প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৩
রাজিয়া রহমান
ইশতিয়াক শেখ বেশ ভালো করেই ইরার গ্রুমিং করেছে।ইরা বুঝতে পারলো এই বাড়িতে কীভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ইরা এখনো ধাতস্থ হতে পারছে না। তবে ইশতিয়াকের কথাগুলো ও মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।
ইশতিয়াক গাড়িতে উঠে ইরাকে নিয়ে প্রথমে গেলো কংফুতে ভর্তি করাতে।ইরার সর্বপ্রথম দরকার সেল্ফ ডিফেন্স শেখা।ইরার ভয় ভয় লাগছে। এই মানুষটা ইরার স্বামী অথচ ইরা এখনো ভালো করে এই মানুষটাকে ভরসাই করতে পারছে না।
কেনো এতো অস্থির লাগছে ইরা বুঝতে পারছে না।
কোনো কিছুর প্রতি ইরার আগ্রহ নেই। একটা নতুন জীবন শুরু হয়েছে তার অথচ প্রতিও ইরার কোনো আগ্রহ নেই।বুঝি বেঁচে থাকতে হচ্ছে বলে বেঁচে থাকা।
যেমন হতে চলেছে হতে দেওয়া।
ইশতিয়াক ইরাকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে গেলো।ইশতিয়াকের ইচ্ছে করছে পুরো শপিংমল কিনে ফেলতে।
কিন্তু বউয়ের সেসবের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। ইরা থমকে দাঁড়িয়ে আছে কিডস সেকশনে।
ইশতিয়াক ইরার কানে কানে বললো, “এখনো অনেক দেরি আছে এই সেকশন থেকে কেনাকাটা করার জন্য বউ।”
ইরার দিকে তাকাতেই দেখে ইরার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ইশতিয়াক ঘাবড়ে যায়।
ইরা কাঁদছে কেনো?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কি হয়েছে ইরার?
ইরার কাঁধে হাত রাখতেই ইরা বললো, “আমার ভাইঝিটা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে ওর জন্য এই সেকশন থেকে কিনতাম আমি।”
ইশতিয়াক দুঃখিত হয়ে বললো, “সরি ইরাবতী। নিশ্চয় কিনবে পরের বার।আল্লাহ নিশ্চয় তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করবে।”
ইরার কেমন যেনো লাগতে শুরু করলো।
ইশতিয়াককে বললো, “আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাই।”
ইশতিয়াক নিজের ফোনটা বের করে দিলো।
ইরা সাগরের নাম্বারে ডায়াল করলো। দুবার রিং হতেই সাগর রিসিভ করলো। ইরার মনে হচ্ছে অনেক বছর পর বুঝি ভাইয়ের সাথে কথা বলছে সে।
হ্যালো বলতে পারলো না কান্নার জন্য।
ওপাশ থেকে সাগর বললো, “কাঁদছিস কেনো তুই?”
“তোমাকে খুব মিস করছি ভাইয়া।”
“পাগল, আমি ভালো আছি।”
“তুমি কোথায়?”
“একটা মসজিদের ইমামের থাকার রুমে।”
“মানে?”
“হ্যাঁ। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।তাই আমার মেয়েটার কবরের পাশে এসে বসে ছিলাম। ওই মসজিদের ইমাম সাহেব ওনার রুমে থাকতে দিলেন।”
“বাসায় যাও ভাইয়া।কেনো এমন করছো?”
“বাসায় আমার কে আছে বল?আমার জন্য কোথাও কেউ নেই এখন আর।তুই ছিলি শুধু, তোকেও পাত্রস্থ করে দিয়েছি।এখন আমি স্বাধীন ইরা।পিছুটান মুক্ত একজন মানুষ। পাখির মতো উড়ে বেড়াবো।”
মুহূর্তেই ইরা অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে যায়। শুধু তার জন্য ভাইয়ের আজকে সব হারিয়ে গেলো।
নিজেকে ইরা কীভাবে ক্ষমা করবে?
পকেট থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে দিলো ইশতিয়াক। তারপর ইরাকে বললো, “প্লিজ ইরা,এমন করো না।তুমি আমার আপন বউ অথচ লোকে ভাববে আমি বুঝি অন্যের বউ নিয়ে এসেছি।”
ইরা চোখ মুছে ইশতিয়াকের পিছু নেয়।
ইশতিয়াক অনেকগুলো শাড়ি,থ্রিপিস কিনেছে ইরার জন্য।
সাথে জুয়েলারি ও কিনেছে।
কেনাকাটা শেষ করে যখন বের হবে ইরা দেখলো ইশতিয়াকের দুই হাতে ধরছে না এতো শপিং ব্যাগ।
ইরা বিরক্ত হয়ে বললো, “কি কিনেছেন এতো?”
“আমার যা যা পছন্দ হয়েছে তাই তাই কিনেছি ইরা।”
“কেনো?”
“আমার ইরাবতীর জন্য।”
ইরা কথা বাড়ায় না।
ইশতিয়াকের গাড়ি যখন গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো তখন বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছে বেশ কিছু অতিথি।
ইকবালের শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে। শায়লা ওদের ইনভাইট করেছে। শায়লার বিশ্বাস ইশতিয়াক নিজের বাবার জন্য হলেও তার পাতা ফাঁদে পা দিবে।
প্ল্যানটা শায়লার নিজেরই।তারিনের বাবা কিছুই বলে নি। বরং শায়লা নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলো অতিরিক্ত লাভের আশায়।
বিয়ের দিন ঠিক করার জন্য সবাই মিলে বসেছে।যদিও হাসিব শেখ নির্বাক দর্শক এখানে।কথা যা বলার শায়লা বলছে।ইকবাল উসখুস করছে বসে।তার এরকম ভদ্র হয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
লিনা একপাশে বসে আছে। বসে বসে পা নাচাচ্ছে।
ইশতিয়াক ভেতরে আসতেই শায়লা বললো, “এই তো,আমার ছোট ছেলে চলে এসেছে।মিট মাই সান ইশতিয়াক শেখ।”
ইশতিয়াক বাজখাঁই স্বরে বললো, “ডোন্ট ডেয়ার টু কল মি ইয়োর সান,আ’ম নট ইয়োর সান।”
তারিনের বাবা মা দু’জন একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়।
ইশতিয়াকের ইরাকে দেখে লিনা চমকায় কিছুটা।ইরা আবার কেনো আসলো!
ইশতিয়াক সবার উদ্দেশ্যে বললো, “দিস ইজ মাই ওয়াইফ,ইরাবতী।”
আকাশ ভেঙে পড়লেও লিনা এতো অবাক হতো না যতটা এই কথা শুনে হয়েছে।
শায়লা নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না।ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “তোমার কীভাবে সাহস হলো এই মেয়েকে বিয়ে করার?”
“আমার লাইফ পার্টনার আমি চুজ করবো।এই ইশতিয়াক শেখের অর্ধাঙ্গিনী তো যেই কেউ হতে পারবে না।কোয়ালিটি লাগবে।”
ইরা সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলো।
হাসিবুল শেখ ছাড়া কেউ সালামের উত্তর দিলো না।ইকবালের পায়ের তালু থেকে মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলছে রাগে।
ইশতিয়াক এই মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললো শুধু তার হাত থেকে বাঁচাবে বলে!
ইশতিয়াক ইরাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো।
শায়লা তাকিয়ে রইলো। গত পরশুই তো এই মেয়েকে তিনি অপমান করেছেন তার শাড়ি পরেছে বলে
সেই মেয়ে এখন তার বাড়িতে বউ হয়ে চলে এসেছে?
অতিথিদের সামনে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেলো শায়লার।
ইকবাল তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।
সবচেয়ে বেশি ভয় হলো লিনার।
ইশতিয়াক রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ইরাকে বললো, “ওয়েলকাম মাই ডিয়ার।”
ইরা ভেতরে প্রবেশ করলো।এই রুমে সে আরো একদিন এসেছিলো। সেদিনের আসা আর আজকের আসার মধ্যে অনেক পার্থক্য।
আজ থেকে এই রুমটা তার ও।
ভেতরে এসে ইরা বিছানার পাশে দাঁড়ায়।
ইশতিয়াক বললো, “শাওয়ার নিবে?তুমি আগে যাও,তোমার পরে আমি যাবো।”
ইরা শপিং ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতেই ইশতিয়াক বললো, “দাঁড়াও।”
ইরা তাকালো ইশতিয়াকের দিকে।
একটা শপিং ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি,ম্যাচিং পেটিকোট, ব্লাউজ বের করে ইরার হাতে দিলো ইশতিয়াক।
ইরা চমকে উঠে শাড়ির প্রাইস ট্যাগটা দেখে।
ছানাবড়া দৃষ্টিতে ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললো, “এতো দামী শাড়ি?”
ইশতিয়াক ইরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি যে রত্নটিকে বউ করে পেয়েছি তার তুলনায় ভীষণ নগন্য এটা ইরাবতী।”
ইরার কেমন লাগে।এতো দামী শাড়ির কথা ইরা ভাবতেও পারে না কখনো।
ইশতিয়াক ইরাকে গোসলে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অপেক্ষা করতে লাগলো ইরার জন্য।
ইরা শাড়ি পরে যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো ইশতিয়াক তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলো।
বিড়বিড় করে বললো, “মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ!তোমাকে কী ভীষণ সুন্দর লাগছে ইরাবতী! আমি এক্সপ্লেইন করতে পারছি না তোমার এই সৌন্দর্য।”
ইরা তোয়ালে দিয়ে চুল প্যাঁচানোর মধ্যে ইশতিয়াক উঠে গিয়ে ইরাকে জড়িয়ে ধরে।
এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যে ইরা নিজেকে ছাড়াতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়।
ইরার ফর্সা,উন্মুক্ত ঘাড়ে চুমু খায় ইশতিয়াক।
ইরা কেঁপে উঠতেই ইশতিয়াক ছেড়ে দেয় ইরাকে।
ইশতিয়াক গোসল করে আসে।
ইরা বললো, “জায়নামাজ আছে?”
ইশতিয়াক শপিং ব্যাগ থেকে একটা জায়নামাজ বের করে দিলো ইরাকে।
ইরা জিজ্ঞেস করলো, “আপনি পড়বেন না?”
লজ্জিত হয়ে ইশতিয়াক বললো, “আমি কখনো নামাজ পড়ি নি ইরা।”
ইরা ভীষণ চমকায়।বিস্মিত হয়ে বললো, “আপনি মুসলমান না?”
“হ্যাঁ। নামের মুসলমান বোধহয় আমি।”
ইরার দুই চোখ ভিজে উঠে। একটা মানুষ তার জীবনের এই পর্যায়ে এসেও বলছে সে কখনো নামাজ পড়ে নি!
ইরার ভীষণ কষ্ট হলো।সে তো এমন ধনী কাউকে চায় নি।খুব সাধারণ একজন জীবন সঙ্গী চেয়েছিলো।যে দ্বীনদার হবে।
যে ইরাকে দ্বীনের পথে পুরোপুরি নিয়ে আসবে।
ইরার টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে ইশতিয়াকের ভীষণ অনুশোচনা হলো।
ইরা কম্পিত গলায় বললো, “নামাজ না পড়ার শাস্তি জানেন?”
“না।”
ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“না ইরা।ধর্মীয় জ্ঞান আমার বিন্দুমাত্র ও নেই।”
ইরার কলিজায় টান লাগলো।
কী বলছে এই মানুষটা!
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২২
এতো শিক্ষিত হয়ে কী লাভ যদি ধর্মীয় জ্ঞান না থাকে!
যে শিক্ষা প্রভুর কাছ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে নেয়,তা কখনো সুশিক্ষা হতে পারে না।
ইশতিয়াক ইরার হাত ধরে বললো, “আমাকে নামাজ পড়া শেখাবে ইরা?”
ইরা মাথা নাড়িয়ে বললো, “নিশ্চয় শেখাবো।”