প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭০
আদ্রিতা নিশি
“আমার অনেক ইচ্ছা আছে। কিন্তু তা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। শুনুন, এবার আমার সব ইচ্ছা পূরণ করার দায়িত্ব আপনার। আজ থেকে দায়িত্বটা পালন করতে শুরু করুন। ফ্যামিলি ট্যুরে যাওয়ার ইচ্ছে বা আবদার পূরণ করার কথা দিয়েছেন। তাই আমি আমার আরো কিছু ইচ্ছা পূরণ করার আবদার করব আর সেগুলো দ্রুত পূরণ করবেন। আমার বহুদিনের ইচ্ছে আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে রাত জেগে চন্দ্রবিলাস করব, দুজনে হাত ধরে নিস্তব্ধ ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোকময় রাস্তায় হাটব, বৃষ্টিবিলাস করব, ফুচকা খাবো। এভাবেই সুন্দর করে জীবনটা চলবে।”
সন্ধ্যা অতিক্রম করে রাত্রির আলিঙ্গনে নিমগ্ন হয়েছে ধরণী। দূর হতে ভেসে আসা যানবাহনের শব্দ এবং নিস্তব্ধতার আবরণে পরিবেষ্টিত চারিপাশ। শীতল হাওয়ার বেগ তীব্রতর হয়ে উঠেছে।সেই শব্দ যেন কোনো এক রোমাঞ্চ মুর্ছনার ন্যায় কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অম্বরের বক্ষজুড়ে থালার সদৃশ উদিত চাঁদ। তার শীতল, শুভ্র কিরণে উদ্ভাসিত সমগ্র ধরণী যেন রাত নিজেকে আলোকময়তায় শুচি করেছে। সেই জ্যোৎস্নার অপার কোমলতায় ছাদের প্রান্তে প্রতিস্থাপিত দুটি ছায়াবৎ অবয়ব—নর-নারী নয় প্রেমের চিরন্তন রূপে রূপায়িত এক দ্বিমূর্তি।রেলিঙ-সংলগ্ন স্থিত নবদম্পতির দৃষ্টি অবিচল একে অপরের চোখে নিবদ্ধ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শব্দহীন সেই মিলন তথাপি ভাষাতীত এক প্রেমময় সংলাপ বহমান। চক্ষুর গভীরে ডুব দিয়ে হৃদয়ের অন্তঃস্থ ভাষা অনুধাবনের প্রয়াস যেন ধ্বনিত হচ্ছে নীরব এবং নিঃশব্দতায়।এই মুহূর্ত কেবল রাতের একটি ক্ষণমাত্র নয়। এটা এক নব অধ্যায়ের আরম্ভ, এক অনন্ত পথচলার পূর্বপ্রস্তুতি। দৃষ্টির লাঘব, নিঃশব্দতার অন্তর্নিহিত আহ্বান আর হৃদয়দ্বারের সঞ্চালন মিলিয়ে গঠিত হয়েছে প্রেমের সেই প্রথম উন্মেষ।চন্দ্রালোকিত এই পবিত্র সন্ধিক্ষণে যেন প্রকৃতি নিজেই স্থবির হয়ে সাক্ষী দিচ্ছে। হাওয়া যেন থেমে গিয়েছে নিঃশ্বাস গুণবার নিবিড় আকাঙ্ক্ষায়। আর অম্বর? সে তো নির্বাক স্নেহভরে চেয়ে আছে প্রেমের সেই মূর্ত রূপে।যা এখনো অনুচ্চারিত তবুও হৃদয়ে সুস্পষ্টরূপে প্রতিস্থাপিত।কপোত-কপোতীর মধ্যে বিস্তারিত নৈঃশব্দ্য অপার গভীরতায় আবিষ্ট। পরস্পরের নিঃশ্বাসধ্বনি যেন সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই রচিত অলিখিত গাঁথা হৃদয়স্পন্দনের সহিত তাল মিলিয়ে যাচ্ছে।চন্দ্রালোকের শুভ্র ছটায় দীপ্ত সেই মুহূর্ত রোমাঞ্চে পরিব্যাপ্ত। যেখানে শব্দ অনুপস্থিত তবু অনুভব উচ্চকিত।এই মন্ত্রমুগ্ধ নৈঃশব্দ্য হঠাৎ ভঙ্গ করল এক মেয়েলী সুমিষ্ট কান্তকণ্ঠ। সেই কন্ঠস্বর মুহুর্তে ভঙ্গ করল বিবাহিত প্রেমিকের ধ্যান জ্ঞান। বিলীন হয়ে গেল মুগ্ধতা। সারহান বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল। মোহগ্রস্থের ন্যায় মেয়েলী মুখশ্রীতে পুনরায় তাকাল। সংযত কন্ঠে বলল;
“আর কি কি ইচ্ছে আছে তোর?”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটালো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভেবে ওষ্ঠ উল্টে বলল;
“আর মনে পড়ছে না। মনে পড়লে আপনাকে বলব।”
থেমে সাহস সঞ্চার করে আগ্রহের সহিত জানতে চাইল ;
“আপনার কোনো ইচ্ছে নেই।”
সারহান নীরব থেকে ভাবল তার ইচ্ছে আছে কিনা? ইচ্ছে ছিল তো যাকে দীর্ঘ দিন গোপনে ভালোবেসেছে তাকে একান্ত নিজের করে নেওয়ার। ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে। যাকে মন প্রাণ দিয়ে চেয়েছে তাকে অর্ধাঙ্গিনী রুপে পেয়েছে। সে নিঃশব্দে হাসল। সুগভীর কন্ঠে বলল;
“উহু আমার কোনো ইচ্ছে নেই।”
“আজব মানুষ আপনি!সবার কোনো না কোনো ইচ্ছে থাকে। আপনার নেই কেন?”
“কারণ আমার ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেছে।”
“আপনার কোন ইচ্ছে পূরণ হয়েছে?”
“তোকে আমার বউ বানিয়ে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেওয়ার।”
সারহানের কন্ঠ বিমোহন ধরিয়ে দেওয়ার মতো লাগল। অরিত্রিকা বিস্মিত হলো। ওষ্ঠযুগল কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। বিয়ে করে বউ বানানোও বুঝি ইচ্ছের মধ্যে পড়ে? এই প্রথমবার শুনল। অদ্ভুত মানুষটার যে অদ্ভুত ইচ্ছে আছে তা জেনে মোটামুটি চমকে গেছে সে। সারহান অরিত্রিকাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রুযুগল নাচিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল;
“কি হলো এমন হা করে আমার দিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? বেশ কয়েকদিন ধরে এটা আমি লক্ষ্য করছি। তোর চোখের দৃষ্টি সংযত কর। আই নো, আমি হ্যান্ডসাম, ডেশিং তাই বলে চোখ দিয়ে গিলে খাবি?”
অরিত্রিকার বিস্ময় ভাব উড়ে গেল। কটমট করে তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল;
“একশবার আপনার দিকে তাকিয়ে থাকব। আপনার রুপ, যৌবন চোখ দিয়ে গিলে খাবো। গিলে না খেতে পারলে জুস বানিয়ে খাবো। সুদর্শন হয়েছেন, মাঝে মাঝে শার্ট না পড়ে খাম্বার মতো শরীর দেখিয়ে বেড়ান আর আমি তাকালেই যত দোষ নন্দ ঘোষ?অন্য মেয়েরা আপনার ছবি দেখে অশ্লীল মন্তব্য করে তখন চুপ কেন থাকেন?”
“আমার শরীরকে তুই খাম্বা বললি?”
“হ্যা। আপনার সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার হাড়গোড় নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার ভদ্র মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে আপনি কি জিম করেন?”
“মাথায় হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন ঘুরছে?”
“আসলে…. আপনার বডি দেখতে হট।”
অরিত্রিকা বেফাঁস কিছু বলে ফেলতেই জিভ কাটল।এটা সে কী বলল! মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা কথাটা কেমন করে যে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল নিজেই বুঝে উঠতে পারল না। চক্ষুদ্বয়ে আতঙ্ক আর মনে ভীষণ দ্বিধা ছেয়ে গেল।এখনই সারহান ভাই নিশ্চয়ই তাকে নির্লজ্জ ভাববে এই চিন্তায় তার বুক কেঁপে উঠল।সে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে হাস ফাঁস করে উঠল। এমন অপ্রস্তুত,অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইল। তড়িঘড়ি করে এক পা বাড়াল ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঠিক তখনই একটা দৃঢ়, পুরুষালি হাত বাড়িয়ে ওড়নার এক কোণা ধরে ফেলল। টান পড়তেই অরিত্রিকার শরীর স্থবির হয়ে গেল।সে থমকে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সারহান ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মুহূর্তেই তার পিঠ ঠেকল সারহানের প্রশস্ত, উষ্ণ বক্ষের সঙ্গে। শরীরে যেন বিদ্যুতের হালকা প্রবাহ বয়ে গেল। মেয়েলি স্নায়ুতে কাঁপন ধরে গেল।সে চোখ-মুখ আঁকড়ে বন্ধ করে নিল। লজ্জা, সংকোচ আর চমকে যেন শরীরটা অনিচ্ছায় কেঁপে উঠল।সারহান তখন নিঃশব্দে হাতে ওড়নার কোণা ছেড়ে দুহাতে অরিত্রিকার কোমর জড়িয়ে টেনে নিল নিজের বুকের সহিত। সে স্পর্শ ছিল না কোনো অবাধ্যতা ছিল এক মৌন অনুমতির ভাষা। এক মুহূর্তে নির্বাক সেই স্পর্শে উচ্চারিত হয়ে গেল বহু না-বলা কথা।
“আমাকে দেখে তোর মনে আর কি কি অভদ্র চিন্তার আবির্ভাব ঘটে? বল, আজ সব শুনবো।”
সারহান খানিকটা ঝুঁকে এসে গভীর ভাবে ফিসফিসিয়ে বলল। অরিত্রিকার কর্ণে সারহানের খোঁচা খোঁচা কণ্টকিত দাঁড়ির স্পর্শ হঠাৎ করেই চৈতন্যে বিদ্যুৎ সঞ্চার করল। সেই স্পর্শ যেন অনভিপ্রেত তাপরেখা এঁকে গেল তার সংবেদনশীল কর্ণপটে। মুহূর্তেই তার হাত পা শীতল হয়ে আসলো। মনে হলো র*ক্তপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুষ্কতা তার কণ্ঠনালী দখল করল। স্বর যেন কোথাও হারিয়ে গেল। গোলাপবর্ণ ওষ্ঠযুগল অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল!হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে বাড়ল।সে নড়েচড়ে শক্তি প্রয়োগ করে স্বয়ংকে সরাবার চেষ্টা করল। মোচড় দিল শরীর ঠেলে মুক্ত হতে চাইল। কিন্তু সারহানের সুগঠিত, বলিষ্ঠ দেহের প্রতিরোধ অরিত্রিকার সমস্ত প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিল। সে এক প্রকার অসহায়তায় আচ্ছন্ন হইল। মস্তিষ্ক ও শরীর যেন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। মনে ভয়, বাইরে দ্বিধা সমস্ত পরিস্থিতি হঠাৎ করে অদ্ভুত ও ভীতিকর হয়ে উঠল।সারহান অরিত্রিকার গালে গাল স্পর্শ করে মদ্যক কন্ঠে বলে উঠল;
“নড়ছিস কেন?”
অরিত্রিকা মূর্তির ন্যায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।
সারহান পূর্বের মতোই নিঃসঙ্কোচ স্বরে বলল;
“গুড গার্ল।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“ছাড়ুন! কেউ দেখে ফেলবে।”
চন্দ্রালোকের শুভ্র আলোয় দৃশ্যমাণ অরিত্রিকার গলদেশ। ফর্সা উন্মুক্ত স্থানটুকু যেন নেশার মতো টানলো সারহানকে। ওষ্ঠের উষ্ণতায় ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল সেথায়। কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। পুরুষালি মনসত্তা নিষিদ্ধ বাসনায় জর্জরিত হলো। এ মুহুর্ত আকর্ষণটুকু দমাল না। হুট করে ছুঁইয়ে দিল মেয়েলী উন্মুক্ত কোমল গলদেশে। তৃষিত হৃদয়টার তৃষ্ণা স্বল্প নিবারণ হলো। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের বাঁধন দৃঢ় করে নেশাত্নক কন্ঠে বলল;
“এই মুহূর্তে তোকে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না।
তুই আমার কাছে আশ্চর্য মাদকতা।যার গভীরে এ মুহুর্তে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।তোর ছোঁয়া চাই একটু গভীরভাবে যাতে এই বিক্ষুব্ধ মন শান্তি খুঁজে পায়।”
অরিত্রিকা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে চমকে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। শরীরের কাঁপন বৃদ্ধি পেল। সে শুকনো ঢোক গিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকাল। ওষ্ঠ ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল;
“ট্যুরে যাব। প্যাকিং করতে হবে।”
“আমার থেকে পালাতে চাইছিস?”
“উহু! আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করতে হবে। অনেক টাইম লাগবে।”
“বাহানা বানিয়ে আমার থেকে পালাতে চাইছিস? আমাদের বিয়ে কিন্তু হয়ে গেছে। এভাবে পালাই পালাই করলে হবে?”
“দেখুন! আমরা কিন্তু ছাদে আছি। কেউ দেখে ফেলবে।”
অরিত্রিকা ধীরজ কন্ঠে বলল। সারহান একহাতে অরিত্রিকার গাল ছুঁয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলল;
“সবাই ব্যস্ত আছে। আমাদের রোমান্স দেখার কারো সময় নেই।”
অরিত্রিকা উপায়ন্তর না পেয়ে কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“আমাদের রিসেপশন হয়নি। আপনি কথার খেলাপ করছেন।”
“তুই কি বলতে চাইছিস স্পষ্ট করে বল।”
“আপনি জানেন আমি আসলে কি বুঝাতে চাইছি।”
“তোর কথা ভেবে এখনো দূরে আছি। তোকে সময় দিচ্ছি আমাকে জানার, নতুন করে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা বোঝার। তোর ইচ্ছা ছিল প্রেম করে বিয়ে করার! আমার কাছে এটা অদ্ভুত লাগছিল। তবুও তোর কথা ভেবে বললাম বিয়ের পরে এই ইচ্ছাটা পূরণ করব। তোর ইচ্ছে এখনো পূরণ করে যাচ্ছি। যাকে ভালোবাসি তার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখা বেমানান দেখায়। আকদের সাত দিন পেরিয়েছে অথচ আমি তোর কাছে আসিনি। কারণ কি জানিস, তোকে সময় দিচ্ছি আমাতে অভ্যস্ত হওয়ার। যদি ভেবে থাকিস তোর বাপের জন্য দূরে আছি তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ভাবছিস। সামান্য একটা রিসেপশন নামক বাহানা সারহান ইদায়াত চৌধুরীকে তোর থেকে দূরে রাখবে! এটা অসম্ভব। আকদের আগে এবং পরে যা কিছু হয়েছে বা হবে সবকিছুতে আমার মর্জি সামিল বুঝেছিস!”
“হু।”
অরিত্রিকা ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক সময় নিল কথাগুলো বুঝতে। তারমানে সারহান ভাই এ সম্পর্কটা আস্তে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে সময় দিচ্ছে। অথচ সে ভাবতো বাবার দেওয়া কথা রাখতে এমনটা করছে। কতোটা গর্দভ সে! এ বুদ্ধি নিয়ে সে কিভাবে সংসার করবে। সারহান ঠিকই বলে — সে একটা মাথামোটা।
“সারহান দোস্ত! খোলা আকাশের নিচে এসব কি উল্টোপাল্টা করছিস? ভাই একটু তো প্রাইভেসি যুক্ত জায়গায় যেতে পারতিস।”
চিলেকোঠার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবির হাহুতাশ করে উচ্চস্বরে বলে উঠল। অবশ্য দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়েছে। সারহান বিরক্তবোধ করল। অসময়ে এসে তার রোমান্স করার পিন্ডি চটকে দিল। সে চিলেকোঠার দরজার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে টাউজারে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়াল। অরিত্রিকা ছিটকে সরে দাঁড়াল। কান দুটো ঝা ঝা করে উঠল। গাল দুটো গরম হয়ে গেল। সে গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে নিল দ্রুত। ইস!কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি। অস্বস্তি, লজ্জায় নাকটা যেন কাটা গেল। ইচ্ছে করল লুকিয়ে পড়তে। সে আড়চোখে এক পলক সারহানের দিকে তাকিয়ে ছুটে ছাদ থেকে চলে গেল। আবিরের দিকে না তাকিয়ে চিলেকোঠার দরজা পেরিয়ে কোনমতে ছুটল। আবির সেই দৃশ্য দেখে শব্দ করে হেসে দিলো। তারপর হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলো সারহানের দিকে।
সারহান কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আবিরের দিকে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল;
“হাসা বাদ দে নয়তো ছাদ থেকে ফেলে দেবো।”
আবিরের হাসির মাত্রা বাড়ল;
“আমাকে হুমকি দিচ্ছিস! তোর হুমকিতে ভয় পাই নাকি।”
“অসময়ে কেন এসেছিস?”
“কেন? এসে কি রোমান্সের সময়ে ডিস্টার্ব করে ফেললাম?”
“একদম ষ্টুপিডের মতো কথা বলবি না।”
“রেগে যাচ্ছিস কেন দোস্ত! মাথা ঠান্ডা কর। আমি তো জানতাম তুই একটা নিরামিষ। যে রোমান্সের ‘র’ বোঝেনা। এখন তো দেখছি তুই আমিষে ভরপুর হয়ে গেছিস। আকদের পরের সাইড এফেক্ট এটা বুঝতে পেরেছি।”
আবির দাঁত কেলিয়ে বলল। সারহান “ চ” বর্গীয় শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল। মেজাজ সামলে ভরাট কন্ঠে বলল;
“কেন এসেছিস সেটা আগে বল।”
আবির হাসি থামিয়ে বলল;
“আমার বউয়ের কথা মনে পড়ছিল তাই ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর বউয়ের কাছে যা।”
“তোর সাথেও জরুরী কথা ছিল। দশবারের বেশী কল করলাম অথচ তুই রিসিভ করিসনি।”
“ফোন রুমে।”
“ওহহ। খবর পেলাম তুই নাকি ইলহামের পটল তোলার বন্দবস্ত করেছিলি? ”
আবির সন্দিহান কন্ঠে বলল। সারহান আবিরের দিকে শীতল চাহনিতে তাকাল। নিরলস কন্ঠে বলল;
“হুমম।”
আবির অবাক হয়ে বলল;
“পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করা কি খুবই দরকার ছিল? জানিস তো, মিডিয়া সামান্য বিষয়কে তিল থেকে তাল বানায়।”
“পাবলিক প্লেসে আমার বউকে যে প্রপোজ করার সাহস দেখায় তাকে কিভাবে ছেড়ে দিবো? বেশী কিছু করিনি শুধু গলা চেপে ধরেছিলাম। মিডিয়ার কাজই ওটা — ছোট্ট একটা নিউজকে বড় করে দেখানো।”
“সিরিয়াসলি!বেশী কিছু করিসনি? তাহলে ইলহাম হসপিটালে এডমিট কেন?”
“সামান্য গলা চেপে ধরেছিলাম। এতটুকুতেই হসপিটালে পৌঁছে গেল? ডাক্তার কি বলল? বাঁচবে নাকি ম*রে যাবে?”
“হসপিটালে এডমিট আছে। কিন্তু শঙ্কামুক্ত নয়। ওর গলায় থাইরয়েড কার্টিলেজ ফ্র্যাকচার হয়েছে।”
আবির চিন্তিত হয়ে কথাটা জানাল। সারহান ফিচেল হাসল। আশেপাশে তাকিয়ে বলল;
“চিন্তা করিস না। ইলহাম সহজে ম*রবে না। তাজের মৃ*ত্যুর রহস্য, নয়ন তালুকাদের অপকর্ম সম্পর্কে না জেনে ওকে মৃ*ত্যু দেবো না।”
আবির আতংকিত ভাব নিয়ে বলল;
“সারহান পাগল হয়ে গেছিস? ইলহামকে কেন মা*রবি?”
“ইলহাম আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছে। আমার থেকে পুনরায় অরিত্রিকাকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আজকের পর থেকে আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। তাই ভাবছি… ”
“সারহান মাথা ঠান্ডা কর। ওর দিকটা আমাকে হ্যান্ডেল করতে দে। এখন বল ইশতিয়াককে কিভাবে খুঁজে বের। ওই কু*ত্তার বাচ্চাকে আমরা দুজন চিনি না।”
“ইশতিয়াক আমাদের পরিচিত আবির। ছেলেটা আমাদের সাথে হাইড এন্ড সিক গেম খেলছে। ভেবেছে ওকে আমরা খুঁজে পাবো না।”
“আমাদের পরিচিত? কে এই ইশতিয়াক?”
আবির হতবাক হয়ে বলল। সারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চক্ষুদ্বয়ে ক্রোধ ছলকে উঠল। কাঠিন্যতা এঁটে বলল;
“সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ইশতিয়াক যে নয়ন তালুকদারের লোক তা স্পষ্ট। একটা মানুষ প্রতিশোধ নিতে তিন বছর আগে চাচাকে গু*লি করে।কাহিনীর শুরুটা এখান থেকেই। সবকিছু ছিল পূর্ব পরিকল্পিত! চাচা বাড়ি ফিরতেই অরিত্রিকা চৌধুরী বাড়ি থেকে জেদ করে, কান্নাকাটি, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সবাইকে নিয়ে অন্য বাড়িতে চলে যায়। তারপর ইরফানের সাথে অরিত্রিকার হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়া। সেই বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া। এরপর অরিনের জীবনে ইশতিয়াক আসা। ওদের সম্পর্ক প্রায় তিনবছর হতেই ব্রেকআপ হয়ে যাওয়া সবকিছুতে রহস্যের গন্ধ পাওয়ায় যায়। বিশেষ করে হঠাৎ অরিনের বিয়ে রাহাতের সাথে ঠিক হওয়া। এই বিয়ে ঠিক হওয়া কিন্তু পূর্বপরিকল্পনার অংশ ছিল। রাহাতকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করে অরিনকে সে যেন বিয়ে করে। এর পেছনেও কোনো উদ্দেশ্য ছিলো তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এমন আরও ঘটনা ঘটে গেছে অথচ আমরা বুঝতেই পারিনি। সব ঘটনা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহা থেকে এসব করছে এবং পরবর্তীতে আরও খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতে পারি আমরা।”
আবির বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তারমানে তিনবছর আগে থেকে চক্রান্ত চলছে অথচ তারা ঘুনাক্ষরে টের পায়নি। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“তুই এতো কিছু কিভাবে জানলি? সামনে আবার কি হতে চলেছে?”
“আমি অরিত্রিকার চলে যাওয়ার পর এমন কিছু ধারণা করেছিলাম। কিন্তু কোনো ক্লু পাইনি। এর মাঝে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বিষয়টা। তারপর একদিন অরিত্রিকা নিজের মুখে বলেছিল — সে ইচ্ছাকৃত এ বাড়ি থেকে চলে যায়নি। সেদিন থেকে আবার রহস্য উদ্ঘাটন করতে লাগলাম।”
“বুঝলাম। এবার বল সামনে কি হতে চলেছে? কি হতে পারে বলে অনুমান করছিস?”
“হয়তো আমার মৃ*ত্যু।”
“তুই পাগল হয়ে গেছিস? কি উল্টো পাল্টা বকছিস?”
আবির চমকে উঠে রাগ দেখিয়ে বলল। সারহান হাসল। কেমন যেন নিষ্প্রাণ সেই হাসি। অতঃপর অদ্ভুত নিস্পৃহ কন্ঠে বলল;
“আমার কিছু হয়ে গেলে ফাইরুজকে দেখে রাখিস! ওকে সব বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখিস।”
আবির নির্বাক ভঙ্গিমায় তাকাল। সারহান এসব কি বলছে? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে! আগে কখনো এসব কথা মুখে আনেনি। তবে এখন কেন বলছে। সে প্রথমবার ভয় পেল। শঙ্কিত কন্ঠে বলল;
“দেখ, এসব উল্টাপাল্টা বকবি না। যদি অরিত্রিকা এসব কথা কথা শুনে ফেলে তখন কি হবে ভাবতে পারছিস?”
“ওকে নিয়েই আমার ভয়। যদি আমার কিছু হয়ে যায় তখন ফাইরুজ কিভাবে থাকবে? মেয়েটা আমায় ভীষণ ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া ও এক মুহুর্ত থাকতে পারবে না। আমার চঞ্চলা হরিণীর চঞ্চলতা হারিয়ে যাবে। এক নিমেষে ছোট হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। এসব ভাবলেই দম আটকে আসে। ”
“আর একটা কথা বললে তোকে এক লাথি দিয়ে পদ্মা নদীতে ফেলব শালা।”
সারহান কয়েক পা পিছিয়ে রেলিঙে হেলান দিলো। অতঃপর অদ্ভুত হেসে বলল;
“ভদ্র ভাবে কথা বল। আমি তোর বউয়ের বড় ভাই হই।”
আবির ফুঁসে উঠে বলল;
“একদম দাঁত কেলিয়ে হাসবি না। তোর ইমোশনাল কথাবার্তা শুনে আমার কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছিল।”
“আগামীকাল দাদুর পিতৃ ভিটায় যাবো।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৯
“কেন যাবি?”
“হানিমুনে।”
সারহান শব্দহীব হেসে বলল। আবির রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। একটু আগেই অর্ধেক ম*রে যাচ্ছিল। এখন আবার হাসছে? এটা বন্ধু নয় এটম বো*ম কখন, কোথায় ঠুসঠাস করে ফাটে বোঝা দায়!