প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮
আদ্রিতা নিশি

রাত সাতটা পঁয়তাল্লিশ। রাজশাহীর প্রধান সড়ক মানুষের কলরব স্পন্দনে মুখরিত। যানবাহনের অবিরাম গতি, মানুষের চঞ্চল পদধ্বনি, কোলাহলে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। শিক্ষানগরী বলে পরিচিত হলেও এই শহর এখন ব্যস্ততার নতুন সংজ্ঞা গড়ে তুলেছে। দিনের তুলনায় রাতই এখানে অধিক জীবন্ত।সড়কের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রাজকীয় ল্যাম্পপোস্টগুলো তাদের হলদেটে আলো বিলিয়ে দিয়েছে রাস্তায়। পথচলতি মানুষের ছায়াগুলোকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে তুলেছে। আলো-আঁধারির এই খেলা শহরের ব্যস্ততম রাত্রিকে অন্যরকম আবহ এনে দিয়েছে।নানা শ্রেণির মানুষ ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যে, কারও মুখে ক্লান্তির ছাপ, কারও চোখে তীব্র উদ্দীপনা। সড়কের পাশে সারিবদ্ধ দোকানপাট, শপিংমল, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ সবখানে মানুষের ঢল নেমেছে। ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে আড্ডায় মগ্ন কয়েকজন, পাশে কোনো পথশিশু কাগজ কুড়িয়ে নিচ্ছে।কোথাও বা হকারের উচ্চ স্বরে ডাক ভেসে আসছে।সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা এখানে যেন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ব্যস্ততার মহোৎসবকে। যা নির্দেশ করছে রাতে অবিরাম চঞ্চলতার নাম।

“ ইশরা বেবি আনমনা হয়ে কী ভাবছিস? ”
ইশরা ঘাড় ঘুরিয়ে অরিত্রিকার দিকে তাকায়। অরিত্রিকা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখের ভাব ভীষণ সিরিয়াস। অরিত্রিকারা হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সারহান তার পরিচিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল অরিত্রিকাকে। ড্রেসিং করে কিছু জরুরী ঔষধপত্র নিয়ে আবারও গাড়ি করে রওনা হয়েছে গন্তব্যে।
ইশরা গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরস্বরে বলল,
“ভাবছিলাম, তোকে যে শু*ট করেছে তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না কেন? আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার তোর গায়ে যে গু*লি লেগেছে সেটা কোনো নিউজ চ্যানেল বা সংবাদপত্রে কোথাও হাইলাইট হয়নি! সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশার মতো লাগছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিত্রিকাও ভাবুক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে সামনের ফ্রন্ট সিটে বসে থাকা সারহানের দিকে তাকাল। সে কিছু একটা আন্দাজ করে ফিসফিস করে বলল;
“এসব সারহান ভাইয়ের পাওয়ার বইন। নিশ্চয়ই ওই ব্যাডাকে গু*ম করে দিয়েছে আর নিউজচ্যানেলের লোকদের চুপ থাকতে বলেছে। এই জন্য এসব রাজনীতিবিদদের আশেপাশে সামনে পেছনে থাকতে নেই। কখন দেখবি আমাদের মতো নাদানদের ও গু*ম করে দিবে।”
ইশরা সিটে একটু নড়েচড়ে বসল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে চক্ষুদ্বয় সরু করে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। গলায় খোঁচা মারা সুর এনে বলল,
“আগে তো খুব বলতি, রাজনীতিবিদকে বিয়ে করবি? এখন আবার মুখে অন্য বুলি ফুটল কেন?”
অরিত্রিকা চমকে উঠল। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সতর্ক দৃষ্টিতে সারহানের দিকে তাকাল।ইশরার কথা কানে গেছে কি না তা বোঝার চেষ্টা করল।সারহান একদৃষ্টে ফোন স্ক্রোল করছে।মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন নেই। অস্বাভাবিক নিস্পৃহ। তার এই ভাবলেশহীনতা অরিত্রিকার মনে সামান্য স্বস্তি এনে দিল। সে নিঃশব্দে একবার শ্বাস নিল।তারপর তড়িঘড়ি ফিসফিস করে বলল,

“এই! আস্তে বল, গাড়িরও কিন্তু কান আছে!”
ইশরা দুহাতে মুখ চেপে হাসছে।এই মুহূর্তের মজাটা সে পুরোপুরি উপভোগ করছে। অন্যদিকে, অরিত্রিকার মুখ আমাবস্যার ন্যায় কালো হয়ে গেল। বিরক্তিতে গাল ফুলিয়ে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকায়। এই মেয়ে কোথায় কখন কী বলতে হয় একদম জানে না! সবসময় এমন কিছু বলে বসে যা তাকে সারহান ভাইয়ের সামনে ছোট করে দেয়।বাইরের বাতাস গালের ওপর আলতো ঝাপটা দিয়ে যায় কিন্তু অরিত্রিকার মনটা তাতে শান্ত হয় না। বরং স্মৃতির ঘর থেকে এক ঝলক অতীত উঁকি দেয়। চার-পাঁচ বছর আগের এক বৃষ্টিস্নাত দিনের কথা মনে পড়ে যায়।তখন তার বয়স চৌদ্দ কি পনেরো হবে। সে আর ইশরা ছাদের চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখছিল, কখনো বা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। হাসি-ঠাট্টার মাঝে সময় কেটে যাচ্ছিল অনায়াসে। কিন্তু মজার পরও একটা ভয় ছিল তাদের এই অবস্থা দেখে কেউ কিছু বলবে না তো?বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি উপভোগের পর দুজনেই ভিজে একাকার হয়ে নিচে নামছিল, আর তখনই সামনে পড়ে গেল সারহান!
অরিত্রিকা সিঁড়ির মাঝখানে হঠাৎ থমকে গেল সাথে ইশরাও। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সারহানের চোখেমুখে সেই চিরচেনা গম্ভীরতা। ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“জামা ভিজলো কীভাবে?”
অরিত্রিকা ভয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল কোনো উত্তর দিতে পারল না। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দটা সারহানও শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু সারহান চুপ করে থাকল না। ধমকের সুরে আবারও প্রশ্ন করল,
“বলছি, জামা ভিজলো কী করে?”
ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইশরা মুখ কাচুমাচু করে একদম অপ্রত্যাশিতভাবে বলে বসলো;
“অরিত্রিকা হিসু করে দিয়েছে!”

এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর ইশরা ছুট লাগাল সিঁড়ি বেয়ে নিচে, আর অরিত্রিকা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!লজ্জা, রাগ, অপমান সব মিলে চোখে পানি এসে গেল তার। কোনো কথা খুঁজে পেল না বলার মতো, শুধু সারহানের গম্ভীর চোখ দুটো মুখের সামনে স্থির হয়ে গেল। ইশরা এই মেয়ে তার মান-সম্মানের একেবারে ফালুদা বানিয়ে দেয়, তাও আবার বদমেজাজি মানুষটার সামনে!অরিত্রিকা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল আর সারহান? সে কিছুক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল তারপর কোনো কথা না বলে আশ্চর্যজনকভাবে ফিরে গেল ছাদের দিকে যেন কিছুই হয়নি। কিছুই হয়নি? অরিত্রিকার জন্য তো পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল! সেদিনের কান্না, অপমান, আর রাগ সব মিলে সে যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিল। ইশরার সাথে তার সেদিন ভয়ানক ঝগড়া হয়। কথায় কথায় দুজনের বাকযুদ্ধ এমন জায়গায় গিয়েছিল যে প্রায় এক মাস তারা একে অপরের সাথে কথা বলেনি।

এরপর?অরিত্রিকা সারহানকে দেখলেই লুকিয়ে পড়ত। লজ্জায়, অপমানে, বিব্রতকর অবস্থার ভয়েই হয়তো। মনে মনে সে শপথ নিয়েছিল এই ফুপির বেটিকে আর কখনো কোনো গোপন কথা বলবে না!কিন্তু সমস্যা একটাই সে ভুলেই গিয়েছিল যে, তার গোপন কথা না বললে পেটের ভেতর শান্তি আসে না!কোন দুঃখে যে ইশরাকে একদিন বলে বসেছিল, সে রাজনীতি করা ছেলেকে বিয়ে করবে! একদম বলা ঠিক হয়নি। এই যে আজও সেই কথা নিয়ে তাকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল!ইশরা জানে না, কিন্তু অরিত্রিকা খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ের সামনে মুখ খুললেই বিপদ!হতাশায় জর্জরিত হয়ে অরিত্রিকা গাড়ির সিটে হেলান দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফেরাল বাইরের দিকে। রাস্তার ধারে ফুলের দোকানিরা বাহারি ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে। কৃত্রিম আলোর নরম ঝলকানিতে সেই ফুলগুলো আরও মোহনীয়, আরও মনোমুগ্ধকর লাগছে। লাল গোলাপের গভীর রঙ, রজনীগন্ধার শুভ্র মাধুর্য, জারবেরার উজ্জ্বলতা সবকিছু মিলে অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।অরিত্রিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখ জুড়িয়ে গেল। মন একটু প্রশান্ত হলো যেন।অজান্তেই মনে হলো সে লাল গোলাপ চায়। এখনই।

“ সারহান ভাই গাড়ি থামাতে বলুন । ”
অরিত্রিকা আচমকা উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল।
ইশরা আতকে উঠে তার দিকে তাকায়।সামনের সিটে বসা সারহানের মনোযোগে ব্যঘাত ঘটে। ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অরিত্রিকার ওপর স্থির হয়। চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট।দাঁতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বলল;
“সমস্যা কী তোর? এমন চিল্লাচ্ছিস কেন?”
“ গোলাপ ফুল নিব। গাড়ি থামাতে বলুন দ্রুত। ”
অরিত্রিকার কণ্ঠে উল্লাসের সুর। এক মুহূর্তে মনের সমস্ত জঞ্জাল মুছে গেল তার। তবে সারহান তার চিরাচরিত গম্ভীরতায় ভ্রু দুটি কুঁচকে সামনের দিকে চোখ মেলেই ফোনে মনোযোগী হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বিরক্তি ছড়িয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে;

“মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল কেনার মতো সময় কিংবা মুড কোনোটাই নেই আমার।”
অরিত্রিকা বেশ রেগে গেল। বলল;
“ আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে ফুলের দোকানের কাছে নিয়ে যেতে বলুন নয়ত আমি চিৎকার করে বলব আপনি আমায় কিড*ন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছেন।”
অরিত্রিকার কথায় সারহানের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। বরং খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে পাত্তা না দিয়ে সে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। গাড়ি চলছে গন্তব্যে। অরিত্রিকার মন নিমেষে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। রাগ যেন মন খারাপে পরিনত হলো। নাক ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে অন্যত্র তাকিয়ে রইল। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। অভিমানী চোখের অশ্রু মুছে নিল সে। এই অসহ্য মানুষটার সাথে আসা একদম উচিত হয়নি। অন্য কেউ থাকলে নিশ্চয়ই একটা হলেও ফুল কিনে দিত।
ইশরা অরিত্রিকার গোমড়া মুখ দেখে নিজের মনও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কিছুটা নরম হয়ে, ভারী কণ্ঠে বলে,

“মন খারাপ করিস না সোনা।”
“ সারহান ভাই একটা আস্ত বদমানুষ। কি এমন চেয়েছিলাম আমি? শুধু ফুল কিনতে চেয়েছিলাম। কিপ্টা একটা, ভেবেছে আমি উনার টাকায় ফুল কিনব হু। আমার ও টাকা আছে এটা হয়ত ভুলে গেছেন। ”
অরিত্রিকা মলিন মুখে বলল। ইশরা অরিত্রিকার মনকে কিছুটা শান্ত করার জন্য তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“আগামীকাল আমি আর তুই ঘুরতে যাব পদ্মার পাড়ে। আসার সময় তোর পছন্দের লাল গোলাপ কিনে দেব। আর মন খারাপ করে থাকিস না।”
অরিত্রিকা মন খারাপ করে বসে থাকে। ইশরা হতাশ হয়ে সামনে তাকায়। মিররে চোখে পড়তেই ভড়কে যায় সে। সারহান গম্ভীর মুখে মিররের দিকে তাকিয়ে তাদের অবলোকন করছে। ইশরা দ্রুত চোখ ফিরিয়ে অরিত্রিকার দিকে তাকায়।

“ স্টপ দ্য কার।”
সারহানের নির্দেশনা পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয় ড্রাইভার। হঠাৎ ব্রেক করতেই অরিত্রিকা এবং ইশরা চমকে যায়। দুজনে কৌতুহলবশত তাকায় সারহানের দিকে। সারহান ফোনে সময় দেখে কাটকাট স্বরে বলে উঠে ;
“ পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ফুল কেনার জন্য। পাঁচ মিনিটের বেশী সময় নিলে আই স্যয়ার তোদের দুজনে এখানেই রেখে চলে যাব। ”
অরিত্রিকা এবং ইশরা কিছু না বুঝে নির্বাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কোথায় এসেছে তারা। বাহিরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকায় সারহানের দিকে। এটা তো সেই জায়গা যেখানে অরিত্রিকা কিছুক্ষণ আগে ফুলের শপ দেখেছিল। ভাবতেই অবাক লাগছে সারহান ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এই স্থানে নিয়ে এসেছে। অরিত্রিকা এবং ইশরা দুজনে আনমনা থাকায় খেয়াল করেনি তারা কোন রাস্তায় যাচ্ছে।

অরিত্রিকার মন ভালো হয়ে যায়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল ;
“ ধন্যবাদ সারহান ভাই। চল, ইশরা। ”
অরিত্রিকা শেষোক্ত কথাটি ইশরাকে বলার পর, তারা দুজনে একে অপরকে দেখল এবং গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সারহান একদম নির্বিকার ও গম্ভীরভাবে গাড়িতে বসে থেকে ফ্লাওয়ার শপের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।

অরিত্রিকা ও ইশরা ফুলের দোকানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারপাশে কাঁচা ফুলের মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভরপুর। দোকানীরা বাহারি রকমের ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে। অরিত্রিকা মনোযোগ দিয়ে পছন্দের ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখছে, এবং ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হাসি হাসি মুখে মুহূর্তগুলো উপভোগ করছে।তার দৃষ্টি একদম আঁটকে গেছে লাল গোলাপের দিকে। গোলাপগুলো চিরকালীন সৌন্দর্য দিয়ে তার মনকে ছুঁয়ে যায়। সেগুলোর গাঢ় লাল রঙ, সুঘ্রাণ এবং প্রশান্তি তার অন্তরকে শান্তি দেয়। নরম হাতে একটি পছন্দসই গাঢ় লাল গোলাপ তুলে নেয় আর সুঘ্রাণে মোহিত হয়ে যায়। এক মুহূর্তে সে চোখ বন্ধ করে ফুলটির সৌন্দর্য আর গন্ধে ডুব দেয়।চোখ খুলে মুচকি হাসতে হাসতে মনে মনে ভাবে, “ইস, আজ কেউ থাকলে নিশ্চয়ই গোলাপ কিনে দিত, প্রপোজও করত। কিন্তু কেউ নেই। “ঠিক তখনই ইশরা পাশে এসে দাঁড়ায়। অরিত্রিকা তার সাথে ফিল্মি স্টাইলে কিছুটা মজা করে ভাবতে থাকে। যেই ভাবা সেই কাজ। “ইশরাকে তো ফ্রেন্ড হিসেবে প্রপোজ করা যায়!”
অরিত্রিকা ঘাড় ঘুরিয়ে রাখঢাক না করে সামনের দিকে হাতের গোলাপ বাড়িয়ে প্রাণবন্ত আমোদিত কন্ঠে বলে উঠে;

“ আই লাভ ইয়্যু। ডু ইউ লাভ মি? ”
কিন্তু হায় কপাল!কাকে কি বলে ফেলল! সামনে ভালোভাবে তাকাতেই সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখ তার চড়কগাছ! দ্রুততার সহিত হাত নামিয়ে তটস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। সামনের মানুষটাকে দেখে তার কলিজা কেঁপে উঠেছে। সামনে ইশরা নয় বরং জাঁদরেল সারহান ভাই দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই বাজখাঁই গলায় ধমক দিবে, নয়ত পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় খাবে। তীক্ষ্ণ চাহনি যেন তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভয়ের মাত্রা বাড়ছে তার। কালো মাস্ক পরিহিত মানুষটি তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। ভ্রুযুগল কুঁচকে আছে। দেখে মনে হচ্ছে অতিশয় বিরক্ত মানুষটি।
অরিত্রিকা ঢোক গিলে।অস্বস্তি নিয়ে ধীর কন্ঠে শুধায়;
“ সারহান ভাই আপনি এখানে কী করছেন?”

সারহান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শান্ত চাহনির চক্ষুদ্বয় অরিত্রিকার ভয়ার্ত মুখাবয়বে নিবদ্ধ যেন কিছুই শোনেনি এমন ভাব। অরিত্রিকা মাথা নিচু করে উসখুস করতে লাগল। খেয়াল না করে সারহান ভাইকে সরাসরি প্রপোজ করে দিল ভেবে লজ্জায় হাসফাস করে উঠল সে। সারহান তাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ অরিত্রিকার হাত হতে গোলাপটি নিয়ে নেয়। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল অরিত্রিকা। সে সংকুচিত নয়নে তাকায় সামনে দন্ডায়মান মানবটির দিকে। সারহান গোলাপটি নেড়ে দেখছে।
“ আই লাভ রেড রোজ। ইউ নো, দ্য বিউটি অব অ্যা রোজ লাইস নট ইন ইটস কালার, বাট ইন ইটস ফ্রেগর্যান্স, জাস্ট অ্যাজ আ পারসন’স ট্রু এসেন্স ইজ ফাউন্ড ইন দেয়ার হার্ট।”

সারহানের কন্ঠ বেশ শান্ত এবং দৃঢ় শোনালো। অরিত্রিকা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল অবুঝের ন্যায়। ওষ্ঠযুগল উল্টে কিছু একটা ভাবতে থাকে। সারহান সেই অবুঝ চাহনি দেখে অদ্ভুত হাসে। এক কদম এগিয়ে যায় অরিত্রিকার দিকে। হাতের মুঠোবন্দী গাঢ় রঙের লাল গোলাপ সযতনে গুঁজে দেয় অরিত্রিকার কৃষ্ণ বর্ণীয় খোলা চুলের গহ্বরে। তারপর পুনরায় পিছিয়ে যায়। অরিত্রিকা স্তব্ধ হয়ে যায়। আজ তার ভীষণ অবাক হওয়ার দিন। সারহানের নতুন সত্তায় সে আজ খেই হারিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। চঞ্চল চোখ জোড়ায় ভীড় করেছে অসংখ্য দ্বিধা। সে আগ্রহ নিয়ে চুলে গুঁজে রাখা গোলাপ ছুঁয়ে দেয়। সারহান তার পরখ করে।
সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ইউ ডোন্ট লুক ব্যাড অ্যাট অল উইথ অ্যা রোজ টাক্‌ড ইন ইয়োর হেয়ার।”

সারহানের বলা অপ্রত্যাশিত প্রশংসা শ্রবণ হতেই অরিত্রিকার মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠে। সারহানের নতুন রুপ দেখে সে বেহুশ হওয়ার জোগাড়। সে দুই চোখ কচলে বিস্মিত চাহনিতে তাকায়। মস্তিষ্ক অতিরিক্ত ভাবনা নিতে না পেরে হ্যাং হয়ে গেছে এসব হচ্ছে টা কি? সে ভেবেছিল দুই চারটা থাপ্পড় পড়বে গালে। এখন তো সব কাহিনী উল্টে গেল। এমন শান্ত রুপ দেখে সে পুরাই শকড। সেসব ভাবনা চিন্তা গিলে বলল;
“ সারহান ভাই আপনি ঠিক আছেন? না মানে এমন অদ্ভুত কথা বলছেন কেন হঠাৎ? আপনার এমন শান্ত রুপ আমার কেমন যেন সন্দেহজনক লাগছে। লাল পানি খেয়েছেন?”

সারহানের চোখ সংকুচিত হয়ে গেল। ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল মুহুর্তে। ভরাট কন্ঠে বলল;
“ এই পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় খেতে ইচ্ছে করছে তোর? দুই চারটা থাপ্পড় মে’রে আমার আসল রুপ দেখিয়ে দিব? ”
সারহানের কণ্ঠের গম্ভীরতা মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। চোখের তীক্ষ্ণতা যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল। অদ্ভুত শীতলতায় ভরা ভাবভঙ্গি অরিত্রিকার শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দিল। অরিত্রিকা একটু সশব্দে শ্বাস ফেলল। তড়িঘড়ি করে বলে ;

“ না দরকার নাই। আপনি এখানে দাঁড়ান আমি ইশরাকে ডেকে নিয়ে আসছি। ”
অরিত্রিকা কথাটা বলে সেখান থেকে পগারপার হয়ে যায়। সারহান খিঁচে আসা মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। দৃষ্টি ফিরিয়ে পাশের কাঠের টেবিলে সাজিয়ে রাখা ফুল দেখতে থাকে। বেশ কয়েকটি গোলাপ মুঠোয় নেয়। মৃদু রহস্যময় হেসে আওড়ায়;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭

“যে হৃদয়ে রুক্ষতা, সে কখনোই লাল গোলাপের ভালোবাসা অনুভব করতে পারে না।কারণ সেই ভালোবাসা তো মনোমুগ্ধকর ও মিষ্টি অনুভূতি।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৯