরি রুমে ঢুকে গেল। রুমে ঢুকতেই দৃষ্টি স্থির হলো ডিভানে। সারহানের উন্মুক্ত শরীর দেখে লজ্জা, অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সহসা মাথা নিচু করল। ক্ষীণ কন্ঠে পুনরায় ডাকল ;
“সারহান ভাই।”
সারহানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল মেয়েলী কন্ঠস্বর। সে তৎক্ষনাৎ চক্ষুদ্বয় মেলে সোজা হয়ে বসল। অরিত্রিকাকে সামনে নতুন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো। বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলল;
“তুই? ”

অরিত্রিকা কুন্ঠা ঠেলে মিনমিন করে বলল;
“আপনি এসেছেন কি না দেখতে এসেছি। কতবার কল করলাম অথচ আপনি কল রিসিভ করেননি। জানেন, আমি টেনশন করছিলাম আপনার জন্য।”
সারহানের অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেল। সে নিখুঁত ভাবে পরখ করল অরিত্রিকাকে। মেয়েটা আজ দুহাতের কব্জি অব্দি মেহেদী দিয়েছে। মুখশ্রীতে লজ্জার আভা স্পষ্ট। সে ডিভান থেকে উঠে কাবার্ড থেকে শার্ট বের করে জড়িয়ে নিলো শরীরে। শার্টের বাটন আটকে সরাসরি সামনে এসে দাঁড়াল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“আপনি এতো রাত অব্দি জেগে আছেন কেন? দেখলাম দরজাও খুলে রেখেছেন।”
“তুই আসবি তাই দরজা খুলে রেখেছিলাম।”
অরিত্রিকা হতচকিত দৃষ্টিতে তাকায় সামনে দন্ডায়মান মানবটির দিকে। হতবাক হয়ে বলল;
“আপনি কি করে জানলেন আমি আসব?”
সারহান শান্ত, দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো ;
“আমার মন বলছিল তুই আসবি।”

“আপনার জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হয়। এভাবে কাউকে না বলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হবেন না।”
“হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ না হলে কিভাবে জানতাম আমার অনুপস্থিতি ও কাউকে পোড়ায়।”
“আপনি আসলেই একজন নিষ্ঠুর মানব।”
“নিষ্ঠুরসত্তার অধিকারী না হলে এ নশ্বর দুনিয়ায় টিকে থাকা দুষ্কর।”
সারহান পুরূ কন্ঠে জবাব দিলো অভিমানীনি মানবীকে। অরিত্রিকা ওষ্ঠ উল্টে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। সারহান সেই চাহনি দেখে কোমল কন্ঠে শুধালো ;
“শাড়ি পছন্দ হয়েছে?”
অরিত্রিকা উপেক্ষা করতে পারল না। অভিমান ভুলে মাথা দুলিয়ে মিহি কন্ঠে বলল;
“পছন্দ হয়েছে। আপনি কি করে জানলেন বিয়েতে খয়েরী রঙের বেনারসি পড়ার ইচ্ছে আমার।”
সারহান ওষ্ঠ কামড়ে হাসল। শান্ত কন্ঠে বলল;
“যাকে ভালোবাসি তার ভালোলাগা, খারাপ লাগা, পছন্দ, অপছন্দ সব কিছু জানা জরুরী। আমিও জেনে নিয়েছি। কারণ রাজনীতির সাথে সংসারটাও করতে হবে।”
অরিত্রিকা লজ্জা পেল। চক্ষুদ্বয় সন্তপর্ণে নামিয়ে নিলো। সারহান অরিত্রিকার মেহেদী দেওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল ;
“মেহেদী দিয়েছিস?হাত দেখি।”

অরিত্রিকা বিনাবাক্যে হাতদুটো মেলে ধরল সারহানের সামনে। সারহানের ওষ্ঠকোণের হাসি প্রসারিত হলো। সতৃষ্ণ চাহনিতে পরখ করে প্রশংসাসূচক বাক্য ছুড়ল;
“সুন্দর লাগছে। সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় লাগছে তোর হাতের তালুতে লেখা আমার নামটা।”
সারহান পিছিয়ে গিয়ে বসল বিছানায়। অরিত্রিকা সহসা হাত নামিয়ে লুকিয়ে ফেলল। লাজুক হেসে বলল;
“রাহা আপনার নাম লিখে দিয়েছে।”
“ভালো করেছে। আকদের আগেই মেহেদী দিয়ে আমার নামের স্ট্যাম্প মে*রে দিয়েছে তোর হাতে।”
“তাহলে আপনার হাতেও মেহেদী দিয়ে আমার নামের স্ট্যাম্প মে*রে দেওয়া হোক।”
“আমার হাতে মেহেদী দিয়ে আপনার নাম লেখার অধিকার শুধুমাত্র আপনাকে দিলাম আমার না হওয়া বিবিজান।”
“ঠিক আছে নেতা সাহেব। তাহলে আমার অধিকারটা এ মুহুর্তে বুঝে নিতে দিন।”
কথাটি বলে অরিত্রিকা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সারহান প্রানবন্ত হেসে সেদিকটায় তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পূর্বের মন খারাপ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। বক্ষস্থলপ যেন অবর্ণনীয় আনন্দের দোলা দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ঝড়ের বেগে ছুটে আসল কোথা থেকে। রয় সয় না করে সরাসরি বসল সারহানের পাশে। আমোদিত কন্ঠে বলল ;

“আপনার হাত দিন।”
সারহান দেখল প্রণয়িনীর প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত মুখখানা। সে বাম হাত বাড়িয়ে দিলো। অরিত্রিকা পুরুষালী হাতটা আলতো করে ধরল। অতঃপর নিয়ে আসা মেহেদী দিয়ে সারহানের হাতের তালুতে নিজের নামটা লিখতে লাগল। সারহান বুঝতে পারল মেয়েটি মেহেদী আনতে দৌড়ে গিয়েছিল। সে সুস্নিগ্ধ নয়নে তাকাল। মুগ্ধতা ভড় করল চোখে। একরাশ ভালোলাগায় সিক্ত হয়ে গেল। অরিত্রিকা তার নামটা ইংরেজী অক্ষরে যত্ন করে লিখল। অতঃপর বিজ্ঞদের মতো পরামর্শ দিলো;
“মেহেদী পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে তুলে ফেলবেন আর সকাল হওয়া আগ অব্দি পানি ছোঁয়াবেন না।”
কথাটা বলেই অরিত্রিকা সারহানের হাত ছেড়ে দিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শুধালো ;
“আপনার ফোন কোথায়?”
সারহান বলল;
“ডিভানের ওপরে।”
অরিত্রিকা কথামতো ফোনটা নিয়ে আসলো। তারপর পূর্বের স্থানে বসে সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“আপনার হাত আমার হাতের পাশে মেলে ধরুন আর ফটাফট পিক তুলুন। আমাদের মেহেন্দীর স্মৃতি হিসেবে রাখব পিকগুলো।”

সে ফোন সারহানকে দিয়ে দেয়। চঞ্চলা ভঙ্গিমায় হাত উঁচিয়ে ধরে তালু মেলল। সারহান নিঃশব্দে হাসল। সেও অরিত্রিকার হাতের পাশে হাত খানা মেলে ধরল। তারপর ফোন দিয়ে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলল। দুজনের হাতের ছবি তোলার পরে সারহান বলল;
“এদিকে তাকা। ”
অরিত্রিকা তাকাল। সারহান দুজনের সেলফি তুলল কয়েকটা। এর মাঝেই শোনা গেল ম্যাও ম্যাও ধ্বনি। সারহান পিক তোলা বাদ দিয়ে কপাল কুঁচকে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। দেখল লেভি এসেছে। সে খানিকটা বিরক্তবোধ করল। বিরবির করে বলল;
“এই বিড়ালের নিশ্চয়ই আমার সাথে শত্রুতা আছে। যখনই ফাইরুজকে আমার সাথে দেখে তখনি হাজির হয়। আমি নিশ্চিত, রোমান্সের টাইমেও ব্যাঘাত ঘটাবে।”
অরিত্রিকা উঠে লেভিকে কোলে নিলো। সারহানের পাশে বসে পুনরায় বলল লেভিকে নিয়ে সেলফি তোলার জন্য। সারহান অরিত্রিকা কষ্ট দিতে চাইল না। বিরক্তি চেপে কয়েকটা সেলফি তুলল। অরিত্রিকা উচ্ছসিত হয়ে বলল;
“দেখি কেমন হয়েছে।”

সারহান পিকগুলো বের করে দেখালো। অরিত্রিকা তা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল;
“আমাদের তিনজনকে কত্তো সুন্দর লাগছে। একদম হ্যাপি ফ্যামিলি।”
সারহান বিমূঢ় চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। শেষমেষ একটা বিড়াল তার ছোট ফ্যামিলির অংশ হয়ে গেল! অরিত্রিকা সারহানের মুখপানে চাইল। মুখের করুণ অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিলো। হাসি থামিয়ে বলল;
“কি হলো মুখ গোমড়া করে আছেন কেন? আমার নাম আপনার হাতে লিখে দিয়েছি তাই মন খারাপ করেছেন?”
সারহান অরিত্রিকার নাক টেনে দিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল;
“মোটেও না।”
“তাহলে?”
“কিছুনা।”

সারহান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল। অতঃপর মেহেদী দেওয়া হাত খানা মেলে তালুতে দৃষ্টি স্থির করল। সেখানে ইংরেজী অক্ষরে লেখা অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী। সে ডুবে গেল ঘোরে। আওড়ালো;
“ সৃষ্টিকর্তা তোকে আমার তকদিরে লিখে রেখেছিল তাই নিজের করে পেয়েছি। তবে এই পাওয়ার মাঝেও এক আকাশ পরিমাণ আক্ষেপ আমার রয়ে গেছে। তোকে আমি অতীতের কলুষিত অন্ধকারে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারিনি।”
সে তপ্ত শ্বাস ফেলল। অপরপাশের মানুষটাকে বুঝতে দিলো না মনের মাঝে চলমান ঝড়ের তান্ডব। অরিত্রিকা হঠাৎ অদ্ভুত কন্ঠে বলল;
“সারহান ভাই আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল।”
“কী কথা?”
“দুবছর আগে…”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬০

“দুবছর আগে কি ঘটেছে সেসব সম্পর্কে আমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। অতীত আমার কাছে ম্যাটার করে না। ম্যাটার করে বর্তমান। ”
“কিন্তু আপনার জানা প্রয়োজন সবকিছু।”
“বলছি তো আমি জানতে ইচ্ছুক নই। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬২