প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৬
মিমি মুসকান
বৃষ্টির তেজ এখনো কমেনি। আর ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হলে ঢাকা শহর ডুবে যাবে নির্ঘাত। সেই কখন থেকে ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমরিশার বান্ধবীর ফোন। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে যে। এখনো কোথায় সে। কোথায়?
নরম বুকের উপর তার নিথর দেহ শুয়ে আছে। নড়চড় করার মতো শক্তি পাচ্ছে না। হলুদ শাড়িতে হলুদ পাখি হয়ে আকাশে যে ডানা মেলে উড়ছিল তাকে মূহুর্তেই খাঁচা বন্দি করে ফেলল মান্নাত। শাড়ি লুটিপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। আমরিশার লিপস্টিক রাঙানো অধরজোড়ার দাগ মান্নাত ঘাড়, গলা, গাল সবকিছুতে অদ্ভুত রকমের নকশা এসেছে। মান্নাত বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তার ঠোঁটের কোণে লাগা লিপস্টিক মুছে দিল। লিপস্টিক ঠোঁটে অবশিষ্ট নেই আর। আমরিশা চোখ বুজে আসছে। বুকের মধ্যে পাঁচ আঙুলে খাম*ছি ধরে চোখ বুজে নিল। মান্নাত তার ছোট শরীর নিজের আগলে নিয়ে বলে উঠলো,
“আমরিশা, এই আমরিশা! কথা বলো? কাঁদছো কেন? ক*ষ্ট হচ্ছে তোমার? কি হয়েছে জান, কথা বলো!”
আমরিশার বলার মতো কোনো মুখ নেই। সে তার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। রা*গে ল*জ্জায় নিজের উপর ধি*ক্কার দিচ্ছে।কি করল এটা। মান্নাত এবার উঠে বসল। তার ছোট শরীরটা চাদরে পেঁচিয়ে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নিল। আমরিশা ফিরে চাইছে না। গুনগুন শব্দ করে কাঁদছে। কি কারণে কাঁদছে মান্নাত বুঝে উঠতে পারছে না। সে কেবল চাপা স্বরে বলছে,
“জান, জান আমায় বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে।”
“ছাড়ুন আমায়!” তীব্র ঘৃণা*র স্বর। কেবল তার উপর না। স্বয়ং নিজের উপরেই যেন শতভাগ।
“কি করে ফেললাম। এটা তো কথা ছিল না। আমি এখন কি করব? কি করব এবার!”
চাদরে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁ*দে উঠল সে। মান্নাত তাকে শান্ত করার পুরো চেষ্টা করছে। শেষে ধ*মকের সুরে বলল,
“থামো!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কান্না থেমে গেল সাথে সাথেই। আমরিশা অশ্রু*সিক্ত নয়নে ড্যাব ড্যাব করে দেখছে মান্নাত কে। তার কোলের মাঝে এই মুখটা যেন শান্তির স্রোত বয়ে দিচ্ছে। সে মুচকি হেসে বলল, “বিয়ে করে ফেলি।”
“কি বললেন?” চমকে উঠল সে। মান্নাত হেসে বলল, “তো তোমার কি মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে ছেড়ে দিব। উঁহু একদম না। আমার জানকে আমি ছাড়ছি নাকি। কেঁদো না জান, তোমার কান্না আমার স*হ্য হয় না।”
হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল উল্টোপিঠে। শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “তুমি বললে এখনি বিয়ে করে ফেলব। চলো উঠো এখনি।”
“এভাবে হয় না। আমি মা কে কি বলব? আর আপাকে কিভাবে বুঝাব। তাদের ছাড়া বিয়ে তাও এভাবে। সারাটে জীবন আমি মুখ দেখাব কিভাবে?”
মান্নাতের মলিন মুখে এবার চিন্তার ভাঁজ। আমরিশা মুখখানি আবার মলিন হয়ে উঠছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। এই যেন কেঁদে ফেলে। হুট করে সে ঠোঁট জোড়া কা*মড়ে ধরল সে। আমরিশা রীতিমতো কই মাছের মতো লাফিয়ে উঠল। চোখ মুখ গরম করে তাকাল এদিক। মান্নাত মৃদু হাসল। তার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের আগলে তাকে জড়িয়ে ধরল। বলে উঠলো, “সাত দিন! কথা দিচ্ছি সাতদিনের মধ্যে তোমার আমার বিয়ে হবে তাও পরিবারের সম্মতিতে।”
আমরিশা ফিরে চাইল। আস্থা খুঁজছে দৃষ্টি জোড়া। মান্নাত মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল। ললাটে চুমু খেয়ে বলল, “তোমাকে কথা দিচ্ছি জান, তুমি শুধুই আমার হবে। আমরা বিয়ে করবো। খুব জলদি তুমি আমার বউয়ের পরিচয় পাবে!”
আমরিশা মুখ লুকিয়ে ফেলে উদাম বুকের মধ্যে। এর চেয়ে শান্তির জায়গা এখন আর তার জানা নেই। মান্নাত ও ভেবে নেয়, প্রান্তিক কে সবটা জানাতে হবে এবার। সময় ঘনিয়ে আসছে!
আফরিন আজ মহাখুশি। হবেই না বা কেন? আলফি ভাই নিজে তাকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। তিনি গাড়ি ড্রাইভ করছেন। তার পাশেই আফরিন বসে পা ঝুলাচ্ছে বাচ্চার মতো। আলফি আড়চোখে তাকে দেখছে। ভাবতেই অবাক লাগছে এই মেয়েকে সে কিভাবে পছন্দ করল। কিভাবে মন দিয়ে বসল এতোটুকু বাচ্চাকে। ও তো এখনো বাচ্চা! ভালোবাসার বুঝেটা কি? বয়সে ছোট দেখতে হলে কি হবে? পাকনামি যেন তার রগে রগে। রক্তে ভরে গেছে!
আফরিন মিটিমিটি হেসে কেবল এদিক ফিরছে। আলফি ভাই এবার বলেই উঠলেন,
“এভাবে কি দেখছিস? জীবনে ছেলে দেখিস নি?”
“দেখেছি। কিন্তু আপনাকে দেখার পর আর কাউকে দেখিনি।”
আলফি গাড়ি ব্রেক কষতে গিয়েও কষল না। এই পিচ্চি মেয়ে বলে কি? ফিরে চাইতেই দাঁত বের করে হাসল। আলফির প্রান্তিকের কথা মনে পড়ল হুট করে। ও যেমনি মেয়ে পটাতে পটু তেমনি ঠিক এই মেয়ে! এদের জিন এক হলো কিভাবে?
“এভাবে কি দেখছেন? মেয়ে দেখেননি জীবনেও?”
আলফি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “দেখেছি”
“কিন্তু আমার মতো একজনকেও দেখেননি তাই না। আচ্ছা আলফি ভাই, আপনার দেখা মেয়েদের মধ্যে আমি বেশি সুন্দরী হতেই পারি তাই না।”
“তুই আর দুটো কথা বললে আমি তোকে এই মাঝরাস্তায় ফে*লে চলে যাবো বললাম!”
“তাহলে একটি কথা বলব!”
আলফি চোখ রাঙালো। আফরিন মুখ ভেংচি কেটে বাইরে তাকাল। রাতের অন্ধকারে বাইরে তাকানোর মতো কিছু নেই। অতঃপর সে ঘুরে ফিরে এদিক তাকাল। বেহায়ার মত গালে হাত দিয়ে এদিক চেয়ে আছে। আলফি গলার টাই লুজ করল। তাকে দেখতে আজ বিরাট হ্যান্ডসাম লাগছে। সাদা শার্ট, কালো ব্লেজার, ফরমাল প্যান্ট, কালো টাই! আফরিন মাথা দুলিয়ে বলল,
“আলফি ভাই আপনাকে আজ হাসবেন্ড ম্যাটারিয়াল লাগছে!”
জোরছে ব্রেক কষল আলফি। চোয়াল শক্ত করে এদিক ফিরে বলল, “বের হ গাড়ি থেকে!”
“যা বাবা, আজকাল মানুষের প্রশংসা করলে বুঝি রে*গে যায়। যা সত্যি তাই তো বললাম।”
“তুই বেশি পাকনা আফরিন। তোর সাথে থেকে থেকে আমার বোনও পাকনা হয়ে যাবে।”
“তো কি বলেন? আর চলবো না আপনার বোনের সাথে!”
আলফি কথা না বাড়িয়ে গাড়ি ড্রাইভ শুরু করল। বৃষ্টির তেজ এখনো কমেনি। গাড়ি চালাতেও হচ্ছে সাবধানে। এই আফরিনের কথার কারণে যে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে তা আর বলতে হবে না। আফরিনের মুখটা ভারী হয়ে উঠল। অভিমানী স্বরে বলে উঠলো, “ওহ আপনি তাহলে আমাকে ইনডাইরেক্টলি বলছেন আপনাদের বাড়িতে আর না আসতে। ঠিক আছে আসবো না!”
আলফি অবাক হলো? এই মেয়ে যে দু লাইন বেশি বুঝে তা আর বলতে হবে না। কথা বাড়াল না সে। বাতাসের তেজ ও বাড়ছে। এতো রাতে বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। এরপর ষোলকলা পূর্ণ করল গাড়িটা। হঠাৎ আপনাআপনি থেমে গেল। আলফির মাথায় হাত। এরচেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে? সাথে এই পাকা মেয়ে এখন অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আর এখনই তার গাড়ি নষ্ট। মাঝরাস্তায় এখন কি করবে সে?
তবু আফরিনকে গাড়িতে বসতে বলে নিজে বেরিয়ে গেল। ব্লেজার খুলে রেখে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি দেখতে বেরিয়েছে। টায়ারের কিছু হলো নাকি? না, টায়ার তো ঠিকই আছে। তাহলে? সামনের গাড়ির হুড খুলে চেক করছে। অন্ধকারে ফোনের আলো জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির তেজে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাথার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে দুরুম দুরুম। এরই মধ্যে পাশে এসে কে যেনো দাঁড়াল। আলফি চেয়ে দেখল আফরিন দাঁড়িয়ে।
ভিজে গেছে সাথে সাথেই। আলফির কানের কাছে চেঁচিয়ে বলছে, “গাড়িতে ছাতা নেই আলফি ভাই?”
আলফি চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল। ইচ্ছে করছে ঠাঁটিয়ে একটা চড়* মারতে মেয়েটাকে। ওর মাথায় ঘিলু বলতে কি কিছু নেই? আছে শুধু প্রেম আর ভালোবাস। খালি বিয়ের চিন্তা। ধপ করে হাতটা শক্ত করে ধরে গাড়ির ভেতর ছুঁড়ে ফেলল। তাও পিছনের সিটে। আলফির এমন আচরণে আফরিনের মন*ক্ষুণ্ন হলো। বেচারা ওমন বৃষ্টির মধ্যে ভিজছিলো বলেই তো সে জিজ্ঞেস করল। এতে রাগ করার কি হলো?
আলফি এসে বসল সামনের সিটে। ফোন বাজছে। মান্নাতের কল। ফোন ধরতেই তাকে বলল,
“গাড়ি মাঝপথে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তুই প্লিজ গাড়ি নিয়ে আয়। আমি লোকেশন দিচ্ছি। না না, বাইক না গাড়ি নিয়েই আয়। সাথে মেয়ে আছে। আরে বাবা, বললাম তো। ধুর রাখছি!”
আফরিন এতোক্ষণ কান খাড়া করে শুনছিলো। আড়চোখে চেয়ে দেখছিলো বার বার। দেখবে নাই বা কেন? তার হাসবেন্ড ম্যাটারিয়াল আলফি ভাই ভিজে পুরো একাকার। সাদা শার্ট চিপকে আছে শরীরের সাথে। কি আকর্ষণীয় দেহ দেখা যাচ্ছে। ওই পাকা মেয়ে আবার না দেখে থাকবে। আলফি তাকাল সামনের আয়নার দিকে। আফরিনের আড়চোখে দেখার ব্যাপারটা সে দেখল। দৃষ্টি আরেকটু নিচু নিতেই চোখ ফিরিয়ে নিল। ঠোঁট কামড়ে ধরল। এই মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আরেক কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে!
আফরিন পরেছিলো সাদা রঙের টপস। বৃষ্টির পানির ছোঁয়ায় সেই সাদা টপস এখন তার শরীর জুড়ে চিপকে আছে। ফুটিয়ে তুলছে শরীরের প্রতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এই মেয়ের সেদিকে কোনো খেয়াল আছে। থাকার কথাই না। ওতো বুদ্ধি তার নেই। আলফি তার ব্লেজার ছুড়ে মা*রল পিছনের সিটে। বলল, “পরে নে!”
অভি*মানী চোখ জোড়া ফিরেও তাকাল না ব্লেজারের দিকে। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। কি একতেজী মেয়েরে বাবা। আলফিও কম যায় না। রাগ মাথায় চ*ড়লে ঠিক থাকে না তার। এখন ওই পুঁচকে মেয়েকে একটা চ*ড় মারতেও তার হাত কাঁপবে না। রাগ কাঁ*পছে সে। গাড়ি থেকে হুট করে বেরিয়ে পিছনের সিটে গিয়ে বসল সে। আফরিন ভয়ে আঁ*তকে উঠল। আলফি ভাই বরাবরই তার জন্য শান্তশীল মানুষ। এখন তার চোখ রাঙানো দেখে এবার যেন একটু নিমিয়েই গেল আফরিন। ঠোঁট কাম*ড়ে ধরল। আলফি তার বাহু চে*পে ধরে কাছে টেনে নিল। ব্যাথায় আর্ত*নাদ করতে গিয়ে আফরিন থেমে গেল। ব্লেজার হাতে নিয়ে আলফি তাকে সেটা পরিয়ে দিল। আফরিন মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ধম*কে দিল।
“আর একটা কথা বললে গাড়ি থেকে ছুঁ*ড়ে ফেলে দিবো তোকে। চুপ! একদম চুপ!”
আফরিন চুপ করে ফেলল কিন্তু তার চোখে এসে ভিড়তে লাগল অশ্রুরেখা। সে ঠোঁট চেপে নাক টেনে নিল। না কাঁদবে না সে। আলফির থেকে একটু দূরে সরে বসে অভিমানী হয়ে তাকাল।
আলফি এবার খানিকটা নরম স্বরেই বলে উঠলো, “তোকে আমি বলেছি এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে আসতে। বেরুলি কেন? নিজের প্রতি কি বিন্দুমাত্র খেয়াল তোর থাকে না!”
ব্লেজার দুই হাতে চেপে ধরে ভারা*ক্রান্ত গলায় বলে উঠলো, “আমার প্রতি এতো দরদ দেখাতে কে বলেছে আপনাকে? দেখাবেন না দরদ। ওদিকে আপনার বিয়ে ঠিক হচ্ছে আর এদিকে আপনি আমার প্রতি দরদ দেখাচ্ছেন। কি ভাবেন আমি কিছু বুঝি না।”
আলফি পড়ল সাত আসমান থেকে। ওর বিয়ে আবার ঠিক হলো কবে? কাঁদতে না চাইলেও কেঁদে উঠল আফরিন। মনটা ভীষণই নরম তার। আজকের অনুষ্ঠানেই শুনেছে আলফি ভাইয়ের বিয়ের কথা। ঠিকঠাক হবে বোধহয়। থাক তাতে কি? বিয়ে তো আর হচ্ছে না। আফরিন চিরকালই পজিটিভ মানুষ। কিন্তু এখন আলফি ভাইয়ের বকুনি খেয়ে কিছু একটা বলা তো চাই। মেয়ে মানুষ বলে কথা। কথায় চিঁড়ে না ভিজলেই কেঁ*দে ফেলবে। সেই কৌশল আফরিনের বেশ জানা।
আলফি থতমত খেয়ে বলল, “আমার বিয়ে? কবে? কখন?”
আফরিন নাক টেনে বলল, “এমন ভাব কেন করছেন আলফি ভাই? কি ভাবেন আমি কিছু বুঝি না। আপনাকে তো ভালো মানুষ বলেই ভেবেছিলাম। ওখানে বিয়েও ঠিক হয়েছে আর আপনি এখানে আমার সাথে ফ্লার্টিং করছেন।”
আলফি অপরাধীর মতো তোতলাতে লাগল। থেমে থেমে বলল, “আমার কবে বিয়ে ঠিক হলো? আর আমি কখন তোর সাথে ফ্লার্টি করলাম?”
আফরিন এদিক ফিরল। কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে এখনই। এগিয়ে এসে হুট করেই আলফির কলার চেপে ধরল। বলল, “আপনি নিজেকে কি ভাবেন বলবেন? এই যে আমাকে এতো রাতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এগুলো কি? আপনি চাইলেই কি পারতেন না ড্রাইভার আংকেল কে দিয়ে আমায় পাঠাতে। এখন আবার ব্লেজার খুলে দিচ্ছেন। এসব কি খুব সহজ। সবার সাথেই এমনটা করেন আপনি?”
আলফির মাথা গ*রম হয়ে যাচ্ছে। আফরিনের হাত সরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কন্ট্রোল ইয়োর সেলফ আফরিন!”
এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো, “আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না আলফি ভাই। ভালো না বাসলে এতো চিন্তা কেন করেন? এতো কেয়ার কেন করেন? কি দরকার? আমার ছোট মনটা নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলছেন। এসব মানায় না আপনাকে। আপনি আজকেই বলে দিন, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমি কথা দিচ্ছি কাল থেকে আর আপনার বাড়িতে যাবো না। আপনাকে আর বির”ক্তিও করব না। আপনি আর আফরিনের মুখও দেখবেন না। শুধু একবার বলে দিন আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আমার চিঠিগুলো আপনি পড়েন নি। নাকি পড়েছেন? তার উত্তর দিন। আজ আমার উত্তর চাই আলফি ভাই। আমি তো বলেও দিয়েছি বিয়ের পর পড়াশোনা করবো, তাহলে? তাহলে আমায় কেন ভালোবাসবেন না আপনি?”
এরপর আরো শত কথা। কথা শুনে আলফির এখন মনে হচ্ছে আফরিন পাক্কা ড্রামা বাজ মেয়ে। ভালোই কৌশল জানে। কিন্তু তার চোখের পানি দেখে সে গলে গেলে। নিজের মনকে শক্ত রাখার এতো চেষ্টা করলেও পারল না। দুর্বল সে হয়েই গেল। বাইরে আকাশ কাঁদছে এদিকে কাঁদছে আফরিন। কষ্ট হবেই না কেন? আফরিনকে সে পছন্দ করে। অত্যধিক পছন্দ! জীবনের প্রথমে কোনো মেয়ের প্রতি তার ভালো লাগা কাজ করেছে। কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছে। সমস্যা একটাই! মেয়েটার বয়স। আফরিন আর কয়েকটা বছর আগে জন্ম নিলে এতো সমস্যা হতো না!
আফরিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আলফি তার মাথায় হাত রাখার চেষ্টা করতেই সে ফুঁসে উঠল।
“একদম দরদ দেখাবেন না। আপনি আমায় না ভালোবাসলে কোনো দরদ দেখাবেন না। আপনার এতো ভালো মানুষি দেখে আমি আরো আপনার প্রেমে পড়ে যাবো।!”
তার কথা শুনে আলফি ঠোঁট চেপে হাসল। আফরিনের কান্নার সুর আগে থেকেও বেড়ে গেছে। আলফির এখন মজা লাগছে। তার জন্য ও কোনো মেয়ে কাঁদতে পারে? নিজের মা আর বোনের পর এই আফরিন কে দেখল এমনভাবে কাঁদতে। নরম স্বরে বলল,
“আর কাদিস না থাম এবার। বৃষ্টিতে ভিজে এভাবেই শীতে কাঁপছিস। এরপর কেঁদে ফেদে জ্বর বাধাবী, ঠান্ডা ও লাগবে। এরপর কাল বাড়িতে কেবল তোর হাঁচির শব্দ শুনব!”
আফরিন মাথা দুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে থেমে গেল। চোখে মুখে অদ্ভুত রকমের বিস্ময়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। কান্না থেমে গেছে তার। হা হয়ে চেয়ে থেকে বলল, “এর মানে?”
আলফি মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুই কিভাবে বলতে পারলি তোর মুখ কখনো আমায় দেখাবি না। তুই জানিস, আমার চোখ সর্বক্ষণ তোকে খুঁজতে থাকে!”
আফরিনের মন খুশিতে উলালা হয়ে গেছে। সে এই ঠোঁট চেপে হাসছে। লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলছে। লজ্জা মাখা স্বরে বলে, “তার মানে আপনি সত্যিই আমায় বিয়ে করবেন বলুন। আমায় ভালোবাসেন!”
আলফি তৎক্ষণাৎ মুখটা গম্ভীর করে বলে উঠলো, “ভালোবাসা বাসি ট্রাকের মধ্যে ভরে রাখ এখন। সব তোর ভার্সিটিতে উঠার পর। এখন কিছু না!”
আফরিনের কান্না উধাও। অথচ চোখের কোণে এখন জল গড়িয়ে পড়ছে। অথচ মেয়েটা হাসছে খিলখিলিয়ে। আলফি এগিয়ে এসে তার চোখের জল মুছে দিল। ভাবনায় পড়ে গেল। এতো আগে স্বীকার করা ঠিক হলো? আর কিছুদিন কি অপেক্ষা করার দরকার ছিল?
বাজ পড়ল। পরপর দু’বার! প্রথমবার বাজ পড়ার শব্দে আলফিকে সে আঁকড়ে ধরল। দ্বিতীয়বার তার বুকে মুখ লুকাল। আলফি শ্বাসরোধ করে সিটের দুই দিকে হাত ছড়িয়ে বসে আছে। কোনোভাবেই আফরিনকে জড়িয়ে ধরা যাবে না। উঁহু একদমই না!
বৃষ্টির তেজ কমে আসছে। আলফি আর আফরিন কাছাকাছি বসে আছে। আফরিনের মুখটা আলফির বুকের মধ্যে। একটু উঠিয়ে দেখল। দুজনের চোখাচোখি হলো। আলফি হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এলো। নিজেকে কন্ট্রোলের সব চেষ্টা। অতঃপর তার ললাটে একটা চুমু খেলো। গভীরতম চুমু। জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষের ছোঁয়া পেয়ে আফরিন লাফিয়ে উঠল। ধরফর করে পিছিয়ে গেল দ্রুত। তার বুক কাঁপছে। মুখ খুলে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে। তাকে দেখামাত্র আলফি হেসে উঠল। এই পাকা মেয়েকে শায়েস্তা করার পথ সে পেয়ে গেছে। আফরিন খেয়াল করল, তার শরীর গরম হয়ে আসছে। কান দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে। সিটের এক কোণে ঠেসে বসে রইল সে। আলফি হেসে বলল, “বাকিটুকু তাহলে তোলা রইল!”
আফরিন মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করল, “কি তোলা রইল!” পরক্ষণেই বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে বসে রইল। কিন্তু চুপ করে বসে থাকার মানুষ সে নও। আচমকা বলে উঠলো, “তার মানে ভার্সিটিতে উঠার পর আপনি আমার এখানে চুমু খাবেন আলফি ভাই!”
ঠোঁটের দিকে ইশারা করল সে। আলফির পুরো শরীর গর*ম হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ থমকে থাকার পর মনে পড়ল। ও অন্যকেউ না। আফরিন! এর কান্না, লজ্জা সবকিছুই দু সেকেন্ডের জন্য আসে। এরপর দ্রুতই সে আগের বেশভুষায় ফেরত চলে আসে। আফরিন এগিয়ে এসে বলতে লাগল, “আপনি জানেন আমাকে কখনো কেউ চুমু খায়নি। আপনি..
বাকি কথা শোনার ধৈর্য আলফির নেই। তার মাথা ইতোমধ্যেই ঘুরে যাচ্ছে। সে দ্রুতই গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এরই মধ্যে মান্নাতের গাড়ি এসে থামল!
মান্নাতের আসার কথা থাকলেও সে একা আসেনি। সাথে নিয়ে এসেছে মৌনতা আর আশিককে। বৃষ্টি এবার পড়ছে ঝিমিয়ে। আশিক ছাতা নিয়ে আগে বেরুল। তার পিছন পিছন মৌনতাও বেরুলো। বেরিয়েই প্রশ্ন, “কিরে তুই বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন দাঁড়িয়ে?”
আলফি জবাব দেবার আগেই দুজনে গাড়ির ভেতরের মেয়েটিকে দেখে ফেলল। আফরিন ও দেখছে তাদের। মান্নাত বেরুলো এবার ছাতা হাতে। আলফির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কি করছিস দাঁড়িয়ে?”
আফরিন বেরিয়ে এলো সাথে সাথেই। মান্নাতের সাথে এই অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ সে বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি। তবে মান্নাত পুরোপুরি হতবাক। আফরিন হাত নাড়িয়ে বলল, “আরে আপনি যে? কি জানি নাম আপনার ওই বাংলা সিনেমার হিরো মান্না না কি?”
আশিক বলে উঠলো, “মান্নাত!”
“হ্যাঁ, কেমন আছেন আপনি?”
মান্নাত নিজেকে সামলে উঠে শুধায়, “তুমি এখানে কি করছো আফরিন?”
“বাসায় যাচ্ছি!” বলেই হেসে উঠল।
প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৫
সকলে চোখে মুখে অবাকের রেশ। আলফি বলে উঠলো, “তোরা একে অপরকে চিনিস?”
মান্নাত মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ!”
আফরিন সাথে সাথে জবাব দেয়, হ্যাঁ উনি তো দুলাভাইয়ের ফ্রেন্ড!”
“তোর দুলাভাই আবার কে?”
মান্নাত চাপা স্বরে বলে উঠলো, “প্রান্তিক চৌধুরী!”
তিন মাথা থমকে তাকায় আফরিনের দিকে। আফরিন মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ আপার বর, আমার দুলাভাই!” তিন মাথার উপর বা*জ পড়ল সাথে সাথেই। চমকে উঠল আকাশ। বৃষ্টি শেষ হয়েছে সবে। এমন সময় মেঘের গর্জন রহস্যময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করল!