প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩০

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩০
রাজিয়া রহমান

রাতের খাবারের টেবিলে বসে উপমার যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। রুমা স্বামীর পাশে বসে তার স্বামীকে সবকিছু বেড়ে দিচ্ছে।আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে রুমা উপনাকে ওদের সাথে বসতে দেয় নি।উপমা প্লেট ৫টা আনতেই রুমা একটা উঠিয়ে দিয়ে উপমাকে বললো, “তুই একটু পরে খাইস।কিচেন থেকে এনে দিতে হবে তো কিছু লাগে যদি।”
উপমা একটা চেয়ার শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।নিজেকে কাঠের পুতুলের মতো লাগছে।
এতো অসহায় কেনো সে!

স্বামী,সংসার কপাল থেকে চলে গেলে কী মানুষের জীবন এরকম হয়ে যায়?
এরকম ভাঙাচোরা একটা জীবন!
মনির বাচ্চাদের মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছে।
উপমার বুক খচখচ করে। তার সন্তানটা বেঁচে থাকতো যদি!
চোখ বুঁজে উপমা কল্পনা করে। সেই কল্পনায় দেখতে পায় সাগরকে।সাগর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গান গাইছে।তার বাবু খিলখিল করে হাসছে।
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যন্ত্রণায়।রুমা গদগদ হয়ে মনিরের প্লেটে এটা ওটা তুলে দিচ্ছে।
উপমার মনে পড়ে কখনোই সে এরকম করে সাগরকে খেতে দেয় নি।
কি আশ্চর্য!
আজকে উপমার ইরাকে ও মনে পড়ছে।
ইরা সবসময় নিজেই সবকিছু বেড়ে দিতো।প্রয়োজনে নিজে সবার পরে খেতো।
উপমা ভেবে পায় না কেনো এমন লাগছে তার!
আজ কোথাও ঠাঁই মেলেনি বলেই কী আজকে ওদেরকে এতো মনে পড়ছে?
মনির উপমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তা তোমার বোনের চেহারা চুরুত এরকম হইছে কেমনে রুমা?সাগর কী ভাত খাওয়ায় না ওরে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উপমা তখনও ভাবনার জগতে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনির উপমার সংসারের কোনোকিছু সম্পর্কে অবহিত নয়।রুমা এখনো জানায় নি মনিরকে কিছু।
উপমাকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে মনির রুমাকে বললো, “ওর কী হইছে?”
“কিছু না।এমনি কিছু ভাবে হয়তো। তুমি খাওয়া শেষ করো।”
মনির খেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে উঠে গেলো।
রুমা উঠে এসে উপমাকে বললো, “তুই খেয়ে সবকিছু জ্বাল দিয়ে রাখিস।ফ্রিজে রাখিস না।ফ্রিজে জায়গা নাই।”
উপমার আর খেতে ইচ্ছে করলো না।
সব গুছিয়ে রেখে রুমে যেতেই দেখে রুমা বাচ্চাদের রেখে গেছে ওর রুমে। উপমা রুমে যেতেই বাচ্চারা বললো, “খালামনি,আম্মু বলছে তোমার সাথে ঘুমাতে আজকে।”
উপমা বুঝতে পারে সবকিছু।
অথচ তার কেমন হিংসা হচ্ছে।
মনিরের পাশে রুমাকে উপমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।
উপমা বিরক্ত হয়ে বললো, “তোরা ভয় পাবি না আমার সাথে? খালামনি কিন্তু রাতে শাকচুন্নির মতো ভয়ংকর হয়ে যাই।”

রুমার বাচ্চারা দুজন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। উপমার ভীষণ শান্তি লাগতে লাগলো।
নিজে জামাইয়ের লগে লুতুপুতু করবে!
উপমা তা হতে দিবে না।
রুমের লাইট বন্ধ করে মনির সবেমাত্র রুমার উপর উঠেছে সেই মুহূর্তে দরজায় বাচ্চাদের শব্দ পেলো।ততড়িঘড়ি করে মনির নেমে আসে।রুমা পরনের কাপড় ঠিক করে রুমের লাইট দিয়ে দরজা খুলতেই বাচ্চারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকে।

মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “খালামনির সাথে ঘুমাবো না।আমরা তোমার সাথে ঘুমাবো মা।খালামনিকে ভয় করে।”
“কিসের ভয়? ওটা তোমাদের খালামনি তো।তোমাদের কতো আদর করে জানো না?কেনো এমন করছো?”
“না না,খালামনি বলছে রাত হলে খালামনি নাকি শাকচুন্নি হয়ে যায়।তখন যদি আমাদের মেরে ফেলে?”
রুমা হেসে বললো, “দূর পাগল। তোর খালামনি তোদের বোকা বানিয়েছে।আয় আমার সাথে।”
রুমা বাচ্চাদের নিয়ে যায় উপমার কাছে।উপমা বিছানায় বসে আছে।
রুমা ভেতরে এসে বললো, “তুই ওদের কী বলছিস উপমা?”
উপমা হেসে বললো, “আরে আপা, তোর বাচ্চাদের সাথে দুষ্টুমি করছিলাম।ওরা তো আমার কথা না বুঝে ছুটে পালিয়ে গেলো।”
“আর এসব আজেবাজে কথা বলিস না ওদের।ওরা ছোট মানুষ। ভয় পাবে।”
বাচ্চাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমা শুইয়ে দেয় বিছানায়।তারপর উঠে বের হয়ে যাওয়ার সময় উপমা ডাক দিয়ে বললো,

“আপা।”
“হু।”
“আমার সাথে কেনো এমন করলি?”
রুমা বুঝতে না পেরে বললো, “কেমন করছি?”
“আমালে কেনো সংসার করতে দিলি না আপা?”
রুমা ঘুরে তাকায় উপমার দিকে।তারপর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কি বললি?তোকে আমি সংসার করতে দিই নি?আমি দিই নি না-কি তুই নিজের দোষে নিজে করতে পারস নাই?”
“আমি না হয় বুঝতে পারি নি,কখনো কী বুঝিয়েছিস আমাকে?”
“তুই কী আমার বাচ্চাদের সমান যে তোকে বুঝাতে হবে?কী বুঝিস না তুই?জামাই বুঝস,জামাইয়ের সাথে শুইতে জানস,বাচ্চা পয়দা করতে জানস তাহলে এসব জানস না?”

উপমার গলা শুকিয়ে আসে।
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে উপমার।ধরা গলায় বললো, “এর বাহিরেও একটা সংসারে অনেক কিছু থাকে আপা।জামাইয়ের সাথে শুইতে সবাই জানে।তাই বলে সংসার সবাই বুঝে না।কখনো কোনো সমস্যায় পড়ে কল দিলে কখনো সমস্যার সমাধান করে দিছস?উল্টো বলছস ওদের কারো কথা শুনবি না।তোর যা ইচ্ছে তা করবি।লাগলে চলে আয় ওই বাড়ি থেকে।
কেনো আপা?
আমার ভুলটা আমাকে কেনো দেখিয়ে দিলি না?কেনো বললি না মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার নামই সংসার? কেনো বললি না শাশুড়ী ননদকে নিয়ে ও সব সামলে নোট হয়।কম্প্রোমাইজ, স্যাক্রিফাইস এসব নিয়েই সংসার হয়।
কেনো আপা?”

“এখন আমার দোষ হইছে?তুই কী কোনো দিন সমাধান চাইছস?তুই তোর ইচ্ছে মতো করেছিস সবকিছু।সবকিছু মানলাম আমার দোষ। তোর বাচ্চা কী আমার কারণে মরছে? তুই তো নাগিনীর মতো বিষধর। কতো বিষধর হইলে নিজের বাচ্চারেও নিজে শেষ করছস ভেবে দ্যাখ।
এখন অন্যের কাঁধে দোষ চাপাইস না।”
উপমা এই কথার উত্তর দিতে পারে না। সেদিন কেনো এই পাগলামি করেছে উপমা জানে না।সে তো বুঝে নি এভাবে তার কলিজার টুকরো শেষ হয়ে যাবে।বরং ভেবেছিলো সাগরকে কব্জা করতে পারবে।
যাকে কব্জা করার জন্য এতো প্রচেষ্টা চালিয়েছে সে আজ কোথায়?
কাউকেই তো উপমা ধরে রাখতে পারলো না।
রুমা বের হতে গিয়ে দেখে মনির এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে।সব কথাই মনিরের কানে গেছে।
রুমা স্বামীকে দেখে আর কিছু বললো না।
মনির বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো, “তোমার বোইনের কী সংসার ভেঙে গেছে?”
রুমা অস্ফুটস্বরে বললো, “হু।”

“বুঝতে পারছি।তা এখন ও তোমার দোষ দিতেছে কেনো?”
“জানি না।পাগল হয়ে গেছে ও।”
“পাগল? হুম।জাতে পাগল হলেও তালে ঠিক আছে।”
মনির আবার ও রুমাকে কাছে টেনে নিলো।
উপমা আগের মতো বসে রইলো। রুমা বের হয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে নি।
কিছুক্ষণ পর উঠে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে রুমার খিলখিল হাসি। সেই হাসি উপমার কানে বিষের মতো লাগে।
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই উপমার সাগরকে মনে পড়ে।
সাগর!
ঘুমাতে পারে না উপমা।যন্ত্রণা তাকে ঘুমাতে দেয় না।

রাতে খাবার সময় ইশতিয়াকের বড় ফুফু খেয়াল করলো ইশতিয়াক ওর মা বোনের সাথে কথা বলে না।যেহেতু ইশতিয়াক অনেকটা সময় দেশের বাহিরে ছিলো আর তারা ও সেভাবে কখনোই এই বাসায় আসে নি।
তাই ভেতরের খবর কিছুইও তাদের জানা নেই।কিন্তু এখন আসার পর একটু একটু করে বুঝতে পারছে মা ছেলের মধ্যে কথা নাই।
তারা ধারণা করে নিলো ইশতিয়াক এই মেয়েকে বিয়ে করায় মনে হয় ইশতিয়াকের মা ওর সাথে কথা বলে না।
খাবার টেবিলে বসে ইশতিয়াকের বড় ফুফু শায়লাকে বললো, “ভাবীর মনে হয় ছোট পোলার উপর গোস্বা। পোলার লিগে তো কথা কইতে দেখি না।”
শায়লা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “সেটা আমাদের মা ছেলের ব্যাপার তানিয়া।তোমার এসব নিয়ে কথা না বললেও চলবে।”

ইশতিয়াক খাওয়া থামিয়ে ফুফুর দিকে তাকিয়ে বললো, “না ফুফু,তোমাদের জানা উচিত। আফটার অল তোমরা আমার ফুফু।আমার আপন রক্ত তোমরা।এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক তোমাদের সাথে আমার।
তোমাদের জানা উচিত ইশতিয়াক শেখ যাকে তাকে মা বলে ডাকে না ফুফু।আর শুধু জন্ম দিলেই মা হয়ে যায় না কেউ।”
রাহেলা আর লায়লা আড়চোখে একে অন্যের দিকে তাকালো।
শায়লার অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর। এতো তাচ্ছিল্য!
হাসিব শেখের দিকে তাকিয়ে বললো, “যাকে তাকে মা বলে ডাকতে রুচিতে বাঁধে,আর বাবা ডাকতে কেমন লাগে ইশতিয়াক?”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৯

হাসিব শেখ চমকে উঠেন।শায়লার দুই চোখে ঘৃণা।
“আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলবে না কেউ।একটা খারাপ শব্দ কেউ বলবে তার জিভ টেনে আমি ছিঁড়ে ফেলবো।”
শায়লা খিলখিল করে হাসে।সেই হাসিতে হাসিব শেখের হাঁসফাঁস লাগে।
শায়লা ছেলের দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বললো, “খুব শীঘ্রই তোমার চোখ খুলে যাবে ডিয়ার।জাস্ট ওয়েট।”
ইশতিয়াক উত্তর দিলো না।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here