প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪
আদ্রিতা নিশি

রাতের খাওয়া শেষ করে অরিত্রিকা নিজের রুমে এসেছে। কিছুক্ষণ পূর্বে সারহান নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে তারপর ডাইনিং রুমে খেতে গেছে। এ সুযোগে সে আস্তেধীরে হেঁটে নিজের রুমে জরুরী কিছু দেখার জন্য এসেছে। সে উঁচু পেটটা নিয়ে এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। আটমাস হিসেবে পেটটা একটু বড়সর লাগে। কিন্তু পরনে ঢিলে ঢালা পোশাকের জন্য তেমন একটা চোখে বাঁধে না। শুধু চলতে ফিরতে একটু অসুবিধে হয়। এ কারণে অধিক সময় সারহান, তানিয়া বেগম কিংবা সাথী বেগম আশেপাশে থাকে। সে আলমারি খুলে একটা কাগজ এবং আলট্রাস্নোগ্রাফি রিপোর্ট সহ আরও কিছু কাগজ বের করল। সেগুলো হাতে নিয়ে এসে বিছানায় বসল। অতঃপর আলট্রাস্নোগ্রাফি রিপোর্টটা খাম থেকে বের করল। আলতো হাতে স্পর্শ করল সেটি। মুচকি হাসল। আবেগ্লাপূত হয়ে আওড়াল
“আমার সোনা বাচ্চা।”

কিয়ৎ ক্ষণ চেয়ে থেকে আরও কিছু কাগজপত্র চোখ বুলিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো গুছিয়ে রাখল। অতঃপর উঠে গিয়ে সেগুলো সাবধানে রাখল। তারপরে টেবিলের ডয়ারে রাখা ডায়েরিটা বের করল। সেখানে রাখা চেয়ারটায় বসে আজকের সুন্দর মুহুর্তের কথা সেথায় লিখল। লেখা শেষ করে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাতেই দুইটি নাম ভেসে উঠল। অরিত্রিকা ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসল। সেভাবে আওড়াল;
“সানিয়াত আলহান চৌধুরী, সার..”
হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। মনে হলে কেউ রুমে এসেছে। সে দ্রুত ডায়েরি বন্ধ করে ডয়ারে রেখে উঠে দাঁড়াল। তড়িঘড়ি করে পিছু ঘুরল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সে এগিয়ে গেল। ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটিয়ে বলল;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আব্বু তুমি এখানে?”
আজমল সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন;
“তোমার রুমে গিয়েছিলাম। না পেয়ে এ রুমে এসেছি।”
অরিত্রিকা হাসি বজায় রেখে বলল;
“ জরুরী কাগজপত্রগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রাখলাম। বলা যায় না কখন হসপিটালে দৌড়াতে হয়। আম্মুকে বলে দিও ওগুলো আলমারিতে আছে।”
আজমল সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললেন;
“সারহানের থেকে আর কতোদিন লুকিয়ে রাখবে? আমার মনে হয় ওকে তোমার সবকিছু বলে দেওয়া উচিত। ছেলেটাকে এভাবে ধোঁয়াশা রাখা উচিত হচ্ছে না।”

অরিত্রিকার মুখখানা চুপসে গেল। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিনমিন করে বলল;
“তোমরা তো সবাই জানো। উনিও কয়েকদিনের মধ্যে জেনে যাবেন। আপাতত জানাতে চাইছি না আমি।”
“কিন্তু আম্মা ও তোমার স্বামী। সব জানার অধিকার আছে।”
“জানি আব্বু। আর তো কিছুদিন.. ”
“যা ভালো মনে করো, তাই করো। যখন জানতে পারবে তুমি ওর থেকে এতো বড় ঘটনা লুকিয়েছো তখন কি যে হবে..”
“যা হওয়ার হবে। ”

অরিত্রিকা একটু সাহসী কন্ঠে বলল। আজমল সাহেব হাসলেন। তারপর কিছু কথা বলে প্রস্থান করলেন। অরিত্রিকা গিয়ে বসল বিছানায়। পেটে চিনচিনে ব্যথা করছে। ডেলিভারি ডেট আসতে তো এখনো দশদিন-পনেরোদিন বাকী আছে। তাহলে এমন কেন হচ্ছে? সে বালিশটা পেছনে দিয়ে পিঠটা ঠেকিয়ে আরাম করে বসল। পা দুটো সামনের দিকে মেলে দিল। মাথাটা বিছানার বোর্ডের সাথে ঠেকিয়ে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করল। চক্ষুপটে স্মৃতিস্বরুপ ভেসে উঠল—দুই মাস পূর্বের দৃশ্য। সেদিন ছিল তার জীবনের আরেকটু সুন্দর মুহুর্ত! দ্বিতীয়বার দেখেছিল নিজের ভেতর বেড়ে ওঠা ছোট্ট অস্তিত্বকে। তার গর্ভে ছোট্ট ভ্রণ মানবাকৃতি ধারণ করেছিল। কেমন নড়ছিল! সে অশ্রুসিক্ত নেত্রপল্লব মেলে অপলক চেয়ে রয়েছিল আলট্রাসাউন্ড মেশিনে ভেসে ওঠা বাবুর প্রতিকৃতির দিকে। তবে মনে আক্ষেপ ছিল সারহান সেদিন তার সঙ্গে যায়নি। কোনো কাজের জন্য আঁটকে গিয়েছিল। আজমল সাহেব এবং তানিয়া বেগম মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন চেক- আপ করাতে।

“অরিত্রিকা!”
রাহার কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় মেলে তাকাল। সরাসরি তাকাল সামনের দিকে। রাহা ভদ্র মেয়ের মতো এসে বসল। বলল;
“আগামীকাল রেজাল্ট দিবে।”
অরিত্রিকা ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল;
“হুম জানি।”
“যদি ফেল করি। দুজনে যা পরীক্ষা দিয়েছি।”
“ফেল করলে করব। যতটুকু পড়ার পড়েছি, ততটুকু খাতায় লিখেছি।”
“ফেল করলে আমায় উনি রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। উনি নষ্ট ইয়ারফোন হলেও আমি তো উনার বউ! আমি কি উনি ব্যতিত অন্য কারো বউ হওয়ার কথা ভাবতে পারি?”

রাহা বিরস মুখে বলল। অরিত্রিকা অতি কষ্টে হাসি নিয়ন্ত্রণ করল। কন্ঠে বিরসতা এনে বলল;
“আমার উনি থ্রেট দিয়েছিলেন বাবুকে নিয়ে আলাদা থাকবেন আর আমায় ভালোবাসবেন না। প্রথমে সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম আমি ছাড়া উনি এক মুহুর্তে থাকতে পারবেন না। তাই আমি রিলাক্সে আছি।”
রাহা বলল;
“কিন্তু উনি সিরিয়াস। বিয়ের পর কে পড়াশোনার পর এতো চাপাচাপি করে বলতো?”
অরিত্রিকা আনমনা ভাব নিয়ে বলল;
“আমার গম্ভীর, রগচটা, কাঠখোট্টা, খাম্বা, রোমান্টিক বরটা এমন করে।”
“এ্যাহ!”

“হুম। ভেবেছিলাম বাবু হবে শুনে পড়াশোনার কথা মুখে আনবে না। এখন দেখি নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া, ঘুম, ব্যায়ামের সাথে পড়াশোনা ফ্রি। যারা ভাবে বিয়ের পড়াশোনা করতে হয় না। তারা আমার মতোই গাধা। তখন পড়াশোনা, সংসার আর বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে হয়।”
“ঠিক বলেছিস। তাই তোর বউমাকে আপাতত আনছি না।”
“ওহহ আচ্ছা। ”

কথাটা বলে ফিক করে হেসে ফেলল অরিত্রিকা। রাহাও তাল মিলিয়ে হেসে উঠল এভাবে নানা উদ্ভট কথায় মত্ত হলো দুজন। মিনিট দশেক পড়ে হঠাৎ অরিত্রিকার নজর গেল দরজার দিকে নজর গেল। মুহুর্তে হচকচিয়ে গেল। হাসি থামিয়ে হাত দিয়ে গুঁতো দিয়ে ইশারা করল রাহাকে। রাহা ইশারা অনুসরণ করে দরজার তাকাল। সারহান ও ইরফান দুজনে বুকে হাত গুঁজে তাদের দিকে কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারল তাদের এতোক্ষণ বলা কথাগুলো শুনেছে— ভেবেই মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। রাহা নজর ফিরিয়ে চাপা স্বরে বলল;

“তোর আর আমার বেয়াই কখন এসেছে?”
অরিত্রিকা আমতা আমতা করে বলল;
“মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ আগেই এসেছে।”
“আমরা যখন আমাদের জামাই বউ মা নিয়ে কথা বলি তখন কেন আসেন?”
“জানিনা।”

রাত পেরোতেই চৌধুরী বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল।অরিত্রিকার লেবার পেইন শুরু হয়েছে। ডেলিভারির তারিখ ছিল আরও দশ দিন পরে, কিন্তু ব্যথা অপ্রত্যাশিতভাবেই আগে শুরু হয়ে গেল। সারহান ড্রাইভিং সিটে শক্ত হয়ে বসে আছে। পেছন থেকে ভেসে আসছে অরিত্রিকার ব্যথাতুর মৃদু চিৎকার, মাঝেমধ্যে কান্নার শব্দও মিশে যাচ্ছে তাতে। প্রতিটি শব্দ কর্ণকুহরে অসহনীয় ভঙ্গিতে প্রবেশ করছে। সেই আত্নচিৎকার বুকের ভেতরে তীরের ন্যায় বিঁধছে। অসহনীয় যন্ত্রণা*য় মুচড়ে উঠছে অন্তঃকোণ। সেই অসহ্য অনুভূতি যেন তৈরি করছে তোলপাড়। অজানা শঙ্কা আর অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় স্নায়ুগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ মুখ অস্বাভাবিক লাগছে।

কেমন বিবর্ণ মুখাবয়ব, নিশ্চল চাহনি!তানিয়া বেগম আর সাথী বেগম মেয়েকে শান্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন অথচ ব্য*থার আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে নিজেরাও নীরবে কেঁদে ফেলছেন। এসময় সাদাত দৌড়ে এসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো সামলে পাশের সিটে বসতেই সারহান দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিল। অরিত্রিকা কাতরাচ্ছে, কিন্তু তার অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয়ের চাহনি নিবদ্ধ নেতাসাহেবের দিকে। সে উপলব্ধি করছে মানুষটার মনের অবস্থা। তবুও অদ্ভুত ভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে— যদি এটাই হয় তাদের শেষ দেখা!একই সময়ে আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেব আরেকটি গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছেন। বাড়িতে ইরফানকে রেখে আসতে হয়েছে, কারণ রাহা আর ইশরা যায়নি। ইতোমধ্যেই আবির খবর পেয়েছে। সে অরিনকে বাড়িতে রেখে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবে।

চৌধুরী বাড়ি থেকে হসপিটালের দূরত্ব প্রায় দশ মিনিটের। কিন্তু সারহানের দ্রুত গাড়ি চালানোর কারণে তারা মাত্র সাত মিনিটেই সেখানে পৌঁছে যায়। হসপিটালে ঢুকতেই নার্সরা তৎপর হয়ে অরিত্রিকাকে স্ট্রেচারে তুলে সরাসরি ওটিতে নিয়ে যায়। ডক্টর মনজুর পূর্বপরিচিত হওয়ায় কোনো আনুষ্ঠানিক জটিলতা পোহাতে হয়নি। তার ওপর, আসার আগেই তাকে ফোন করে সব খবর জানানো হয়েছিল।এদিকে আবির অরিনকে চৌধুরী বাড়িতে রেখে দ্রুত চলে এসেছে। তার সঙ্গে মুনও আছে। হসপিটালে এসে তারা দেখে, চৌধুরী পরিবারের সবাই ইতোমধ্যেই ওটির সামনে অপেক্ষা করছে। সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সারহান ও আজমল সাহেবকে সেখানে দেখা গেল না। আবির চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। কিছুটা দূরে বসার জায়গায় দুজনকে দেখে সে আর দেরি করল না— সোজা সেদিকেই এগোল। মুনও পেছন পেছন অনুসরণ করল।

“সারহান! শান্ত হও। অরিত্রিকার কিছু হবে না।”
সারহান নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে বসে ছিল। আজমল সাহেবের কথায় মাথাটা তুলে তাকাল। তার দু’চোখ রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। মুখাবয়ব বিবর্ণ হয়ে হয়ে। কিছুক্ষণ পূর্বে ডক্টরের থেকে খবর পেয়েছে অরিত্রিকার কন্ডিশন কিছুটা ক্রিটিকাল। নরমাল ডেলিভারির চান্স কম। তবুও চেষ্টা করবেন নয়তো সিজার করবেন। এতোটুকু শুনে তার অবস্থা বেহাল। সে আর কথা না শুনেই দূরে এসে বসেছে। মনে মনে, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে যেন তার অর্ধাঙ্গিনী এবং বাচ্চার কিছু না হয়। তার এ মুহুর্তে বারবার মনে পড়ছে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে অরিত্রিকার ব্যথাতুর কন্ঠে বলা কথাগুলো;

“আমার যদি কিছু হয়ে যায় আপনি আমাদের বাবুদের আগলে রাখবেন নেতাসাহেব। অনেক ভালোবাসবেন আর আমায় আপনার স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখবেন। আমায় ভুলে যাবে না বাবুর বাবা।”
আরেকটু থেমে বলেছিল;
“আমায়.. একটু জড়িয়ে ধরবেন কল্পপুরুষ।”
কল্পপুরুষ শব্দটা ঝংকার তুলেছিল পুরুষালি অন্তঃকোণে। মেয়েটা সহজে এ নামে ডাকে না। তবে সে জানতো মেয়েটা, কল্পনায় যে কল্পিত পুরুষকে নিয়ে নানা ভাবনায় মত্ত হতো সেসব ডায়েরির পৃষ্ঠায় লিখে রাখত। সত্যি, কি সে নিভৃতসুধার কল্পপুরুষ?হয়তো!সারহান অরিত্রিকার ওমন অবস্থা দেখেও ছিল শক্ত। মেয়েটার সামনে ভাঙতে দেয়নি। সবাই সেথায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাদের পরোয়া না করে দৃঢ় ভাবে আলিঙ্গন করেছিল। কপালের মধ্যাংশে উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলেছিল;

“সৃষ্টিকর্তার ওপর আমার অটল ভরসা আছে। আমি জানি, উনি কখনো খারাপ কিছু হতে দেবেন না। তুই ফিরবি… আবারও আমার বুকে ফিরবি, ফাইরুজ। আমরা সংসার গড়ব, আলহানকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেব। এভাবে আমাদের স্বপ্নের সংসারের সমাপ্তি হতে পারে না… কখনোই না…”
অরিত্রিকা অতি কষ্টেও হেসেছিল। কি মায়াবী হাসি!সেই দৃশ্য এখনো ভাসছে চক্ষুপটে। আজমল সাহেব ভেতরে ভেতরে চিন্তিত। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। সারহান চাচার দিকে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল;
“আমি শান্ত হতে পারছি না… আমার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।”
আজমল সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করে বললেন;
“তোমার কোনো দোষ নেই সারহান। ওপরওয়ালা চেয়েছিলেন তাই এতো বড় সুখবর পেয়েছিলাম আমরা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অরিত্রিকার কিছু হবে না।”

সারহান নীরব রয়। আজমল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলেন আবির ও মুন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এগিয়ে গেলেন তাদের সামনে। আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন;
“তোমার বন্ধুকে শান্ত করো।”
আবির মাথা দুলিয়ে এগিয়ে যায়। আজমল সাহেব না দাঁড়িয়ে ওটির সামনে গেলেন। মুন বন্ধুর ওমন অবস্থা দেখে মন খারাপ করে সেদিকটায় গেল। সে প্রথমবার সারহানকে এতোটা ঝিমিয়ে যেতে দেখেছে।
আবির গিয়ে বসল৷ সারহানের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল;

“এতো টেনশন করিস না দোস্ত! শালিকা আর আলহান বাবার কিছু হবে না৷ ওরা একদম সুস্থ থাকবে।”
সারহান নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় শুনল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল ওটির দিকে। সরাসরি গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াল। আরশাদ সাহেব ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। কতোক্ষণব্যাপী বোঝাল অথচ ছেলেটা তেমন কথা বলছে না। তানিয়া বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বললেন;
“চিন্তা করিস না বাপ! সবকিছু ভালো হবে ইনশাল্লাহ। ”
সারহান মায়ের পানে তাকাল। কন্ঠে শঙ্কা নিয়ে অস্ফুটস্বরে আওড়ালো ;
“আমার ফাইরুজ, আমার বাচ্চা… মা।”
তানিয়া বেগমের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। তবুও ছেলের মুখে আদুরে হাত বুলিয়ে সংযত কন্ঠে বললেন;

“ওরা সুস্থ থাকবে।”
“ফাইরুজ কতো পাচ্ছে অথচ আমি কিছু করতে পারছি না।”
“তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেন বাপ? নিজেকে একটু স্বাভাবিক কর।”
সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে। নির্জীব চাহনিতে ওটির দিকে তাকায়। পনেরো মিনিট হয়ে গেল অথচ কোনো আপডেট নেই। মনে মনে সে অধৈর্য হয়ে উঠল। কখন তার স্ত্রী, সন্তানকে দেখতে পারবে? তাদের দেখে এ অশান্ত মনটা শান্ত করবে? সাদাত এককোণে বসে আছে। ইশরাকে এদিককার আপডেট জানাচ্ছে। মেয়েটা একটু পর পর কল করছে পরিস্থিতি জানার জন্য। ইশরা বাদেও সারহানের বন্ধুমহলের সবাই বন্ধুকে কল দিয়ে না পেয়ে তাকে কল করছে।

চৌধুরী বাড়ির সবাই তখন ওটির সামনে উৎকণ্ঠায় পায়চারি করছে। কিছুক্ষণ আগেই ভেতর থেকে ভেসে এসেছিল নবজাতকের কান্না, সেই কান্না নতুন অতিথির আগমনের আনন্দঘন খবর জানিয়েছে। তবে অরিত্রিকার অবস্থা না জেনে কারও মন শান্ত হচ্ছে না। লাল বাতি হঠাৎ নিভে যেতেই সবাই সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সারহান সবার আগে এগিয়ে গিয়ে উৎকণ্ঠিত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই ওটির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ডক্টর অরুনিতা । ধীরে ধীরে মুখের মাস্ক ও গ্লাভস খুলতে খুলতে তিনি সবার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। সারহান উদ্বিগ্ন ভাব দমিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল;

“ডক্টর আমার ওয়াইফ.. কেমন আছে?”
ডক্টর অরুনিতা শান্ত চাহনিতে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন;
“অরিত্রিকা সুস্থ আছে। অজ্ঞান হয়ে আছে। জ্ঞান ফিরলে দেখা করবেন আর বাচ্চারা সুস্থ আছে। কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার চৌধুরী। ”
সবাই শুকরিয়া আদায় করল ওপরওয়ালার। সারহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার বুকের ঝড়টা যেন থামল। সে তৃপ্ত শ্বাস ফেলল। শান্ত কন্ঠে বলল;
“ওর কি সিজার…”
কথার মাঝেই ডক্টর বলে উঠলেন ;
“নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। দ্রুত মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।”

কথাটা বলে হেসে ডক্টর চলে গেলেন। সবার চোখেমুখে তখন অনাবিল আনন্দের আভা। ঠিক সেই মুহূর্তে ওটির দরজা আস্তে খুলে বেরিয়ে এলো নার্স। তার হাতে সাদা তোয়ালে জড়ানো সদ্য জন্মানো ছোট্ট বাবু। দৃশ্যটা দেখে চারপাশে আনন্দ বিস্ফোরিত হলো। সাদাত তো উৎফুল্ল হয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাতিজাকে কোলে নেবার জন্য, কিন্তু নার্স মৃদু হেসে তাকে সরিয়ে দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল বাচ্চার বাবার কাছে।
সারহান এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তার শীতল চাহনি নিবদ্ধ হলো শিশুটির দিকে। বাবুটি কেমন বিস্ময়ভরা চোখ মেলে পিটপিট করে আশপাশ দেখছে। সেই দৃষ্টি যেন সারহানের বুকের গভীরে শীতল শিহরণ বইয়ে দিল। অবর্ণনীয় এক আবেগ তাকে গ্রাস করল এটাই হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতি।
“স্যার আপনার ছেলে। বাবুকে কোলে নিন।”

কথাটা বলে নার্স বাবুটাকে এগিয়ে দিল। সারহানের হাত কাঁপছিল।তবুও সেই কম্পনকে জয় করে সে সাবধানে নিজের বুকে আগলে নিল ছোট্ট শরীরটাকে। মুহূর্তেই বুক ভরে উঠল অদ্ভুত উষ্ণতায়।চোখ ভিজে গেল নিখাদ সুখে। আঙুলের ডগা দিয়ে সে স্পর্শ করল নবজাতকের নরম দুটি হাত। গোলগাল ফর্সা মুখটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো এ যেন তার আর অরিত্রিকার মিশ্র প্রতিচ্ছবি।সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে কোলে নেবার এ অনুভূতি ভাষাহীন আনন্দে ভাসিয়ে দিল তাকে। ওষ্ঠ কোণে নিঃশব্দে ফুটে উঠল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিল কপালটায়। কোমল কন্ঠে আওড়ালো ;

“আমার বাবা, আমার আহলান!”
ছোট্ট বাচ্চাটি কি বুঝল, কে জানে? হঠাৎ করেই মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটে। তারপরই বাবার আঙুল শক্ত করে চেপে ধরল। সারহান থমকে গেল।চোখ নামিয়ে তাকাতেই দেখল ক্ষুদ্র হাতের দৃঢ় স্পর্শ। মুহূর্তটা এতটাই সুন্দর, এতটাই আবেগঘন যে সারহান যেন সময়ের গতিপ্রকৃতিই ভুলে গেল।কিন্তু সেই মোহনীয় আবহ ভেঙে গেল সাদাত আর আবিরের কাণ্ডে। দু’জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাবুটাকে কোলে নেবার জন্য, একরকম লম্ফঝম্প শুরু করে দিল। তাদের উৎসাহে চারপাশ আবার হাসি-আনন্দে ভরে উঠল।
“ভাই, আমার ভাতিজাকে দাও দ্রুত, কোলে নিব।”
সাদাত অধৈর্য হয়ে বলল। তখুনি আবির বলে উঠল ;

“আমায় দে দোস্ত। তোর ডুবলিকেটকে একটু কোলে নিয়ে গাল টেনে দেই। ওলে লে আমার বন্ধুর ছানাটাহ!”
সারহান চোখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারল চারপাশের সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ তার কোলে থাকা ছোট্ট আহলানের দিকে। প্রত্যেকে মুখিয়ে আছে বাবুটাকে কোলে নেবার জন্য। কিন্তু সারহানের নিজের মনে অদ্ভুত টান আহলানকে বুক থেকে আলগা করার সাহসই পাচ্ছে না।
ঠিক তখনই আজমল সাহেব এগিয়ে এলেন। স্নিগ্ধ হাসি মুখে বললেন,
“দাও তো, নাতীকে একটু কোলে নিই।”

সারহান চুপ করে রইল। মন থেকে দিতে ইচ্ছে করছে না, তবুও বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে শিশুটিকে তুলে দিল চাচার হাতে। ছোট্ট আহলান অন্য কারও বুকে যেতেই সারহানের বুকের ভেতরটা হালকা শূন্যতায় ভরে গেল। মুহূর্তেই মনটা খানিকটা খারাপ হয়ে উঠল।
“স্যার আপনার মেয়ে।”
আরেকজন নার্স এসে সামনে এসে দাঁড়াল। তার কোলে মোড়ানো ছিল আরেকটি নবজাতক। একেবারে ছোট্ট, সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়ে বাচ্চা। “আপনার মেয়ে” শব্দটা শুনতেই মুহূর্তে সারহান চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠল। চোখ থমকে গেল নার্সের কোলে থাকা শিশুটির দিকে। সাদা তোয়ালের ভাঁজে মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কেবলমাত্র গোলাপি আভা মেশানো ছোট্ট চিবুক আর নড়াচড়া করা আঙুলগুলো দৃশ্যমান।সারহান হতভম্ব ভাব নিয়ে উচ্চস্বরে বলল;

“আমার মেয়ে মানে?”
নার্সটা একটু ভড়কে গেল। তবুও হাসি বজায় রেখে বলল;
“হ্যা স্যার আপনার মেয়ে। কোলে নিন।”
সারহানের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল। তার মেয়ে মানে? সে তো জানে তার ছেলে হবে? এখন আবার মেয়ে কোথায় থেকে আসলো। অন্য কারো বাচ্চা ভুলবশত বাচ্চার বাবা মনে করে তাকে দিচ্ছে না তো? সে ভাবাবেগ সামলে নিল। সংযত কন্ঠে বলল;
“দেখুন, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বাচ্চা ওই দেখুন। এটা নিশ্চয়ই অন্য কারো বাচ্চা। আশেপাশে খুঁজে দেখুন বাচ্চার বাবাকে।”
নার্স হেসে দিল;

“আপনি তো এমপি তাই না?”
সারহান স্বাভাবিকতা টেনে বলল;
“জ্বি।”
“তাহলে বাচ্চার বাবা ঠিকই আছে।”
“বললাম তো আমি বাচ্চার বাবা নই।”
সারহান ঠান্ডা কন্ঠে বলল। আবির কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে এসেছিল। কথোপকথন শুনে মাথায় হাত দিল।আরশাদ সাহেব এগিয়ে আসলেন। দুজনকে কথোপকথন করতে দেখে বলে উঠলেন;
“কি হচ্ছে? ”
সারহান গম্ভীর কন্ঠে বলল;

“উনার কোলে বাচ্চাটা নাকি আমার। অন্য কারো বাচ্চা হবে হয়তো অথচ মানতেই চাচ্ছেন না।”
আরশাদ সাহেব স্বর টেনে বললেন;
“তোমার দ্বারা সব সম্ভব।”
“মানে? আমি কি করলাম?”
“একের পর এক যে ঝটকা দিচ্ছ। তাতে পুরো চৌধুরী ভিলার মানুষ নড়চড়ে উঠছে।”
“এসব কথা পরেও বলতে পারবেন।অন্যকারো বাচ্চার বাবা বানিয়ে দিচ্ছে। উনার সাথে বলে দ্রুত কনফিউশান দূর করুন।”
“আজব ছেলে! অন্যকারো বাচ্চা কেন হতে যাবে আমার নাতনি? তোমার বাচ্চা তুমি কোলে নাও।”
সারহান তাজ্জব বনে গেল। আশ্চর্যিত কন্ঠে বলল;
“আমার বাচ্চা মানে?”

নার্স একপ্রকার জোর করে সারহানের কোলে বাচ্চাটাকে কোলে দিয়ে চলে গেল। তখুনি বাচ্চাটা ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল। সে এবার ভালোভাবে মুখের দিকে তাকাল। মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাচ্চাটা দেখতে হুবহু আহলানের মতো। তারমানে সে দুই বাচ্চার বাবা! তার ভেতরটা টলে উঠল। এমন ঝটকা পেয়ে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগল। চৌধুরী বাড়ির সবাই এসে জড়ো হলো সামনে। হেসে একযোগে টেনে বলল;
“সারপ্রাইজ…. ফাইরুজের নেতাসাহেব।”
সারহান তখনও স্তব্ধ হয়ে আছে। তার স্তম্ভিত চাহনি কোলের বাচ্চার দিকে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে বিমূঢ়তা। আরশাদ সাহেব হেসে বললেন ;

“রিসেপশের দিন আমাদের সারপ্রাইজ দিয়েছিলে। সেটার শোধ তুললাম। শুধু তুই আমাদের ঝটকা দিতে পারো—এমপি সাহেব! আমরাও তোমায় ঝটকা দিতে পারি। বিয়ে করতে দেরি অথচ দুই বাচ্চার বাপ হতে দেরি নেই।”
আবির দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল;
“ইয়ে শ্বশুরআব্বা, এক বাচ্চার বাপ হতে গিয়ে দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাওয়াকে বলে টেকনোলজিয়া।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৩ (২)

সারহান ভ্রান্ত চাহনিতে চারপাশে তাকিয়ে রইল। সবার মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে আর দেরি হলো না অরিত্রিকার জমজ সন্তান হওয়ার খবরটা আগে থেকেই তারা জানত, অথচ ইচ্ছে করেই তার কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। এতো বড় খবর অথচ বাবা হয়ে সে টেরই পেল না! মুহূর্তে বুকের ভেতর অদ্ভুত আবেগ ছড়িয়ে গেল। তার ঘর আলোকিত করে এসেছে রাজপুত্র আর রাজকন্যা ভাবতেই মনটা ভরে উঠল দ্বিগুণ আনন্দে। আগের সব ভালো লাগাকে ছাপিয়ে নতুন মমতায় ভিজে গেল তার সত্তা। ঠিক তখনই নবজাতকের কান্নার শব্দ ভেসে এসে ছেদ ফেলল তার চিন্তায়। সারহান শান্ত চাহনিতে সন্তানের দিকে তাকাল। ভেতরটা ভরে উঠল অবর্ণনীয় অনুভূতিতে। বিস্ময় ভাব গিলে হাসল। বাবুর কপালের মধ্যাংশে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে স্নেহ পূর্ণ কন্ঠে আওড়ালো;
“আমার আম্মা!”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪ (২)