প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৩
আদ্রিতা নিশি
“কাউকে স্বল্প সময়ের পরিচয়ে ভালোবাসা যায় না। তবে ভালোলাগাতে পারে। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা নামক অনুভূতি জন্ম নেয়। ”
সারহান নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে রইল। নিরবচিত্তে ভাবল, সারহান ভাই একদম ঠিক বলেছেন। সে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল। ইরফান ভাই যদি রাহার মনের খবর না জানে তাহলে কিভাবে অনুভূতি জন্ম নিবে? সারহান অরিত্রিকার ভাবমূর্তি অবলোকন করে দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“ছোট্ট মস্তিস্কে চাপ দেওয়ার দরকার নেই। আমি আছি সবকিছু সামলে নেওয়ার জন্য।”
অরিত্রিকা বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“আপনি ইরফান ভাইয়ের সাথে রাহার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন?”
“সবকিছু পারিবারিক ভাবে হবে। আমি শুধু বাবা এবং চাচাকে জানাব। বিয়ে ইরফানের ওপর নির্ভর করছে।”
“চারদিকের এতো টেনশনে আমার মাথাটা ফেটে যাবে। একদিকে, সাদাত, ইশারা। অন্যদিকে ইরফান ভাই, রাহা।”
“রিলাক্স ফাইরুজ। এসব নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই।”
“টেনশন করতে চাই না। কিন্তু না চাইতেও করে ফেলি।”
অরিত্রিকা পুকুরের দিকে তাকিয়ে বিরস কন্ঠে বলল। সারহানের মাঝে কোনো বিচলিত ভাব দেখা গেল না। কন্ঠে কোমলতা মিশিয়ে বলল;
“আমাকে ভরসা করিস?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরিত্রিকার মনে শান্ত দোলা দিয়ে গেল। সে মাথা নিচু করল। মৃদু হেসে কন্ঠে বলল;
“আপনিই আমার ভরসার একমাত্র স্থান সারহান ভাই।”
“তাহলে ভয়, দুশ্চিন্তা মন থেকে নিঃশেষ করে দে।”
“চেষ্টা করব।”
“দুশ্চিন্তা, ভয়কে জয় করতে হয়। তাহলে জীবনে সার্থকতা মিলে।”
“আপনার কথায় সহমত আমি। কিন্তু কিছু ভয়কে জয় করা সম্ভব নয়। কারণ সেসব আমাদের মনে আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে ধরে থাকে।”
অরিত্রিকা ম্লান হেসে বলে। সারহান নীরব রয়। সে মেয়েটার বলা অব্যক্ত কথা বুঝতে পেরেছে। তবুও না বোঝার ভাণ করে। সে ইচ্ছে করলে অতি বুদ্ধিমত্তার সহিত কারণটা জেনে নিতে পারতো। কিন্তু জানতে চায় না। পুরনো কথা টেনে আনলে কথা বাড়বে, কষ্ট পাবে, বর্তমানে বিরূপ প্রভাব পড়বে। থাক না কিছু কথা, কিছু ঘটনা সবার অগোচরে এবং তার মনের ভেতরে। যদি সেসব জেনেও চুপ থেকে অরিত্রিকা ও পুরো পরিবার ভালো থাকুক তাই হোক। তার নিভৃতসুধা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক এবং তার একান্ত নিজের থাকুক।
“ভাইয়া আপনাকে বাবা ডাকছে।”
হঠাৎ তানহা ডেকে ওঠায় সবাই ঝগড়াঝাটি বাদ দিয়ে চুপ হয়ে যায়। মনের বিক্ষিপ্ততা নিয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। অরিত্রিকা পিছু ফিরে। সরাসরি দৃষ্টিতে স্থির করে তানহার মুখপানে! মেয়েটা বেশ শান্ত স্বভাবের। ভাবভঙ্গি দেখে ভদ্র স্বভাবের মনে হয়। কিন্তু এ মুহুর্তে মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। কারণ তানহা ড্যাবড্যাব করে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে উপচে পড়ছে উচ্ছ্বসিত ভাব। ওষ্ঠকোণে নিবিড় লাজুক হাসি। মনে হচ্ছে, বছর দশেক পর পছন্দের মানুষকে দেখে লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অরিত্রিকার গা জ্বলে গেল। বুকের মধ্যে যেন আগুন লেগে গেল। চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। ইচ্ছে করল এক ধাক্কায় মেয়েটিকে পানিতে ফেলে দিতে। আহ! কি মধুর ডাক — ভাইয়া। সে ক্রোধ চেপে রেখে জ্বলন্ত চাহনি নিক্ষেপ করল। সারহান পিছু ফিরতেই খেয়াল করল অরিত্রিকা রেগে বোম হয়ে আছে। হঠাৎ মেয়েটা কেন রাগল বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করল না বরং এবার তানহার দিকে তাকাল। ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ঠিক আছে। যাচ্ছি।”
তানহা মিষ্টি হেসে সবার দিকে তাকিয়ে বলল;
“গোসলের সময়ে হয়ে গেছে। আপনারা সবাই পুকুরের পানিতে গোসল করবেন নাকি মোটরের পানিতে?”
সাদাত ও ইরফান চুপ রইল। ইশরা স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“মোটরের পানিতে।”
“তাহলে দ্রুত গিয়ে গোসল করে নিন। গোসলখানা একটা তাই সবার গোসল করতে দেরী হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা। এই শোনো আমাকে রাহাকে আর অরিত্রিকাকে আপনি বলো না। আমরা তোমার সমবয়সী।”
“ঠিক আছে। ”
“ভাইয়ারা আপনারা আগে গোসল করে নিন। আমরা পরে করছি।”
ইশরা সারহান, ইরফান এবং সাদাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল। ভাইয়া শব্দটা সাদাত প্রথমবার শুনে তার মাথা ঘুরিয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল ইশরার দিকে। মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করল। বুকের ভেতরে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ল। অসহনীয়, অসহ্য লাগল। ভালোবাসার মানুষটা ভাইয়া বলে ডাকলে এমন যন্ত্রণা হয় আগে জানা ছিল না। সাদাতের হঠাৎ বড় ভাইয়ের জন্য করুণা হলো। বেচারা ভাইটা অরিত্রিকার মুখ থেকে তিন বছর ভাই সম্বোধন শুনেছে ও আকদের পরেও শুনছে। কিভাবে সহ্য করছে? মেজাজ কিভাবে আয়ত্তে রেখেছে? ভেবেই মনটা ভার হয়ে আসলো। মনে মনে আফসোসের বন্যা বইল। কাজিনদের ভালোবাসা বা পছন্দ করার জ্বালা দুই ভাই ঢেড় বুঝতে পারছে। ইশরা আড় চোখে তাকিয়ে সাদাতকে দেখে নিল। ছেলেটার মুখের অবস্থা দেখে হাসতে গিয়েও থেমে গেল। এ মুহুর্তে একদম হাসা যাবে না। হাসলে গর্দাণ যাবে। সে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। একটু পরে সারহান, সাদাত এবং ইরফান সেখান থেকে প্রস্থান করল।
তানহা এগিয়ে আসলো। হাসি মুখে বলল;
“তোমাদের মধ্যে ভাইয়ার কাজিন কারা?”
ইশরা অরিত্রিকাকে দেখিয়ে বলল;
“ ও আর আমি। আরেকজন হলো অরিত্রিকার ফ্রেন্ড।”
“ওহহ। তোমরা তিনজন অনেক কিউট। আমার ফ্রেন্ড হবে তোমরা?”
“অবশ্যই। আমাদের তুই ফ্রেন্ড হিসেবে ভাবতে পারো।”
“সত্যি?”
“হুমম।”
ইশরা বলল। অরিত্রিকা এবার মুখ খুলল। রুঢ় কন্ঠে বলল;
“তুমি সারহান ভাইকে কবে থেকে চেনো?”
রাহা এবং ইশরা অবাক হয়ে গেল এমন প্রশ্ন শুনে। এমন সময়ে কে উদ্ভট প্রশ্ন করে? তানহা থতমত খেল। আমতা আমতা করে বলল;
“ পাঁচ – ছয় বছর ধরে চিনি উনাকে।”
অরিত্রিকা গমগমে কন্ঠে বলল ;
“আমি উনাকে আমার জন্মের দিন থেকে চিনি।”
“অ্যাহহ!”
“হুমম। শোনো উনাকে কোনো কথা সরাসরি না বলে আমাকে আগে বলবে। আমি উনাকে বলে দিবো।”
“ঠিক আছে। কিন্তু তোমার কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না।”
তানহা অবুঝের ন্যায় বলল। অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলল;
“পরে বুঝিয়ে দিবো। এখন চলো।”
তানহা কিছু না বলে এগোতে লাগল। রাহা ও ইশরা একযোগে বলল;
“মেয়েটার সাথে ওমন করলি কেন?”
অরিত্রিকা রাগত স্বরে বলল ;
“তানহাকে দেখে ভদ্র, সভ্য মেয়ে মনে হলেও তেমনটা নয়। মেয়েটা ত্যানা ছেড়ার যম। আমার সারহান ভাইয়ের ওপর নজর দেওয়া.. ঘুচিয়ে দিবো একদম।”
কথাটা বলে অরিত্রিকা রেগেমেগে হনহনিয়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল। ইশরা ও রাহা হতাশ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে বিছানার ওপর গোল করে বসে আছে অরিত্রিকা, রাহা এবং ইশরা। এ মুহুর্তে গোল মিটিং চলছে। গোল মিটিং বলা যায় না — এটা হলো কোর্ট। বিচার আজকের আসামি রাহা এবং ইশরা। অরিত্রিকা হলো আইনজীবির দায়িত্ব পালন করছে। প্রথমে রাহাকে কাঠগড়ায় তোলা হলো। রাহার মুখখানা চুপসে গেছে। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকা দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় পেট গুরগুর করছে। কি প্রশ্ন করবে ভেবেই হাইপারটেনশন বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটা এতো সিরিয়াস কেন? ইশরা গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আগ্রহী ভঙ্গিতে বসে রাহার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।
অরিত্রিকা নড়েচড়ে উঠল। আসামি সমতুল্য বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে আইনজীবীর মতো ভাব নিয়ে সন্দিহান কন্ঠে প্রথম প্রশ্ন করল;
“ইরফান ভাইকে সত্যি ভালোবাসিস?”
ইশরা প্রশ্নটা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কথাটা বুঝতে একটু অসুবিধা হলো। হঠাৎ এহেন প্রশ্ন শুনে যে কেউ অবাক হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্নটা রাহাকে কেন করল? মেয়েটা কি তবে তার ভাইকে ভালোবাসে? এতটুকু ভেবেই মস্তিষ্কে জট বেঁধে গেল। রাহার মুখটা আরও চুপসে গেল। ইশরার সামনে প্রশ্নটা করা কি খুব জরুরী ছিল? অরিত্রিকা এটা না করলেও পারতো। তার ননদীনি তাকে নিয়ে কি ভাববে? সে হতাশায় পরিপূর্ণ চাহনিতে তাকাল বান্ধবীর দিকে। কিয়ৎ চুপ থেকে মুখ কাচুমাচু করে বলল;
“হ্যা। আমি ইরফান ভাইয়াকে সত্যি ভালোবাসি।”
“কবে থেকে ভালোবাসিস? ”
“সঠিক জানিনা। তুই যখন উনাকে বিয়ে করবি না বলে জানিয়েছিলি। তখন উনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন ও মন খারাপ করে থাকতেন। সে সময় ইরফান ভাইয়ার ভঙ্গুর অবস্থা দেখে আমার খারাপ লেগেছিল। তারপরে উনাকে নিয়ে মনের অজান্তে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম। দেখা হলে কথা বলে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতাম। এভাবেই হয়তো ভালোবেসে ফেলেছি।”
“ইরফান ভাইকে বিয়ে করবি?”
“আমার কথায় কি যায় আসে? উনি আমায় ভালোবাসেননা অরিত্রিকা। উনি আমাকে শুধু তোর বান্ধবী হিসেবে দেখেন। আমি যখন উনাকে স্বাভাবিক করার জন্য কথা বলি তখন ভাইয়া রেগে যান কিংবা মুখটা পেঁচার মতো রাখেন। ইরফান ভাইয়া আমায় অপছন্দ করেন হয়তো। কিন্তু আমি সেসব পরোয়া না করে নানা ছুতোয় কথা বলি। কি করব বল? উনার সাথে কথা না বললে মন খারাপ থাকে, কিছু ভালোলাগে না, কান্না পায়, অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে। বারবার উনার কথা মনে পড়ে।
রাহা মলিন কন্ঠে বলল। ইশরা স্তম্ভিত নয়নে তাকাল। মেয়েটা তার ভাইকে এতোটা ভালোবাসে? আগে কেন বলেনি? তবে একটু আন্দাজ করেছিল রাহা তার ভাইকে পছন্দ করে। সেসব ছাপিয়ে ইশরার কানে প্রতিধ্বনিত হলো রাহার বলা কথাটা — কথা না বললে মন খারাপ থাকে, কিছু ভালোলাগেনা, কান্না পায়, অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে। বারবার উনার কথা মনে পড়ে। তার অন্তঃকোণে শিহরণ বইয়ে গেল। মস্তিষ্কে হানা দিলো সাদাত নামক মানুষটি। রাহার মনের ভাবের সাথে তার অধিকাংশ মনের ভাব মিলে যায়। তবে কি সে সাদাতকে….! আর ভাবতে পারল না। মন মস্তিষ্ক প্রায় অচল হয়ে গেল। এটা কখনো সম্ভব নয়। সে ভালোবাসতে পারে না ওকে। ইশরার কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। সে অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার বৃথা প্রয়াস চালালো। রাহার কথা শুনে অরিত্রিকার ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটল। তৃপ্ত শ্বাস ফেলে বলল;
“ সারহান ভাই ফিরে বড়বাবা এবং আব্বুকে বিষয়টা জানাবেন। তারা ইরফান ভাইয়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবেন। সারহান ভাই তোর ভালোবাসা পূর্ণতা দিতে চেষ্টা করবেন। আমিও তোর সাপোর্টে আছি। বাকীটা ওপরওয়ালা এবং ইরফান ভাইয়ের হাতে।”
রাহার চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। তারমানে সারহান ভাইয়া তার কথা ফেলেননি। তিনি ইরফান ভাইয়াকে পেতে সাহায্য করবেন! এটা ভেবে রাহা নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। আবেগাপ্লুত হয়ে অরিত্রিকাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু ফেলে কন্দনরত কন্ঠে বলল;
“থ্যাংস বনু। ভাইয়াকে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ বলে দিস। আমি ভাবতে পারছিনা আমার কথায় উনি এতো বড় পদক্ষেপ নিবেন।”
অরিত্রিকা রাহার মাথায় হাত বুলিয়ে হালকা হেসে বলল;
“তুই একটা পাগলী। এমন করে কাঁদছিস মনে হচ্ছে তোর বিয়েটা ইরফান ভাইয়ের সাথে ফিক্সড হয়ে গেছে।”
“আমার বড় ভাই নেই। এটার আফসোস ছিল। কিন্তু এখন আফসোস নেই। কারণ তোর নেতাসাহেবকে আমি আমার ভাইয়ের আসনে বসিয়েছি। বড় ভাই ছোট বোনের ভালোবাসার মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য এতো বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন এর থেকে আনন্দের আর কিছু আছে?”
“কান্না করা বাদ দে। তোর ননদীনি বোধ হয় স্টোক করেছে। ওর মাথায় পানি ঢাল।”
“এই রে ভুলেই গেছি আমার ননদীনির কথা।”
রাহা জিভ কেটে অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিল। অশ্রুত চোখ দুটো মুছে সরাসরি তাকাল ইশরার দিকে। সাহস সঞ্চার করে ছোট্ট করে বলল;
“ স্যরি ইশরা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার ভাইয়ের প্রতি ফিলিংস কাটানোর। কিন্তু পারিনি। আমায় ভুল বুঝো না প্লিজ। আমি তোমায় সবকিছু এক্সপ্লেইন করব, শুনবে আমার কথা?”
ইশরার বিস্মিত ভাব উবে গেল। সে নিজেকে সামলে স্মিত হেসে বলল;
“এক্সপ্লেইন করার দরকার নেই। ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। হুট করে কাউকে দেখে ভালোলাগে। তারপর ভালোবাসা জন্ম নেয়। সত্যি বলতে আমি অবাক হয়েছি তুমি ভাইকে এতোটা ভালোবাসো।”
“তুমি আমার ওপরে রাগ করোনি?”
“রাগ করব কেন? এতো মিষ্টি মেয়ের ওপর কেউ রাগ করে?”
“ঢপ মারছো?”
“উহু সত্যি বলছি।”
কথাটা বলে হাসল ইশরা৷ রাহাও তাল মিলিয়ে হাসল। অরিত্রিকা দুজনের হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিঞ্চিৎ অবাক হলো। ইশরা বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিবে এটা কল্পনাতীত ছিল। এখন ইরফান ভাই আশানুরূপ মত দিলেই হয়। সে এবার ইশরার দিকে তাকাল। পূর্বের ন্যায় সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল;
“ সাদাতের টমেটো! এবার তুই বল, সাদাত আর তোর মধ্যে কাহিনী কি চলছে?”
ইশরার হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। সে অদ্ভুত প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। মনোভাব বুঝতে না দিয়ে তুতলিয়ে বলল;
“আমাদের মধ্যে কিছু চলছে না।”
“তাহলে দুজনের মান-অভিমানের পালা কেন চলছে?”
“মান-অভিমান! ওসব কিছু নয়। একটু রাগারাগি হয়েছে।”
“তা দেখেই বুঝতে পারছি। প্রপোজাল রিজেক্ট করেছিস তুই অথচ এমন ভাব করছিস সাদাত তোকে চিট করেছে। আমরা সবাই জানি ওর ক্যারেক্টার একটু ঢিলা ছিল। তাই বলে তুই ওর অনুভূতিকে অবিশ্বাস করবি? আমি গর্দভ মার্কা মস্তিষ্ক নিয়ে বুঝেছি ও কতোটা তোকে ভালোবাসে।”
“আমি সাদাতের অনুভূতিকে অবিশ্বাস করিনি। আমি জানি ওর বলা প্রতিটা কথা সত্যি। কিন্তু আমি নিজেকে ভাই, মা, মামা, মামীদের সামনে ছোট করতে পারব না। তুই বল, সাদাতের বয়স কতো হয়েছে? মাত্র একুশ। এই বয়সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভালোবাসার পেছনে ছুটছে। কেন নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবছে না? কেন অবুঝের মতো আচরণ করছে? মেয়েদের বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তাই পড়াশোনা শেষ করে জব না করলেও চলে। কিন্তু ছেলেদের পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার গঠন করতে হয়।”
ইশরা মনে চলমান ভাবনা দমিয়ে ম্লান মুখে বলল। অরিত্রিকা এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
“অবুঝের মতো আচরণ করছে তোকে হারানোর ভয়ে। সাদাত ভাবছে পড়াশোনা শেষ করা অব্দি যদি তুই অপেক্ষা না করিস। যদি ফুপু তোকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়?”
ইশরা বিরক্তি সূচক চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“সাদাতের এখন বিয়ের বয়স হয়েছে? সংসার করার বুদ্ধি হয়েছে? বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করার মতো অর্থ আছে? ছেলেটা আবেগে গা ভাসাচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না বাস্তবতা কতোটা কঠিন।”
“তাহলে কি ভেবে নেবো সাদাতকে তুই শুধু বন্ধু হিসেবে দেখেছিস।”
“ সাদাত শুধু আমার বন্ধু।”
“তাহলে আজ থেকে ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করবি। আমি চাই না তোকে না ভুলতে পেরে উল্টাপাল্টা কিছু করুক।”
“এসব কি বলছিস? তুই তো জানিস ওর সাথে কথা না বললে থাকতে পারিনা।”
ইশরা বিস্মায়াবিষ্ট কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকা হঠাৎ অদ্ভুত কন্ঠে বলল;
“অভ্যাস বদলা।”
ইশরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে শুধালো ;
“এতো সহজে অভ্যাস বদলানো সম্ভব?”
“মানুষ চাইলে সবকিছু করতে পারে। সাদাতের পড়াশোনায় ফোকাস করা জরুরী।”
“বুঝতে পেরেছি তোর কথার মানে। শুধু এতোটুকু বলতে পারি ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব।”
ইশরা কেমন উদাসীন ভঙ্গিতে বলল। অরিত্রিকা ইশারার দিকে একবার তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে খোলা জানালার সামনে দাঁড়াল। অশান্ত মনকে শান্ত করতে বাহিরের প্রকৃতির দিকে তাকাল। বিমর্ষ মনে ভাবল, সাদাত এবং রাহার কথা। দুজনে বর্তমানে একই অবস্থা পার করছে। একতরফা ভালোবাসার ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবেই শঙ্কিত তার মন। সে চায় সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। সময়টা এখন গোধূলি লগ্ন—দিন ও রাতের মিলনক্ষণ। অম্বরে রঙে ছড়িয়ে আছে হালকা কমলা, ম্লান সূর্যের কিরণ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তের আঁচলে। বাতাসে প্রশান্ত শীতলতা তা দিয়ে প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়ে তুলেছে চারপাশ। গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে মৃদু কেঁপে উঠছে আর দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের বাড়ি ফেরার ডাক।
অরিত্রিকা সারহানের বরাদ্দকৃত রুমের সামনে পায়চারি করছে। ভেতরে প্রবেশ করার সাহস টুকু কুলচ্ছে না। বারবার মনে পড়ছে সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। ভয়, সংকোচ, লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। এ মুহুর্তে রুমে যাবে কি যাবে না ভেবে নাজেহাল অবস্থা প্রায়। মিনিট দশেক এদিক থেকে ওদিক হাঁটাহাটি করে অবশেষে সাহস সঞ্চার করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। চোরা চোখে আশে পাশে তাকিয়ে শব্দহীন পায়ে আস্তে ধীরে এগোতে লাগল। রুমে কেউ নেই। জানালা খোলা, দরজা খোলা কোথায় গেল সারহান ভাই? সে নানা ভাবনায় বিভোর হয়ে এসে বসল বিছানায়। তখনি বাহির হতে রুমে প্রবেশ করল সারহান। শার্টের বোতাম গুলো খোলার সময় নজর পড়ল অরিত্রিকার দিকে। সে শার্টের বোতাম গুলো পুনরায় লাগাল। ধীরজ পায়ে এগিয়ে এসে অরিত্রিকার সামনে দাঁড়াল। পুরূ কন্ঠে শুধালো ;
“হঠাৎ আমার রুমে আসার কারণ কি?”
অরিত্রিকার ভাবনার ছেদ ঘটল। সে সরাসরি তাকাল সারহানের দিকে। রাখ ঢাক না করে ওষ্ঠ উল্টে আবদার করল;
“ঘুরতে যাব বাহিরে। নিয়ে যাবেন?”
“আর কে কে যাবে?”
“জানিনা। ভালোলাগছে না রুমে বসে থাকতে চলুন সবাই মিলে পুরো গ্রাম ঘুরে আসি।”
“ইরফান মিটিংয়ে ব্যস্ত। সাদাত ঘুমাচ্ছে। ওরা হয়তো যেতে পারবে না।”
“তাহলে কি করব? আমাদের ঘুরতে যাওয়া হবে না?”
অরিত্রিকা মন খারাপ করল। সারহান হাতের ঘড়িটা খুলে বিছানায় রেখে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;
“আজ যাওয়া হবে না। আগামীকাল সকালে যাব।”
অরিত্রিকা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল;
“ঘুরতে এসেও শান্তি নেই। সব জায়গায় কাজ আর কাজ।”
“আমারও কাজ আছে। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে বউয়ের আবদার পূরণ করছি। এমপি হয়েছি, বিয়ে করেছি। এখন ঘরে – বাইরে দুইদিক সমানতালে সামলাচ্ছি।”
“আপনাকে বলেছি আমার জন্য কাজকর্ম বন্ধ করতে? সারাদিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে কাজ করুন কেউ কিছু বলবে না।”
“এটাই সারাজীবন করে যেতে হবে মনে হচ্ছে। বিয়ে করার আগে যেমন ছিলাম, এখনও তেমন আছি। ভবিষ্যতেও তেমনই থাকতে হবে মনে হচ্ছে । এবার বল, বিয়ে করে লাভ কি হলো আমার?”
“কেন? আমার মতো সুন্দরী একটা বউ পেয়েছেন। মন প্রাণ খুলে দেখতে পারছেন।”
অরিত্রিকা সহজ সরল কন্ঠে বলল। সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“বউ কি শুধু দেখার জিনিস?”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে গেল। ক্যাবলা মার্কা হেসে বলল;
“বর ও কিন্তু দেখার জিনিস নয়। তবুও তো দেখছি। আপাতত ঘুরাঘুরিতে ফোকাস করুন নেতাসাহেব।”
“নেতাসাহেবের বিবিজানের মাথায় তাহলে একটু বুদ্ধি আছে। বর যে দেখার জিনিস নয় তা বুঝতে পেরেছেন। আপনাকে কি পুরষ্কার দেওয়া যায় বলুন তো?”
“ব্লু দ্য শানেল পারফিউম, আপনার রুমের পুরো বেলকনিতে, আপনার রুমের অর্ধেক, আপনার কাবার্ডের অর্ধেকাংশ, আলমারির অর্ধেকাংশ, রেশমী চুড়ি, গোলাপফুল, গাজরা, শাড়ি, লিপস্টক আপাতত এগুলো পুরষ্কার দিতে পারেন।”
“ব্লু দ্য শানেল জেন্টস্ পারফিউম জানিস নিশ্চয়ই?”
“যখন পারফিউম ব্যবহারকারী ব্যক্তি আমার, তখন তার ব্যবহৃত পারফিউমও আমার ব্যবহার করার অধিকারেই পড়ে। ভালোবাসা মানে ভাগ করে নেওয়া, সীমা টানা নয়।”
অরিত্রিকা কন্ঠে অধিকারবোধ ঢেলে বলল। সারহানের কপালের মধ্যাংশে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। কন্ঠে চতুরতা টেনে বলল;
“বউয়ের মতো অধিকার নিয়ে কথা বলতে শিখেছিস—ভালোই! এখন বল আমার পারফিউম, রুম আর বেলকনির দিকে নজর দিয়ে রেখেছিস ঠিক কখন থেকে?”
“আমি যখন আপনার স্ত্রী তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার জীবনের প্রতিটি দিকেই আমার অধিকার থাকে। আপনার পারফিউমে আগ্রহটা বহু আগের আর রুম-বেলকনির দিকটায় নজরটা গেছে বৈবাহিক দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার পর।”
অরিত্রিকা বেশ ভাব নিয়ে বলল। সারহানের কপাল কুঁচকে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। ত্যাছড়া কণ্ঠে বলল;
“আই সি… আমার অজান্তে রুমে ঢুকে রুম, বেলকনি, আলমারি, কাবার্ড সব ভাগ করে নেওয়া হয়! পারফিউম চুরি করে মাখাও হয়! আর কী কী ভাগ করা হয়, শুনি?”
সারহানের কথায় অরিত্রিকার মুখখানা শুকিয়ে গেল। মিনমিন করে বলল;
“আর কিছু ভাগ করিনি। সত্যি বলছি।”
সারহান বুকে দুহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গাম্ভীর্যতা এঁটে বলল ;
“দুই তিনদিন ধরে আমার সাদা শার্টটা খুঁজে পাচ্ছি না। তুই দেখেছিস শার্টটা? ”
অরিত্রিকার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে হতচকিত দৃষ্টিতে তাকাল সারহানের দিকে। মানুষটা এতোগুলো সাদা শার্টের ভেতর তার চুরি করে রাখা শার্টটা খুঁজছে? এখন কি হবে? যদি বুঝে ফেলে? সে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। মিনমিন করে বলল;
“আমি আপনার শার্ট দেখিনি। হয়তো রুমেই কোথাও আছে । আমি ফিরে ভালোভাবে খুঁজে দিবো।”
“রুমে না থাকলেও বাড়িতে কোথাও আছে নিশ্চয়ই।”
“হতে পারে। রাহা, ইশরা মনে হয় আমায় খুঁজছে। আমি আসছি।”
“ওকে।”
সারহান অনুমতি দিতেই অরিত্রিকা ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সারহান দরজার দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠ কামড়ে হাসল। সে আগে থেকে জানতো শার্টটা অরিত্রিকার কাছে আছে। মেয়েটা সবসময় ভুলে যায় তার রুমের বাহিরে সিসি ক্যামেরা লাগানো। কখন কে যায়, আসে সবকিছু সে বাড়িতে না থেকেও ফোনে দেখতে পায়।
“ঘুরতে এসেও ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন! এতো কাজ পাগল হয়ে কোনো লাভ নেই বুঝলেন। একটু নিজেকে সময় দিন।”
ইরফান ছাদের এককোণে চেয়ারে বসে ল্যাপটপে জরুরী কাজ করছিল। এমন সময় আগমন ঘটল রাহার। সে হেলেদুলে এসে ঠাস করে বসল পাশের চেয়ারে বসে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল। ইরফানের স্বাভাবিক মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে ভরাট কন্ঠে বলল;
“আমাকে ডিস্টার্ব করতে চলে এসেছো?”
রাহা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল;
“আমি আপনাকে কখন ডিস্টার্ব করলাম?”
“চুপ থাকো। আমি কাজ করছি।”
“কাজ করুন। আমি কি কাজ করতে নিষেধ করেছি?”
“চুপ করবে নাকি মুখ সেলাই করে দেবো?”
“দিন সেলাই করে।”
উক্ত কথাটি বলে রাহা মুখ এগিয়ে দিল। ইরফান কটমট করে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠ বলল;
“মেজাজ গরম করতে বাধ্য করো না রাহা। নিচে যাও।”
রাহা স্বাভাবিক ভাবে বসল। হাই তুলে বলল;
“ছাদে বসে হাওয়া খেতে ভালোলাগছে। আপনার কথা মানতে পারছি না সরি।”
“দূরে গিয়ে বসো।”
“কেন?”
“তোমার জন্য কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না।”
শক্ত কন্ঠে কন্ঠে কথাটা বলে ইরফান কাজে মনোযোগী হলো। রাহা হতাশায় নিমজ্জিত হলো। এভাবে যেচে কথা বলে কি কারো মন পাওয়া যায়? হয়তো না। তবে কেন এতো বৃথা চেষ্টা করছে, নিজেকে ছোট করছে? সে তাচ্ছিল্য হাসল। অতঃপর চেয়ারটা নিয়ে সেখান থেকে উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে বসল। ইরফান কাজ বাদ দিয়ে রাহার দিকে তাকাল। মেয়েটাকে মনমরা দেখাল। তার কথায় কি কষ্ট পেয়েছে? কষ্ট পেলে পাক তাতে কিছু যায় আসে না। সে পুনরায় কাজে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সে ঠাস করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ল্যাপটপটা চেয়ারের ওপর রেখে এগিয়ে গেল রাহার দিকে। মেয়েটার পাশে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়াল। অদূর প্রকৃতিতে দৃষ্টি স্থির রেখে হঠাৎ শান্ত কন্ঠে বলে উঠল;
“তোমার বাড়ি থেকে পালানো একদম উচিত হয়নি। তোমার বাড়ির আশেপাশের মানুষ, আত্মীয়স্বজন সবাই তোমার সম্পর্কে কি ভাববে কি বলবে তা তোমার ধারণার বাহিরে।”
রাহা তাকিয়ে দেখল না মানুষটিকে। সে দূরে দৃশ্যমান কৃষ্ণচূড়াঁ গাছের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“যে মানুষটা আমার চরিত্র সম্পর্কে বাবাকে জঘন্য কথা বলেছে তাকে কিভাবে বিয়ে করব বলুন?”
“মানে?”
“আমি আপনাকে অনেক আগে থেকে চিনলেও পরিচয়টা হয়েছে অল্পদিনে। মনে আছে, অরিত্রিকার আকদের একদিন আগে শপিং মলে কথা বলেছিলাম সেটা ওই বদলোক আমার বাবাকে বলেছে। তারপর আরো অনেক কিছু বলে শেষে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছে।”
এতটুকু বলে থামল রাহা। তারপর বাকী ফেসবুকে ছবিপোস্ট করার ঘটনা বলল। কিন্তু ইরফানকে পছন্দ করে সেটা গোপন রাখল। ইরফান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল মেয়েটার দিকে। সামান্য বিষয় নিয়ে এতো কিছু ঘটেছে অথচ সে ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। তবে রাহার ওপর তার রাগ হলো মেয়েটা কি মাথামোটা? ফেসবুকে কেন তাদের ছবি পোস্ট করা লাগবে? এসব ভেবে বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। চোখ মুখ শক্ত করে গমগমে কন্ঠে বলল;
“পাকনামী করে ছবি ছেড়েছো এখন মাশুল গুণতে থাকো।”
রাহা ম্লান হেসে বলল;
“মাশুল তো গুনছি। এই যে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে আপনাদের ঘাড়ে ঝুলে পড়েছি।”
“এখান থেকে ফিরে তোমার বাবার কাছে ক্ষমা চাইবে।”
“ক্ষমা চাইলে সবকিছুর সমাধান হবে না।”
“তোমার বাবাকে সব কিছু খুলে বলো। তাহলে হয়তো উনি বুঝতে পারবেন।”
“হয়তো বুঝতে পারবে। কিন্তু আপনার নামটা আমার সাথে জড়িয়ে যাবে, আপনার আমার সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা উঠবে। আপনি কিছু না করেও কটুক্তির স্বীকার হবেন। সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। আমার জন্য আপনার বদনাম হোক সেটা কখনো চাইব না।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭২
ইরফান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। মূর্তিয়মান ভঙ্গিমায় কথাটার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করল। রাহা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একপলক ইরফানের দিকে তাকিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পেছনে রেখে গেল এক গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পরা মানবকে।