প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৬

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৬
আদ্রিতা নিশি

অরিত্রিকা চঞ্চলা চিত্তে গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করল কিচেনে। কিচেনে তখন অরিন এবং তানিয়া বেগম রান্না শেষ করে বেরোতে নিচ্ছিলেন। অরিত্রিকা অসময়ে এখানে দেখে বেশ অবাক হলেন। কৌতূহল তার জাগল মনে! অরিন ও বেশ অবাক হয়েছে।সে কিছু বলবে এমন সময় আবিরের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সে আর না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। অরিত্রিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছটফটে ভঙ্গিমায় আশে পাশে তাকাচ্ছে। সেই চাহনি দেখে আন্দাজ করলেন অরিত্রিকার এখানের আসার কারণ। তিনি কৌতূহল মেটাতে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন;

“কিচেনে কেন এসেছিস?”
অরিত্রিকার চঞ্চলা দৃষ্টি স্থির হলো। সে সরাসরি তাকাল তানিয়া বেগমের দিকে। মৃদু হেসে বলল;
“সারহান ভাইয়ের জন্য কফি বানাতে এসেছি।”
তানিয়া বেগমের শিথিল মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। সময় ব্যয় না করে সরাসরি নাকচ করে বললেন;
“আমি বানিয়ে দিচ্ছি কফি।”
“আমি কফি বানাবো বড়মা।”
“হাত পুড়িয়েছিলি মনে নেই?”
তানিয়া বেগম কন্ঠস্বর কঠোর করলেন। অরিত্রিকার মুখখানা ঝিমিয়ে গেল। তবুও হাল ছাড়ল না। অনুনয় করে মায়া মেশানো কন্ঠে বলল;
“ও বড় মা! তোমার ছেলে আমার হাতে বানানো কফি খেতে চেয়েছে। আমি কি করে উনার কথা ফেলতে পারি বলো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তানিয়া বেগম নরম হয়ে মোমের ন্যায় গলে গেলেন। এক পলক দেখে নিলেন মেয়েটার নিষ্পাপ, মায়াবী মুখখানা। তিনি অনুমান করতে পারলেন না নিষ্পাপ মুখের মেয়েটি তাকে বড়সড় মিথ্যা বলল। অরিত্রিকা ভোলাভালা মুখ করে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে অনুমতি পাবার! অনুমতি কি পাবে? এ চিন্তায় অন্তঃকোণ বিচলিত হলো। সেই অপেক্ষা যেন শেষ হলো। তানিয়া বেগম অনুমতি দিয়ে দিলেন;
“ঠিক আছে। সাবধানে কফি বানাবি।”
অরিত্রিকা লম্ফঝম্প করে উঠল। উচ্ছসিত ভাব নিয়ে একগাল হেসে বলল;
“আই লাভ ইউ বড় মা।”

তানিয়া বেগম হাসলেন। আদুরে হাত মেয়েটার মাথায় বুলিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলেন। অরিত্রিকা যেন রান্নঘর রুপী একখানা বড় সাম্রাজ্য পেল— এককালীন। উড়ো উড়ো হৃদয় নিয়ে হেলেদুলে নিজের মনমর্জিতে কফি বানানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলো। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে একটা পাত্র রাখলো চুলায়। তারপর তাতে দুই কাপের মতো পানি ঢেলে দিলো। পাত্রের পানি ফুটতেই কফি পাউডার দিয়ে দিলো। পাত্রে কফি ফুটছে। অরিত্রিকা সেই পাত্রে একধ্যানে তাকিয়ে অদ্ভুত গান গাইতে শুরু করল;

“এক কাপ কফি বানাই স্বামীর জন্য। পাত্রে পানি দিবো…. কফি পাউডার দিবো, ভালোবাসা দিবো সামান্য। এক কাপ কফি বানাই স্বামীর জন্য। তিতা কফি….কালা কফি, জঘন্য কফি বানাই উনার জন্য। ”
অরিত্রিকা গানটা শেষ করে খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রথম বার মনে হলো সে এই বাড়ির বউ। সারহান ইদায়াত চৌধুরীর একমাত্র অর্ধাঙ্গিনী ; বিবিজান — মিসেস চৌধুরী। ভাবুক মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে উঠল। নতুন এক আবেশে ঘোর লাগিয়ে দিলো। অজানা সুখ সাগরে পাড়ি জমালো
। কফি হয়ে এসেছে। সে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে চুলা বন্ধ করে কফিটি একটা কাপে ঢালল। তারপর সাবধানে কাপটি হাতে নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। লিভিং রুমে গিয়ে দেখল বাকীরা বসে আছে। কিন্তু সারহান ভাই নেই। সে সেখানে না দাঁড়িয়ে সরাসরি চলে গেল গম্ভীর মানবের রুমে।

অরিত্রিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি করছে। আধ খোলা দরজার ফাঁকা অংশ দিয়ে জিরাফের মতো গলা দিয়ে রুমের ভেতরটা পর্যবেক্ষণ করছে। রুমের ভেতরে কেউ নেই! আশ্চর্য হলো বটে!সারহান ভাই কোথায় গেল? তাকে কফির আনতে বলে না জানিয়ে কি বেরিয়ে গেছে? হয়তো পার্টি অফিসে গেছে। তার মন খারাপ হলো। মানুষটা একবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না? তার রাগে, দুঃখে কান্না পেল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পণ করল কোনোদিন পাষাণ মানুষটার জন্য কফি বানাবে না। সে বিমর্ষ মনে সেখান থেকে ফিরে যেতে লাগল।
“কোথায় যাচ্ছিস কফি না দিয়ে?”

গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে কর্ণে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা পা দুটো থেমে গেল। বিমর্ষ অভিমানী মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। তড়িৎ বেগে তাকাল রুমের ভেতরটায়। সারহান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে শরীরে পারফিউম দিচ্ছে। সেই দৃশ্য যেন তার হৃদয়ে ঝড় তুলল। রাগ, অভিমান ভুলে অনিমেষ চেয়ে রইল। শুভ্র রঙটা পূর্বের ন্যায় আকর্ষণীয় লাগল। শ্যামমানবের শরীরে যেন আরও দীপ্তি ছড়ালো। সারহান পুনরায় উচ্চস্বরে বলে উঠল ;
“কি হলো এখনো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”
অরিত্রিকার ধ্যান ভাঙল। নিজেকে স্বাভাবিক করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রুমের ভেতরে। দন্ডায়মান মানুষটার পাশে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। সারহান পারফিউমটা রেখে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে শুধালো ;
“কফি না দিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?”

অরিত্রিকা মাথা নত করল। ওষ্ঠ উল্টে নিরব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। সে কি উত্তর দেবে? অকারণে ভুল বুঝে রাগ, অভিমান করে চলে যাচ্ছিল এটা বলবে? শুনতে মোটেও শোভা পাবে না। সারহান নিগূঢ় চাহনিতে অবলোকন করল। মেয়েটার নিশ্চুপতা মোটেও ভালো লাগল না। এমন অকারণ নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার একটাই কারণ — তার ওপর অভিমান করা। সে চাহনি স্থির রেখে অরিত্রিকার হাত থেকে কফি নিয়ে কাপে চুমুক দিলো। মুহুর্তে মুখের ভেতরে থাকা কফি টুকু ছিটকে বাহিরে আসতে চাইল। পুরুষালি মুখখানা কুঁচকে পাংশুটে হয়ে গেল। হাতে থাকা কাপটা টি টেবিলে রেখে খুকখুক করে কেশে উঠল। অরিত্রিকা চমকে গেল। দৃষ্টি উঁচিয়ে তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল ;
“কি হয়েছে?”

সারহানের কাশি থেমে গেল। সে অসহায় চাহনিতে তাকাল মেয়েলী মুখশ্রীতে। মুখে তিতকুটে ভাব নিয়ে নিরবে ভাবল, এ কোন অপরাধের শাস্তি পেল সে। কফিটা মাত্রাতিরিক্ত তেঁতো। কফি পাউডার অনেক বেশী দেওয়া হয়েছে। তার মুখের অভ্যন্তরীণ অংশ বিদঘুটে স্বাদে হতাহত হয়ে রইল। পুরো শরীরটা বিদঘুটে অনুভূতিতে ঝাঁকিয়ে উঠল। সে চোখ মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। অরিত্রিকাকে কোনো কথা শোনায় না। শুধু শান্ত কন্ঠে শুধায় ;
“কফিটা তুই বানিয়েছিস?”

অরিত্রিকা ভড়কে গেলো। মুখখানা ভার করে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। সারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বিছানার ওপরে রাখা ঘড়িটা নিয়ে হাতে পড়তে পড়তে নির্বিকার কন্ঠে বলল;
“কফিতে কফি পাউডার বেশী পড়ে গেছে।”
“স্যরি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”
অরিত্রিকা আঁতকে উঠে করুণ স্বরে বলল। সারহান প্রতিক্রিয়াস্বরুপ স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“পরের বার মনোযোগ দিয়ে কফি বানাবি।”
অরিত্রিকা মাথা দুলালো। বিমর্ষ চাহনিতে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল;

“আবার কফি বানিয়ে নিয়ে আসবো?”
“লাগবে না।”
“আচ্ছা।এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
মেয়েলী কন্ঠস্বরে কি অধিকারবোধ ঢালা ছিলো! সারহানের মনটা কেমন যেন করে উঠল। প্রথমবার মনে হলো সে বিবাহিত! তার ঘরে নতুন কারো আগমন ঘটেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ধীরে ধীরে। সে নড়েচড়ে উঠল। দুর্বধ্য হেসে জবাব দিলো;
“থানায় যাবো।”
অরিত্রিকা থানায় যাওয়ার কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সেই বখাটে তিনজনের কথা। কি নৃশং*স ভাবে পি*টিয়েছিল সারহান ভাই। সেই কারণে কি থানায় ডাকা হয়েছে। সে ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিমায় চাইল। শঙ্কিত কন্ঠে বলল ;

“কেনো ডেকেছে? ওই বখাটে.. ”
অরিত্রিকার গলদেশ হতে কথা বের হচ্ছে। মেয়েলী শরীরটা ভয়ে, আতংকে কাঁপছে। সারহান সেই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। দ্রুত দুবাহু ধরে অরিত্রিকাকে আগলে নেয় বুকে। একহাতে বাহুতে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ততা জানান দেয়। অতি শান্তু কন্ঠে বলে;
“ওই বখাটেরা আপাততঃ জেলে আছে। আমি তাদের জন্য যাচ্ছি না। আমার যাওয়ার কারণ ভিন্ন।”

অরিত্রিকা দুহাতে আঁকড়ে ধরল সারহানের দেহখানা। চক্ষুপটে ভেসে উঠল এক ঝলক পুরনো স্মৃতি। একজন কালো পোশাক পরিহিত লোক, মুখে মাস্ক, হাতে রি*ভলবার। তার দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রোধ নিয়ে রক্তা*ভ চাহনিতে তার দিকে তাকে আছে। হাতে থাকা রি*ভলবার তার শরীরে তাক করে হিসহিসিয়ে বলছে ; “তোর সারহান ভাই আমার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছে। আমিও ওর জীবন বিষিয়ে তুলব। রাজনীতি দিয়ে ওর জীবনের ধ্বংস লিখবো। আপন মানুষের মৃ*ত্যুতে তর্পাবো। কাছের মানুষের মৃ*ত্যুর দায়ভার চাপিয়ে দিবো। তারপর রাজনীতি গলার ফাঁস হবে আর সেই ফাঁসে পৌঁছে যাবে কারাগারে। অতঃপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়তো মৃ*ত্যুদন্ডের প্রহর গুনাবে। কেউ ঘূনাক্ষরে টেরও পাবে না।”

“কেন যাচ্ছেন থানায়?”
অরিত্রিকা ফুঁপিয়ে উঠে কাতর স্বরে বলল। সারহান আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চুলের ভাজে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা মিশিয়ে বলল;
“কাউকে ইনসাফ দিতে।”
অরিত্রিকার মনটার বড্ড নাজুক অবস্থা। অশ্রু তখনো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার ন্যায়। অশ্রুসিক্ত নয়ন লাল টকটকে। মেয়েটা নাক টেনে টেনে নিঃশব্দে কাঁদছে। আলিঙ্গন পূর্বের চেয়ে আরও শক্ত করেছে। সারহানের কাঠিন্যতার খোলসে হৃদয়টা ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে উঠল সেই কান্নার দৃশ্যে। সে দিশেহারা হলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে সামলে নিলো নিজে। অধৈর্যতার মাত্রা বুঝতে না দিয়ে শুধালো ;

“ কাঁদছিস কেন?”
“আপনাকে নিয়ে বড্ড ভয় হয় আমার!”
“ক্লিয়ার করে বল।”
“বলবো। শুনুন, আপনি কিন্তু সাবধানে চলাফেরা করবেন। কাউকে সহজে বিশ্বাস করবেন না।”
“ যথাআজ্ঞা বিবিজান।”
সারহান জোরপূর্বক জানতে না চেয়ে সুগভীর কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা প্রশস্ত বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে চাইল। চোখ মুখ অন্ধকার করে মলিন কন্ঠে জানতে চাইল;
“ইশতিয়াক নামের কাউকে চেনেন?”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে ভাজ পড়ল। ইশতিয়াক নামটা তার পরিচিত। অরিনের সেই এক্স বয়ফ্রেন্ড। যার খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। মেয়েটা হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করল? সে চেনে এমন আভাস দিলো কি! গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল ;

“তুই কিভাবে চিনিস ইশতিয়াককে? ”
“আব্বুর যেদিন গু*লি লেগেছিল সেদিন দেখা হয়েছিল উনার সাথে। স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন উনি আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আর আজকেও সকালে আপুকে উনার সাথে ফোনে কথা বলতে শুনলাম। আপুর ভাবসাব মোটেও সুবিধার লাগছিল না। ভয় পাচ্ছিল, তুতলে কথা বলছিল।”
“তুই ইশতিয়াককে চিনতে পারবি?”
সারহান তৎক্ষনাৎ বলে উঠল। অরিত্রিকা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে মন খারাপ করে বলল;
“নাহ! আমি উনাকে পেছন থেকে দেখেছি। দারোয়ান চাচার সাথে কথা বলছিল।”
সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। অরিত্রিকা ভেজা গাল মুছে দিলো সযতনে। অতঃপর শক্ত কন্ঠে বলল;

“অরিনের বয়ফ্রেন্ড ইশতিয়াক! আমি ছেলেটাকে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। তবে এবার শীঘ্রই খুঁজে বের করতেই হবে। নয়তো নতুন কোনো অঘটন ঘটাবে। আবার অরিনকে ডিস্টার্ব করছে! ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি। ”
অরিত্রিকা ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে গমগমে কন্ঠে বলল;
“ওই শয়তানটার জন্য আপু কষ্ট পেয়েছে। যদি হাতের কাছে পাই চড়িয়ে আলু ভর্তা বানিয়ে দেবো। আপনি যদি ওই বদলে লোককে পান তাহলে মে*রে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিবেন।”
সে থেমে পুনরায় বলল;
“ইশতিয়াকের পিক আপুর কাছে থেকে নিন।”
সারহান বলল;

“আবিরকে সেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। ইশতিয়াক সম্পর্কে পূর্বে যেসব তথ্য পেয়েছি সব ভুয়া। নামটাও নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ভুয়া হওয়ার সম্ভবনা আছে।”
অরিত্রিকা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তবে কি কেউ ছদ্মবেশে তাদের জীবনে পদার্পণ করেছিল? সারহান অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে পাঞ্জাবি টেনেটুনে ঠিক করল। ফোনটা পকেটে পুড়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“সাবধানে থাকবি। বেশী উড়নচন্ডীর মতো নেচে নেচে ঘুরবি না। ভদ্র মেয়ের মতো পড়াশোনা করবি। ”
অরিত্রিকা রাগে ফুঁসে উঠল ;
“আমাকে দেখে উড়নচণ্ডী মনে হয়?”
“তাই তো মনে হয়।”
সারহান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। অরিত্রিকা ভেজা নেত্রপল্লব বড় করে হতভম্বের ন্যায় দরজার দিকে অনিমেষ পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে রইল।

“অরিন শার্টের বাটনগুলো লাগিয়ে দাও।”
অরিন বিছানায় বসে আছে মাথা নিচু করে। চোখে মুখে বিরাজ করছে ভয় এবং আতংক। সকাল থেকে ভীষণ চিন্তিত সে। ইশতিয়াক নামক দুশ্চিন্তা তার মাথায় পুনরায় ভর করেছে। সকাল নয়টায় রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই আননোন নম্বর থেকে কল এসেছিল। সে কৌতূহল বশত কল রিসিভ করেছিল। ব্যস, কল রিসিভ করা যেন জানের কাল হলো। ইশতিয়াকের থেকে হুমকি পেল — যদি সে আবিরকে ডিভোর্স না দেয় তাহলে ইশতিয়াক আবিরকে মে*রে তাকে বিয়ে করবে। শীতল পরিবেশে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। আবির খেয়াল করল অরিনের চোখ মুখ শুকনো এবং ভীতিগ্রস্ত। সে এগিয়ে আসলো। অরিনের পাশে বসল। অতঃপর শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“অরিন কি হয়েছে?”

অরিন কেঁপে উঠল। ভাবনার ছেদ ঘটল তৎক্ষনাৎ। পাশে বসা মানুষটার দিকে বিমর্ষ চাহনিতে তাকাল। সহজ সরল কন্ঠে রাখ ঢাক না করে বলল;
“ইশতিয়াক কল দিয়েছিল আবির। হুমকি দিয়েছে আমাকে।”
আবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চক্ষুদ্বয় রাগে র*ক্তবর্ণ ধারণ করল। কাঠিন্য কন্ঠে বলল;
“কি বলেছে ওই বাস্টার্ডটা? ”
অরিন মাথা নিচু করে মলিন কন্ঠে বলল;
“আপনাকে ডিভোর্স দিতে ওকে বিয়ে করতে বলেছে। যদি না করি তাহলে আপনাকে মে*রে আমাকে জোর করে বিয়ে করবে। জানিনা, হঠাৎ ইশতিয়াক কেন এমন করছে। সে আমাকে ঠকিয়েছিল। তবে কেন ফিরে এসে আপনার আর আমার জীবনটা বিষিয়ে দিচ্ছে? আমি পুরনো ক্ষ*তের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না আবির। আমার কারণে আপনার জীবনটা দূর্বিষহ হয়ে উঠছে।”

তার কন্ঠে কাতরতা অনুভূতিপ্রবণতার শব্দগুচ্ছ গলদেশ হতে বের হলো। অন্তঃকোণ অসহনীয় উত্তাপে জ্বলে পুড়ে ছারখার প্রায়। সুখের সংসার বুঝি তার তকদিরে নেই।কে ভুল মানুষকে ভালোবাসলো? এ ভুলের অন্ত কোথায়! তার জানা নেই। যদি জানতো কাউকে ভালোবাসা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে তাহলে কখনো ভালোবাসার মতো স্পর্ধা করতো না। আবির এক হাত অরিনের হাতে রাখল। সেই স্পর্শ যেন একমাত্র ভরসা হয়ে উঠল। অরিন অসহায় চাহনিতে তাকাল দন্ডায়মান মানুষটির দিকে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। অস্থির ভেজা কন্ঠে বলল;
“আমার বোধ হয় আপনার সাথে সংসারটা করা হলো না আবির! আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে প্রথমবার নিজেকে সুখী মনে করেছিলাম। সেই সুখ যে দুঃখ হিসেবে ধরা দিবে জানা ছিল না।”
আবির অরিনের হাতটি শক্ত করে ধরল। অতি বিচলিত কন্ঠে বলল;

“অরিন শান্ত হও! ইশতিয়াক তোমাকে ভয় দেখিয়েছি। ও আমাদের দুজনকে চাইলেও আলাদা করতে পারবে না।”
“আপনি ওকে চিনেন না। ওই শয়তানটা সবকিছু করতে পারে।”
“আমিও দেখি ওর কলিজা কত বড়! তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চায়! সামনে আসুক — জ্যান্ত পুতে দেবো শু*য়োরের বাচ্চাটাকে।”
“আবির! আমার মনে হচ্ছে ইশতিয়াক আমাকে ভালোবেসে নয় বরং কোনো কিছুর প্রতিশোধ নিতে এমনটা করছে।”
“আমারও তেমনটাই মনে হচ্ছে। ইশতিয়াক কি তবে তোমার ফ্যামিলির কারো থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছে?”
আবির সন্দেহবাতিক কন্ঠে আওড়াল। অরিন বিরস মুখে জবাব দিলো ;

“জানি না।”
আবির কিছুক্ষণ মৌন থেকে প্রশ্ন করল ;
“ইশতিয়াকের সাথে তোমার প্রথম দেখা কবে হয়েছিল?”
“আমি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন।”
“ইশতিয়াক ওর পরিচয় দেওয়ার সময় কি কি উল্লেখ করেছিল? আর কতোদিন পর পর দেখা করতো?”
“ইশতিয়াক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। সে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। আমাদের মাসে এক- দুইবার দেখা হতো। বেশীরভাগ সময় মেসেজে কথা হতো।”
“স্থানীয় বাসিন্দা, ভার্সিটিতে পড়তো তাহলে এতো দিন পর পর কেন দেখা করতো? ”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল। অরিন মলিন কন্ঠে বলল;
“বাবার ব্যবসা ও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।”
আবির তপ্ত শ্বাস ফেলে ভরাট কন্ঠে বলল;
“তোমায় বোকা বানিয়েছে অথচ তুমি বুঝতে পারোনি। ছেলেটা অনেক চালাক। নিজের পরিচয়টা অব্দি মিথ্যা। ইশতিয়াকের ছবি আছে?”
“উহু। রাগে ডিলিট করে দিয়েছি।”
“তোমরা মেয়েরা আসলেই মাথামোটা। কিছু হলেই রাগ দেখাও, কান্নাকাটি করো।”

দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে অরিত্রিকার মামা এবং মামী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু আফ্রিদি ও ইফাকে রেখে গেছেন। ওরা তিন – চারদিন থাকবে। ইফা ভার্সিটি থেকে ফিরল মাত্র। সদরদরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল পুরো লিভিং রুম শুনশান, নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। মনে হচ্ছে, কোনো ভুতুড়ে বাড়ি। বাড়ির সবাই কোথায় গেল? এসময় তো লিভিংরুম পরিবারের সদস্য্যদের দিয়ে পরিপূর্ণ থাকতো। সে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসলো ভেতরে। ঠাস করে বসলো সোফায়। কাঁধে থাকা ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো সোফায়। চক্ষুদ্বয় নিদ্রাচ্ছন্ন। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। এ অসময়ে ঘুম পায় না তার। কিন্তু গতকাল রাতে একটার পরে ঘুমিয়েছে। ঘুমের ঘাটতি পড়ছে।

আফ্রিদি গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এসে সামনে তাকাতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা পেল সোফায় বসে থাকা ইশরার দিকে। মুহুর্তে পা দুটো থমকে গেল। দৃষ্টিজোড়া স্থির হলো মেয়েলী ঘর্মাক্ত মুখশ্রীতে। বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন মুক্তোর দানার ন্যায় জ্বলজ্বল করছিল। সেই দৃশ্য দেখে পুরুষালি মন অশান্ত হলো। চোখে মুখে লেপ্টে গেল মুগ্ধতা! ভালোলাগায় সিক্ত হলো সত্তা।
সাদাত কানে ইয়ারপড গুঁজে গান শুনতে শুনতে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। হাতে তার কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান। সে এক ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। সোফার কাছে আসতেই দৃষ্টি পড়ল ক্লান্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকা ইশরার দিকে। ড্রেসআপ, ব্যাগ দেখে নিমেষে বুঝে নিলো মেয়েটা ভার্সিটি থেকে এসেছে। সে ইয়ারপড খুলে টাউজারের পকেটে রাখল। ফোনে চলমান গানটা বন্ধ করল। অতঃপর নিঃশব্দে গিয়ে বসল ইশরার পাশে। হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে অন্যত্র তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“এটা খা।”
গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর হঠাৎ কর্ণে প্রবেশ করতেই চমকে গেল ইশরা। চকিত নয়নে তাকাল পাশে বসা মানুষটার দিকে। হতবুদ্ধির ন্যায় স্বর তুলল ;
“হু?”

সাদাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সরাসরি তাকাল ইশরার চোখে। দুজনের চোখাচোখি হলো। মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখ জোড়ায় দৃষ্টি স্থির করতে পারল না। সে চোখ সন্তর্পণে নামাল। সাদাত কপাল কুঁচকে সেই দৃশ্য নিরবচিত্তে অবলোকন করল। অতঃপর ইশরার হাতটা ধরে ক্যানটা ধরিয়ে দিলো। পুরুষালী স্পর্শে কাঁপল মেয়েলী অবয়ব। অস্বস্তির আবরণে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। পূর্বে কখনও এমন আজব অনুভূতি হয়নি তার। তবে আজ কেন?
“কি হলো? কোল্ড ড্রিংকস হাতে নিয়ে বসে আছিস কেন?”

সাদাত বিরক্তি প্রকাশ করে বলল। ইশরা থতমত খেয়ে গেল। সময় ব্যয় না করে ঢোক ঢোক করে খেতে লাগল। সাদাতের গম্ভীরমুখানা শিথিল হয়ে আসে। চাহনি হয় শীতল, গভীর। অপলক চাহনিতে প্রিয়তমার ঘর্মাক্ত মুখশ্রী দেখতে লাগল। প্রেম পিপাসায় তৃষিত হৃদয় এক পশলা প্রেমময় বৃষ্টির নামল। বক্ষ নামক ভূমির দেহ ঠান্ডা হয়ে আসলো। নেশাত্নক চোখ দুটো মায়াবী ডাগর আঁখিযুগলের অতল গহ্বরে ডুব দিলো। প্রেমিকের অবাধ্য মন চাইল বেসামাল হতে। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল পাতলা অধরযুল। নিষিদ্ধ অনুভূতি উসকানি দিতে লাগল মনে। সাদাত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে অন্যত্র তাকাল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। দিন দিন মেয়েটাকে দেখলে ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক নয়!

“সাদাত তোর সাথে আমার কথা ছিলো। ”
ইশরা কোল্ড ড্রিংকস শেষ করে নিচু স্বরে বলল। সাদাত অন্যত্র তাকিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠে বলল;
“বল।”
ইশরা নড়েচড়ে উঠল। কাতর গলায় বলল;
“আমাকে ইগনোর করছিস কেন? তোর এমন ব্যবহার সহ্য হচ্ছে না। ”
সাদাত শক্ত গলায় বলল;
“আমি তোকে কখন ইগনোর করলাম?”
“গতকাল বিকেল থেকে। আমার কোনো কাজে কষ্ট পেয়েছিস?”
“নাহ।”
“তাহলে অচেনার মতো ব্যবহার করছিস কেন? আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলছিস না কেন?”
“আমার কথা বলার মুড নেই। ”

সাদাত চোখ মুখ শক্ত করে কাঠিন্যতা এঁটে বলল। ইশরা চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। ভেজা কন্ঠে বলল;
“তোর অবহেলা আমার সহ্য হচ্ছে না সাদাত। আগে কখনো দীর্ঘক্ষণ কথা না বলে থাকিস নি। কিন্তু এবার তুই আমার সাথে ভালোভাবে চব্বিশ ঘন্টা কথা বলিস নি।”
সাদাত তাকাল ইশরার দিকে। মেয়েটার চোখে অশ্রু দেখে বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল। তবুও তা বুঝতে না দিয়ে মনটাকে শক্ত খোলসে আবৃত করে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“তুই আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিস ইশরা।”
ইশরা হতভম্ব হয়ে গেল। অবুঝের ন্যায় বলল ;
“মানে? ”
সাদাত অদ্ভুত হাসল ;

“তোর জন্য আমি সাদাত আসতাফ চৌধুরী পুরোটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছি। কেন আসলি আমার জীবনে ভালো থাকার কারণ হয়ে? কেন এসে আমাকে সুদ্রে দিলি? কেন নতুন করে কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার পথ দেখালি? কেন বেপরোয়া একটা ছেলে থেকে নিশ্চুপ থাকতে শিখিয়ে দিলি? আমি ছিলাম — বাউণ্ডুলে, মেয়েবাজ, বেপরোয়া এক ছেলে। তোর কারণে সেসব অভ্যাস বদলে গেল। আমি তো চাইনি আমার জীবনে কেউ একজন ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে যাক। আমার রাত জাগার কারণ হোক। কাউকে হারানোর ভয়ে সারাক্ষণ গুমরে থাকা আমার সাথী হোক। তবে কেন এমন হলো?”

ইশরা নির্বাক, স্তব্ধ। চক্ষুদ্বয় বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সাদাত কি বলছে? মস্তিষ্ক যেন অচল। সব কথা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সাদাতের কন্ঠস্বর ভঙ্গুর ;
“আমি ক্ষণে ক্ষণে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি ইশু। দমবন্ধ হয়ে আসছে। বার বার মনে হচ্ছে তোকে ভালোবেসে ভুল করে ফেলেছি। মন ডেকে বলছে, তুই এ জনমে আমার হবি না। কিন্তু আমি সহজে তোকে পাওয়ার আশা ছাড়বো না। যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ তোকে পাওয়ার জন্য লড়াই করব।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৫

সাদাত থেমে পুনরায় বলে;
“আমার বড্ড ভয় হয়। ইরফান ভাইয়ের মতো ধৈর্য, মনোবল কোনোটাই নেই আমার। ভাইয়ের মতো একতরফা ভালোবেসে সারাজীবন দগ্ধ হতে চাই না আমি। ইশু আমায় ফিরিয়ে দিস না। তোকে ছাড়া আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৭