প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৮
রাজিয়া রহমান
শায়লার রুমটা বিশাল। খুবই এলিগ্যান্টভাবে ইন্টেরিয়র করে সাজানো। দক্ষিণের দিকে বারান্দাটা সুবিশাল।
বারান্দার দোলনায় শায়লা চুপচাপ বসে আছে। বাহিরের দিকে অনেক গুলো ফুলফল গাছ।মৃদু বাতাসে গাছগুলো দুলছে।শায়লা সেদিকে তাকিয়ে গুনগুন করে ওঠে।
শায়লার মনে আনন্দ ভীষণ।
ইকবালের বিয়ের আর দুই দিন বাকী আছে।বাড়ির পুরোটা মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক এসেছে। যদিও প্রোগ্রাম হবে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরারয়।
ছেলের বিয়েতে শায়লা কোনো রকম কমতি রাখতে চায় না।ইশতিয়াক বুঝুক রাজকীয় বিয়ে কাকে বলে।নিজে দেখে একটা ফকিরের মেয়ে বিয়ে করার জন্য একটু হলেও আফসোস হোক ওর।
হনুফা এসে দরজায় টোকা দিলো।শায়লা বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মিনিট দুয়েক পরে রুমের দরজাটা খুলে গেলো।নীলি,রিমি,ঝুমা,লাবনী ভেতরে এসে দাঁড়ায়।
শায়লা বারান্দা থেকে উঠে রুমের ভেতর এসে ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
ছোটখাটো মানুষটাকে দেখে নীলির হুট করে মনে হলো এই সুন্দর মুখটার মানুষের সন্তান এতো নোংরা হয় কীভাবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শায়লা আদুরে সুরে বললো, “দাঁড়িয়ে কেনো মেয়েরা?বসো না প্লিজ।”
এক কোণে রাখা দুই সিটের সোফাটাকে দেখিয়ে দিলো শায়লা।
কেউই সেদিকে এগিয়ে গেলো না।
শায়লা নিজে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বললো, “দাঁড়িয়ে থাকলেও মন্দ লাগছে না।তোমাদের এরকমই ভালো মানাচ্ছে।মনে হচ্ছে চারজন রক্ষিতা দাঁড়িয়ে আছে।ট্রাস্ট মি,আমার জায়গা থেকে তোমাদেরকে রক্ষিতা ছাড়া ভালো কিছু মনে হচ্ছে না।”
চারজনেই একে অন্যের দিকে তাকালো।
এই মানুষটার কথাবার্তা এতো নোংরা!
এতো নোংরা চিন্তাভাবনা!
শায়লা নিজেই বললো, “লিনার গায়ে হাত তুলে তোমরা ঠিক কাজ করো নি।ও আমার ভীষণ আদরের মেয়ে।আমি চাইলেই তোমাদের হাতগুলো কে টে নিতে পারতাম।কিন্তু দয়া করেছি তোমাদের।”
রিমি অধৈর্য্য হয়ে বললো, “আপনি আমাদেরকে কেনো ডেকেছেন?”
“তোমরা না সিদ্ধান্ত নিয়েছো থানায় যাবে অভিযোগ জানাতে?প্রেমের ফাঁদে ফেলে তোমাদের ধোঁকা দিয়েছে আমার ছেলে।তাই ভাবলাম অযথা তোমাদের কষ্ট দেওয়ার কী দরকার। আমি নিজেই পুলিশ ডেকেছি তোমাদের অভিযোগ নেওয়ার জন্য। বুঝতে পেরেছো মেয়েরা?”
শায়লার শীতল কণ্ঠে বলা কথাগুলো চার জনকেই ভীত করে তোলে।বড়লোকদের অনেক ক্ষমতা থাকে।তারা চাইলে অনেক কিছু করতে পারে সবসময়ই জেনে এসেছে আজ চারজনেরই মনে হলো জানা ভুল ছিলো না।
শায়লা খিকখিক করে হেসে বললো, “শোনো না,ইকবালের সাথে তোমাদের কিছু ভিডিও ক্লিপস আছে ইকবালের পেনড্রাইভে।যেখানে ওর ফেল হাইড করা।তোমরা চাইলে সেসব তোমাদের ফ্যামিলিতে পাঠিয়ে দিতে পারি যাতে তারাও তোমাদের ইজ্জত নষ্ট হয়েছে বলে ইকবালের জন্য মামলা করতে আগ্রহী হন।”
রিমির গলা শুকিয়ে গেলো। রিমির বাবা একটা মসজিদের ইমাম। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে মেয়ের সাথে এরকম কিছু বাবা মনে হয় মরেই যাবে।
বাকিদের অবস্থা ও একই রকম। বাড়িতে যদি কেউ একটু জানতে পারে তাহলে জ বা ই করে দিবে।ওরা তো পুলিশের কাছে যাবে বলে নি।
ইরা ওদের বলেছিলো ওরা চাইলে আইনিপদক্ষেপ নিতে পারে।
নীলি কাঁদোকাঁদো সুরে বললো, “আমরা তো কেউ-ই থানা পুলিশ করি নি।”
হিংস্র বাঘিনীর মতো শায়লা নীলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলির গলা টিপে ধরে বললো, “আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললি কেনো তোরা কু ত্তা র বাচ্চা,কে সাহস দিছে?তোদের আমি জ বা ই করে কু ত্তা দিয়ে খাইয়ে দেবো।আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলা!”
নীলির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে,চোখ উলটে আসে।রিমি,ঝুমা,লাবণী তিনজন মিলে টেনে শায়লাকে সরিয়ে আনলো নীলির উপর থেকে।ভয়ে বুক কাঁপছে ওদের ও।নীলির অবস্থা খারাপ। চেহারা নীল হয়ে গেছে।
হাঁপাতে লাগলো নীলি।আর একটু হলে বোধহয় মরেই যেতো ও।
শায়লা কোমল গলায় বললো, “মেয়েরা!”
“জ..জ..জি আন্টি।”
লাবণী ভীত সুরে উত্তর দিলো।
শায়লা বিছানায় বসে মুচকি হেসে বললো, “ইকবালের ভীষণ শখ ইরার সাথে একটা রাত কাটানোর।বিয়ের পরেও হয়তো ইকবালের তোমাদের মাঝেমাঝে দরকার হতে পারে। কল পাওয়ার সাথে সাথে কিন্তু চলে আসবে।আর কীভাবে ইরাকে ইকবালের ঘরে ঢোকাবে সেটা তোমরা ডিসাইড করো।
আমার কথার ব্যতিক্রম হলে সব ফুটেজ সবার ফ্যামিলির কাছে চলে যাবে,সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাবে।
যাও এবার এখান থেকে।”
একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা।এই মহিলা এতো জঘন্য!
কিন্তু ইরাকে ওরা!
ঝুমার কান্না আসে।ইরা ওদের মতো নয়।ওরা জানে ইকবাল ওদের কখনো জোর করে নি।ইকবালের মিষ্টি কথা ওরা বিশ্বাস করে বিয়ে করবে ভেবে লোভে পড়ে নিজেরাই এগিয়েছে ইকবালের দিকে। শুধু পার্থক্য এখানেই যে ওরা কেউই কারো সাথে শেয়ার করে নি।প্রত্যেকে ভেবেছে ইকবাল শুধু তাকেই অ্যাপ্রোচ করছে।কিন্তু অগোচরে যে ইকবাল সবার সাথেই একই রকম করছে সেটা ওরা জানতে পারে নি। যখন জেনেছে তখন সব হারিয়েছে।
শেখ ভিলা থেকে বের হয়ে চারজনেই বাসস্টপে বসে পড়ে। নির্বাক চারজনই।একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
নীলির গলায় হাত রেখে বললো, “কি হবে এবার? ইরাকে কীভাবে?”
ঝুমা কাঁদোকাঁদো সুরে বললো, “প্লিজ না,ইরাকে না।আমরা নিজেরা জেনে-বুঝেই এগিয়েছি।ইরা আমাদের মতো না জানিই তো আমরা। ওর সাথে আমরা এই অন্যায় কীভাবে করবো?”
লাবণী থমথমে সুরে বললো, “কিন্তু তা না করলে আমাদের কী হবে বুঝতে পারছিস তুই? আমাদের ফ্যামিলির কেউ যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে আমাদের বাবা মা’য়ের কী হবে?আমাদের ভাই বোনরা কীভাবে চলাফেরা করবে?”
“আর আমাদের জীবনের কী হবে?আমরা তো ট্র্যাপে পড়ে গেছি। আজীবনের জন্য ওদের হাতে বন্দী আমরা।”
রিমির কথা শেষ হতেই ঝুমা বললো, “আমার ইচ্ছে করছে ম রে যেতে।সু ই সা ই ড করতে ইচ্ছে করে।কেনো এতো লোভে পড়লাম আমি!কেনো বিশ্বাস করলাম ওই নোংরা লোকটার মিষ্টি কথা? কেনো বিশ্বাস করলাম লিনাকে?”
ইরা বসে আছে পার্লারে।পেডিকিওর মেনিকিওর করছে।ইশতিয়াক বাহিরে গাড়িতে বসে আছে।
ইরার বিরক্ত লাগছে। একটা মেয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে ঘষামাজা করছে বিষয়টা ইরার জন্য অস্বস্তিকর।
ইরার জন্য যা অস্বস্তিকর ইশতিয়াকের বোধহয় সেটাই পছন্দ।
ইরা বুঝতে পারে না।
তা না হলে ইরার ইচ্ছা না থাকার পরেও তাকে এই লোক ক্যারাটেতে ভর্তি করিয়েছে।
এখন আবার ইরা যখন বললো ওর এই ব্যাপারটা ভালো লাগে না সে তাকে নিয়েই এসেছে।
ইরার এই ভালো দিকটা ইশতিয়াকের ভীষণ ভালো লাগে। ইরা মতামত জানায় কিন্তু গোঁ ধরে বসে থাকে না।
বুঝিয়ে বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারলে রাজি হয়।
ইরা,ইরা,ইরা,ইরা,ইরা,ইরা….
ইশতিয়াক জপ করতে থাকে।ইশতিয়াক বুঝতে পারে না সে কেনো দিন দিন এই মেয়েটার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে!
অথচ যাকে এখনো খুব গভীর একটা চুম্বন ও করতে পারে নি ইশতিয়াক তার জন্যই কেনো বুকের গহীনে এতো তোলপাড়!
তবে মানুষ কেনো শরীরের প্রেমে পড়ে?
শরীর কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির চাইতে?
ইরা বের হলো অনেকটা সময় পর।হাত পায়ের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষনীয়।
গাড়িতে উঠে বসতেই ইশতিয়াক বললো, “কাছে আসো তো দেখি।”
“কেনো?”
“আসো আগে।”
ইরা এগিয়ে গেলো কিছুটা। ইশতিয়াক ইরার কপালে চুমু খেয়ে বললো, “সাফোকেশন হচ্ছিলো খুব।”
“এখন ঠিক আছেন?”
“আগের চাইতে ভালো লাগছে।”
ইরা আরেকটু এগিয়ে যায়।ইশতিয়াকের কাঁধে হাত রেখে নাকের সাথে নাক মিলিয়ে ফিসফিস করে বললো, “এবার?”
“এবার বোধহয় আরেকটু বেশি ভালো আছি ইরা।”
সিগারেটের ধোঁয়ায় পুড়ে যাওয়া ঠোঁটটায় ইরা আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো, “এবার নিশ্চয় সব ঠিক হয়ে গেছে?”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৭
ইশতিয়াক ইরার ডান হাত নিজের বুকের বাম পাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, “হ্যাঁ সব ঠিক হয়ে গেছে শুধু এই জায়গাটায় একটা আগ্নেয়গিরি জ্বলছে।তোমাকে শক্ত করে বুকে টেনে নিলেই সেই আগ্নেয়গিরি নিঃশেষ হয়ে যাবে।”
“এতো লোভী হওয়া ভালো না ইশতিয়াক শেখ।”
“প্রসঙ্গ যদি হয় বউয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার তাহলে ইশতিয়াক শেখ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লোভী ব্যক্তি ইরাবতী।”