প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৮
মিমি মুসকান
আট দশ মিনিট বাদে প্রান্তিকের কেবিনে ঢুকল আরিনা। প্রান্তিক তাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। সে জানত আরিনা আসবে। ওত পেতেই যেন ছিল, কখন সে অফিসে এসে। এই কারণেই তো ছুটে চলে এলো। সোজা এসে বসে পড়ল চেয়ারের উপর। প্রান্তিকের মুখোমুখি। আজ তাকে যেন একটু বেশিই খুশি লাগছে।
প্রান্তিকের সাদা শার্ট লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। গলার টাই আজ পরা হয়নি। চুলগুলো ঠিকঠাক নেই, মুখটাও ফ্যাকাশে। ভীষণ অগোছালো লাগছে তাকে দেখতে। এর কারণ ধরতে বেশিক্ষণ লাগল না আরিনার। গতকাল যে আ’গুন সে জ্বা’লিয়েছে তা এখনো ভালো করেই জ্বলছে বোঝা যায়। পোড়া পোড়া গন্ধ এখান থেকেই পাচ্ছে সে। আরিনাকে আজ খুশি খুশি লাগছে।
প্রান্তিকের এমন উদাসী মনই যেন তার খুশির কারণ। প্রান্তিক এবার নড়েচড়ে বসল। তার চোখের নজর সরছে না আরিনার উপর থেকে। ক্ষো’ভ, ঘৃ’ণা, অভি’মান সবকিছু সেখানে উপস্থিত।
আরিনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল বছর খানেক আগে। আরিনার পর আর কারো সাথে সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। আরিনা থাকতে আবার নতুন কেউ! তাদের সম্পর্ক গভীর ছিল, যথেষ্ট গভীর! আরিনা তাকে ভালোবাসতো। একটু বেশিই কি না বাসতো। প্রান্তিকের স্বভাব চরিত্র নিয়ে বহু আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। এরপরেও প্রান্তিকের সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি, ব্যতিক্রমী ও হয়েছে। সবার চাইতে ভিন্ন। কিন্তু তবুও তার মনে ভয়ের বাসা বাঁধতো। এই মনে হতো প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। ভয় হতো কেবল। প্রান্তিক যদি তাকে ছেড়ে দেয় তখন কি হবে? সম্পর্কে আসে সন্দেহ আর অভিমান। কোনো সম্পর্কে সন্দেহ আসলে তা বেশিদিন টিকতে পারেনা। আরিনা সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল কিন্তু সে ভুলে গেল। ভালোবাসায় সন্দেহ থাকতে নেই। ভালোবাসতে হয় মন প্রাণ দিয়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তবু কতোখানি সহ্য করা যায় এসব। প্রান্তিক যে অভ্যস্ত ছিল না। বার বার ফোন করে কোথায় আছো জিজ্ঞেস করা, কার সাথে আছো, কি করছো? কোন মেয়ের সাথে কথা বলছো, এতো কেন মিশছো? এসবের উত্তর দেবার মতো মনোভাব তার তখনো হয়ে উঠেনি। অকারণে ঝগ’ড়া আর অপ’মানে অতিষ্ঠ হয়ে প্রান্তিক শেষমেষ এই সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
অথচ তার মনে কিছু ছিলনা এমনটাও নয়। বউ হিসেবে আরিনা খারাপ হয়না। এরমধ্যে আরিনার সাথে সম্পর্ক এতো গভীর হওয়ায় একটু দুর্বল যেন সে হয়েই গেছিলো। দাদাজান কেও বলেছিলো আরিনার কথা। তিনি অবশ্য আগে থেকেই আরিনাকে চিনতেন। আরিনার বাবার সুবাদে। খোঁজখবর নেবার পর তিনি এককথায় না করে দিলেন। তার কঠোর নিষেধ, এই মেয়ে এই বাড়ির বউ হতে পারবে না। তিনি কি জেনেছিলেন তা জানা নেই তবে তার মনে ভয়ের বাসা বেঁধেছিল। এই মেয়েকে মিসেস ক্যারির সাথে গুলিয়ে ফেলছিলেন তিনি। এক মেয়ের জন্য ছেলে হারিয়েছেন। আরেক মেয়ের জন্য একমাত্র নাতিকে হারাবেন। সম্ভব না! এমন মেয়েকে বাড়ির বউ বানিয়ে আনলে সংসার জোড়া লাগার বদলে ভা’ঙবে আরো। আবেগ দিয়ে কি সংসার হয়? ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করে আনেনি। কতোদূর চলল সম্পর্ক? সবই তো দেখলেন। তার ছন্নছাড়া নাতিকে শুধরানোর জন্য যেমন মেয়ে দরকার তেমনি পেয়েছিলেন প্রিয়তার মধ্যে। তাই তো আরিনার থেকে প্রিয়তাকে তার উপযুক্ত বলে মনে হলো।
দাদাজানের না বলার পর প্রান্তিক আর কথা বাড়াল না। তার নিজের ও মনে হলো, এই সম্পর্ক জোড়া লাগলেও বেশিদিন টিকবে না। আরিনার যেমনি তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, এই সংসারে কোনো শান্তি থাকবে না। নিজের মা বাবাকে দেখে যথেষ্ট বুঝেছে সে। তবে বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। এবার, প্রিয়তা সবকিছু জানার পর তাকে বিশ্বাস করতে পারবে তো?
মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের একটু বেশিই চালাক ভাবি। অথচ অনেক ভেবেচিন্তে আবার ভুল সিদ্ধান্তকেই বেছে নিই। আরিনা এসেছে ২ মিনিট হলো। সেই প্রথম হেসে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?”
“খুব ভালো!”
“তোমাকে দেখতে অনেক ক্লান্ত লাগছে।”
“লাগতেই পারে কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি আমার শান্তি নষ্ট করতে পারবে না। কিছুদিনের জন্য হয়তো অশান্তি হবে কিন্তু আমার বিশ্বাস সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
আরিনা কিঞ্চিত হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল অদ্ভুত ভাবে। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসল আরাম করে। বলল, “একটা মেয়ে সবকিছু ভাগ করে নিতে পারে কিন্তু নিজের পুরুষকে নয়। প্রিয়তা মেনে যাবে এমনটা কেন ভাবছো?”
“চা খাবে?”
“না কফি। কিন্তু তোমার চায়ের নেশা কবে থেকে হলো?”
প্রান্তিক মৃদু হেসে বলল, “আমার বউ খুব ভালো চা বানায়, ওর থেকেই অভ্যাস হয়ে গেছে!”
ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা উধাও হয়ে গেল নিমিষেই। ছোট করে বলল, “ওহ”।
কফি আর চা এসেছে। প্রান্তিক নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। কিন্তু চা তার মন মতো হয়নি। প্রিয়তা অনেক দারুণ ভাবে চা বানায়। আরিনা অবাক হয়ে দেখল একপলক। অতঃপর নিজের কফি মগে চুমুক দিল। প্রান্তিক চায়ের কাপ রেখে বলল,
“এটা কি খুব দরকার ছিল?”
“আমায় জিজ্ঞেস করছো? তোমার কি মনে হয়? আমি তোমায় এতো ভালোবেসেছি অন্যের সাথে সুখে দেখবো বলে?”
“এটা তোমার কেমন ভালোবাসা আরিনা, যেখানে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষের সুখই দেখতে পারো না?”
কফির মগখানা কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল আরিনার হাত। প্রান্তিক তাঁর চোখে চোখ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, “যা কিছু হয়েছে সবটাতে দোষ কি কেবল আমার? তোমার কনট্রিবিউশন কি নেই? আমরা এডাল্ট আরিনা। আমি থার্টি প্লাস পুরুষ। তুমি আমি একসাথে রাত কাটালে সেখানে কি হতে পারে তা সবারই জানা। কিন্তু তাই বলে এভাবে? আমি তো তোমাকে জোর করিনি। তুমি কি বলবে? আমি তোমার ফায়দা নিয়েছি?”
আরিনা একটু বিচলিত হয়ে উঠল। কফি মগ রেখে আচমকা বলে উঠলো, “আমি সে কথা কখন বললাম!”
“বলোনি। যা বলেছো তা আ’গুন লাগানোর জন্য যথেষ্ট। প্রিয়তাকে তুমি চিনো না। তোমার কথায় সে কতোটা কষ্ট পেয়েছে আমি সেটাও তোমাকে বলতে চাই না। ব্যস এতো টুকু বলি, আমাদের ক্ষ’ত সারাজীবন তাজা থাকে না। শূন্যস্থান বলে কিছু নেই, একসময় না একসময় তা পূরণ হয়ে যায়। তুমি কি ভাবছো? তোমার সারাটে জীবন আমায় ভালোবেসে কেটে যাবে? অসম্ভব! হতেই পারে না। সময়ের সাথে সাথে সব ক্ষত শুকিয়ে যাবে। তোমার জীবনেও তুমি আবার কাউকে ভালোবাসবে। তার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখবে। কি হবে? তখন যদি আমি গিয়ে তোমার আর আমার অতীতের রঙিন দিনের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিই। ভালো লাগবে? ততোদিন না আসা অবধি তুমি আমার পরি’স্থিতি বুঝতে পারবে না!”
কথাটুকু শেষ করে ঘড়ির দিকে চোখ গেল প্রান্তিকের। এবার তাকে উঠতে হবে। উঠে দাঁড়াল সে। আরিনা এতোক্ষণ কেবল মনোযোগ দিয়ে সমস্তটা শুনল। নরম স্বরে বলে উঠলো, “কি হবে যদি তা কখনো না হয়? আমি কখনো তোমাকে ভুলে না যাই। সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসতে থাকি!”
প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ১৭
প্রান্তিক নিজের চেয়ার জায়গামতো রাখল। হেটে দরজার কাছ অবধি এলো। এক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “তাহলে আমি বলব আমি লাকি। তোমার সাথে এতোবড় অ’ন্যায় করার পরেও তুমি আমায় ভালোবাসো, এর জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারি। আবার দু’র্ভাগাও! তোমার সেই ভালোবাসা আমার কপালে নেই আছে কেবল তোমার মনে। যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারে আমরা তাকেই মহৎ বানিয়ে দিই। তবে এই আমাদের শেষ দেখা। চাইব আর কখনো আমাদের দেখা না হোক। যা ছিল এখানেই শেষ হয়ে যাক।”
কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল প্রান্তিক। আরিনার কথা শোনার জন্য আর দাঁড়ালো না সে। আর কিছু যেন তার শোনার নেই।