প্রণয় আসক্তি পর্ব ১৪

প্রণয় আসক্তি পর্ব ১৪
লেখিকাঃমাহযাবীন

আর্শের শরীর মৃদু কাঁপছে।ছেলেটি একটু পর পর নিজের নিচের ওষ্ঠ কামড়ে ধরছে,নিঃশ্বাস টাও ঘন হয়ে আছে তার।সেই সাথে নিজের দু’হাত ডলে চলছে সে।
আর্শের এমন অস্বাভাবিক আচারণ অবাক চোখে দেখে চলছে মিয়ামি।এর আগে কখনো আর্শের এমন অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী হয়নি সে।নিজের দৃষ্টির সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে হৃদয়ে এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মিয়ামির।না সে এটি সহ্য করতে পারছে আর না আর্শকে এ যন্ত্রণা দিয়ে মুক্ত হতে সাহায্য করতে পারছে।শুধু তার অসহায় দু’নয়ন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে চলছে।

আর্শ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতেই মিয়ামিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কেনো এসেছে, মিয়ু?প্লিজ চলে যাও এখান থেকে।
আর্শের কন্ঠও স্বাভাবিক নয়।তার কথার উত্তরে কিছু বলার মতো অবস্থাতে নেই মিয়ামি।সে অপলক তাকিয়ে আছে আর্শের দিকে।আর্শ আবারও বলে ওঠে,
-চলে যাও,প্লিজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর্শের ঠোঁট জোড়া মিয়ামিকে চলে যেতে বললেও ছেলেটির চোখ জোড়া যেনো তার কাছে সাহায্য চাইছে।চাইছে একটি প্রশান্তির স্থান যেখানে তার অস্থির হৃদয়ে দুদণ্ড স্বস্তি মিলবে।মিয়ামি,আর্শের চোখের এ আবদার দূরে ঠেলে দিতে অক্ষম।মেয়েটি আর্শকে একটু স্বস্তি দেওয়ার প্রচেষ্টায় ছেলেটির কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।যতটা নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরলে মানুষটকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়া যায় ঠিক ততোটাই নিবিড়ভাবে নিজের ভালোবাসাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে সে।

আর্শ তার শরীরের ভেতর যন্ত্রণা অনুভব করছে।তার বুকে মিয়ামির উপস্থিতিও এ যন্ত্রণা লাঘবে সফল নয়।আর্শ অনুভব করছে,ঠিক এই মুহূর্তে ড্রাগস না নিলে তার নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে যাবে।সে মিয়ামিকে জড়িয়ে না ধরেই অস্থির কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমি না পারছি না,মিয়ু।একটু খাই?প্লিজ?অল্প একটু?

আর্শের করুন স্বরের এমন মিনতি শুনে মিয়ামির যন্ত্রণা যেনো আরো বেড়ে গেলো।যার বহিঃপ্রকাশ তার চোখের অশ্রু কণা।মিয়ামির কোনো উত্তর না পেয়ে আর্শের অস্থিরতা আগের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেলো।সে অস্থির কন্ঠস্বরে দ্রুত বেগে বলে উঠলো,
-প্লিজ মিয়ু,প্লিজ।একটু খাবো,শুধু একটু।প্লিজ একটু?

কথাগুলো বলতে বলতেই অধৈর্য্য হয়ে আর্শ তার ঠিক সামনে বরাবর অবস্থিত দেওয়াটায় স্বজোরে একটি ঘুষি মারে।হটাৎ আর্শের এমন কাজে ভয়ে কেঁপে ওঠে মিয়ামি।তখনই আর্শকে ছেড়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে আর্শের হাতের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠে সে।ছেলেটির হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মিয়ামি দেরি না করে আর্শের হাতটি ধরতে যায় কিন্তু আর্শ নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে নেয়।কেমন যেনো দিশেহারার ন্যায় আচারণ করছে ছেলেটি।মিয়ামি আবারও আর্শের কাছে যেতেই আর্শ হাঁটু গেরে তার সামনে বসে পরে।টলমলে চোখ মাটিতে আবদ্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতেই বলে ওঠে,

-আমি আর পারছি না,মিয়ু।আমি সত্যিই পারছি না।
আর্শকে এতোটা কষ্ট পেতে দেখে,তার এতোটা অসহায়ত্ব দেখে মিয়ামি ভেতরে ভেতরেই ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে।সব কিছু ভুলে আর্শ তার কাছে যা আবদার করছে সেটির অনুমতি দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু এর অনুমতি দিলে তো আর্শ হেরে যাবে তার শত্রুর কাছে,হেরে যাবে তাদের প্রণয়,আর্শের শত্রু তার ড্রাগ আসক্তি জিতে যাবে আর মিয়ামির আর্শ আসক্তি হেরে যাবে।এটি তো কখনোই হতে দিবে না মিয়ামি।

পৃথিবীর সব কিছু ভুলে,দূরে ঠেলে দিয়ে নিজের মনের কথায় সায় দিয়ে আর্শের ঠিক সামনে বরাবর হাঁটু গেরে বসে পরে মিয়ামি।আর্শের কম্পিত শরীর,টলমলে চোখ, অস্বাভাবিক চাহনি সবটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আর একটি মুহূর্তও দেরি না করে দু’হাতে আর্শের গাল আঁকড়ে ধরে তার ঠোঁট জোড়া নিজ আয়ত্তে নিয়ে নেয় মিয়ামি।তার আনাড়ি ওষ্ঠদ্বয় যেনো আর্শের কষ্ট গুলোকে নিজের মাঝে টেনে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

মিয়ামির প্রণয়ের স্পর্শে ধীরে ধীরে আর্শ যেনো এক অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করছে।এক ঘোরের দুনিয়ায়।যে দুনিয়ায় শুধু সে,মিয়ামি এবং তাদের মধ্যবর্তী এক তীব্র অনুভূতি।আর্শ সময়ের সাথে সাথে পুরোপুরি মিয়ামির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে।নিজের দু’হাতে আলতো করে মিয়ামির কোমর আঁকড়ে ধরেছে সে।চোখজোড়া বুজে নিয়ে সেও যেনো মিয়ামি নামক ঘোরে বিলীন হয়ে নিজের কষ্টগুলোকে সমাধি দিয়ে প্রিয় মানুষটির মাঝে প্রশান্তি খোঁজায় মত্ত হয়ে গিয়েছে।

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপে ফেসবুক চালাচ্ছে বিহান।আর্শি সেই যে আইডি ডিএক্টিভ করে গেলো তারপর ২-৩ দিন হয়ে গিয়েছে এখন অব্দি একবারও আইডিতে এক্টিভ হয়নি।বিহানের খুব মনে পরছে মেয়েটির কথা।

যথেষ্ট ভালো বন্ধু ছিলো তারা।সকালের গুড মর্নিং দিয়ে রাতের গুড নাইট অব্দি কথা হতো তাদের।প্রতিদিনই কিছু না কিছুর ছবি দিতো সে মেয়েটিকে।যেমন-নিজের গার্ডেনের বা নিজের রান্না করা কোনো খাবারের বা নিজেরই।কোথাও ঘুরতে গেলে তো অসংখ্য ছবি পাঠাতো সে,মেয়েটিকে।আর মেয়েটিও ছবি পেয়ে খুশি হয়ে যেতো।যা তার টেক্সটেই বুঝতো বিহান।আর্শির সাথে কথা বলতেও ভালো লাগতো তার।মেয়েটিকে সামনাসামনি কখনো না দেখলেও তাদের দু’জনের বন্ধুত্বটা যথেষ্ট মজবুত ছিলো।মেয়েটির সাথে কতশত গল্প করতো সে,কত গেম ও তো খেলেছে তারা একসাথে।এমন সব স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়ে পরলো বিহান।

স্মৃতিচারণ করতে করতেই বিহান ফেসবুকের একটি অপশনে ঢোকে।যেখান থেকে দেখা যায় কে কে তার প্রোফাইল ভিজিট করেছিলো।এই অপশনটিতে প্রায়ই ঢোকে সে বিনা কারণে।
এখন এ অপশনটিতে ঢুকে ভিজিটর লিস্টে চোখ পরতেই চমকে ওঠে বিহান।আর্শির মায়ের আইডি থেকে কেউ একজন এই ২-৩ দিনে ৪-৫ বার তার প্রোফাইলে ভিজিট করেছে।বুঝতে আর বাকি থাকে না যে এই কেউ একজন টা অবশ্যই আর্শিই।

মুহূর্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে বিহানের।মেয়েটি রাগ করে আইডি ডিএক্টিভ করলেও তার চিন্তা করা এখনো ছাড়েনি মেয়েটি।সে যেমন আর্শিকে মিস করছে ঠিক তেমনই মেয়েটিও তাকে মিস করছে।
এদিকে,মিয়ামিকে সবার অগোচরে গৃহে প্রবেশ করিয়ে আর্শি সোজা নিজ কক্ষে চলে আসে।কাবাবে হাড্ডি হওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে তার নেই।

নিজ কক্ষে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সে।ঠোঁটে একটু হাসি ফুটে আছে তার।এ হাসিটির কারণ মিয়ামি ও তার বাচ্চামি।একটু আগে ফোন কলে মিয়ামির বলা কথা আবার এতো রাতে প্রিয় মানুষটিকে এক নজর দেখতে এতোটা ঝুঁকি নিয়ে ও বাসা থেকে এ বাসা অব্দি চলে আসা,এসব নিয়ে ভাবছে সে।আর্শ আর মিয়ামিকে দেখে বেশ ভালো লাগে তার।এদের মাঝের ভালোবাসা টা দেখে আর্শির মনেও প্রশান্তি জায়গা করে নেয়।

কিন্তু মনে মনে প্রশ্নও জাগে মিয়ামি,আর্শকে যতটা ভালোবাসে তার থেকে কোনো অংশে কি কম ভালোবেসেছিলো সে বিহানকে?কেনো মিয়ামির ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা আর তার ভালোবাসায় মাঝ পথে বিচ্ছেদ!
এসব ভাবতে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় তার।সেই সাথে বিহানকে খুব করে মিস করতে আরম্ভ করে সে।অতঃপর বিহানকে এক নজর দেখার মনোবাসনা নিয়ে নিজের মায়ের আইডিতে লগ ইন করে আর্শি।

মিয়ামির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আর্শ।পেটে মুখ গুঁজে দু’হাতে মিয়ামির কোমর আঁকড়ে ধরে আছে সে।মিয়ামি ধীরে ধীরে আর্শের মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে।তার হাতের আলতো স্পর্শে এক প্রশান্তিময় ঘুমে বিভোর হয়ে গিয়েছে আর্শ।

কিন্তু মিয়ামির চোখে এক বিন্দু পরিমাণ ঘুম নেই।তার চোখের সামনে ঐ সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত ভেসে চলছে।আর্শের ওমন অস্বাভাবিক আচারণ, অস্থিরতা, অসহায়ত্ব কোনোটিই ভুলতে পারছে না সে।
তখন,ছেলেটি তার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হয়।প্রায় অনেকটা সময় পর সে মিয়ামির থেকে সরে এসে বিনা বাক্য ব্যয়ে মিয়ামির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে।

প্রণয় আসক্তি পর্ব ১৩

ও সময়,কয়েক ফোঁটা অশ্রু কণাও আর্শের চোখ হতে গাল গড়িয়ে মিয়ামির কোলে সমাধিত হয়েছিলো।এ প্রথম আর্শের চোখের পানি দেখে মিয়ামির ভেতরের যন্ত্রণা টা যেনো কয়েকশো গুণ বৃদ্ধি পেয়ে যায়।আর্শের কয়েক ফোঁটা চোখের জলের সমাধি দেখে মিয়ামির কয়েকশো অশ্রু কণা সমাধিত হয় তখন।সে আলতো হাতে আর্শের চোখের জল মুছে দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে আর্শের চোখের উপর চুমু একেঁ দেয়।এতে আর্শ আরো নিবিড়ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে।

ঘুমন্ত আর্শের চেহারা পানে তাকিয়ে তার মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতেই বিভিন্ন চিন্তেরা এসে জায়গা করে নিচ্ছে মিয়ামির মনে।এখন যখন সে এ আসক্তির ভয়াবহতা নিজ চোখে দেখে উপলব্ধি করেছে তখন সে অনতিবিলম্বে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার গুরুত্ব টা অনুভব করছে।সেই সাথে আরো একটি বিষয়ে অনুশোচনা কাজ করছে মিয়ামির মাঝে।এখন অব্দি আর্শ ও তার বিয়ে সম্পন্ন হয়নি তবে এতোটা কাছে আসা টা কি অনুচিত নয়!অবশ্যই অনুচিত কিন্তু কি করতো সে তখন!আর কোনো উপায় তো খুঁজে পাচ্ছিলো না সে।হয় ড্রাগস এর কাছে হেরে যাওয়া নাহয় একটি অনুচিত কদম।এ দু’য়ের মাঝে মিয়ামি দ্বিতীয় টি বেছে নিয়েছিলো।কারণ সে ওয়াদা করেছিলো তার প্রিয়কে,তার আর্শ আসক্তি জিতবেই।

প্রণয় আসক্তি পর্ব ১৫