প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৯ (২)
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকার ঘুম ভাঙল সকাল আটটার দিকে। শরীরটায় ব্যথার আনাগোনা, কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। তবে গতকালের থেকে এ মুহুর্তে অনেকটা সুস্থ এবং স্বাভাবিক লাগছে। সে নড়েচড়ে উঠে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চক্ষুদ্বয় মেলে পিটপিট করে চায়। অতঃপর আস্তে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে। সে চমকে উঠে। বিস্ময়াবিষ্ট চাহনিতে তাকায়। আরেকটি আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে তার ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে যায়। সারহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! বুক অব্দি কাঁথা জড়ানো।
ঠিক বুকের কাছে লেভি গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। আর সারহান ভাইয়ের হাতটা লেভির গায়ের ওপর আলতো করে রাখা। অরিত্রিকার মনটা ভালো হয়ে যায় সেই দৃশ্য দেখে। এতো আদুরে মুহুর্ত সে খুব কমই দেখেছে — সে হাসে। মন – মস্তিষ্ক প্রশান্তির জোয়ার খেলে যায়। শরীরের চোখের পলকে অসুস্থতা যেন গায়েব হয়ে যায়। সে দ্রুত তার ফোনটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না। কাোথা হারিয়ে বসেছে সে নিজেও জানে না। তার ফোন না পেলেও নেতাসাহেবের ফোনটা পায় বালিশের কাছে। সে ফটাফট নিয়ে লক না খুলে ক্যামেরা ওপেন করে কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে। তারপর কয়েকটা সেলফি তুলে ফোনটা যথাস্থানে রেখে দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসে। বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয় ঘুমন্ত মানুষটার দিকে। সারারাত সারহান তার পাশে থেকেছে খেয়াল রাখার জন্য ভাবতেই অন্তঃকোণ ভালোলাগায় সিক্ত হয়। যে মানুষটা তার অতীত জানার পরও আগের মতো ভালোবাসে, খেয়াল রাখে, যত্ন করে এমন জীবনসঙ্গী পেয়ে মনে হচ্ছে জীবনটা ধন্য। সে কি ভেবেছিলো গম্ভীর, কাঠখোট্টা মানুষটা তাকে হারানোর ভয় পাবে, আহাজারি করবে, মরিয়া হয়ে উঠবে? নাহ ভাবেনি। তবে গতকাল থেকে অনুভব করেছে নেতাসাহেব তার বিবিজানকে কতোটা ভালোবাসে এবং তার বিবিজানের দিকে যে নজর দিবে তার জীবন শেষ করে দিতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। সে খানিকটা ঝুকে হাসে। আলতো করে স্পর্শ করে সারহানের এলোমেলো সিল্কি চুল। অতঃপর ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গের গালে গোপালী ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দেয়। এ মুহুর্তে আগের মতো দ্বিধা কাজ করল না। তবে একটু লজ্জা লাগল। অরিত্রিকা দ্রুত সোজা হয়ে বসল। মানুষটা জেগে গেলে ভীষণ লজ্জা পাবে সে।
সারহানের ঘুম ভাঙল আধাঘণ্টা পরে। চোখ মুখ কুঁচকে একবার গভীরভাবে আড়মোড়া ভাঙল সে। ধীরে ধীরে উঠে বসতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে পাশে ঘুমন্ত লেভির দিকে। বিছানার মাঝখানে ছোট্ট শরীরটা গুটিসুটি মে*রে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। সারহান কিছুক্ষণ নিরবে তাকিয়ে থাকল। তার চোখে কোমলতা স্পষ্ট।গতরাতের দৃশ্যটা হঠাৎ চক্ষুপটে ভেসে ওঠে। কী ভীষণ অস্থির ছিল লেভি! সে সোজা উঠে এসে ঘুমন্ত সারহান আর আ*হত অরিত্রিকার মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল বারবার মুখটা সামনে এনে অরিত্রিকার মুখের ক্ষ*তের দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ করে ডাকছিল। সেই মুহূর্তে সারহানের মনটা বিষন্ন হয়ে উঠেছিল।
একটা ছোট্ট প্রাণী—ভাষাহীন অথচ কেমন করে বুঝে নিয়েছে তার প্রিয় মানুষটা ক*ষ্টে আছে!লেভির সেই অসহায় ডাক সারহানের হৃদয়ে গেঁথে যায়। তার মায়া লাগে, কষ্ট হয়। সে তখন লেভিকে কাছে টেনে নেয় বুকের কাছে বসিয়ে গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্চর্যভাবে লেভির ডাকা ধীরে ধীরে থেমে যায়। সে নড়াচড়া বন্ধ করে, শান্ত হয়ে যায়। হয়তো সারহানের আদরে কিছু উপলব্ধি করতে পেরেছিল।এরপর ঠিক কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সারহানের মনে নেই। এখন সকালবেলায় সেই দৃশ্য মনে পড়তেই নরম আবেগে ভরে যায় তার ভেতরটা। বিছানায় নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট লেভির দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
“গুড মর্নিং নেতাসাহেব। ”
মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সারহান তড়াক গতিতে সামনে তাকায়। তার দৃষ্টি স্থির হয় হাস্যজ্জ্বল মেয়েলী মুখশ্রীতে। সেই দৃশ্য যেন তার বুকে স্বস্তি জাগায়। সে কপালের মধ্যাংশে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে ঠেলে দেয়৷ কাঁথাটা সরিয়ে স্মিত হেসে জবাব দেয় ;
“গুড মর্নিং বিবিজান!”
অরিত্রিকা মৃদু হাসে ;
“নিজের রুমে না গিয়ে এখানে কি করছিলেন?”
সারহান পূর্বের ন্যায় বলে উঠল;
“বিবিজানের খেয়াল রাখছিলাম।”
“আপনি এখানে ছিলেন, আব্বু দেখেনি তো?”
“দেখেছে তো।”
“কিছু বলেনি?”
“নাহ বলেনি। কিন্তু আড়চোখে এমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমি তোর হাসবেন্ড নই প্রেমিক।”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বড় করে তাকাল। পরক্ষনে শব্দ করে হেসে বলল;
“আব্বুর সাথে আপনার আর আবির ভাইয়ার কিসের এতো শত্রুতা বলুন তো?”
সারহানের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। কন্ঠে গাম্ভীর্যতা মিশিয়ে বলল;
“রাজনীতির দোহাই দিয়ে শ*ত্রুতা করছে। মনপ হয় তোকে ভালোবাসার জন্য প্রতিশোধ নিচ্ছে। শত্রু হিসেবে প্রতিশোধ নিতে তোর হিটলার বাপ আমাকে আর আবিরকে বিবাহিত সিঙ্গেল রাখার পায়তারা করছে।”
“আমার আব্বুকে হিটলার বলতে পারলেন?”
“তোর বাপ আসলেই একটা হিটলার। শুধু আবিরের রিসেপশনটা হতে দে তারপর তোর বাপের সাথে আমার কথা আছে।”
“কি কথা?”
“এটা জামাই – শ্বশুরের সিক্রেট কথা। তাই তোকে বলতে পারলাম না।”
কথাটি বলে সারহান বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। টি-শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে স্বাভাবিক ভাবে শুধায় ;
“শরীর কেমন লাগছে?”
অরিত্রিকা মিনমিন করে জবাব দিলো;
“ভালো।”
“ব্য*থা কমেছে?”
“হুমম। নিশাদের কি খবর?”
“লাইফ সাপোর্টে আছে।”
“আপনি কেন শু*ট করেছেন? পুলিশকে ধরিয়ে দিতেন।”
অরিত্রিকা ঝিমিয়ে ওঠা কন্ঠ নিয়ে বলল। সারহানের ভাবমূর্তি স্বাভাবিক রইল। কন্ঠে নির্লিপ্ততা নিয়ে বলল;
“পুলিশের হাতে দিলে শাস্তিটা কম হয়ে যেত তাই আমি নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছি।”
অরিত্রিকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মলিন কন্ঠে বলল;
“নিশাদ নাকি তাজিয়া আপুকে ভালোবাসতো অথচ কুকর্ম ফাঁস হতেই মে*রে ফেলল। তারপরেও বলে আপুকে নাকি এখনো ভালোবাসে। আচ্ছা, ইলহাম তালুকদার আপনাকে শত্রু কেন মনে করে?”
“ইলহাম ভাবে আমি তাজিয়ার আ*ত্মহত্যার জন্য দায়ী।”
“তাজিয়া আপু তো আ*ত্মহত্যা করেনি।”
“এটা ও জানে না। নিশাদ আর নয়ন তালুকদার মিথ্যা বলে এতোদিন ধোঁয়াশায় রেখেছে ইলহামকে।”
“আপনার উচিত ইলহাম তালুকদারকে জানানো।”
অরিত্রিকা কিছুক্ষণ মৌন থেকে জোড়ালো কন্ঠে বলল। সারহান মাথা দুলিয়ে গম্ভীর স্বর তুলে বলল;
“প্রমাণগুলো হাতে দিয়ে তারপর বলব।”
অরিত্রিকা বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে। শরীরে ব্য*থা অনুভব হতেই চোখ মুখ খিঁচে নেয়। সারহান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরিত্রিকার হাত ধরল। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“নামার দরকার নেই।”
অরিত্রিকা অসহায় চাহনিতে তাকাল সারহানের পানে। মুখ ভার করে তটস্থ ভঙ্গিতে মিনমিন করে বলল;
“ওয়াশরুমে যাব।”
সারহানের চোখ মুখ অতিশয় শান্ত দেখালো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে নরম কন্ঠে বলল;
“আমি তোকে হেল্প করছি।”
অরিত্রিকা আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সারহানে হাতটা ধরে এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে।
❝ওও শ্বশুর আব্বা একটু কথা কহেন না…
ওও শ্বশর আব্বা একটু জামাই বলে ডাকেন না….
ওও শ্বশুর আব্বা আমার ওপর রাগ করে থাকিয়েন না…
ওও শ্বশুর আব্বা এমন রাগ করে থাকলে কিন্তু আপনার মেয়েকে এ বাড়ি আসতে দেবো না…
ওও শ্বশুর আব্বা রাগ কমান নয়তো আমার পোলা – মাইয়ারে নানা ডাকতে দিমু না….❞
দুপুরের পরে আজমল সাহেব মাত্রই সদর দরজা দিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করছিলেন। এমন সময় তাকে ইঙ্গিত করে আবিরের গাওয়া গানটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। বিরক্তি সূচক চাহনিতে তাকালেন সোফায় বসা বদমাশ জামাইটার দিকে। তিনি চোখ বুলালেন সেখানে উপস্থিত আছে অরিন, সাদাত আর ইশরা। তারা সবাই মিটিমিটি হাসছে। তা দেখে আরও বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। চোখ মুখ কুঁচকে এগিয়ে এসে রুঢ় কন্ঠে বললেন ;
“আমাকে ইঙ্গিত করে গান কেনো গাইছো?”
আবির চমকে উঠার ভাণ করে লাফিয়ে দাঁড়ায়। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে;
“আরে শ্বশুর আব্বা আপনে?”
আজমল সাহেব রেগে বললেন;
“আমার সাথে মশকরা করছো?”
“শ্বশুরের সাথে কেউ মশকরা করে! আপনি তো সম্মানের পাত্রী থুক্কু পাত্র।”
“ঠিকঠাক ভাবে সম্মান দাও না অথচ শ্বশুর যে সম্মানের পাত্র তা ভালো করেই জানো।”
“সম্মান করতে আর দিলেন কই? সম্মান করতে গেলে ধোড়া সা*পের মতো ফোঁস করে উঠেন।”
“এই ছেলে তুমি আমাকে সাপের সাথে তুলনা,করলে? তোমার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।আমার মেয়েটা যে কি দেখে তোমার মতো বেয়াড়াকে বিয়ে করতে রাজি হলো ভেবে পাই না। ভাগ্য করে দুটো জামাই পেয়েছি, দুটোই চরম লেভেলের অসভ্য।”
রাগত স্বরে কথাটি বলে হনহনিয়ে প্রস্থান করলেন আজমল সাহেব। আবির হুম হা করে হেসে উঠল। তার সাথে যোগ দিলো সাদাত এবং ইশরা। অরিন কটমট করে তাকাল আবিরের দিকে। গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনি আব্বুর সাথে ওমন করে কথা বললেন কেন?”
আবির পুনরায় আয়েশ করে সোফায় বসল। হাসি থামিয়ে বলল;
“ কি বলেছি? আমি তো গান গেয়ে শ্বশুর মশাইকে ইমপ্রেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি ইমপ্রেস না হয়ে উল্টো রেগে গেলেন।”
“ওটা কোনো গান হলো? আপনি ইচ্ছে করে খোঁচা দিয়ে গানটা গেয়েছেন।”
“ খোঁচা দিয়েছি বেশ করেছি। আমি তোমার হাসবেন্ড অথচ উনি আমায় তা মনেই করেন না। আমার মধ্যে কিসের কমতি আছে।”
“আপনার ব্রেনটা নেই। ওটাই বড় কমতি।”
“ব্রেন না থাকলে তো মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। কিন্তু আমি তো কিছু ভুলিনি। বিরোধী দলের ছেলেদের হাতে পিটুনি খেয়েছিলাম ওই রাতে তোমায় ইয়ে দিয়েছিলাম ওটা তো মনে আছে।”
আবির বাঁকা হেসে বলল। অরিন চমকে গেল। চক্ষুদ্বয় বড় করে তাকাল। সাদাত এবং ইশরা ইয়ের মানে বুঝতে না পেরে একসাথে প্রশ্ন করল;
“ইয়ে কি ভাইয়া?”
অরিন চোখ পাকিয়ে ইশারা করল কোনো বেফাঁস কথা না বলার জন্য। আবির সেই চাহনি উপেক্ষা করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল;
“ΔEmo + ←→SoulPrint + ⍺Spark”
সাদাত, ইশরা দ্বিধান্বিত হয়ে বসে রইল। তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। আবির তা দেখে দাঁত কেলিয়ে বলল;
“এটা হলো স্পেশাল গিফট। সবাই বিয়ের পর বউকে দেয়।”
সাদাত শুনে ইশরার দিকে তাকাল। ইশরা সেই চাহনি দেখে ভড়কে গেল। এই ছেলে ওমন করে তাকাচ্ছে কেন? আবির ভাইয়া আর অরিন আপু যদি বুঝে ফেলে তখন কি হবে? সে তড়িঘড়ি করে অন্যত্র তাকায়। সাদাত পুনরায় আবিরের দিকে তাকিয়ে আগ্রহী কন্ঠে বলল;
“ভাইয়া কোথায় থেকে গিফটটা অর্ডার করেছো আমায় বলো। আমিও বিয়ের পর আমার বউকে স্পেশাল গিফট দিবো।”
অরিন খুকখুক করে কেশে উঠল। মনে মনে, আবিরকে বকে চলল। বাচ্চা ছেলে- মেয়ের সামনে কিসব বলে চলেছে। আবির শব্দ করে হেসে বলল;
“শিউর শালাবাবু। আগে বিয়ে করো তারপর বলব। তুমি চাইলে তোমার বড় ভাইয়ের থেকে কোথায় স্পেশাল গিফট পাওয়া যায় জেনে নিতে পারো।”
“না.. না। তুমি বলো।”
“আচ্ছা।”
আবির দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল। তারা সবাই আবারও সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে লাগল। চৌধুরী বাড়ির আবহ সকাল থেকে স্বস্তিদায়ক। সবাই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে এবং অরিত্রিকাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ইরফান হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। এগিয়ে আসতেই দেখল এক দল আড্ডায় মত্ত। সে আস্তেধীরে এগিয়ে আসে। ঠাস করে বসে পড়ে সাদাতের পাশে। সবাই কথা থামিয়ে তাকাল ইরফানের দিকে। আবির সোফায় রাখা ব্যাগগুলোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধালো ;
“ইরফান বাবু কোথায় থেকে আসা হচ্ছে? ”
ইরফান ক্লান্ত ভঙ্গিমায় জবাব দিলো;
“শপিংমলে।”
“হঠাৎ শপিংমলে? ”
“রাহার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য।”
“ওহহ আচ্ছা।”
“ইশরা, রাহা কোথায়?”
ইরফান জিজ্ঞেস করল। ইশরা ভাইয়ের দিকে তাকাল। স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“আমার রুমে শুয়ে আছে।”
রাহা গতকাল ইশরার রুমে ঘুমিয়েছিল৷ গত তিন ধরে সেখানেই থাকছে। সকালেও মেয়েটার দেখা পায়নি ইরফান। অসময়ে শুয়ে আছে শুনে সে চিন্তিত হলো। উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল ;
“ওর শরীর ঠিক আছে?”
“তুমি গিয়ে দেখে এসো।”
“হুম।”
কথাটি বলে শপিংব্যাগগুলো নিয়ে শাণিত পায়ে প্রস্থান করল। আবির সেই দৃশ্য দেখে হাসল;
“তোমরা কিছু বুঝতে পারলে?”
সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আবিরের দিকে। আবির সবার চাহনি লক্ষ্য করে হাসি বজায় রেখে বলল;
“আমাদের ইরফান বাবু বউকে চোখে হারাচ্ছে। ব্যাটা তো বিয়ের দুইদিন যেতেই বউ পাগল হয়ে গেল।”
সবাই হেসে ফেলল। আবির সোফা থেকে উঠে বলল ;
“প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু করে দাও তোমরা। ”
সাদাত, ইশরা উচ্ছসিত ভাব নিয়ে বলল ;
“আচ্ছা।”
“যাই, বউ পাগল বন্ধুর সাথে দেখা করে আসি।”
কথাটা বলে আবির সারহানের রুমের দিকে পা বাড়াল৷ অরিন উঠে কিচেনের দিকে গেল। আবিরের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুজন চলে যেতেই সাদাত ফোনটা বের করে গুগল ওপেন করল। ইশরা তা দেখে বলল ;
“কাকে কল দিচ্ছিস?”
সাদাত আবিরের বলা স্পেশাল গিফটের নাম সার্চ দিতে দিতে বলল;
“আবির ভাইয়ের বলা স্পেশাল গিফটের নাম সার্চ দিচ্ছি।”
“ওও।”
“হুমম।”
সাদাত টাইপ করে সার্চ দিলো। সার্চ দেওয়ার পরেই ডিটেইলস বেড়িয়ে আসলো। সে হতভম্ব হয়ে গেল৷ দ্রুত গুগল থেকে বের হয়ে ফোনটা বন্ধ করে পকেটে রাখল। ইশরা কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল ;
“ওটা কি গিফট?”
সাদাত থমথমে গলায় বলল;
“তেমন কিছু না।”
“তেমন কিছু না মানে? বল কি গিফট।”
“বলতে পারবো না।”
“আমি শুনবোই। বল আমায়। ”
“টমেটো! তোর গিফট নেওয়ার বয়স হয়নি। যখন হবে তখন জানিয়ে দেবো।”
কথাটা বলে সাদাত একপ্রকার ছুটে পালালো। ইশরা বোকার মতো তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না কথা গুলোর মানে।
সারাদিন বিশ্রাম করে সন্ধ্যার দিকে একটু হাটাহাটি করছে অরিত্রিকার। তার সঙ্গ দিয়েছে লেভি। সে আস্তে ধীরে হেঁটে লিভিং রুমে নামল, দেখল পুরো লিভিং রুম ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। আশ্চর্য হলো বটে এসময়ে সবাই কোথায় উধাও হলো? মনে নানা ভাবনা নিয়ে লিভিং রুম, কিচেনের দিকটা হেঁটে আসলো। তারপর সদর দরজা খুলে বাহিরে বের হলো। আশে পাশে তাকাতেই নজর পড়ল পার্কিং প্লেসের দিকে। ইরফান ভাই বাইক স্টার্ট দিচ্ছেন আর রাহা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কৌতূহল বশত এগিয়ে যায় সেদিক টায়। কাছাকাছি গিয়ে শুধায় ;
“সন্ধ্যায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
ইরফান বাইক স্টার্ট না দিয়ে স্থির হলো। অরিত্রিকাকে দেখে বলল;
“রাহার বাড়িতে যাচ্ছি। তোর কি অবস্থা এখন?”
অরিত্রিকা বলল;
“এখন ভালো আছি। রাহার বাসায় কেন যাচ্ছেন?”
“আংকেল – আন্টি ডেকেছেন।”
“ওহহ।”
অরিত্রিকা এবার রাহার দিকে তাকায়। মেয়েটা মুখ ভার করে আছে। সে এগিয়ে যায়। ভ্রু নাচিয়ে বলল ;
“তোর মুখ দেখে কি মনে হচ্ছে জানিস, ইরফান ভাই তোকে জোর করে বাপের বাড়ি রাখতে যাচ্ছে।”
রাহা হঠাৎ অরিত্রিকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়;
“আমার ভয় করছে জান।”
“কিসের ভয়?”
“আব্বু যদি ডিভোর্সের কথা তোলেন?”
“আরে পাগলী! আংকেল কেন ওমন করবেন?”
“তুই আব্বুকে চিনিস না। ”
রাহা কন্দনরত কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা রাহাকে কিছুক্ষণ বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে। ইরফান সেই দৃশ্য দেখে হতাশার শ্বাস ফেলে। এ মেয়ে উদ্ভট চিন্তা করে মন ভার করে আছে। বড্ড আশ্চর্যের ব্যাপার! অরিত্রিকা শান্ত কন্ঠে বলল;
“তেমন কিছু হবে না।”
রাহা চুপচাপ উঠে বসল বাইকে। ইরফান গাড়ি স্টার্ট দিলো তখুনি অরিত্রিকা বলে উঠল;
“ভাইয়া! পরিস্থিতি যেমনই হোক আমার ভাবীকে ও বাড়িতে রেখে আসবেন না।”
রাহা ড্যাবড্যাব করে তাকাল।ইরফান কথার ধরণ শুনে হেসে ফেলল;
“ওকে, সারহানের মিসেস।”
তারপর বাইক স্টার্ট দিলো। অরিত্রিকা আর সেথায় দাঁড়ালো না গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। লিভিংরুমে ঢুকে দেখা হলো ইশরার সাথে। মেয়েটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসলো। কানে কানে কিছু বলে আবারও ছুটে চলে গেল। সে কথা আর ওমন আচরণে হতবিহ্বল হয়ে গেল। কেমন বোকাসোকা চাহনিতে তাকিয়ে রইল। পরমুহূর্তে মনে পড়ে গেল সারহান ভাইকে কথাটা জানাতে হবে। তার কেমন যেন লজ্জা লাগল। কিভাবে বলবে সে?
অরিত্রিকা তাড়াহুড়োয় অনুমতি ব্যতিত সারহানের রুমে ঢুকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে মানুষটাকে খুঁজল। কিন্তু রুমে কেউ নেই। আশ্চর্য! কোথায় গেলেন উনি। সে শুনতে পায় ওয়াশরুমের থেকে ভেসে আসছে পানি পড়ার শব্দ। এই সন্ধ্যা বেলায় কে গোসল করে? সে আনমনা ভাবনায় বিভোর হয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। লেভি তার সঙ্গ ধরে এ রুমে আসেনি। কোথায় আছে তা জানা নেই। ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমে আসলো সারহান। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে আসতেই খেয়াল করল অরিত্রিকাকে। মেয়েটা দৃষ্টি মেঝেতে স্থির করেছে। চোখ মুখ কেমন যেন খিঁচে রেখেছে। সে ওষ্ঠ কামড়ে হাসল! বুঝতে পারল প্রেয়সী হয়তো আন্দাজ করেছে আজও টি শার্ট ব্যতিত আছে। সে এ আন্দাজ টুকু মিথ্যা প্রমাণ করল। গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল;
“মিসেস আপনার মিস্টার আজ সভ্য ভাবে আছে। ওভাবে মেঝেতে তাকিয়ে না থেকে আমায় দেখুন। মাইন্ড করব না!”
অরিত্রিকা কুন্ঠা ঠেলে নেত্রপল্লব ঝাপটে তাকায় সারহানের দিকে। অতঃপর লাজুক হাসে। সারহান তা লক্ষ্য করে তোয়ালেটা যথাস্থানে রাখে। অতঃপর এগিয়ে এসে ভ্রু উঁচিয়ে দৃঢ় কন্ঠে শুধায়;
“কি বলতে এসেছিস বল।”
অরিত্রিকা ওষ্ঠ ভিজায়। বলতে উদ্যত হয় কিন্তু জড়তা, অস্বস্তিতে বলতে না পেরে অসহায় বোধ করে। সারহান তীক্ষ্ণ চাহনিতে অবলোকন করে। হয়তো বুঝতে পারে কোনো কারণে বলতে পারছে না। সে হেঁটে আলমারির দিকে যায়। আলমারির পাল্লা খুলে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“যদি বলতে না পারিস বলার দরকার নেই।”
পেছন থেকে তখুনি ভেসে এলো মেয়েলী রিনরিনে কন্ঠস্বর;
“বলব। তবে একটু সময় চাই।”
সারহান একটা বক্স বের করে আলমারি লাগালো। অতঃপর এগিয়ে এসে শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল ;
“ওকে। ”
অরিত্রিকার দৃষ্টি আটকালো সারহানের হাতে থাকা বাক্সটার দিকে। ছোট্ট -সুন্দর লাল রঙা বাক্স! দেখতে আকর্ষণীয়। চঞ্চলা মন কৌতূহলী হয়। বাক্সে কি আছে দেখার জন্য মরিয়া হয়। সারহান প্রিয়তমার অধৈর্যের ন্যায় আচরণ পরখ করে অগোচরে হাসে। সে ধৈর্য পরিক্ষা না নিয়ে হাঁটু গেড়ে সামনে বসে। বাক্সটা খুলে বের করে এক জোড়া নুপুর। অরিত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়। তার মনটা যেন থমকে যায় নুপুরটা দেখে। নুপুর ডিজাইন সিম্পল কিন্তু দেখতে আকর্ষণীয়! মানুষটা তার জন্য এটা কিনেছে ভেবে অন্তঃস্থিত মন পুলকিত হয়ে যায়। সারহান সময় ব্যয় না করে প্রেয়সী দুই পায়ে নুপুর দুটো পরিয়ে দেয়। একটু নড়াচড়াতেই ঝনঝন শব্দে প্রতিধ্বনিত হয় চারিপাশ।
“আগে যখন নুপুর পায়ে আমার আশেপাশে ঘুরতিস তখন আমার হৃদয়ে অনুভূতিরা এভাবেই ঝংকার তুলতো।”
সারহান অতি শান্ত কন্ঠে আওড়ালো। অরিত্রিকা পলকহীন চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। তার মনে হয়, সে ভাগ্যবতী। কারণ সে সারহানের মতো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছে। সারহান উঠে দাঁড়ায়। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল ;
“এবার বল কি বলতে এসেছিস?”
অরিত্রিকার ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে মুখখানা কাচুমাচু করে নিতে তাকায়। মিনমিন করে বলে;
“চলুন, ইরফান ভাইয়ের বাসর সাজাতে হবে।”
সারহান বিমূঢ় চাহনিতে তাকায়। উচ্চস্বরে বলে উঠে ;
“হোয়াট! আমি বাসর সাজাবো মানে?”
অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলল;
“হুমম। চলুন আপনাকে সবাই ডাকছে।”
সারহান গাম্ভীর্যতা এঁটে বলল ;
“আমি কারো বাসর সাজাতে যেতে পারবো না। তুই গেলে যা।”
“কেন যাবেন না? চলুন অনেক মজা হবে।”
“বাসর সাজাতে মজা লাগে আগে জানা ছিলো না আমার।”
“ওসব কথা বাদ দিন। চলুন। ”
“আমি যাব না। ”
সারহান চোখ মুখ শক্ত করে বলল। অরিত্রিকা একটু রাগ দেখিয়ে বলল ;
“কেন যাবেন না?”
সারহান বিরক্তিপ্রকাশ করে বলল ;
“ওসব সাজাতে পারি না আমি।”
“পারেন না তো কি হয়েছে। চলুন আমার সাথে গিয়ে বসে থাকবেন।”
“এসব বাসর সাজানোর আইডিয়া কার মাথায় এসেছে? ”
“আবির ভাইয়ার৷ চলুন নয়তো আপনার বাসর সাজাবে না। ”
অরিত্রিকা বেফাঁস কথা বলে জিভ কাটল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল।সারহান তির্যক চাহনিতে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৯
“বাসর সাজিয়ে আর কি হবে?”
অরিত্রিকা লজ্জা পেল। মানুষটা এমন কথা বলবে তা কল্পনাতে ছিল না। নিজের প্রতিও বিরক্তবোধ করল। বেফাঁস কথা উচিত হয়নি। লজ্জা ভাব বুঝতে না দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল ;
“চলুন।”