প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৭
রাজিয়া রহমান
লিনা যখন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলো শায়লা মেয়েকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। লিনার নাকে ব্যান্ডেজ করা।
শায়লার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে।
লিনা!
তার কতো আদরের, কতো শখের মেয়ে!
যেই মেয়ের জন্য শায়লাকে কতো ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে সেই মেয়ের এরকম দুর্দশা দেখে শায়লার অন্তরের আগুন দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে। লিনা এগিয়ে এসে শায়লাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো, “মম দেখো,ওরা আমাকে কী করেছে!ওই ইরার জন্য আজ ওরা এরকম করার সুযোগ পেয়েছে আমার সাথে। আমাকে ওরা খুব মেরেছে।”
শায়লার সারা শরীর জ্বলে ওঠে।
ইরা!
এতো স্পর্ধা ওর!
শায়লা লিনাকে টেনে নিয়ে হাসিবুল শেখের রুমে গেলেন।হাসিবুল শেখের সাথে লিনার কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কন্যা স্নেহ বলতে কোনো কিছুই হাসিবুল শেখ লিনার জন্য কখনো অনুভব করেন নি।
যাকে জন্ম দেন নি তাকে কীভাবে নিজের কন্যা বলে বুকে টেনে নিবেন?
যাকে দেখলে স্ত্রীর দুশ্চরিত্রতা মনে পড়ে যায় তাকে কী কন্যা বলে মানা যায়?
তবুও হাসিবুল শেখ কখনো এই গোপন সত্য প্রকাশ করেন নি।প্রকাশ করলে কামরুল আহসানের মতো সরকারের বড় আমলার মুখে চুনকালি পড়ে যেতো। কাগজে কলমে স্বীকৃতি তো দিয়েছেন লিনাকে নিজের কন্যা হিসেবে।
নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শায়লা এগিয়ে এসে হাসিবুল শেখের চোয়াল চেপে ধরে বললো, “আমার মেয়ের দিকে তাকাও হাসিব।দেখো আমার মেয়ের অবস্থা।এর জন্য কে দায়ী জানো?তোমার ওই বস্তির পুত্রবধূ।”
“তো?আমি কী করবো?আমাকে কেনো দেখাতে নিয়ে এসেছো এসব?আমি কী ডাক্তার?”
“তোমার যে কিছু করার নেই তা আমি আজকে না।আরো বিশ বছর আগে থেকেই জানি।তুমি যে একটা বিগ জিরো সেটা আমার চাইতে ভালো কেউ জানে না।তোমাকে শুধু দেখিয়ে গেলাম এজন্য যে এর ফল ওই বস্তির মেয়েটা পাবে।খুব শীঘ্রই পাবে।শায়লা শেখ কোনো হিসাব ভুল করে না।বরং একই হিসাব সে বারবার সঠিকভাবেই সমাধান করতে জানে।ওকে আমি কীভাবে আঘাত করবো তা ও নিজেও বুঝতে পারবে না।”
হাসিবুল শেখের ভয় লাগলো শায়লার কথায়।শায়লাকে আন্ডারএস্টিমেট করা যায় না। শায়লার হাত মন্ত্রী মিনিস্টার পর্যন্ত লম্বা তা তিনি জানেন। আর জানেন বলেই তাকে সবকিছু মেনে নিতে হয়।
একই শায়লার নানা রূপ!
ইশতিয়াক ইরাকে নিয়ে ফিরলো সন্ধ্যা বেলায়।ইরার কারাটে ক্লাস শেষ করে। ইরার ভীষণ আগ্রহ দেখা গেলো।যেদিন ভর্তি করাতে নিলো ইরা সেদিনও খুব একটা ইন্টারেস্টেড ছিলো না বরং ইশতিয়াকের মনে হয়েছে বুঝি এক প্রকার জোর করে ইরাকে ভর্তি করাচ্ছে সে।
কিন্তু আজকে ইরা ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো।
ইশতিয়াকের গাড়ির শব্দ পেয়ে হাসিবুল শেখ ইরাকে আর ইশতিয়াককে ডেকে পাঠালেন।
দু’জনেই হাসিবুল শেখের রুমে এলো।
হাসিবুল শেখ ইরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ইরা?লিনার সাথে কী হয়েছে?”
“কয়েকটা মেয়ে মিলে মেরে লিনাকে আহত করে দিয়েছে।”
“কেনো?”
“সেটা আমার চাইতে লিনা ভালো বলতে পারবে আংকেল।”
“আমাকে বাবা বলে ডাকতে কী তোমার সমস্যা হয়?”
“না,সমস্যা হবে কেনো?আসলে আমার মুখের বাবা ডাক আপনি অ্যাকসেপ্ট করবেন কি-না তা তো জানি না।যেচে পড়ে লজ্জা পেতে চাই নি বলেই আংকেল বলছি।”
“তাহলে একবার বাবা বলে দেখো।”
“বাবা!”
“এবার বলো কী হয়েছে?”
“সম্ভবত লিনার থ্রুতে আমার ক্লাসের কয়েকটা মেয়ের সাথে আপনার বড় ছেলের পরিচয় হয়।সেই পরিচয় সম্ভবত বোনের বান্ধবী কিংবা বান্ধবীর ভাই এই সম্পর্ককে ডিঙিয়ে অন্য কিছুতে টার্ন নেয়।যার কারণে তার বিয়ের খবর জেনে ওরা লিনার ওপর আক্রমণ করে বসে যেহেতু লিনাই ওদের সাথে ওর ভাইয়ের পরিচয় করিয়েছে এবং এখন তার ভাই তাদের ঠকিয়ে অন্যত্র বিয়ে করছে অথচ লিনা তা গোপন রেখেছে।”
“ওরা এই সংবাদ পেলো কীভাবে?”
“আমি বলেছি যে ওর বড় ভাইয়ের ও বিয়ে সামনে।”
“বুঝতে পেরেছি।তোমাকে একটা কথা বলি মা?”
“বলুন বাবা।”
“তুমি সাবধানে থেকো।তোমার বিপদ আসতে পারে যেকোনো দিক থেকে।”
ইশতিয়াক ইরার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাকে ডিঙিয়ে ইরাকে স্পর্শ করার মতো সাহস আর স্পর্ধা কোনো বিপদের নেই ইনশাআল্লাহ।”
ইরার ভীষণ ভালো লাগে। সামান্য একটা ইনশাআল্লাহ শব্দ বলেছে ইশতিয়াক তবুও ইরার মনে হলো ইশতিয়াকের ভালো উন্নতি হয়েছে।
উপমার ঘাড় ব্যথা হয়ে আছে।বিকেল থেকে সে কাজগুলো করছে।রুমার হাজব্যান্ড আসবে দুই এক দিনের মধ্যে। তার অফিসের বসের ছেলের বিয়েতে তাদের সব স্টাফদের ফ্যামিলিসহ ইনভাইট করেছে।সেজন্য ঢাকায় আসবে।
রুমা হাজব্যান্ড আসবে উপলক্ষ্যে পার্লার থেকে হাইড্রা ফেসিয়াল করেছে,পেডিকিওর মেনিকিওর করেছে,নেইলস করিয়েছে।
এতো বড় একটা অনুষ্ঠানে যাবে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তো।
উপমাকে এসে বললো, “চিকেন নাগেটসটা হয়েছে? রোলটা করে ফেল।”
উপমা বিকেল থেকে বসে বসে এখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে।ফ্রোজেন আইটেম করছে বোনের জামাইয়ের জন্য। প্রতিবারই কাজী ফার্মস,প্যারাগন থেকে ফ্রোজেন অনেক খাবার আনা হয়।কিন্তু রুমা ভেবে দেখলো এখন যেহেতু উপমা আছে অযথা কেনো সে এতো খরচ করবে?
উপমা তো সারাদিন শুয়ে বসেই সময় কাটায়।
উপমার ঘাড় ব্যথা করছে প্রচন্ড।নিচের দিকে আর তাকাতে পারছে না।
রোলের শিটগুলো সরিয়ে রেখে উঠে সোফায় শুয়ে পড়লো।
রুমা আবারও এলো।এসে বোনকে শুয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো, “কি আশ্চর্য! তুই এখন শুয়ে আছিস কেনো?কতো কাজ পড়ে আছে?”
“ঘাড় ব্যথা করছে আপা।”
“তো?এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে তো।কতো টাকার জিনিস এগুলো। এমনি এমনি তো আসে না।টাকার কতো মূল্য বুঝিস না তো তুই।”
উপমার ভীষণ অপমানিত বোধ হলো।আপা তাকে টাকার মূল্য বোঝাচ্ছে!
সে এখানে এসেছে কয় দিন হয়েছে?
এখনই আপার এই সুর?
অথচ যখন সাগরের সাথে সংসার ছিলো উপমার তখন আপা ই তো বলতো কোনো ছাড় দিবি,কোনো টলারেট করবি না।ওদের উচিত জবাব দিবি সবকিছুতে।একদম পাত্তা দিবি না।আমরা আছি তুই ভাবিস না।”
উপমার চোখে জল জমে,বুক ভারী হয়ে আসে।
ভেতরে জন্মায় ক্রোধ।প্রচন্ড ঘাড় ব্যথা নিচে জেদ করে আবারও ফ্লোরে নেমে বসে পড়লো।
চোখের পানি মুছতে মুছতে উপমা বাকি কাজ শেষ করলো।
রাগ করে রাতে আর খেতে গেলো না।
রুমা ডেকে বললো, “উপমা,বাবুদের একটু খাইয়ে দে না বোন।দেখ না আমি নেইলস করিয়েছি,পারবো না।”
রুমে থেকে আস্তে করে উপমা বললো, “তোকে নেইলস করতে বলেছে কে?কিসের এতো আদেখলাপনা করছিস এই ধূমসি চেহারা নিয়ে?
মুটকি তোকে এগুলোতে একটুও মানায় না।”
বাহির থেকে রুমা ডেকে আবারও বললো, “কিরে?আসছিস না কেনো?”
“এই তো আসতেছি।”
উপমা বের হয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দিলো রুমার কথামতো। সিংকে বাসনপত্র সব জমে আছে।
বুয়া আসছে না এখন আর।
উপমা দাঁতে দাঁত চেপে সব পরিষ্কার করলো।
সব কাজ সেরে উপমা রুমাকে বললো, “আপা,শফিক ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোর?”
রুমা বোনের দিকে তাকিয়ে ভাবে উপমা এখানে থাকলে রুমারই লাভ।বুয়ার বেতন হিসেবে যেই টাকা পাঠায় তার হাজব্যান্ড সেটা পুরোটা থেকে যাবে রুমার কাছে।
ফাঁকতালে ফ্রি-তে কাজের মেয়ে পেয়ে গেলে ক্ষতি কী?
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৬
তাই কোমল গলায় বললো, “ভাইয়া তোকে ওখানে নিবে না।আব্বা মা ও দেখলাম।ভাইয়ার সাথে একমত।তোর ওপর সবার রাগ।আম্মা তো আমাকে বলেছে তোকে যাতে আমি ও জায়গা না দিই।সবাই তোকে ফেলে দিতে পারলেও আমি তো পারছি না।তুই তো আমার বোন।আমার নিজের বোন।তাই আমি এই কাজটা পারবো না করতে।তুই ভাবিস না।তুই আমার কাছেই থাকবি।লাগলে আজীবন রাখবো তোকে আমি।”
উপমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। সেই হাসির মানে কী কে জানে!