প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২০

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২০
অনুসা রাত

আরবাজের ঘরে বেশ বড় বড় দুইটা জানালা।বিছানার পাশেই ইয়া বড় একটা জানালা।এজন্যই সকাল হতেই সেই জানালা থেকে অনেক রোদ এসে চোখমুখে পড়ে।
ঠিক তেমনই রোদ এসে মেহেরের চোখেমুখে পড়তেই মেহেরের ঘুম ভেঙে গেল।চোখ খুলে সে নিজেকে আরবাজের বুকের মাঝে আবিষ্কার করলো।শীতের চোটে আরবাজ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।
মেহের আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো যে ঠিক কয়টা বাজে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল মেহের।সকাল ৯ টা বেজে গেছে!
এতক্ষণ যাবত সে ঘুমাচ্ছিলো।মেহের চেষ্টা করলো আরবাজের হাত সরাতে।কিন্তু এত ভারী হাত সে কিছুতেই সরাতে পারছে না।অবশেষে আর না পেরে মেহের ডাক দিলো আরবাজকে,

-“আরবাজ?উঠুননন।”
আরবাজ শুনলোও না। নড়বে তো দূর।মেহের আরবাজের হাত ঝাঁকিয়ে ডাকলো,
-“উঠুন না আরবাজ?”
আরবাজ এবার একটু নড়ে উঠলো।আরো কয়েকবার ডাক দিতেই আরবাজ মেহেরের দিকে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তাকালো।কিন্তু মেহেরকে এতটা কাছে দেখে আরবাজের ঘুম উবে গেল।তৎক্ষনাৎ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে বললো,
-“তুমি এখানে?”
ছাড়া পেয়ে মেহের ঠিকঠাক হয়ে বসলো।তারপর বললো,
-“আমি.. মানে…”
-“কয়টা বাজে?”
-“৯ টা।”
আরবাজের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।ফোন চেক করতে করতে বললো,
-“ওহ শিট!আমার অফিস আছে আজকে।”
বলতে বলতে আরবাজ বিছানা ছেড়ে নেমে গেল।মেহের উদগ্রীব হয়ে বললো,
-“আমাকে আগে বলতে পারতেন।”
-“নিজেই তো উঠছো নয়টায়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেহের চুপ হয়ে গেল।আরবাজ ওয়াশরুমে চলে গেল।আর মেহের বাইরে থেকে আওয়াজ পাচ্ছে।হয়ত বাইরে বেশ আয়োজন চলছে।আরবাজ বের হতেই মেহের ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।কিন্তু মেহের বের হওয়ার পর আরবাজকে পেল না।শুধু বিছানার উপর একটা প্যাকেট দেখতে পেল।মেহের সেটায় হাত দিত না যদি না উপরে তার নাম লেখা থাকত।প্যাকেট টা খুলে মেহের অবাক হয়ে গেল।কি সুন্দর কলাপাতা রঙের একটা জামদানী। আর সাথে মেচিং ব্লাউজ।
মেহেরের মনে পড়ে গেল সেম প্যাকেটটা সে সেইদিন আরবাজকে আনতে দেখেছিল।তারমানে সেটা মেহেরের জন্যই ছিল!
আরবাজের জন্য মেহেরের মনে একটা ভালো লাগা কাজ করলো।সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।নিজেকে চেনাই যাচ্ছে না।চোখে কাজল পড়তে পড়তেই হঠাৎ দরজা খুলে আরবাজ ঢুকলো।আর বলতে লাগলো,

-“মেহের তুমি কি….”
বলতে বলতে আরবাজের কথাটা মুখেই আটকে গেল।আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহেরের দিকে।আরবাজকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মেহের কাজল টা ড্রেসিংটেবিলে রেখে আরবাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিছু বলবেন?”
আরবাজ ঢোক গিললো।এক পা এক পা করে মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো,আর বলতে লাগলো,
-“তুমি এটা কেন পড়েছ?”
মেহের হাসার চেষ্টা করে বললো,
-“আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি?মানে..শাড়িটা কি আমার নয়?”
আরবাজ মেহেরের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল।আরবাজের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই মেহেরের।তাই চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।আরবাজ ধীর গলায় বললো,
-“শাড়িটা তোমার জন্যই ছিল।”
মেহের চোখ তুলে তাকালো আরবাজের দিকে।আরবাজের সেই চোখে আজ মেহেরের জন্য অন্যকিছু দেখতে পারছে মেহের।আরবাজ আবেশিত গলায় বললো,

-“এতটা আকর্ষণীয় লাগবে জানলে তোমাকে দিতাম না পড়তে।”
মেহের হাই ভোল্টের ঝটকা খেয়ে বললো,
-“জ্বীইই?”
আরবাজের হুশ এলো।চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি?কিছু বলবে নাকি?”
-“আপনিই তো কি সব বলছেন।”
-“আমি?কই কি বললাম আমি।”
আরবাজ আমতাআমতা করে কথা বলছে।মেহের চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“কিসব বলছেন।আকর্ষণীয় লাগছে।আবার বলছন কেন পড়লাম।আরে বাবা আমার জন্য আনসেন তাহলে পড়লে সমস্যা আছে?”
আরবাজ না চাইতেও বারবার মেহেরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। এই মেয়েটার এতগুলো রূপ কেন?
-“আপনি না অফিস যান?”
বলতে বলতে মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো।আরবাজ ঠিক মেহেরের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।ধীর গলায় বললো,
-“আমি আজ যাচ্ছি না।”
-“ওমা কেন?”
-“সেটা তোমাকে বলতে যাব কেন?”

মেহের আরবাজের সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা ওটা বলছে।কিন্তু আরবাজের কোনো পাত্তাই নেই।সে আয়না দিয়ে মেহেরকে দেখতে ব্যস্ত।এতটা ফিলিং তার কোনোদিন ই কারোর জন্য হয়নি।যতটা মেহেরের জন্য হচ্ছে। মেহেরের শাড়িটা যেন মেহেরের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরবাজকে চুপ করে থাকতে দেখে মেহেরও চুপ হয়ে গেল।আয়না দিয়ে আরবাজকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পেল।আর বিরবির করলো,
-“আবারো কেমন করে দেখছে।লজ্জা করে আমার।”
আরবাজ আরেকটু কাছে চলে এলো মেহেরের।মেহের বলতে লাগলো,
-“কিছু কি বলবেন আপনি?”
-“….”
-“মিস্টার আরবাজ?”(রাগ নিয়ে)
আরবাজ মেহেরের কাঁধে হাত দিলো।তারপর বলে উঠলো,

-“আমি তোমায় কিছু বলতে চাই মেহের।”
মেহের পিছনে ফিরলো।কৌতুহল নিয়ে বললো,
-“কি বলতে চান?”
-“আমি তোমাকে….”
মেহের উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো,
-“হ্যা বলুন না।”
-“আমি তোমাকে…”
-“আপনি কি বলবেন না আমি চলে যাব?”(বিরক্ত হয়ে)
-“আমি তোমাকে এটাই বলতে চাই যে তোমাকে পেত্নীর মত লাগছে।”
মেহের রাগ নিয়ে তাকালো আরবাজের দিকে।
আর আরবাজ হো হো করে হেসে উঠলো।মেহের রাগ করে বলে উঠলো,
-“থাকুন আপনি।গেলাম আমি।”

বলে যেতে নিলেই হাতে হাত অনুভব করলো মেহের।কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরবাজের বুকে এসে পড়লো।চোখ তুলে আরবাজের চোখে চোখ রাখতেই আরবাজ মুচকি হেসে বললো,
-“তোমার শাড়ির উজ্জ্বলতা যেন আলোকে চুপে চুপে হার মানায়। প্রতিটি পাতা, প্রতিটি আঁচল যেন এক নতুন গল্প বলে, আর তুমি সেই গল্পের প্রধান চরিত্র। তোমার নরম হাসি, কোমল চলনে এই পৃথিবী যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তোমার উপস্থিতি এমন এক অপূর্ব মায়াজালে বাঁধে, যে কেউ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য।”
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।আরবাজের কথাগুলো শুনে সে বেশ অবাক হলো।মনের মধ্যে ভালোলাগার ঢেউ বয়ে গেল।লজ্জায় গাল দুটো লাল হতে লাগলো।নিম্ন স্বরে বললো,

-“বাহ!আপনি এত সুন্দর করে প্রশংসা করেন জানতাম না তো?”
আরবাজ বাঁকা হাসলো।মেহেরের চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“তোমার চুল, সেগুলি যেন জগতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অঙ্গীকার। সেগুলি যেন ঝরঝরে রাতের অন্ধকারে ভেসে আসা এক চাঁদের আলো। যখন তুমি হেঁটে চলে, শাড়ির প্রতিটি প্রান্তের সঙ্গে তোমার চুলের ঝাঁকুনি যেন এক অনির্বচনীয় সঙ্গীত তৈরি করে। তোমার চোখের দীপ্তি আর চুলের মোহনীয়তা, শাড়ির সঙ্গে মিলে এমন এক মূর্তির জন্ম দেয়, যা মনকে অমোঘভাবে আকর্ষণ করে।”
মেহেরের মনটা কেমন করে উঠছে।আরবাজের বলা প্রতিটি লাইন মনের মধ্যে ভালো লাগা সৃষ্টি করছে।আর শুনতে মন চাচ্ছে।মেহের হালকা হেসে বললো,

-“আর?”
-“আর? হাহ!”(হেসে)
-“হাসার কি হলো?”
-“আর তোমার চোখ দুটি যেন গভীর মহাসমুদ্রের মতো, যেখানে ডুবে যাওয়ার মতো এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে থাকে, যেন প্রতিটি দৃষ্টি মূর্ত হয়ে ওঠে, আর আমি তা অনুভব করতে থাকি। তোমার চোখের সেই চাহনি, যেন এক নরম ঝর্ণার মতো, হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে যায়, আর মনে হয়, পৃথিবীর সব রং ওই চোখের মধ্যেই আবদ্ধ। যখন তোমার চোখ আমার দিকে তাকায়, তখন সময় থেমে যায়, আর আমি শুধু সেই চোখের অন্তরালে হারিয়ে যেতে চাই।”
-“ইশশ!”
বলেই মেহের চোখ বন্ধ করে নিল।আরবাজ ফু দিয়ে মেহেরের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিলো। আর মেহের নিজের অজান্তেই আরবাজকে জড়িয়ে ধরে বসলো।

মেহের ঘর থেকে বের হতে না চাইলেও আরবাজ মেহেরের হাত ধরে বের করে নিয়ে এলো।সবাই সোফায় বসে ছিল।মেহেরকে দেখে মীরা হা হয়ে গেল।আর বলতে লাগলো,
-“এ কি রূপে ধরা দিলে সখি।”
আনিয়া মীরার হাতে চিমটি কেটে বললো,
-“এই আস্তে বলো।”
মেহের আরবাজের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।শেহনাজ পারভীন রাগী গলায় বললেন,
-“তোমাকে না বলেছিলাম আজ না বের হতে।”
-“আসলে আন্টি….”
শেহনাজ পারভীন নিজেই বলতে লাগলো,
-“ওহ হ্যা।এখন তো আমি কিছু বলতেও পারব না।ছেলেও এখন বউয়ের আঁচল ধরা শিখেছে।”
নাজমা বেগম বলতে লাগলেন,

-“দেখো মেহের।তুমি এসেছো,আমরা কিছু বলব না।কিন্তু আমার বউমার থেকে দূরে থাকো।”
মেহের মাথা নিচু করে ফেললো।আরবাজ বলতে লাগলো,
-“আমরা আজ বাসায় থাকছি না।তাই এসব বাজে কথা বলারও কোনো মানে হয় না খালামণি।আমার বউ এখানে থাকবেই না তাহলে তোমার বউমার কাছে যাবে কিভাবে।”
-“মুখ সামলে কথা বলিস আরবাজ।গতকালও তুই আমায় অনেক কথা বলেছিস।বেশি বাড় বেড়েছিস তাই না রে?এত দেমাগ কিসের তোর এই বউ নিয়ে?আগে তো ছিল না।আগে তো তোরও সহ্য হত না।”
-“সহ্য হত না বিষয়টা এমন না।সহ্য হয়ত তোমার হত না।কেননা আমি তোমার মেয়েকে বিয়ে না করে ওকে করেছিলাম।”

আনিয়া এটা শুনে অবাক হয়ে বললো,
-“মানে!”
-“হ্যা।খালামণি চেয়েছিলো তোকে আমার বউ করতে।”
-“হোয়াট নন্সেন্স।আমি আরবাজকে বড় ভাইয়ের মত ভাবি।ছোট থেকে ভালো বন্ধু আমরা।”
নাজমা বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
-“বিয়ে দিতে চেয়েছি তো কি হয়েছে? অন্যায় করেছি আমি?আপা! তোর ছেলে কিন্তু আমায় বারবার অপমান করছে।”
আনিয়া বলতে লাগলো,
-“আমি যেদেশে থাকি ওখানে আমার ফিয়ন্সে আছে।মাকে এখনো জানাইনি।কিন্তু এখন জানাতে বাধ্য হলাম।”
-“মানেটা কি আনিয়া। না জানিয়ে তুমি… ”

-“আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে মা।অন্তত এসব বিষয়ে আমায় জোর করো না।”
বলে আনিয়া চলে গেল সেখান থেকে।নাজমা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“দেখলি আপা!আমি এজন্যই তাড়াতাড়ি করে বিয়েটা দিতে চেয়েছিলাম।”
-“কাঁদিস না।সব দোষ এই বন্ধ্যাটার।এর জন্য আজ আমার ঘরে অশান্তি।”
আরবাজ এটা শুনে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহের বলে উঠলো,
-“লজ্জা করে না আপনার?”
শেহনাজ পারভীন অবাক হয়ে গেলেন।রাগী গলায় বললেন,
-“মানে?কিসব বলছ?”

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ১৯

-“যা বলছি একদম ঠিক বলছি।লজ্জা করে না আপনার?আপনি আপনার এসবের জন্য নিজের ছেলের কাছে ছোট হচ্ছেন। কথায় কথায় আমাকে এসব বন্ধ্যা বলে ডাকেন কেন?কে দিয়েছে আপনাকে এই অধিকার?”
শেহনাজ পারভীন রাগ নিয়ে চেয়ে আছে।নাজমা বেগম বলতে লাগলো,
-“ও বাবা গো।বোবার মুখে কথা ফুটেছে।তুই কিছু বলবি না আরবাজ?”
আরবাজ হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইলো
।আজ সে মেহেরকে ফুল সাপোর্ট করবে।হোক তার মা!ভুল তো ভুল ই।এতে যদি তাকে বউয়ের আঁচল ধরা শুনতে হয়,শুনবে!

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২১