প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১২

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১২
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

অন্ধকার রুমে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে আহানাফ। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আবিদের লোকজন তাকে ধোঁকা দিয়ে অচেতন অবস্থায় তুলে এনেছে। রাশেদ নামের ছেলেটির ফোন পেয়ে আবিদ দ্রুত চলে এসেছে। প্রচন্ড ব‍্যাস্ত ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করে ড্রিম লাইটের আলোটা জ্বালিয়ে দেয় আবিদ। রুমের ভেতর কারো উপস্থিতি টের পেতেই আহানাফ নিভু নিভু চোখে তাঁকায়। তার সামনে ব‍্যাক্তিটি চ‍েয়ার নিয়ে বসতেই দেখে। আহানাফ আবছা দৃষ্টিতে উত্তেজিত হয়ে জিগ্যেস করে,

‘কে আপনি? আমাকে তুলে এনেছেন কেনো?’
আবিদের হাসি পায় ছেলেটা চঞ্চল স্বভাবসুলভ। এইযে বন্দি থেকেও বিন্দুমাত্র ভয় লাগছে না ছেলেটির।আবিদ তার সঙ্গে কি করতে পারে তার ধারণা নেই। অবশ্য আবিদের চেহারা সুস্পষ্ট নয় চেনার কথাও নয়। আবিদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাঁকা হেসে বলে উঠে,
‘আওয়াজ নিচে হবে! ভুলে যেয়ো না তুমি আমার কাছে বন্দি। বিনা কারণে তোমাকে এখানে বেঁধে রাখার বিন্দুমাত্র শখ নেই আমার।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আবিদের এমন কাট কাট গলায় তাচ্ছিল্য পূর্ণ উত্তরে আহানাফ ভয় পায়। কারণ সে জানেনা কেনো তাকে এখানে আনা হয়েছে। ভয় পাওয়া খুবই নরমাল।আহানাফের কারো সঙ্গে বাহ‍্যিক কোন শত্রুতা নেই। বাবা আর্মি ম‍্যান হওয়ার সুবাদে বরং সব জায়গাতে পরিচিত। এবং যথেষ্ট সুনাম আছে। তবে হঠাৎ করে তার নতুন শত্রু কোথায় থেকে উদয় হলো? আহানাফকে ভিত অবস্থায় পরোক্ষ করে আবিদের আনন্দ হচ্ছে। আবিদকে মৃদু হাসতে দেখে আহানাফ ঘাবড়ে যায়। ভিত স্বরে বলে,
‘আপনি কে? আপনার আমার সঙ্গে কিসের শত্রুতা?কি চান আপনি?’

আবিদ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে লাইট জ্বেলে দেয়। আহানাফ আবিদকে দেখে থমকে যায়। এতোক্ষণ ভয় পেলেও আবিদকে দেখে তার রাগ হয়। আহানাফের মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে এই ম‍্যাজিস্ট্রেট কেনো তাকে কিডন‍্যাপ করিয়েছে?লোকটি কি চায় তার থেকে? আহানাফ আবিদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিল। তাছাড়া হৃদির কাছ থেকে বেশকিছু তথ‍্য জেনেছিল আবিদ সম্পর্কে। আহানাফ নিজেও অবাক ছিল আবিদের ব‍্যাপারে তার কিউরিসিটি নিয়ে। তবে এসবের পেছনে প্রত‍্যক্ষভাবে প্রিয়দর্শিনী জড়িত ছিল। আহানাফ প্রিয়দর্শিনীকে পছন্দ করে। প্রিয়দর্শিনীর সঙ্গে আবিদের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করে জন‍্য আহানাফ খোঁজখবর নিয়েছিল। আবিদ সু’ক্ষ্ম নয়নে আহানাফকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

‘কাল দর্শিনীদের গার্ডেনে কেনো গিয়েছিলে?’
আবিদের চোখ ধক করে জ্বলে উঠেছে সেইসঙ্গে আবিদের সু’ক্ষ্ম দৃষ্টিতে সামান‍্য নি’ষ্ঠু’রতা ফুটে উঠছে। এতেই আহানাফ ভড়কে যায়। কাল অগচরে প্রিয়দর্শিনীকে একনজর দেখার জন‍্য সে প্রাচীর টপকেছিল। এটা কারো জানার কথা নয়, আবিদ কিভাবে জানলো? আবিদ’কে আহানাফের বরাবরই অদ্ভুত মনে হয়।

সেদিনের ফোন কলের পর প্রিয়দর্শিনীর সঙ্গে আহানাফের যোগাযোগ ছিলনা। আহানাফ ফোন দিলেও প্রিয়দর্শিনী রিসিভ করেনি। এদিকে প্রিয়দর্শিনীকে একনজর দেখার জন‍্য,কেমন আছে জানার জন‍্য আহানাফের মন ব‍্যাকুল ছিল তাই লুকিয়ে দেখার চান্সটা মিস করতে চায়নি। কাল যথেষ্ট সাবধানে দারোয়ানদের ফাঁকি দিয়ে গার্ডেন এরিয়ায় গেছিলো। আহানাফ কপাল ভালো ছিল প্রিয়দর্শিনীকে বাসার সামনে খালি বেলকুনিতে দেখতে পেয়েছিল।

আহানাফ যথেষ্ট সাবধানে অন্ধকারের আড়ালেই হৃদয়হরণীকে দেখছিল। কিন্তু প্রিয়দর্শিনীর নজরে পড়ে যাবে। এবং তার ছায়ামূর্তি দেখে প্রিয়দর্শিনী ভয় পেয়ে যাবে এইটা কল্পনা করেনি। প্রিয়দর্শিনীর চিৎকারে সবাই যখন সতর্ক হলো খুব সাবধানে প্রাচীর টপকে রাস্তায় চলে আসে। রাস্তা নিড়িবিলি ছিল তবে আবিদ শাহরিয়ার তাকে কিভাবে দেখলো? আহানাফকে চুপ থাকতে দেখে আবিদ ধমকে বলে উঠে,

‘চুপ থাকার চেষ্টা করোনা। সারাজীবনের মতো নিশ্চুপ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। কেনো গেছিলে দর্শিনীদের বাড়ি? সিসিটিভি ফুটেজে তোমার চেহারা স্পষ্ট ছিল। কামঅন স্পিক আপ!’

আহানাফ টিনএজার ছেলে। আবিদের মতো বলিষ্ঠ সুপুরুষের কাছে রাম ধমক খেয়ে চমকে উঠবে স্বাভাবিক। আহানাফ বুঝতে পারছে আবিদ তার উপর নজর রেখেছিল। আর ল‍্যাম্পপোস্টের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ সে ঠিক মতো লক্ষ‍্য করেনি। এখন মিথ্যা বলেও লাভ হবে না সে ধরা পড়ে গেছে। অস্বীকার করলে হিতের বিপরীত হতে পারে। তাই সবটা অকপটে স্বীকার করে নেয়। আবিদ মনোযোগ দিয়ে আহানাফের পুরো কথা শুনে। এসব শুনে আবিদের রাগ হওয়ার কথা কিন্তু সে রাগটা দমন করে নেয়। কঠোরভাবে বলে,

‘পছন্দ করার জন‍্য আমার দর্শিনীকেই পেয়েছে?তুমি জানো দর্শিনীর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?’
আবিদের কথা শুনে আহানাফের চক্ষুচড়ক গাছ। যেই আবিদকে সে একদমই সহ‍্য করতে পারেনা।এক কথায় চক্ষুশূল তার সঙ্গে কিনা প্রিয়দর্শিনীর বিয়ে হবে?আহানাফের বি’স্মি’ত দৃষ্টি দেখে আবিদ বলে উঠে,

‘তুমি এখনো ছোট। তোমার পছন্দকে আমি সম্মান করছি। কিন্তু দর্শিনী কিছুদিন পর অন‍্যকারো অর্ধাঙ্গিনী হবে। তার প্রতি তোমার অহেতুক ফিলিংস রাখা অন‍্যায়,অনুচিত। তুমি কাল যেই কাজটা করেছ আমার উচিত ছিলো তোমাকে ঠাঁঠিয়ে চড় মা’রা। কিন্তু আমি সেটা করবো না। টিনএজার ছেলেরা আবেগে ভেঁসে বেড়ায়। আমি মে’রে কেঁ’টে আবেগ কমাতে চাইনা তাই তোমাকে বুঝাচ্ছি। আমার দর্শিনীর থেকে দূরে থাকবে।

আশা করছি দর্শিনী যে আমার তোমাকে সেটা আর বোঝাতে হবে না। আজ এইমুহূর্ত থেকে নিজের মনকে পরিবর্তন করবে। দর্শিনীকে পাওয়ার ইচ্ছে সারাজীবনের জন‍্য মাটি চাঁপা দিয়ে দিবে। আমার গার্ডস যারা তোমাকে বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। আবার সহিসালামত বাসায় পৌঁছে দিবে। আজকে যা কিছু হয়েছে কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। আর দর্শিনীদের গার্ডেনে যে তুমি ছিলে সেটাও আমি ধামাঁচাপা দিয়ে দিবো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই শুধু নিজে থেকে সিচুয়েশন বুঝতে শিখো। দর্শিনীকে ভুলে যাও।’

আহানাফের গাল বেঁয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। ছেলেদের নাকি কাদঁতে নেই কিন্তু আহানাফ অনিচ্ছাকৃতভাবে অশ্রুসিক্ত হচ্ছে!তার পছন্দের মানুষের বিয়ে হয়ে যাবে এটা ভাবতেই আহানাফের শরীর শিউরে উঠছে। আবিদের আহানাফকে এভাবে দেখে খারাপ লাগলো। সে আহানাফের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে বলে,

‘দেখো নিজেকে সামলাও। আমি সবসময় ভাগ‍্যতে বিশ্বাসী যেটা তোমার নয়, তুমি সেটা কখনোই পাবেনা। তাই ভেঙে পড়া যাবে না। ভবিষ্যতে হয়তো দর্শিনীর থেকে বেটার কেউ তোমার জন‍্য অপেক্ষা করছে। তাই এই ঠুনকো আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ো না। আমার বিশ্বাস তোমাকে বোঝাতে পেরেছি।’

আহনাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে আবিদের দিকে তাকাঁয়। আজ আবিদ শাহরিয়ারকে তার সবচেয়ে ভাগ‍্যবান পুরুষ মনে হচ্ছে।ধরণীর বুকে একটুকরো চাদঁ যাকে আহানাফ মনের গহীনে জায়গা দিয়েছিল।সেই চাদঁ আবিদ শাহরিয়ারের ব‍্যাক্তিগত। তার ভিতরে যে সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে প্রিয়দর্শিনী কি কখনো জানবে? আহানাফের সৌভাগ্যটুকু হলোনা সেই চাদঁকে জানানোর যে চাদেঁর অজান্তেই তাকে চেয়েছিল। অথচ সৌভাগ্যবান পুরুষ আবিদ শাহরিয়ারের নিজস্ব সেই চাদঁ। আহানাফ আবেগঘন কন্ঠে আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘প্রিয়দর্শিনীর কি সম্মতি আছে এই বিয়েতে।’
আবিদ আহানাফের ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখে বলল,
‘আমি জানি তোমার মনের অবস্থা। তোমার অবচেতন মন এইটা মানতে পারছেনা এটাই স্বাভাবিক। আমি দর্শিনীকে ভালোবাসি। আর আমি জানি দর্শিনীর মনে আমার জন‍্য ভালোলাগা,তার থেকে বেশি অনুভূতি আছে। এই বিয়েটা দর্শিনীর পুরোপুরি সম্মতিতেই হচ্ছে। তোমার মনে হতে পারে আমি মিথ্যা বলছি। এজন্য তোমার সামনেই আমি দর্শিনীকে ফোন দিয়ে জিগ্যেস করব।’

আবিদ প্রিয়দর্শিনীকে ফোন দেয়। একবার রিং হয়ে কে’টে যায়। দ্বিতীয়বার সেকেন্ডের মধ‍্যে ফোন রিসিভ হয়।আবিদ আহানাফের সামনেই লাউডস্পিকার অন করে দেয়। প্রিয়দর্শিনী আবিদকে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করে,
‘কেমন আছেন ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব?লোকটির খোঁজ পেয়েছেন? জানেন আমার খুব চিন্তা হচ্ছিলো।’
আবিদ মিষ্টি করে হেসে বলে,

‘আমার দর্শিনী কী আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলো? আমি ভালো আছি দর্শিনী! চিন্তার কোন কারণ নেই কাল বাড়িতে চোর এসেছিল। আমি মেট্রোপলিটন পুলিশকে জানিয়ে এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছি।এমন সমস্যা আর হবেনা। যতক্ষণ আমি আছি আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনি করবেন না মনে থাকবে?’
প্রিয়দর্শিনী আবিদের কথায় মৃদু হাসে। আবিদ দায়িত্ববান জানতো কিন্তু তার প্রতি আবিদের এতো ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ রয়েছে সেটা জেনে প্রিয়দর্শিনীর নিজেকে ধন‍্য মনে হচ্ছে। প্রিয়দর্শিনী লজ্জা পেয়ে বলে,

‘সাবধানে থাকবেন ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব। রাখছি!’
আবিদ তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,
‘দর্শিনী একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জিগ্যেস করার ছিল।’
আবিদ একবার আহানাফের দিকে তাকিয়ে দেখে। আহানাফের এসব দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে অদৃশ্যভাবে আঘাত করছে। প্রিয়দর্শিনী তার হবেনা সে ভালো মতো বুঝতে পারছে। আবিদ বিলম্ব না করে বলে,

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১১

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি দর্শিনী। আপনি কি বিয়েতে সেচ্ছায় মত দিয়েছেন?আমার কি আপনার মুখে ভালোবাসি কথাটা শোনার সৌভাগ্য হবে না কোনদিন?’
প্রিয়দর্শিনীর আবিদের কথায় চোখ বন্ধ করে বলে,
‘আমি শুধু আপনারই ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব।সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতে আপনাকে চেয়েছি। এতো অধর্য‍্যবান কেনো আপনি? সময় হোক আপনার ইচ্ছে অবশ্যই পূরণ হবে।’

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৩