প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৪

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৪
মিমি মুসকান

সংসারের জাগতিক মোহমায়া ছেড়ে প্রেমিকা বিদায় দি*চ্ছে তার প্রিয়তম কে। এর চেয়ে বড় বিষা*দময় ঘটনা কিই বা হতে পারে। হৃদয়ের অন্তঃপুরে যেই রমণীকে একবার কোনো পুরুষ ঠাঁই দেয় তাকে হারিয়ে ফেলার য*ন্ত্রণা কি ইজান শিকদার আবার বুঝে না। দিব্যি বুঝে! তাই তো প্রান্তিকের জন্য খা*রাপ লাগছে। খারাপ লাগা এতোটাই যে চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পরক্ষণেই তার পৈশা*চিক হাসি সেই কান্নার রফাতফা করে ছাড়ল।
দুর্ঘট*নায় এই হৃদয়*বিদারক দৃশ্যের কল্পনা করেই ইজান শিকদারের খারাপ লাগছে। হাতের অনটাইম কফি মগে চুমুক দিয়ে তী*ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে কালো গাড়িটাকে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গাড়ির জানালা ভেদ করে ভিতরের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে। প্রান্তিক তার প্রিয়তমা প্রিয়তার ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দেখছে। এসব দেখে ভ্রু কুঁচকে দেখল খানিকটা। এদিক ওদিক তাকালো। ফোনে একটা কল করল। প্ল্যান যেন ঠিকঠাক ভাবেই থাকে। চোখের ইশারা দিল দূরের ভ্যানে আইসক্রিম বিক্রেতাকে।

কফি কাপে শেষ চুমুক দিতেই প্রান্তিক গাড়ি ছেড়ে বের হলো। ঠোঁটে তখনি তার পৈ*শাচিক হাসির দেখা মিলল। মনে উধালপাতাল শুরু হয়ে গেছে। উত্তেজনায় কেমন শীত শীত করছে। লন্ডনে এই সময়টায় অবশ্য খানিকটা শীত শীত করেই। ইজান শিকদার বিমূঢ়। দৃষ্টিতে তীব্র উত্তেজনা। প্রান্তিক গাড়ি ছেড়ে প্রায় অনেকটা দূরেই চলে গেছে। পিছন ফিরে তাকাতেই ট্রাকের সামনে দুটো আলো জ্বলে উঠল।
মুখ খুলে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে সে। ভাবনার মতো সবকিছু হতে দেখে খানিকটা থমকে গেল। কিন্তু একি! প্রিয়তা গাড়ি ছেড়ে নামছে কেন? এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। প্রান্তিক একটু দূরে গিয়ে আবারো ছুটে এলো প্রিয়তার কাছে। প্রিয়তার হাতটা শক্ত করে ধরে নিল। দুজনে পা মিলিয়ে হাঁটছে একসাথে। রাগে বির*ক্তিতে ঠান্ডা মুখ লালচে হয়ে উঠল। চোখ রাঙিয়ে তাকাল ট্রাকের দিকে। ট্রাক থেমে গেছে, আলো নিভে গেছে। ফোন বের করে টাইপ করতে লাগল। প্ল্যান A না হলে B. দরকার পড়লে পরবর্তী প্ল্যানও সে করে রাখবে। তবুও এদের শেষ দেখা চায়। প্রান্তিক চৌধুরী কে একা না করে তার শান্তি নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভারী কালো জ্যাকেট পরনে। মাথার টুপি দিয়ে মুখ ঢাকা। চেনার উপায় নেই। বার বার দেখছে ঘড়ির দিকে। এখান থেকে তাকে যেতে হবে। কিন্তু এভাবেও তো চলে যাওয়া যায় না। আবার না যেয়েও পারছে না। প্রান্তিক আর প্রিয়তাকে গাড়িতে চড়তে দেখে মনের ভেতর সুপ্ত বাসনার ঠাঁই মিলল। নড়েচড়ে উঠল সে। প্রান্তিক গাড়ি ছেড়ে আবারো বেরিয়েছে। ছুটে যাচ্ছে সামনের কনভিনিয়েন্স স্টোরের দিকে। ইজান শিকদারের চোখের ইশারা বুঝল ড্রাইভার।

গাড়িতে আয়েস করে আইসক্রিম খাচ্ছে প্রিয়তা। তার পিছনেই একটি ট্রাক দ্রুত গতিতে ধে*য়ে আসছে তার দিকে। অথচ সে নির্বাক! জানেই না কিছু। কি ঘটতে চলেছে তার সাথে। ইজান শিকদারের চঞ্চল আঁখিজোড়া। ট্রাকের গতি বাড়ছে। ইজান অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখের পাতা অবধি তার নড়ছে না। অদ্ভুত ভাবে ট্রাক গাড়িটার পাশ দিয়ে চলে গেল। একটা ধাক্কা অবধি দিলো না। চোখের মনিকোঠায় স্থির মনি জোড়া ক্ষুদ্র হয়ে উঠল। এমনটা তো হবার ছিলো না। ফোনের মধ্যে তখনি আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ আসল, “প্ল্যান সাকসেসফুল!”
প্ল্যান সাকসেসফুল মানে? এখানে তো কিছুই হলো না। আচমকা আঁতকে উঠল সে। চোখ মুখ বন্ধ করে ছুটতৈ লাগল দ্রুত গতিতে। পায়ের তেজ থামছে না। ৭ মিনিটের মাথায় গন্তব্যে এসে থামল সে। পায়ের তেজ হারিয়ে ফেলেছে। লন্ড*ভন্ড সবকিছু। তার সাদা রঙের গাড়িটা ধুলোয় মিশে গেছে। মিশে গেছে সমস্ত স্মৃতি। রাস্তার মাঝে পড়ে আছে তার শখের গাড়ির অংশবিশেষ। গাড়ির দুঃখে সে থমকে নেয়। গাড়ির মধ্যে যে প্রিয়*জন ছিল তার কথা ভেবেই তার পৃথিবী থমকে গেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে অলৌকিক কোনো শক্তি। পায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই হাঁটার। তবু থমকে থমকে হাঁটছে পথ।

ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে। ভিড়ের মাঝে রাস্তার মেঝেতে বসে কাঁদছে এক নারী। কপাল কেটে র‘ক্ত পড়ছে তার। গাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল এমন সময়ই পেছন থেকে ট্রাক এসে গাড়ি উ*ড়িয়ে দিল। সে বেঁচে গেছে ভাগ্যের জোরে। তবে একটু আঘা*ত পেয়েছে যেন। ভ*য় ও পেয়েছে ভীষণ। হাতের ফোনে বার বার আঙুল টিপে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে। আঙুল কাঁপছে নিদারুণ ভাবে। ভয়ে কেঁপে যাচ্ছে সেও। ভিড়ের মাঝে থেকে দুজন মেয়ে এসে তাকে সামলাতে লাগল। আরিনাকে জীবন্ত দেখে ইজান শিকদার যেন জানে প্রাণ ফিরে পেল অলৌকিক ভাবে। শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে শব্দ করে। শরীরের তেজ ফিরে এসেছে। ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। আগলে নিল বুকের মধ্যে। আরিনা কেঁদে উঠল বাচ্চার মতো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তবু বলছে, “কোথায় গেছিলি তুমি? জানো কি ভয় পেয়েছি আমি? কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? আমি ম*রে যেতাম আরেকটু হলে? তুমি কোথায় ছিলে?”

ইজান শিকদার জবাব দিতে পারল না। সে হতবাক, হতভম্ব! গলা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। যে ইতিহাস সে তৈরি করতে যাচ্ছিল তারই সাক্ষী এবার হয়ে উঠল সে স্বয়ং। কেবল আক্ষেপের সুরে বলতে লাগল,
“আমি আছি, এখানেই আছি, তোমার কাছেই আছি!”
আরিনাকে শান্ত করতে পারল না তবুও। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে।
হাসপাতালে আরিনার পাশে বসে সে। আরিনা অনেক ভ*য় পেয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় অচেত*ন হয়ে পড়ে। ইজান শিকদার অসম্ভব রকম ভয় পেয়ে যায়। ভাবে এই বুঝি শেষ! আর বুঝি ফিরে দেখা হলো না।
তবে ভাগ্য সহায় দিয়েছে। এতোটাও দুর্ভাগ্য ছিলো না তার। তাই তো আরিনা এখনো জীবন্ত। আছে তার পাশেই। আজকের রাতটা হাসপাতালেই থাকতে হবে। বেডে শুয়ে সে। ওষুধে ঘুমাচ্ছে বিভোর। তবুও শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে হাতখান। কপালের ক্ষ*ত স্থানেও দেওয়া হয়েছে ঔষধ। ইজান শিকদার বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল অপলক ভাবে। গভীর চুমু খেলো কপালের মাঝে। অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
ফোনে কল এসেছে সেই আননোন নাম্বার থেকে। কার হতে পারে ধারণা হচ্ছে? আরিনার হাত ছেড়ে কক্ষের বাইরে চলে এলো। রাত এখন অনেক গভীর। পুরো হাসপাতাল নিঝুম, ঝিমিয়ে পড়েছে যেন। তীব্র বাতাসে তাঁর চুল গুলো হেলদোল খাচ্ছে। ইজান শিকদার শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তীব্র নিরবতার গন্ধ। অতঃপর শুরু করল সে নিজেই!

“প্রান্তিক!”
ওপাশ থেকে ফিসফিস স্বরের আওয়াজ। হবে নাই বা কেন? প্রিয়তা যে তার বুকের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। সাবধানে কথা বলতে হচ্ছে তাকে!
“আরিনা বেঁচে আছে তাই না?”
ইজান শিকদার হেসে উঠল। তাচ্ছিল্যের হাসির স্বর প্রান্তিকের কানে অবধি পৌঁছাল। জবাবে সেও হেসে বলল,
“হাসার কথা তো আমার ছিল।”
“আরিনার কিছু হলে আমি তোকে জীব*ন্ত কবর দিতাম প্রান্তিক চৌধুরী!”
“যতক্ষণে তুই ভাবতি ততোক্ষণে আমার কার্য হাসিল হয়ে পড়ত ইজান শিকদার। আমি চাইলে তোর মতোই অপেক্ষা করতে পারতাম। কখন আরিনা গাড়ির মধ্যে থাকে। যদি এমনটাই চাইতাম তাহলে আজ গাড়ির সাথে ছিন্ন*ভিন্ন হয়ে আরিনার দে*হও পড়ে থাকত। ভালো লাগত সেটা!”

ইজান শিকদার চোয়াল শক্ত করল। রেলিং আঁকড়ে ধরল শক্ত করল। প্রান্তিক সিটে হেলান দিয়ে বলল,
“দুজন প্রেমিক পুরুষ যখন তাদের প্রিয়তমার জন্য যু*দ্ধে নামে সেখানে কেউ বেঁচে ফিরতে পারে না ইজান শিকদার। প্রিয়তা আমার জন্য ততোটাই আপন যতখানি আরিনা তোর জন্য। আমি তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, এরপর তোর দৃষ্টি যদি প্রিয়তার উপর পড়ে তাহলে আমার দৃষ্টি কোথায় থাকবে! প্রান্তিক চৌধুরী ওতোটাও বোকা নয় যতোটা তুই ভাবছিস। আমার প্রিয়তার কিছু হলে আমি তোর দুনিয়া উ*ল্টে দিব। যেভাবে এখন দিয়েছি। ট্রেইলার দেখে মন না ভরলে..

ইজান শিকদার দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা কেটে নিল। এই হার সে মেনে নিতে পারছে না। অথচ আরিনার এই হাল ও সে দেখতে পারছে না। বুকে তীব্র যন্ত্র*ণা। যু*দ্ধে নিজের রাণীকে হারিয়ে ফেললে তার জয় কোথায়?
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরিনাকে দেখতে লাগল সে। দৃষ্টিতে কেবল অনুনয় আর অপরাধ*বোধ। তার জন্য আরিনার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কি ক্ষমা করতে পারবে সে। এগিয়ে এসে তার পাশে বসল। দুই হাতে তার হাতটা চেপে ধরল। কেঁদে উঠল নিঃশব্দভাবে। এখন যেন পিছানোর সময় চলে এসেছে!

প্রিয়তা কথা রাখেনি। কথা ছিলো সারারাত দুজনে ঘুরবে। একসাথে ভোরের আলো দেখবে। অথচ সে এখনই তার বুকের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘুমের তেজ অনেক গভীর। প্রান্তিক গাড়ি থামিয়েছে নির্জন এক জায়গায়। শেষরাতের হিম হিম শীতে তার গাড়ির জানালা ভিজে উঠছে। প্রিয়তা একটু নড়েচড়ে উঠে তার বুকের মধ্যে লেপ্টে গেল। প্রান্তিক এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়তা ভীষণ সুন্দর এক জিনিস মিস করল। এতো কাছ থেকে চাঁদকে দেখতে পেলে কি আনন্দটাই না তো। অথচ ঘুমন্ত বউকে ডাকতেও কষ্ট হচ্ছে। অতঃপর চাঁদের সৌন্দর্য সে একাই নিচ্ছে। প্রিয়তার কপালে হাত বুলিয়ে চুমু খেল দুটো। চাঁদের সৌন্দর্য ওতোটা মুগ্ধ করতে পারল না তাকে। বার বার ফিরে চাইছে তার বউপাখির মুখের দিকে। এরচেয়ে স্নিগ্ধতার কিছু হতে পারে না। অন্য কোনো সৌন্দর্য তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে পারে না। তার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ছে তার মুখস্রীর উপর। মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি বউপাখি। আমি থাকতে তোমার গায়ে কেউ ফুলের টোকাও দিতে পারে না। প্রান্তিক চৌধুরী তাহলে তাকে বেঁ*চে থাকতে দিবে না!”

নীলকুঞ্জ ভিলা! আরবি গেছে গোসল করতে। যখন গোসলখানায় ঢুকেছে তখনি আফরিন এসেছে। আরবি না থাকায় তার মন এখন আর পড়াতে বসছে না। আগেও বসত না। এখন কেবল একটা অজুহাত। আন্টি চা আর সিঙাড়া দিয়ে গেছে। বলেছে আরবি আসতে আসতে খেয়ে ফেলতে। আন্টি ভালো মানুষ। আফরিনকে অনেক আদর করে। শাশুড়ি মা হিসেবে খারাপ না। আফরিন আগেই ভেবে নিল। অবশ্য হবু শ্বশুর মশাইয়ের সাথে তার আলাপ এখনো হয়নি। নিশ্চয়ই ভালো মানুষ হবে।

হাতে সিঙাড়া নিয়ে আফরিন বেরিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে একজনকে। কারণ ঘরে ঢুকার আগেই তাকে দেখেছিলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। আলফিকে খুঁজছে সে। তাদের বাড়িটা ভীষণ বড়। নিজের বলে কথা। বানিয়েছে যেমন, সাজিয়েছেও তেমন দেখার মতো। আরবি কক্ষ থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে একটা বেলকনি আছে। সেখানে বেতের চেয়ার পেতে বিকালের টাইমে সবাই চা নাস্তা খায়। আলফি একটু আগেই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আফরিন হাতের মুঠোয় দুটো সিঙ্গাড়া নিয়ে একসঙ্গে কামড় দিয়ে আলফি ভাইকে খুঁজছে। তাকে পেয়েও গেল। বা হাতে মুখটা মুছে ওদিকে গেল সে।
আলফির হাতে চায়ের কাপ। সামনের টি টেবিলে সিঙ্গাড়া রাখা। আলফি সেখান থেকে একটা সিঙাড়া নিয়ে কামড় দিতেই আফরিন হাজির। তাকে দেখা মাত্রই তার চোখ মুখ লাল হবার জোগাড়। যথাসম্ভব তাকে এড়িয়ে চায়ের কাপে মনোযোগ দিল। ওদিকে আফরিন মনোযোগ পাবার জন্য বলে উঠলো,

“হাই আলফি ভাইয়া, কেমন আছেন?”
“ভালো। তুই এখানে কেন?”
“এই‌ হাঁটতে বের হলাম।
বলেই সিঙাড়ায় কামড় দিলো আবারো। এবার দুটোয় দেয়নি। ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে। একটাতেই কামড় দিয়ে মুখ মুছল। আলফি মুখখানা গম্ভীর করে বলে উঠলো,
“তুই কি এখানে ঘুরতে আসিস? পড়ালেখা নেই তোর?”
“আছে তো। আরবি গোসল করছে তাই আন্টি বলল সিঙ্গাড়া খেতে।”
“ভালো।”
“বাই দ্যা রাস্তা আলফি ভাই, আমার শাশুড়ি মা কিন্তু ভালোই সিঙাড়া বানায়!”
“শাশুড়ি মা!” শুনেই আলফি কেশে উঠল। কাশতে কাশতে তার চোখ মুখ লালচে হয়ে গেছে। আফরিন আবার এগিয়ে এসে তার পিঠে থাপ্পড় দিতে লাগল। আলফি থেমে চোখ রাঙি*য়ে তাকাল। আফরিন একগাল হেসে বলল, “হেল্প করছিলাম তো!”
“দূরে যা!”

কণ্ঠে বর্বর*তার ছিল যেন। আফরিন মনটা খারাপ করে পিছিয়ে গেল। এবার আর ভদ্রতা দেখালো না। গাপুস গুপুস করে হাতের দুটো সিঙ্গাড়া খেয়ে ফেলল। শুধু তাই নয়, আলফির পাত থেকেও দুটো নিয়ে রুমের মধ্যে চলে গেল। এই ছোট পুচকের ব্যবহার দেখে আলফি যথেষ্ট অবাক হলো।
কিন্তু আফরিনের রাগ বরফের মতো। জলদিই গলে যায়। এক মিনিটের আগেই সে আবারো হাজির হলো। তার হাতে এবার চায়ের কাপ। দাঁত বের করে বলল, “একা একা চা খেতে ভালো লাগে না ভাই!”
“তাহলে যতক্ষণ থাকবি চুপ থাকবি!”
“আল্লাহ কি চুপ থাকার জন্য মুখটা দিয়েছে।”
“তোর মতো বাচাল গিরি করার জন্যেও তো দেয়নি।”
“না না ভাই, আমি খুবই কম কথা বলি। আপনার কাছে বেশি শোনায়। আপনি আরবি কে জিজ্ঞেস করবেন।”
“পরিক্ষা কবে তোর?‌ প্রথম বর্ষে পাশ করেছিলি তো?”
“পাশ না করলে টেস্ট দিচ্ছি কি করে?”
“ফাইনাল কবে?”

“তিনমাস বাকি! আর দু মাস পর আমার বয়স আঠারো হবে!”
আলফি মাথা নাড়তে নাড়তে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ড্যাবড্যাব করে তাকে বলল, “আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করেছি?”
“না আমিই বললাম। আরবি বলল আমি নাকি পিচ্চি তাই আপনি আমায় পাত্তা দেন না।”
“১৮ মানেই কি খুব বড় হয়ে গেছিস?”
“বিয়ের বয়স তো হয়েছে।”
“কে বলল?”
“পাশের বাসার আন্টি। তিনি তার ছেলের জন্য বার বার আম্মুর কাছে আসেন। তার বাড়ির বউ বানাবেন আমায়!”
“সেই খুশিতে তুই নাচছিস?”
আফরিন উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। মেয়েটার হাসির স্বর মারাত্ম*ক। আলফি ঢোক গিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে দেখল চা শেষ। যা এটা কখন হলো!
“না না আপনাকে শুনাচ্ছি। আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনি একাই তাহলে না। আমার কাছে আরো অপশন আছে!”
“কিসের অপশন?”

“বিয়ের! পাশের বাসার আন্টির ছেলে, ছোট চাচ্চুর ছেলে, আমাদের কোচিংয়ের একটা ছেলে আর আপনিও!”
“এতো!”
“না তো, আমি তো কেবল লাইন মারছি আপনার পিছনে!”
বলেই জিভে কামড় দিল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আলফি ভাই আমার চিঠিগুলোর উত্তর দিবেন না।”
“কিসের চিঠি?”
“ঢং করবেন না একদম। আরবি আমায় বলেছে আপনি সবগুলো পড়েছেন!”
আলফি চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল। তার বোন আস্ত একটা গাধা। একদিন ধরে ওটাকে দেওয়া উচিত। আলফি মুখখান গম্ভীর করে খালি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“বিয়ের কথা ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দে। সেটা এখন দরকার!”
“কি যে বলেন ভাই। আমি তো ভেবেছি এইচএসসির পর আর পড়াশোনাই করব না। ওসব আমার দ্বারা হবে না। বিয়ের পর সংসার সামলাবো।”

“কেন?
“পড়াশোনা করতে আর ভালো লাগে না।”
“কিন্তু তুই তো ভালো ছাত্রী।”
“বংশগত! আমার বাপ ছিল। এরপর বড় আপা, মেঝো আপা আর আমি। ছোটটাও মেধাবী। এবার ট্যালেন্ট পুল বৃত্তি পেয়েছে। যাক গে। তবুও পড়াশোনা ভালো লাগে না। আমার সাথে মেট্রিক দিয়েছে ওই মেয়ের এবার ছোট একটা বাচ্চা হয়েছে। কি সুন্দর যে দেখতে আলফি ভাই কি বলব।”
আলফির মনে হলো এখানে এতোক্ষণ বসে থাকাই তার ভুল হয়েছে। আফরিন কোনো কথা হিসেব করে বলে না। তার যা ইচ্ছে করে তাই বলে। সে হঠাৎ কেশে উঠে বলল, “তোর আমার বয়স ডিফারেন্স জানিস?”
“বেশি না ১১ বছর ১০ দিন।”
“এরপরেও এই বুড়ো ব্যাটাকে বিয়ের কথা বলিস?”
“আপনি বুড়া না ভাই, আপনি হ্যান্ডসাম। কেউ বিশ্বাস করবে না আপনি আমার এতো বড়।‌ জানেন আমার বাপের আর মায়ের বয়স ৮ বছরের ব্যবধান।”

“আগে এসব চলতো আফরিন। এসব ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগ না।”
“না আমি বিয়ে করব। এটাই ফাইনাল।”
আলফি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। বলল, “তাহলে আমায় বিয়ে করতে পারবি না। আমার বউকে আমি বিয়ের পরেও পড়াশোনা করাবো।”
“কেন? বিয়ের পর পড়াশোনা করে কি হবে?”
“কিছু না আমার ইচ্ছে।”
আফরিন তার চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “আলফি ভাই একটা কথা বলি শুনেন, মেয়েরা বেশি পড়াশোনা করা একদম না ভালো না। বিয়ের পর কলেজ ভার্সিটি গেলে তাদের মন বদলে যায়। এরপর দেখবেন একদিন আপনার বউও..

বলতে গিয়ে থেমে গেল। আলফি ভাইয়ার চোখ রাঙানি দেখে বাকি কথা পেটে চালান করে বলল, “আপনাকে বিয়ে করলে পড়াশোনা করতেই হবে?”
আলফি অন্যদিকে ঘুরে মাথা নাড়ল। আফরিনের মুখটা বেজার হয়ে গেল। না না, বিয়ের পর পড়াশোনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এসব সে চায় না। পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না তার। এখন মনে হচ্ছে আলফি ভাইকে আর বিয়ে করা সম্ভব হবে না। অন্য কাউকে দেখতে হবে। তার চেহারা দেখেই এসব আন্দাজ করে ফেলল আলফি। অতঃপর সে চলে গেল।
৫ মিনিটের মাথায় আরবির ঘর ছেড়ে ছুটে এলো। এসেই হাঁপাতে লাগল। আলফি চোখ মুখ কুঁচকে তাকে দেখছে। আফরিন হাঁপাতে হাঁপাতে শুধায়, “আপনাকে বিয়ে করলে কি পড়াশোনা করতেই হবে আলফি ভাই?”

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৩

আলফি মাথা দুলাল। আফরিন ৫ সেকেন্ড ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আমি রাজি। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন কবে?”
আলফি পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। আফরিনের কথা শুনে কাঁশির চোটে সবগুলো পানি গিয়ে পড়ল সামনের রেলিংএ। বেচারার চোখ মুখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। ধমকে*র সুরে এদিক ফিরে বলল, “কি বললি?”
আফরিন জিভ কামড়ে হেসে বলল, “ভেবে দেখলাম। হ্যান্ডসাম বর পাবার জন্য এতোটুকু কষ্ট করাই যায়। পড়াশোনায় আর কষ্ট কি? আপনার মতো একটা হ্যান্ডসাম বর পেলেই আমি খুশি।”
“তুই যাবি এখান থেকে!”
আফরিন গালভর্তি হেসে আবারো ছুট লাগালো। আলফি পিছন তাকাল। দেখল সে ছুটতে ছুটতে আরবির ঘরে ঢুকেছে। অসম্ভব রকম ইঁচড়ে পাকা মেয়ে একটা!

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৫