প্রণয় আসক্তি পর্ব ২২

প্রণয় আসক্তি পর্ব ২২
লেখিকাঃমাহযাবীন

পড়ার টেবিলের পুরোটা জুড়ে বই-খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে পড়ছে আর্শি।অনেকে বলে,গণিতে ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা নাকি বই-খাতা এমন অগোছালো করেই পড়ে।আর এরা নাকি সব ক্ষেত্রেই এমন অগোছালো হয়।এই উক্তিটির সাথে পুরোটাই অমিল আর্শির।সে ছাত্রী ভালো হলেও গণিত তার কাছে ভয়ের অপর নাম।এতে এটিই প্রমাণিত হয় যে,ঐ উক্তিটির আসলে কোনো ভিত্তি নেই নতুবা এমনও হতে পারে যে,আর্শি অনন্য।

পড়ার মাঝেই আর্শি নিজের বিছানাটার দিকে এক পলক তাকায়।বিছানার চাদর টা ঠিকঠাক বিছানো নেই,বালিশ গুলো পুরো বিছানাটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,উপন্যাসের ২-৩ টি বইও বিছানায় অগোছালো পরে আছে।এসবে চোখ বুলোতে বুলোতেই আর্শির বিহানের রান্নাঘরের কথাটি মনে পরে যায়।ছেলেটির রান্নাঘর দেখলে মনেই হয় না যে,ঐ টা কোনো এক ব্যাচেলর ছেলের রান্নাঘর।ছেলেটি বাসায় একাই থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার ঘর সবসময় গোছালো,পরিপাটি।আসলে পেশায় ডাক্তার হলেও নিজের বাবার সম্পদ ও পৈতৃক বাড়ি দেখাশোনার জন্য বিহান নিজের দেশের বাড়িতেই থাকে।সেই সাথে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের বিনে পয়সায় চিকিৎসাও প্রদান করে সে।তার মা ও বোন নিশি থাকে ঢাকায়।মাঝে মধ্যে বিহানের ঢাকায় আসা হয় বেড়াবার উদ্দেশ্যে।

ছেলেটি একা থাকলেও তার ঘরের অবস্থা দেখলে কেউ বলবে না যে এই বাড়িটিতে কোনো মহিলা বা মেয়ে ছাড়া শুধু মাত্র একজন পুরুষের বসবাস।খুব সুন্দর করে নিজের বাড়ি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে বিহান।আর বিহানের এমন হাজারো মনোমুগ্ধকর গুণে মুগ্ধ আর্শি।ছেলেটি অনন্য,অন্য সব ছেলেদের থেকে আলাদা।আর্শি আজ অব্দি কখনো বিহানের সাথে তার চেনা বা পরিচিত অন্য কোনো পুরুষের মিল পায়নি।তাই ই তো বিহানের প্রতি এতোটা আকৃষ্ট সে।

আর্শির ভাবনার মাঝেই মিয়ামি তার কক্ষে প্রবেশ করে।ঠোঁটে হাসি নিয়ে আর্শিকে ডেকে উঠে সে,
-দোস্ত?
মিয়ামির কন্ঠ কানে আসতেই ঠোঁটে হাসি টেনে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর্শি।মিয়ামি আর্শির পাশে এসে বসতেই আর্শি বলে ওঠে,

-এতো দিনে বরের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ননদের কাছে আসার সুযোগ হলো আপনার?
-আরেহ,শুধু কি বর?রুমে পরে থাকি তো পড়াশোনার জন্য। কত্তো পড়া জমে গিয়েছে আমাদের! তুই নিজেও তো রুম দিয়ে বের হোস না।
-হো,পড়া রেখে উঠার সময় কই? তা আমি ফুপু কবে হচ্ছি?
শেষের কথাটি বলেই মিয়ামির দিকে তাকিয়ে চোখ মারে আর্শি।উত্তরে মিয়ামি ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-তোর নিরামিষ ভাই আর তা হওয়ার সৌভাগ্য দিবে বলে মনে হয় না।
মিয়ামির উত্তরে হেসে ওঠে আর্শি।হাসি না থামিয়েই বলে ওঠে,

-আগেই বলছিলাম এই নিরামিষরে দিয়ে তোর পোষাবে না!
-থাকুক না ও নিরামিষ! আমিষ হিসেবে আছি না আমি?তুই চিন্তা করিস না তোরে ফুপু বানানোর দায়িত্ব আমার।
মিয়ামির এবারের উত্তরে জোরেসোরে হেসে ওঠে আর্শি।বান্ধবীর মাথায় আলতো করে বারি মেরে সে বলে ওঠে,
-লজ্জা সরম নেই তোর?
-ঐটা আবার কি জিনিস?খায় না মাথায় দেয়?

উত্তরে আর কিছু বলে না আর্শি।তার ঠোঁটে সেই হাসি টা লেগে আছে।মিয়ামির ঠোঁটেও হাসি ফুটে আছে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই মিয়ামি তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
-ওহ হো,গুরুত্বপূর্ণ কথাটিই তো জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না! আচ্ছা, নিশির ভাই,বিহান ভাইয়াই তোর এফবির বিহান না?

উত্তরে মাথা উপর নিচ করে সম্মতি দেয় আর্শি।আর্শির সম্মতি মিলতেই ঠোঁটে বড়সড় হাসি ফুটে ওঠে মিয়ামির।সে উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ওয়াও! বিহান ভাইয়াকে আমার অনেক ভাল্লাগছে। তোর জন্য একদম পারফেক্ট!
মিয়ামির কথায় একটু লজ্জা লজ্জা লাগলেও মন খারাপের সুরে আর্শি বলে ওঠে,
-উনি তো আমাকে ভালোবাসেন না।

-ভাইয়া কি এটা বলসে সোজাসাপটা বলছে তোরে?
-না কিন্তু ভালোবাসিও তো বলেনি।
-বলেনি তাতে কি? বলবেই বলবে।
মিয়ামির কথায় ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শির।এ কথায় একটু ভরসা খুঁজে পাচ্ছে সে।তবে,বেশ কয়েক দিন ধরে বিহানের ব্যবহার কেমন যেনো ঠেকছে আর্শির।ছেলেটা কেমন অধিকার ফলায় তার উপর আবার মাঝে মাঝে এমন সব কথায়ও শেয়ার করে যা মানুষ নিজের খুব কাছের মানুষের সাথেই শেয়ার করে।এসবে আর্শির মনে একটু একটু আশা জেগেছে যে,ছেলেটি হয়তো তাকে ভালোবাসে।

আর্শ কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।কাজের গতি আগের মতো নেই তার।কেমন যেনো উদাসীন ভাব বিরাজমান তার মাঝে।
সে প্রায় ১ বছরের বেশি সময় ধরে এ একটি অফিসেই কাজ করে চলছে।কাজে তার দক্ষতা, বিচক্ষণতা,নিষ্ঠা ও মনোযোগ দেখে অফিসের বস আর্শকে ভীষণ পছন্দ করেন।কিন্তু গত ২০-২৫ দিন ধরে তিনি যেনো এক ভিন্ন আর্শকে দেখছেন।এমন উদাসীন,নিস্তেজ আর্শকে তো তিনি চেনেনই নাহ।
বেশ কিছু টা সময় নিয়ে তিনি কিছু একটা ভেবে আর্শকে নিজের ক্যাবিনে ডাকেন।
প্রায় ৫ মিনিটে বসের ক্যাবিনে এসে উপস্থিত হয় আর্শ।

-আসসালামু আলাইকুম বস,ডেকেছিলেন?
-হ্যা আর্শ।বসো,কথা আছে তোমার সাথে।
বসের কথায় সম্মতি দিয়ে একটি চেয়ার দখল করে বসে পরে আর্শ।সময় অপচয় না করে বস বলে ওঠেন,
-তুমি যেমন সৎ,তেমনই পরিশ্রমী একটি ছেলে।হয়তো তুমি নিজেও বোঝো যে,তোমার এসব গুণ আমার কতো টা পছন্দনীয়।তোমার প্রতি আমি আস্থা রাখি,আর্শ।কিন্তু গত বেশ কয়েকদিন যাবত আমি লক্ষ্য করছি তোমার কাজের গতি কেমন যেনো ধীর হয়ে গিয়েছে।তুমি নিজেও কেমন যেনো ঝিমাও।এভাবে চললে তো সামনের প্রমোশন টা তুমি পাবে না।

এতোটুকু বলে থামেন বস।আর্শ মাথা নিচু করে সবটি শুনছে।নিজের সাথে সে যে কি এক গুরুতর যুদ্ধে লিপ্ত তা কেউ বুঝতে সক্ষম হবে না।যতোই যুদ্ধ ভেতরে ভেতরে চলুক তার কিছু প্রভাব বাইরেও তো প্রকাশ পাবেই।
একটু নিরব থেকে বস একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন,

-আমি তোমার ভালোটাই চাই,আর্শ।আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমায় উপদেশ দিবো যে,কিছু দিনের জন্যে তুমি ছুটি নিয়ে বাইরে দিয়ে কোথায়ও ঘুরে আসো।দু’সপ্তাহের ছুটি আমি দিয়ে দিচ্ছি।কোথায় ঘুরতে যাবা আমায় জানাও,সব খরছও আমিই বহন করবো।তবুও আমি আমার সেই আগের পরিশ্রমী,নিষ্ঠাবান,মনোযোগী স্টাফটাকে চাই।বুঝেছো?
-ধন্যবাদ স্যার,আমাকে শুধু ছুটি টা দিলেই অনেক উপকৃত হবো।ঘুরার খরচ টা বহন করবার কোনো প্রয়োজন নেই,ইট’স এন রিকুয়েষ্ট স্যার।
বস ঠোঁটে হাসি টেনে আর্শের কথায় সম্মতি দিলেন।

ঘড়িতে থাকা ঘন্টার কাটাটি এখন বারোর ঘরে অবস্থান করছে।রাতের এ সময় টিকে গ্রামে বলা হয়,”রাতদুপুর”।
বারান্দায় থাকা দোলনাটায় বসে আছে মিয়ামি।তার কোলেই মাথা রেখে শুয়ে আছে আর্শ।মিয়ামি আলতো করে আর্শের মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে।এতে আরামে নিজের চোখজোড়া বুজে রেখেছে আর্শ।আর এদিকে,মিয়ামি দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে নিজের প্রিয়কে।এই মানুষটিকে যতই দেখুক মন তো ভরবে না তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি।

আর্শ চোখবুঁজা অবস্থাতেই বলে ওঠে,
-পলক ফেলো এবার,চোখে পানি জমে গিয়েছে।
অবাক হয় মিয়ামি।পলক ফেলতেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে তার চোখ বেয়ে।কই সে তো কাঁদছে না তাহলে পানি কিসের! পর মুহূর্তেই মনে পরলো সে এতোক্ষণ এক দৃষ্টিতে ছেলেটিকে দেখায় ব্যস্ত ছিলো।ফলে অনেকটা সময় ধরে পলক না ফেলায় চোখে পানি জমে গিয়েছে।

কিন্তু আর্শ তো চোখ বুজে আছে তাহলে সে কি করে বুঝলো!এমনটি ভেবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মিয়ামি আর্শের দিকে।প্রশ্ন করবার জন্যে সে মুখ খুলতেই যাবে তার পূর্বেই আর্শ সোজা হয়ে শোয়া থেকে নিজের বাম দিকে অর্থাৎ মিয়ামির দিকে ফিরে শোয়।বাক্য ব্যয় না করে মেয়েটির পেটে নাক ডুবিয়ে দু’হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে সে।জামার উপর থেকে দু-তিনবার আলতো করে মেয়েটির পেটে নাক ডলতেই শিহরণে আর্শের কাঁধের কাছে শার্টের একটুখানি অংশ খামচে ধরে মিয়ামি।
ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে আর্শ মিয়ামিকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
-বন্ধ চোখেও তোমায় অনুভব করতে জানি,মিয়ু।

প্রণয় আসক্তি পর্ব ২১

আগের মতোই এখনো বিহানের সাথে আর্শির সেই সকাল থেকে রাত অব্দি কথা হয়।আর্শি আজকাল অনুভব করছে যে,সময়ের সাথে সাথে সে ও বিহান উভয়ই ধীরে ধীরে একে-অপরের আরো কাছে চলে আসছে।অর্থাৎ তাদের দু-হৃদয়ের মাঝের দূরত্বটা ধীরে ধীরে কমছে।আর্শি তো ভেবেছিলো সে বিহানের থেকে দূরে চলে যাবে।সেই সাথে বিহানকে সে শুধু একজন ভালো বন্ধু ভাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।কিন্তু তার পরিকল্পনার উল্টো হচ্ছে সব।যেখানে সে দুরত্ব বাড়াতে চেয়েছিলো সেখানে দুরত্ব কমেই চলছে।বিহানকে ঘিরে তার অনুভূতিগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলছে।

কিন্তু বিহানের মনে কি চলছে?সে তো জানে আর্শি তাকে ভালোবাসে তাহলে সে কেনো আর্শির থেকে দূরে চলে যাচ্ছে না?সে কেনো আগের থেকে এখন আর্শির বেশি যত্ন নিচ্ছে? কেনো অধিকার ফলাচ্ছে? ছেলেটি কি ভালোবাসে আর্শিকে? যদি ভালোবেসেই থাকে তবে তা মুখে স্বীকার কেনো করছে না?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসবই ভেবে চলছে আর্শি।এমন হাজারো প্রশ্ন এই মুহূর্তে তার মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।কিন্তু একটি প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই তার।বিহানকে প্রশ্ন করার ইচ্ছেটিও নেই তার কাছে।কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাটাও তো খুব প্রয়োজন।কি করা উচিৎ তার?

প্রণয় আসক্তি পর্ব ২৩