প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩২
রাজিয়া রহমান
বিকেল থেকে শুরু হয় অতিথিদের আগমন।
Noboratri Hall-এর প্রবেশমুখ থেকেই যেন এক অন্য জগতে ঢুকে পড়া যায়। ইরার দুই চোখে বিস্ময়।
এরকম রাজকীয় বিয়ে ইরা আগে দেখে নি।মুগ্ধ হয়ে ইরা পর্যবেক্ষণ করছে সবকিছু।
দুই পাশে ঝুলছে সোনালি ড্র্যাপ, মাঝখানে সাদা গোলাপের গেটওয়ে আর নরম হলুদ আলোর ঝিকিমিকি।
রেড কার্পেটের উপর পাপড়ি ছড়ানো, আর পাশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট ক্রিস্টাল লাইট।
দরজা খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় পুরো হলের সিলিং থেকে নেমে আসছে সাদা সিল্ক ড্র্যাপ আর তার মাঝখানে ঝুলছে বড় বড় ক্রিস্টাল চ্যান্ডেলিয়ার।
আলোর টোন পুরোপুরি সোনালি-সাদা মিশ্র, যেন প্রতিটি আলোকরেখা আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মেঝে জুড়ে কার্পেট, টেবিলের ওপর মোমবাতি ও ফুলের ছোট্ট ফুলদানিতে সাদা লিলি সাজানো।
ইরা গুটিগুটি পায়ে হলের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। হলের একদম মাঝখানে উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে রাজকীয় স্টেজ।
ব্যাকড্রপে সোনালি ফ্রেম আর তার ভেতর সাদা ফুলের সমুদ্র । গোলাপ, অর্কিড, টিউলিপ সব মিলিয়ে এক পরীর দেশের মতো দৃশ্য।
মাঝখানে ঝকঝকে সাদা সোফা, পেছনে LED স্ক্রিনে ধীরে ধীরে চলা “The Wedding of Ikbal & Tarin”।
আলো নরমভাবে তাদের চারপাশে খেলে বেড়াচ্ছে, স্টেজের পাশে সাজানো ক্রিস্টাল ভাস আর ছোট মোমবাতি গ্লাসে জ্বলছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অতিথিদের বসার জায়গায় সারি সারি সাদা চেয়ার,
প্রতিটিতে সোনালি বো-টাই ফিতা বাঁধা।
প্রতিটি টেবিলের মাঝখানে ছোট্ট ক্যান্ডেল, আলো মিটমিট করছে।
হলের ডান পাশে বিশাল বুফে সেকশন।
টেবিলগুলো সাদা কাপড়ে ঢাকা, সোনালি লাইন-বর্ডার দেওয়া।
সার্ভিং স্টাফদের ইউনিফর্মও থিম অনুযায়ী সাদা পোশাক, সোনালি টাই।
খাবার পরিবেশনে ব্যবহৃত স্টিল ট্রে ও সার্ভিং ডিশগুলোতে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো,পুরো জায়গাটা ঝলমল করছে।
এক পাশে তৈরি করা হয়েছে ফটোবুথ সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা “Forever Begins Here”
আর চারপাশে সোনালি ফ্রেম, ফুলের মালা আর পর্দা ঝুলছে।
অতিথিরা ছবি তুলছে, হাসছে, আনন্দ করছে
পুরো পরিবেশে একটা লাক্সারি, শান্ত ও ভালোবাসায় ভরা অনুভূতি।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলো একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে চ্যান্ডেলিয়ার থেকে ঝুলে পড়া আলোয় সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ইশতিয়াকের হাত ধরে অতিথি আসনে বসে ইরা।
চারদিকে এতো লোকজন। ইশতিয়াক ছাড়া কাউকে চেনে না ইরা তেমনই ইশতিয়াক ও ইরাকে ছাড়া কাউকে চেনে না।
কিছুক্ষণ পর যখন কনে প্রবেশ করে, তখন পুরো হলের আলো এক মুহূর্তে নিভে গিয়ে শুধু একটা স্পটলাইট পড়ে তার উপর।
সবাই নিঃশব্দ হয়ে তাকিয়ে থাকে,আর মনে হয় এ যেন বাস্তব নয়।
একটা সোনালি-সাদা স্বপ্নের রাত।
ইরার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।
ইশতিয়াক সেদিকে খেয়াল করে জিজ্ঞেস করে, “ইরা।”
“হু!”
“তোমার কী মন খারাপ?”
“হু।”
“আমি এরকম করে তোমাকে বউ করতে পারি নি বলে কষ্ট পাচ্ছো ইরা?”
ইরা হতবাক হয়ে তাকায় ইশতিয়াকের দিকে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে ইরা।তারপর ইশতিয়াকের হাত ধরে বললো, “জানেন,আমার কখনোই এরকম কোনো স্বপ্ন ছিলো না। কিংবা না তো এই অনুষ্ঠান দেখে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে।
আমি একজন বিশ্বস্ত জীবন সঙ্গী চেয়েছি যাকে পেলে জীবনে বারোমাস-ই বসন্ত হয়ে থাকে।
যে আগলে রাখতে জানে যেমন করে গাছ কাঁটা দিয়ে আগলে রাখে তার গোলাপ ফুলকে।
তবে আমার অন্য কারণে কষ্ট হচ্ছে।এই মেয়েটার জীবনটা এতো আয়োজন করে তছনছ করে দেওয়ার কী খুব দরকার ছিলো?
মেয়েটাও নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে এসেছে। এরপর যখন সে দেখবে জীবনে প্রচুর অর্থ সম্পদ থাকার পরেও সামান্য পরিমাণ মানসিক সুখ সে পাচ্ছে না তখনই সে বুঝতে পারবে সে হেরে গেছে।
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।”
ইশতিয়াক ইরার হাত শক্ত করে ধরে বললো, “চিন্তা করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তারিনকে দেখে ইকবাল বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে হার্ট অ্যাটাক করার মতো ভঙ্গি করতেই চারপাশের সবাই আনন্দ প্রকাশ করলো চিৎকার করে।
চারদিকে এতো আনন্দ, এতো লোকজনের ভীড়ে উপমার দুই চোখ আটকে গেলো একেবারে প্রথম সারিতে বসে থাকা সাদা রঙের জামদানী পরা মেয়েটার উপর।
ইরা!
উপমার ভীষণ আশ্চর্য লাগে।ইরাকে কেমন পরীর মতো লাগছে।এখানে এসেই লিনাকে দেখে উপমা বুঝতে পারলো লিনার ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে। তাই ইরাকে দেখে অবাক হয় নি উপমা।
কিন্তু আশ্চর্য হয়েছে ইরার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে। পাশের ছেলেটার হাত ধরে রাখতে দেখে।
তাহলে তলে তলে এই মেয়ে এসব করে বাহিরে?
অথচ বাসায় কেমন ফেরেশতার মতো ভাব নিতো।
উপমার ইচ্ছে করলো গিয়ে ইরাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে আসতে।
উপমাকে উদ্দেশ্য করে রুমা বললো, “ওইটা ইরা না?”
“হু।”
“এখানে কী করে?”
“যার বিয়ে হচ্ছে সে ইরার বান্ধবীর ভাই।সে মনে হয় দাওয়াত করেছে।”
“ইরার পাশের ছেলেটাকে চিনতে পেরেছিস?”
“না।কীভাবে চিনবো?”
“ওইটা তোর দুলাভাইয়ের বসের ছোট ছেলে।”
“ইরা ওই ছেলের সাথে এরকম করে বসেছে!”
“তোর ননদ তো তলে তলে টেম্পু না,হেলিকপ্টার চালায় মনে হয়।”
“তাই তো দেখছি।”
“বাগে পেলে শুনিয়ে দিবো কয়েকটা কথা।”
শায়লাকে দেখা গেলো একটা কালো পার্টি শাড়িতে।ইরা মুগ্ধ হয়ে তাকায়।
বয়স যেনো এই নারীর কাছে হার মেনেছে।দেখে মনেই হচ্ছে না এই নারীর বয়স ৫০+ হতে পারে।
তার লুক,মেকাপ,স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে ৩৫ এর বেশি হবে না।
ইরা বুঝতে পারে এই রূপই শায়লার প্রধান অস্ত্র।
ইকবাল কিছুক্ষণ পর পরই সামনে বসে থাকা ইরার দিকে তাকাচ্ছে। আকাশি রঙকে জাতীয় রঙ ঘোষণা দিতে ইচ্ছে করছে ইকবালের।তা না হলে ইরাকে কেনো এতো মোহনীয় লাগছে।ভাবতে গিয়ে ইকবালের অস্থিরতা বেড়ে যায়।
এই মেয়েটাকে মনে মনে লক্ষ বার ইকবাল বিবস্ত্র করে কল্পনা করেছে। দেশে আসার পর যত মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হয়েছে সবার জায়গায় মনে মনে ইরাকে ভেবেছে।যতো ভেবেছে ভেতরে ভেতরে ইকবালের ভেতরের পশুটা তত ফুঁসে উঠছে।
কেমন হবে ইরাকে যখন আজকে রাতে সে পাবে?
ইরার শরীরটা নিশ্চয় মাখনের মতো। কিংবা নরম তুলোর মতো।
ইরার কাছে নিশ্চয় অনেক সুখ পাওয়া যাবে।
তা না হলে ইশতিয়াক কেনো এই মেয়ের জন্য এতো ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে!
ইকবালের ধৈর্য্য মানে না আর।
তারিন মৃদু সুরে বললো, “কি ভাবছেন এতো তন্ময় হয়ে?”
“তোমাকে তারিন।তোমাকে কখন খুব গভীর একটা চুমু খেয়ে এই জীবনের প্রথম বারের মতো নারীর স্পর্শ পাবো তা ভাবছি।”
তারিন লজ্জাবতী লতার মতো গুটিয়ে যায় ইকবালের এই কথা শুনে।কাজী এসে বসলো ইকবালের পাশের চেয়ারে। এখন বিয়ে পড়ানো হবে।
LED স্ক্রিনের দৃশ্যপট মুহূর্তে চেঞ্জ হয়ে গেলো। এতোক্ষণ ধরে বিরাজমান আনন্দ অনুষ্ঠান মুহুর্তেই অন্য রূপ নিলো।
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্ক্রিনের দিকে।
ইকবাল পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠে।
ক্লারার সাথে ওর অনেকগুলো পিকচার শো করছে।শায়লা ইকবালের দিকে তাকায়। কাকে কী বলবে?
ইশতিয়াক মিটিমিটি হাসছে ইরার হাত ধরে বসে বসে।
আস্তে আস্তে পিকচারগুলো আরো বেশি খোলামেলা হয়ে উঠেছে। তারিনের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
পুরো হলরুমে পিন পতন নিরবতা।
শায়লা তারস্বরে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু কে জানে না কে বসে বসে এই সিস্টেম পরিচালনা করছে।
কয়েকটা অন্তরঙ্গ ভিডিও ও প্লে হলো।একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীরে ইকবালের বুকের ওপর শুয়ে আছে স্বল্প বসনা ক্লারা।
এরপর যে ভিডিও প্লে হলো তারিনকে ভেতর থেকে ভেঙে দিলো সেটি।দেখা যাচ্ছে ইকবাল ক্লারার সাথে একটা চাদরের নিচে শুয়ে আছে। কানে ফোন ইকবালের।তারিনের সাথে কথা বলছে ফোনে। ফোনে তারিনকে বলা কথাগুলো ও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ভিডিও তে।
আর চাদরের নিচে যে দু’জনেই বিবস্ত্র তা জানার জন্য রকেট সায়েন্স লাগবে না।
তারিন উঠে দাঁড়ায়। তারিনের মা নাজিয়া ছুটে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ায়। চারদিকে কানাঘুঁষা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শায়লা পাগলের মতো হয়ে গেলো। এই অনুষ্ঠানে অনেক উঁচু মহলের মানুষ এসেছে তেমনই তাদের অফিসের স্টাফরা ও এসেছে।
সবার কাছে শায়লার মান ইজ্জত শেষ হয়ে যাবে আজকে।
তারিনের বাবা এগিয়ে এসে শায়লার সামনে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “আপনার ছেলের চরিত্র এতো নোংরা মিসেস শেখ!”
“মিস্টার চৌধুরী, বিশ্বাস করুন।এগুলো কেউ ইচ্ছে করে এআই দিয়ে করেছে।আমার ইকবাল এরকম ছেলে নয়।”
“আপনি যা-ই বলুন না কেনো,একটা বাচ্চা ও বলে দিতে পারবে এখানে দেখানো সবকিছুই সত্যি।”
“না, প্লিজ বিশ্বাস করুন।এগুলো কেউ ষড়যন্ত্র করে আমাদের বদনাম করতে চাইছে এগুলো সব মিথ্যে।আর দেখুন না মেয়েটাকে।এই মেয়েটা কে কোনো প্রমাণ আছে?আপনি আমি কেউ চেনেন ওকে?একটা ভিডিওকে কিভাবে বিশ্বাস করছেন আপনারা? আমাদের কতো প্রতিদ্বন্দ্বী আপনি নিশ্চয় জানেন।যে কেউ-ই শত্রুতা করে এরকম করতে পারে।”
ইশতিয়াক উঠে এসে ইকবালের পাশের সোফায় বসে বললো, “প্লিজ মিসেস শেখ,আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকবেন না।”
তারিন মা’য়ের হাত ধরে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এতো দিন ধরে বুনতে থাকা সব স্বপ্ন তার এভাবে ভেঙে গেলো এক নিমিষেই?
এরকম একটা চরিত্রহীন ছেলের সাথে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছে!
তারিন যেনো কাঁদতে ও ভুলে গেছে।
শায়লা চিৎকার করে ইশতিয়াককে বললো, “গেট লস্ট ইশতিয়াক। আমার মাথা নষ্ট করো না তুমি।”
“মাথা নষ্ট হওয়ার এটা তো প্রাথমিক স্টেজ মিসেস শেখ।এখন যে আসবে তাকে দেখেলে মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবে না।”
ইশতিয়াক ফোন কানে নিয়ে কাউকে ডাকলো।
এক মিনিটের মধ্যে দেখা গেলো একটা নীল জিন্স আর সাদা শার্ট পরা মেয়ে এগিয়ে আসছে।ইকবাল চমকে উঠলো।
ক্লারা চলে এসেছে!
ক্লারা এগিয়ে এসে সবার সামনে ইকবালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আই মিসড ইউ ডিপলি সুইটহার্ট, ইভেন আওয়ার লিটল ওয়ান,স্টিল গ্রোয়িং ইনসাইড মি,মিসড ইউ সো মাচ।”
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেনো।শায়লা আর কোনো কথা বলতে পারলো না।ইকবাল নিজেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩১
ইরার ফোন বেজে উঠলো।রিমি কল করেছে।ইরা রিসিভ করতেই শুনতে পেলো অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিমি বলছে, “ইরা,নীলি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে।প্লিজ তাড়াতাড়ি আয় তুই।”
চমকে উঠে ইরা উঠে দাঁড়ায়। ইশতিয়াককে কয়েকবার ডেকে ও সাড়া পেলো না। অগত্যা ইরা একা একাই বের হয়ে গেলো।
