প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৮

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৮
Zannat Xhowdury

পেছনের জ্যাম ছুটাতেই জলদি নিজের গাড়ি স্টার্ট দেয় নির্ণয়।
হাতে সময় নেই। ট্রাফিক হুঁশ করে সামনে এগোতে শুরু করেছে।
একবার পেছনে তাকায়, তারপর দ্রুত গিয়ার চেঞ্জ করে গাড়িটা পাশের ফাঁকা লেনে তুলে দেয়।হাতের থাকা‌ ব্লাক বেল্টের ঘড়িতে থেকে থেকে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে..
সময় জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা নামার তরজর চলছে শহরের ব্যস্ততা ছুঁয়ে। রাস্তায় গাড়ির ঢল , হেডলাইটের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা ধুলোমাখা পেছন। লাল-হলুদ-সবুজ ট্রাফিক সিগন্যালের চোখ রাঙানো রংগুলো মিশে যাচ্ছে মেঘলা আকাশের নিচে।

চলন্ত গাড়ির কাঁচে হালকা ধোঁয়া জমে।ভেতর থেকে বাইরে তাকালে শহরটা কুয়াশার মতো লাগে চেনা, অথচ দুর্বোধ্য।
নির্ণয় গাড়ি চলছে আপন গতিতে হঠাৎ হর্ন বাজে একটা রিকশা পাশ কাটায়,একটা বাইক জুম করে বেরিয়ে যায় বেপরোয়া গতিতে,আর হঠাৎ ছুটে আসে এক দল স্কুলফেরত ক্লান্ত মুখ।
তাদের চোখে সন্ধ্যার আলোর রঙ নেই শুধু বইয়ের ভার, আর ঘরে ফেরার তাড়া।
আকাশে সূর্য ডুবে যাচ্ছে বিশাল বিলবোর্ডের আড়ালে,যেখানে কোনো নায়িকার পোস্টারে ঝকমক করছে মেকআপের হাসি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আলো জ্বলছে একে একে দোকানের, ল্যাম্পপোস্টের, পার্কিং গেটের। তবুও অন্ধকার ঢুকে পড়ছে মানুষের মুখে।
গাড়ির ভিতরে হালকা এয়ারকন্ডিশন, কিন্তু বাইরে চিৎকার, ক্ল্যাক্সন, রাস্তার ভ্যাপসা গন্ধে মিশে থাকা একধরনের উদ্বেগ।
পুরো শহরে জুড়েই হাঁপ ধরা ক্লান্তি নিয়ে মানুষের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা যেখানে কেউ কারও দিকে তাকায় না, তবুও সবাই একসাথে হেঁটে চলে আপন ঠিকানায় ফেরার উদ্দেশ্যে ….
স্নিগ্ধ পরিবেশ গাড়ির রেডিওতে বাজছে পুরোনো প্রেমের গান বাটারফ্লাই নাইটের গলায় টানা একটা টান আর তার ফাঁকেই সেই চেনা চিৎকার “চলে যান ভাই, ডানটা খালি আছে!”

চোখের সামনে শুধু আলো আর গাড়ি,তবু তার মাঝখানে কোথাও এক পশলা অজানা বিষণ্নতা জেগে থাকে ।গাড়িতে চলছে শান্ত পরিবেশ, ড্যাশবোর্ডের আলো নরম, গাড়ির ভিতরটায় এক ধরণের ঘোর লাগা নিঃশব্দতা।
রোজার চোখে কোণে বিন্দু পানির জামানো । থেকে থেকে ফুপিয়ে উঠছে জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে নিজেকে । কি হয়েছে তার সে কথা যেন নিজের ও অজানা … শুধু জানে কাঁদতে হবে তাকে , এখনি কাঁদতে হবে । ভীষণ কাঁদতে হবে । এক কাহিনী বারবার রিপিট টেলিকাস্ট করছে সে ,
পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে , মুখে ললিপপ ঢুকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে গাড়ি ড্রাইভ করছে নির্ণয় , ডান হাতে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে রাখা , বাম হাতটা জানালার কিনারে রাখা।

রোজা তাকায় না সেদিকে , মাথা জানালার কাঁচে ঠেকিয়ে রেখেছে।
চোখের পানি চুপচাপ গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে, সে কোনও শব্দ করছে না। তবুও কান্না কি চুপ থাকতে পারে? তার নিশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা শব্দ রয়ে যায়।
চুসতে থাকা ললিপপ বাম হাতে নিয়ে শান্ত চোখে তাকায় রোজার দিকে , কন্ঠে হালকা বিরক্তি
“মেরেছি তোকে, বকেছি নাকি ছুঁইয়ে দিয়েছি…
তবে এইভাবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস কেন?”
নিশ্চুপ রোজা বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে বেচে নেই পাশে বসে থাকা লোকটির কথার উত্তর দেবার । এক চুলও মাথা নাড়ায় না সে , কন্ঠে মাদকতা এনে হাস্কি স্বরে বলে নির্ণয়
জান আমার”তোর এই কান্নার শব্দ,

আমার রাতের নিঃশ্বাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এবারেও নেই কোনো রেসপন্স । ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয় ।
তোর নিঃশ্বাসের শব্দ আমার কতটা প্রিয়
Do you have any ideas baby ?
বিরক্তি এসে ভর করে রোজার সর্বাঙ্গে , এই লোকের মাথায় কি সবসময় এসব ঘুরে ভেবেই নাক কুঁচকে নেয় সে ।
“তুই চাইলে আমি আবারো তোর নিঃশ্বাস শুনতে রাজি,”হবে নাকি ?
গলা কাঁপছে রোজার , কান্নার জোড় যেন আরো একধাপ বাড়িয়ে দেয়‌, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে নির্ণয়ের।
কান্না জোড় বেড়েছে মানেই রাজি
তো হয়ে যাক আরেক রাউন্ড
কি বলিস জান ?

নিঃশব্দ ফোঁপানি গুলো এবার আর চেপে রাখতে পারছেনা । রোজার চোখে একবার তাকিয়ে আবারো বাকা হাসে নির্ণয় । কন্ঠে মাধুর্য এনে নেশালো সরে বলে ,
I feel something something … honey
কিছু টা অক্সিজেন প্রয়োজন , দিবি ?
ডান হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাখে নির্ণয় আর বাঁহাতটা বাড়িয়ে বাড়ি রোজার গাল ছুঁতে এগিয়ে যায় । গাল ছুই ছুই হাত এসে পৌঁছাতেই , খপ করে সে হাত ধরে ঝকটা দিয়ে সরিয়ে নির্ণয় পানে রাগি একটা লুক দেয় রোজা ।
ছুঁবেন না আমায়, শরীর জ্বলছে আমার..!!
মুসকি হাসে নির্ণয় ঠোট গলিয়ে বাহিরে‌ বেড়িয়ে আসে সেই হাসি ডান গালে হালকা গর্ত হয় লোকটার , মায়াবী ।
লজ্জা হরণের পর লজ্জা পেলে
কার্তিক মাসের কুত্তিও
তোকে নিয়ে মজা নিবে রোজ ।

থতমত খেয়ে যায় রোজা , ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে নির্ণয়ের দিকে । আসলে বুঝতে চাইছে মানুষ টা কি ?
আমাকে ওভাবে চোখ দিয়ে গিলে না খেয়ে,
একটা রিসোর্ট দেখে গাড়ি থামিয়ে দেই ।
তারপর না চকলেট , স্ট্রোবেরি সাথে নিয়ে খাওয়া যাবে।
নির্ণয় ভাই ..!!
ভাতার লাগি শালি !
লজ্জার সাথে বস্ত্র হরণ হয়েছে তোমার ।
So don’t call me ভাইয়া ,
It’s called ছাইয়া
What ভাতার ?

যাহ বাবা , যে এলাকায় মিশনে এসেছিস সে এলাকার টুকি টাকি ভাষা আয়ত্তে নেই তোর “সেইম অন ইউ গার্ল” । ছ্যা: কেমন গোয়েন্দা তুই জ্ঞান এত কম । হাঁটুর নিচে বুদ্ধি
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রোজা নির্ণয়ের বলা প্রতিটি কথা যেন মাথার উপর দিয়ে শিরশির বাতাসের মতো শাইইই করে উড়ে যাচ্ছে তার ‌ ।
উত্তরবঙ্গে ভাতার , শুদ্ধ ভাষায় স্বামী , ইংরেজিতে হাসবেন্ড
Now you call me hubby !
ওইসব হবি বদি আমি বলতে পারবো না । একে তো লাগাম ছাড়া কথা বলছেন তার মধ্যে মুখে ললিপপ ঢুকিয়ে রেখেছেন ছিঃ
এতে ছিঃ করার কি হলো ? ললিপপ চুসতেছি তোর খুশি হ‌ওয়া উচিত ঝড় টা ললিপপে উপরেই যাচ্ছে ।
ধুর ..!!
বিরক্তি নিয়ে আবারো মুখ ঘুরিয়ে নেয় রোজা । সব বিরক্ত লাগছে তার।

কালো রঙের কতগুলো গাড়ি ছুটে চলেছে চেনা-পরিচিত গন্তব্যে
যেখানে একদিন থেমে গিয়েছিল পুরনো দিনের কিছু অধ্যায়। প্রথম গাড়িটার বেকসিটে বসে আছে রেহান। নিস্তব্ধ, অন্ধকার চশমার পেছনে লুকানো চোখে একটানা তাকিয়ে আছে মোবাইলের স্ক্রিনে।
স্ক্রিনে ভেসে আছে এক বাচ্চা মেয়ের ছবি । সাদা লাল মিশ্রনে এক ফ্রক পরা দুপাশে চুলগুলো দুই বেনিতে মোড়ানো। হাসিটাও যেন ঝলমলে রোদের আভাস।
চোখে মুগ্ধতা আর হাজার বছরের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে এক ফালি সুখ যেন এই ছবি ।‌ চোখ থেকে কালো চশমা খুলে , ঠোট ছুঁইয়ে দেয় স্ক্রিনে জ্বলতে থাকা ছবিতে ।

তোমার এই ছবিতে যে আমার কত যুগের প্রেম লুকানো
তা তোমাকে কিভাবে বুঝাই মহারানী।
তোমার স্পর্শ পেতেই তোমাকে আমার চাই।
পুরো দুনিয়া চুলোয় যাক আমি ধ্বংস হবো
যদি তুমি তুমি আমায় ধ্বংস করতে চাও ।
হালকা থেমে চোখ বুজে নেয় রেহান মনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস …
“জান কুরবান মহারানী”
তুমি শুধু আমার এটা একবার শুনতে চাই।

এতোক্ষণে পুরো কাহিনিতে যেন রক্তাক্ত করছে একটি হৃদয়।প্রতিটা বাক্যে, প্রতিটা মুহূর্তে কারো না কারো হৃদয়ে ছুরি চালানো হয়েছে নীরবে, নিষ্ঠুরভাবে। রক্ত ঝরছে, কিন্তু কেউ তা দেখতে পায় না। শুধু অনুভব করে, বুকের ভেতর কেমন একটা জ্বালা, একটা শূন্যতা, যা ধীরে ধীরে সব কিছুকে গিলে নিচ্ছে।
চোখের কোণে জমে থাকা জল এখন আর শুধু জল নয় তা একরাশ অভিমান, বেদনা আর অনন্ত প্রতীক্ষার নির্যাস। তার ভালোবাসার মানুষের ও ভালোবাসার মানুষ আছে।ভেবেই বুকের মাঝে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছে জারা । চিৎকার করে পুরো দুনিয়া কে বলতে ইচ্ছে করছে ।
—প্রকৃতি… শুনছো? সে আমার ছিল না!
আমি যাকে বুকে বেঁধে রেখেছিলাম, সে কোনোদিনই আমার ছিল না…যার জন্য বাঁচতে শিখেছিলাম, সে অন্য কারো জন্যে বাঁচে।’
আকাশ বোবা, বাতাস থমকে গেছে,গাছেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেন তার নীরব কান্নার ভাষা বুঝতে পারছে।

কিন্তু মানুষ…?
মানুষ তো শুনে না।
মানুষ তো বুঝে না সেই চিৎকার, যা শুধু বুকের ভেতর বাজে।
শক্ত ধাঁচের মেয়েটার মনের ভেতরে জমে উঠেছে এক বিশাল কষ্টের পাহাড়। যেটার ওজন এতটাই, যেন সে নিজেই বোঝে না‌ কতটা ভার সে বইছে দিনের পর দিন। ভেতরের ঝড়গুলো এতকাল আটকে রেখেছে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির আড়ালে, চোখের কঠোর চাহনির ভিতরে।
আজ হঠাৎ… সব কিছু যেন বিস্ফোরণের আগে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
সে জানে, চোখ ভিজে গেলে দুর্বল লাগবে, তাই সে চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শান্ত করে নিজেকে।হাত রাখে ডানপাশে বসে থাকা রেহানের কাঁধে ,

প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর যাকে হৃদয়ে সয় তাকে ভাগ্যে সয় না !
কথাগুলো ছুরির মতো বুকে হালকা দাগ কাটে রেহানে …
কি সমস্যা কি বলতে চাইছো ?
চেয়েছিলাম তো তোমাকে তবে তা আর‌ দিলে ক‌ই ?
নিশ্চুপ রেহান জারা আবেগের এক বালতি পানি ঢেলে দৃষ্টি দেয় জানালার বাহিরে দিকে ।
কোনোভাবে রোজ তোমার না হলে তুমি কি আমার হবে ?
রেহান থেমে যায়। তার চোখে বজ্রপাত, বুকের ভিতর আগুন জ্বলছে। জারা সামনে এগিয়ে বসে রেহানের এক হাত তুলে নেয় নিজের হাতে ।

ভিতর কাপছে হাঁসফাঁস করছে বুকে সাহস নিয়ে বলে, “আমি জানি, তুমি ওকে চাও। কিন্তু সে যদি না আসে, যদি নির্ণয় না মানে আমি কি পারি না, তোমার ছায়ায় একটা জায়গা নিতে?”
মূহুর্তেই যেন আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ে, শান্ত বাঘের গলায় ঘন্টা বাধতে গিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলেছে তাকে । রেহান ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জারার দিকে, ডান হাতে চেপে ধরে তার গলা।
তোর মতো পতিতা কিনা আমার হবে ? পচা শামুক খেয়ে বড় হবার মাছ “মীর আবদ্ধ রেহান” নয় ।রোজ আমার না হলে তুইও আমার না ।
রেহান !

দূর হো মা**গি ।
এক ধাক্কা ঠিক জানালার কাঁচে কাছে ছুড়ে ফেলে জারাকে
জারার চোখে জল, শ্বাস বন্ধ হতে চলেছে, তবুও ঠোঁটে একটুখানি হাসি। নিজেকে সামলে আবারো বলে
“তুমি ভাবছো আমি ভালোবাসি না? আমি তো ওই রোজের থেকেও আগে তোমায় চেয়েছি রেহান…
তোরে বলেছি আমাকে চাইতে ?
কথা আটকে আসে জারার । ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে হৃদয় ,
থেমে যায় সে ।

বাইপাসের মোড় ঘুরে চিকন, অন্ধকার গলির পথ ধরে‌ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কালো কাচে ঢাকা গাড়িগুলো।
সামনের আলো ঝাপসা, রাস্তার পাশে পুরনো ঘরবাড়ি,কখনো এক-আধটা পলক ফেলা গলি-ল্যাম্প যেন আলোও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না এই ছায়াময় বহরকে। কিছুটা পথ এগোলেই সেই চিরোচেনা ”
” নীড় কুঞ্জ ”
হঠাৎ হাতের তালুতে থাকা মোবাইলটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় রেহান ।আঙুল সোজা চলে যায় একটা নাম্বারে । স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে একটা নাম্বার ।

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৭ (৩)

Calling P.A
কয়েক সেকেন্ডেই রিসিভ হয় কলটি ।
Stop”
একটা মাত্র শব্দ। রেহানে গলায় কোনো উত্তাপ নেই,কথা শব্দ উচ্চারণ করেই ফোন কেটে দেয়। স্ক্রিন নিভে যায়। তার চোখ ধীরে ধীরে সরে এসে স্থির হয় ভিউ মিররে।
পেছনে থাকা চারটি গাড়ি, সবগুলো একইভাবে থেমে গেছে মোড়ে। একটাও এগোয় না, একটাও পিছায় না।

প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৮ (২)