প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৩
রাজিয়া রহমান
ফোর্স নিয়ে শফিক এসেছে। সাগর তাকে কল করেছে।তবে কি ঘটেছে বিস্তারিত কিছু বলে নি। শফিক এসে দেখে উপমার সাথে একটা ছেলেকে বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারের সাথে।
শফিক আশ্চর্য হলো ভীষণ।
বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।শফিকের বুকের ভেতর অস্থিরতা অনুভব করে শফিক। উপমা আবার কী করেছে?
সাগর এগিয়ে গিয়ে বললো, “স্ট্যাম্পে সই করে আপনার বোনকে রেখে গেছেন।কিন্তু আমি ভুলে গেছি কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।আপনার বোন হচ্ছে একটা পাগলা কুকুর। যে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের উপর।
এরকম কুকুরকে বিষ ইনজেক্ট করে মে রে ফেলা উচিত।
আআমার যদি ক্ষমতা থাকতো তবে তাই করতাম আমি।কিন্তু তা যেহেতু পারছি না সেহেতু আমার যেটুকু ক্ষমতা তাই করবো।আজ আপনার সামনে আপনার বোনকে আমি তালাক দিচ্ছি।”
উপমা কেঁপে উঠলো।
এই প্রথম উপমার মনে হলো আজকে এই কাজটা না করলেও হতো। কিন্তু সাগর এসব কি বলছে?
উপমা চিৎকার করে উঠে।
সাগর এক দলা থুতু ফেলে বললো, “তুমি নর্দমার কীট উপমা।তোমাকে যতোই সুগন্ধি মাখানো হোক না কেনো তুমি দুর্গন্ধ ছড়াবেই।”
শফিক আস্তে আস্তে জানতে পারলো সম্পূর্ণ ঘটনা। ইরার করা রেকর্ডিং ও শুনলো শফিক।
শফিকের মাথার ভেতর ফাঁকা লাগছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কি করলো উপমা এটা!
এখম শফিক কী করবে?
উপমাকে বাসায় নিবে কীভাবে?
নিজের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে যদি জান্নাত বেঁকে যায়।
রাফির দুই গাল ফুলে গেছে,কপাল ফুলে গেছে। হাবিবা ইরার পা চেপে ধরে বললো, “আমার ছেলেরে মা ফ করে দাও।আর কোনো দিন ও এমন কাজ করবে না।ওরে জেলে দিও না।”
ইরা নিজের পা ছাড়িয়ে বললো, “আজ যদি আপনার ছেলেকে আমি মাফ করে দিই তবে আমার ইজ্জতের সাথে আমার বেঈমানি করা হবে।নিজের সাথে আমি এরকম অন্যায় করতে পারবো না।”
শফিক দুজনকেই থানায় নিয়ে যায়।
আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হতে থাকে।এক সময় পুরো বাসা খালি হয়ে যায়।ইরা চেয়ারে বসে পড়ে।
সারা শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে ইরার।
এতোক্ষণ যতটা সাহস ছিলো এই মুহূর্তে ইরার মনে হচ্ছে সে ততটাই দুর্বল।
টেবিলের উপর মাথা রেখে ইরা চুপ করে শুয়ে থাকে।
সাগরের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। যে ঝড় উঠতে যাচ্ছিলো আজকে,সেই ঝড়ে সবার জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতো।সাগরের কোনো কষ্ট লাগছে না উপমার জন্য, সাগরের কষ্ট লাগছে তার অনাগত বাচ্চার কথা ভেবে।
তার বাচ্চার জীবনটা ছারখার হয়ে যাবে।
দুই হাতে মুখ ঢেকে সাগর ফুঁপিয়ে কাঁদে। ইরা নির্বিকার বসে থাকে।
কি করবে!
ইকবাল(ইখতিয়ারের নাম চেঞ্জ করে ইকবাল দেওয়া হলো।) খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘“তোর বান্ধবীগুলো এতো লুজ কারেক্টার কেনো?ওরা তো দেখছি আগে থেকেই প্রিপেয়ার্ড হয়ে থাকে। যেনো অপেক্ষায় থাকে ওরা নিজেই।”
লিনা হেসে বললো, “সবই টাকার খেলা ব্রো।ওরা তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে গলে যায়।তোমার কথা সত্যি ভেবে নেয়।তাই রাজি হয়ে যায়। মনে করে তুমি সত্যি ওদের বিয়ে করবে।গর্দভগুলো জানে না তুমি যে শিকারী।”
ইকবালের ভালো লাগে না। এই পর্যন্ত তিনটা মেয়ের সাথে রুমডেট করেছে ইকবাল। আগের দিন কিছুসময় কথা বলেছে,টুকটাক গিফট দিয়েছে। পরের দিন একটু ইশারা করতেই ওরা নিজেরাই রাজি হয়ে গেছে।
আজকাল এতো বোকা ও হয় মেয়েরা!
ইকবাল যখন যার সাথে কথা বলেছে তাকেই বলেছে,বিয়ে করার জন্য দেশে এসেছে, তার মতো একটা মেয়েকেই খুঁজছে মনে মনে। তার ফ্যামিলি কি আগ্রহী হবে যদি ইকবাল ওর বাবা মা’কে প্রস্তাব দিতে বলে।
ইকবালের হাসি পায় ওদের বোকামি দেখে।
গ্যালারি ঘেঁটে ইরার ছবি বের করে বললো, “এইটাকে তো আনলি না।এইটাকে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে।”
লিনা দেখে বললো, “ও এদের মতো না।ওকে একবার ও আমাদের বাসায় আনতে পারি নি।ও সবার থেকে আলাদা।’’
“তুই তো আমার ইন্টারেস্ট আরো বাড়িয়ে দিলি।এখন তো আমার ওকে চাই-ই চাই।”
“নো ব্রো,ওকে শিকার করতে পারবে না তুমি।ও এসব ফাঁদে পা দেওয়ার মেয়ে না।”
ইকবালের ইগোতে লাগে।
“ইকবালকে দেখে পটবে না এমন মেয়ে জন্ম হয় নি। তুই একবার নিয়ে আয়,শিকারের দায়িত্ব আমার।।”
সিড়ি দিয়ে ইশতিয়াককে নামতে দেখে লিনা চুপ হয়ে গেলো। ইশতিয়াক কখনো লিনার সাথে কথা বলে না। লিনা ও ইশতিয়াককে ভয় পায়।
ইকবাল ডেকে বললো, “হেই ব্রো,কোথাও যাচ্ছো না-কি?”
ইশতিয়াক থমথমে সুরে বললো, “হ্যাঁ, আমার স্কুলটা দেখতে যাচ্ছি।”
“কি যে করো তুমি! স্কুল দেখে কী করবে?এসব ওল্ড মেমোরি নিয়ে পড়ে আছো কেনো এখনো? এবার একটু জীবনে নতুনত্ব আনো।একঘেয়ে জীবন আর কতো?
যেই জীবনে নারীর সংস্পর্শ নেই,সেই জীবন চিরতার রস।এই তিতকুটে জীবন নিয়ে কতো দিন?”
শায়লা দুই তলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।ইশতিয়াক ছায়া দেখেই বুঝতে পারলো শায়লা উপরে দাঁড়িয়ে আছে।
“এই দুনিয়ায় নারী হচ্ছে ভয়ংকর ভাইরাস। যত দূরে থাকা যাবে তত সুস্থ থাকা যাবে।আমি সুস্থ থাকতে চাই।আমার কাছে নারীর অপর নাম কী জানো?
নোংরা, দুশ্চরিত্রা।”
শায়লার বুক কেঁপে উঠে। সেই সাথে মিইয়ে যায় লীনা ও। ইকবাল শায়লার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসে।
ইশতিয়াক বের হয়ে যায়।
শায়লা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।
ইকবাল হেসে বললো, “কি মম!শুনলে তো তোমার ছেলের কথা। তুমি আজীবন ওর কাছে ক্রিমিনালই থেকে যাবে।”
শায়লা হাসিবুল শেখের রুমে যায়।
টিভিতে নিউজ দেখছেন হাসিবুল শেখ।
শায়লা গিয়ে সোফায় বসে বললো, “ইকবাল আর ইশতিয়াকের বিয়ে একই দিনে দিতে চাই।একজন সংসারী হবে আরেকজন ছন্নছাড়া হয়ে থাকবে তা তো হতে দেওয়া যায় না।”
হাসিবুল শেখ থমথমে গলায় বললো, “সংসার কী সেটা তোমার দুই ছেলের কেউ-ই জানে না।ইকবালের বিয়ে দিচ্ছো দাও,ইশতিয়াকের বিয়ে নিয়ে ভেবো না।যেখানে তুমি জানো সবকিছু।”
“তারিনের বোন অরিনকে আমার খুব পছন্দ। দুই ভাই একই ঘরে বিয়ে করলে খুব একটা মন্দ হবে না।আমাদের বিজনেসের কথাটা ভেবে দেখো।তারিনরা কিন্তু দুই বোনই।সবকিছু আমাদের হাতে থাকবে।
নাজিমুদ্দিন সাহেবের উত্তরাধীকারী এই দুই মেয়েই।এখন যেই ডিল ৪০% বেনিফিট পাবো আমরা, তখন কিন্তু ৬০% এর উপরে ও চলে যেতে পারে।”
হাসিবুল শেখ হেসে বললো, “বিজনেস নিয়ে আমি ভাবতে চাই না আর।অনেক ভেবেছি।আর ভেবেছি বলেই তো…. “
“তোমার এসব আজেবাজে কথা শুনতে ইচ্ছে করে না আমার।আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।ইশতিয়াককে তুমি কিভাবে রাজি করাবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে আমি তোমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।এই বিয়ে হতেই হবে।তোমার উপর ইশতিয়াকের দুর্বলতা আছে সেটা নিশ্চয় তুমি জানো!সেটা কাজে লাগাও!”
শায়লা উঠে হাসিবুল শেখের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলো।
মাথায় অসংখ্য হিসাবনিকাশ চলছে শায়লার।
সিগারেট শেষ করে শায়লা হাসিবুল শেখের ঔষধ এনে দেয়।হাসিবুল শেখ বাধ্য ছেলের মতো ঔষধ খেয়ে নেয়।
শায়লা!
শায়লা!
শায়লা!
হাসিবুল শেখের মুখের ভেতর তেতো হয়ে আসে।ঔষধের জন্য নাকি শায়লার নামের বিষক্রিয়ায় সেটা বুঝতে পারেন না।তবে জানেন তাকে এই কাজটা করতেই হবে।
ইশতিয়াক রাতে ফিরতেই হাসিবুল শেখ ডেকে পাঠালেন।
গোসল করে ইশতিয়াক নিচে এলো।
হাসিবুল শেখ কাতর গলায় বললেন, “আমার কাছে এসে একটু বসবে?”
ইশতিয়াক উঠে গিয়ে হাসিবুল শেখের বিছানায় বসলো।
“জীবনটা কী এভাবে কেটে যাবে ইশতিয়াক?”
“কীভাবে?”
‘“তোমার জীবনের কথা জিজ্ঞেস করছি আমি।”
“এরচেয়ে ভালো হওয়ার কথা ছিলো না-কি!”
“চাইলেই তুমি ভালো করতে পারো!”
“ধূলো পরিমাণ আগ্রহ নেই।এভাবেই বরং ছারখার হয়ে যাক জীবন যেভাবে ছারখার হয়েছিল আমার শৈশব। শৈশবেই যার মন মরে যায়,বাকী জীবন সে জিন্দা লাশ হয়ে বাঁচে।”
হাসিবুল শেখ ইশতিয়াকের হাত দিয়ে বললো, “আমার তাহলে আর মান রইলো না বাবা।তুমি ছাড়া আমার আপন যে কেউ নেই সেটা তুমি বোধহয় সবচেয়ে ভালো জানো তাই না?”
“এসব ইমোশনাল কথা বলার দরকার নেই বাবা।”
“আমি জানতাম এই দুনিয়ায় একজন মানুষ আছে যার কাছে আমি আবদার করতে পারি।আজ জানলাম আমি ভুল।”
“অন্যায় আবদার কেনো করো বাবা?”
“অন্যায়ের সজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষ আলাদা হয় ইশতিয়াক। যে চুরি করে তার কাছে সেটা প্রফেশন, আমাদের কাছে সেটা অন্যায়।
তোমার কাছে আমার আবদার অন্যায় মনে হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে সেটা যথাযথ।”
“আমার এসব আলোচনা ভালো লাগছে না।আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যেতে চাই।”
ইশতিয়াক উঠে চলে গেলো।
লিনা পরদিন সকালে ইরাদের বাসায় গেলো।ইকবাল বলেছে কাজটা করে দিতে পারলে লেটেস্ট মডেলের আইফোন পাবে লিনা।
ইরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে শারমিন গুনগুন করে কাঁদছে। শারমিন গত রাতেই এসেছে সাগরের কল পেয়ে।সেই থেকে গুনগুন করে কেঁদে যাচ্ছে।
লিনাকে সবকিছু বললো শারমিন।
লিনার মাথায় একটা প্ল্যান এলো।
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১২
“আন্টি,ওর তো এখন তাহলে মুড ভালো না।এখানে থাকলে ওর মুড আরো খারাপ হয়ে থাকবে।ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই।ক’টাদিন বেড়িয়ে আসবে।তাহলে ট্রমা থেকে বের হয়ে আসবে ও।আমার ভাইয়ের বিয়ে কয়েকদিন পরে।একেবারে বিয়ে শেষ করে আসবে।”
সাগর বললো, “হ্যাঁ নিয়ে যাও।ওর মন ভালো হোক।”
ইরা কিছু বললো না।
সাগর বললো, “যা,আমি বলছি।দেখবি ভালো লাগবে।আমি থানা থেকে আসছি।জামা কাপড় গুছিয়ে নে।”