প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৯
তানিশা সুলতানা
জমিদার হাসেব এর সব থেকে বিশ্বস্ত এবং প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে শিউলি বেগম। নিজ স্ত্রীকেও তিনি এতোটা ভরসা করে না যতটা ভরসা করে শিউলি বেগমকে। যে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি শিউলি বেগমের সাথে পরামর্শ করে নেন। তারও একটা কারণ রয়েছে। শিউলি বেগমের মা জহুরি বেগম ছিলেন জমিদার সাহেব এর প্রেমিকা। দীর্ঘ বছর দুজন গোপনে পরকীয়া করেছেন। জহুরি নিজের স্বামীর অর্জিত টাকা লুকিয়ে সাহেব কে দিয়েছেন। তারপর একদিন সাহেব এর মনে হয় জহুরির মেয়েও দেখতে বেশ ভালো এবং বিশ্বস্ত।
মনোয়ারের দ্বিতীয় বউকে তাড়িয়ে ছিলো শিউলিকে ঘরে তুলবে বলে। তা নাহলে মেয়েটাকে তাড়াতো না। ভীষণ ভালো এবং সাদাসিধে ছিলো মেয়েটা।
আজও পতিতালয়ে গেলে বড্ড মায়া লাগে জমিদার সাহেবের।
“বাবা আনামিকা বেঁচে আছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শিউলির কথায় ভ্রু কুচকে ফেলে সাহেব। এতোক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও এবার কপাল কুঁচকে ফেলে। মাথায় চুলের পরিমাণ খুবই কম। কানের পিঠে এবং পেছনে যে কয়টা চুল রয়েছে তা সবই সাদা রংয়ের। দুই ভ্রু সহ চোখের পাঁপড়ি সাদা হয়ে গিয়েছে। ফর্সা মুখশ্রী কুঁচকে গিয়েছে বয়সের তাপে। বুক ওবদি গড়িয়ে পড়েছে সাদা ঘনো দাঁড়ি।
সেই দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ধীর গতিতে আওড়ায়
” মে রে দাও।
শিউলি হাসেব এর পায়ের কাছে বসে পড়ে। হাত ধরে ভয়ার্তক স্বরে বলে
“বাবা অভি কি আমাদের সাথে বেইমানি করলো? সে কি মনাকে বিয়ে করবে না?
বাঁকা হাসে জমিদার হাসেব
” শিউলি চিন্তা করো না। দাদুভাই আমাকে হারাতে পারবে? তার সকল পদক্ষেপই আমার জানা। তুমি শুধু আনামিকার দিকটা দেখো। দাদুভাইকে কি করে বশ করতে হবে জানা আছে আমার।
শিউলির চিন্তা একটুও কমে না। সে মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে এবং বলে
“আমাদের থেমে যাওয়া উচিত নয় কি?
“তুমি যাও এখান থেকে। বিরক্ত করো না।
অগত্য চলে যায় শিউলি।
জমিদার সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিমায় বসে আছে রাজকীয় সিংহাসনে। গভীর চিন্তার সাগরে ডুবেছে সে। বয়স তার সত্তর পেরিয়েছে। নারীর ব্যবসায় সামিল হয়েছে পঞ্চাশ বছর হলো। কখনো কোনো বাঁধা আসে নি। হ্যাঁ ছেলের বউরা বাঁধার চেষ্টা করেছিলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ব্যবস্থা নিয়েছে জমিদার সাহেব। কিন্তু পূর্ণতা নামক ভয়ংকর সাহসী নারী জমিদার কুটিরে পা রাখার পর থেকেই একেরপর এক বাঁধা আসছে। একে একে কাছের মানুষ গুলো খু ন হচ্ছে। দল ভেঙে যাচ্ছে তার।
মেঝো ছেলেকে কেউ খু ন করেছে এই খবর জেনেছে বেশ আগেই। তবুও মুখ খুলছে না। বা একটুও অনুতপ্ত হচ্ছেন না। নিরবে বোঝার চেষ্টা করছে খু নি কে হতে পারে? আপাতত সন্দেহের তালিকায় অনেকেই রয়েছে। পূর্ণতা, রেশমা, ইমন, ইশান এবং ইফতিয়ার। জমিদার নিশ্চিত এদের মধ্য থেকেই কেউ একজন খু নটা করেছে।
ছেলের মৃ ত্যুতে একটুও আফসোস না হলেও পরবর্তীতে নিজেও খু ন হতে পারে এটা ভেবেই মনে মনে ভয় পাচ্ছে। অবশ্যই নিজেকে রক্ষা করার অশ্র ও ইতোমধ্যেই বানিয়ে ফেলেছে। তারপরও সাবধানের মার নেই।
ভাবতে ভাবতে আঁখি পল্লব বন্ধ করে ফেলেন তিনি। তখনই কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। চতুর জমিদার হুশিয়ার হয়। আত্নমা কেঁপে ওঠে। পিটপিট করে চোখ খুলে।
জমিদারের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী আতোয়ার মাথা নুয়িয়ে জমিদারের সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার কুটিল হাসি।
“মালিক মা***** রে ধইরা আনছি। রাইখা আইছি আপনার কক্ষে।
জমিদার নরেচরে বসে। এতোক্ষণে তার মুখেও হাসির রেখার দেখা মেলে। মুহুর্তেই সকল চিন্তা দূর হয়ে যায়। পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে শব্দ করে হেসে ওঠে। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসে আতোয়ার। আমতাআমতা করে বলে
” মালিক আমারেও একবার সুযোগ দিয়েন।
জমিদার লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আতোয়ারের কাঁধে হাত রাখে। ফিসফিস করে বলে
“আরও কয়েকজনরে ডাইকা আনো। সবাই মিল্লা সুযোগ নেই। মা***র যে তেজ। আমি একা সামলাইতে পারমু না।
আতোয়ার খুশিতে এক প্রকার লাফিয়ে ওঠে। জমিদারের পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং মুহুর্তেই চলে যায় সবাইকে ডাকতে।
জমিদার তার বুক সমান লম্বা দাঁড়ি গুলোতে হাত বুলায়। বিরবির করে বলে
” পূর্ণতা
এবার দেখি কি করিস তুই। বাঁচিয়ে দেখা তোর মাকে।
সেলিনা বেগম হাঁটু মুরে বসে আছে। বিশাল বড় কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে। চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মদের বোতল সিগারেটের খোসা। বেশ বুঝতে পারছে আজকে তার সাথে কি হতে চলেছে। বুক ফুলিয়ে কয়েকবার শ্বাস টানে সেলিনা। মনে মনে প্রস্তুত করে নেয় নিজেকে। কান্না পাচ্ছে না একটুও। কষ্টও হচ্ছে না। শুধু আফসোস হচ্ছে।
“এতোবড় দুনিয়ায় এতো মানুষ রয়েছে। একেকজন মানুষের মৃত্যু একেকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সব থেকে ঘৃণিত এবং কষ্টের মৃত্যু কেনো আল্লাহ সেলিনাকে দিলো?
নোংরা মানুষদের স্পর্শ পেয়েই কেনো দুনিয়া ছাড়তে হবে?
এমন তো হতে পারতো ” প্রায়প্রিয় স্বামীর বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতো।”
কোনো আফসোস থাকতো না।
খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে পুরুষ মানুষের কন্ঠস্বর। হেসে হেসে কিন্তু নিয়ে আলাপ করছে তারা। সেলিনার বুক ধক করে ওঠে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। বিরবির করে বলে
“পূর্ণরে
তোরে শ্যাষ দেখাও দেখতে পারলাম না।
শয়ে শয়ে যানবাহন নিজ গতিতে চলে যাচ্ছে। চোখের পলকে দূর হতে দূরান্তরে পাড়ি জমাচ্ছে। ব্যস্ত রাতায় এদিক ওদিক ছুঁটে বেড়াচ্ছে পূর্ণতা। লম্বা চুল গুলো ইতোমধ্যেই খোঁপা খুলে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁয়েছে। এই মুহুর্তে পাগল মনে হচ্ছে পূর্ণতাকে। ইফতিয়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পূর্ণতার ছটফটানি। সে জানে আশেপাশে অভি নেই। তবুও জোর দিয়ে থামাতে পারছে না পূর্ণতাকে। বা থামাতে চাইছে না। প্রিয় মানুষটার চোখে অন্য কারোর চিন্তা। মন্দ লাগছে না।
তবে পূর্ণতাকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে
“শোনো পূর্ণতা
তুমি যেদিন সুখের সন্ধান পেয়ে যাবে সেইদিন হতেই আমি দুঃখের সাগরে ভেসে যাবো।
নিজের দুঃখের সময়ের কথা চিন্তা করলে মনটা বেইমান হয়ে উঠতে চায়।
ক্ষণিকের জন্য তোমার সঙ্গ পেয়ে লোভী হয়ে গিয়েছি আমি। তোমাকে হারাতে ইচ্ছে করছে না।
কি করি বলো তো?
পূর্ণতা নিশ্চয় তখন তাচ্ছিল্য হেসে বলবে
” লোভ মানুষকে ধ্বংস করে চৌধুরী সাহেব। নিজেকে সামলান।
আর মিষ্টি এই কথা শুনলে বলবে
“আপনি তো বরাবরই লোভী ছিলেন চৌধুরী সাহেব। তাই তো আমাকে একটু ভালোবাসলেন না। ব্যবহার করলেন। দুঃখের সাগরে আপনাকে ভাসতেই হবে।
অন্য কাউকে দুঃখ দিয়ে নিজে কখনোই সুখী হওয়া যায় না।
নিজ ভাবনায় হাসি পায় ইফতিয়ারে। চোখের ওপর হাত রেখে শব্দ করে হেসে ওঠে। প্রাণ খোলা ছিলো সেই হাসি। কতোদিন না না কতো বছর পরে এভাবে হাসি পেলো নিজেরই জানা নেই ইফতিয়ারের।
হাসি থামিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় পূর্ণতা দৌড়ে কোথাও একটা চলে যাচ্ছে। চিন্তিত ইফতিয়ার এক মুহুর্তও সময় নেয় না। নিজেও দৌড় লাগায় পূর্ণতার পেছনের। মেইন রোড পেরিয়ে চিকুর সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ে পূর্ণতা। স্কুল কলেজ ছাড়িয়ে বিশাল এক মাঠে গিয়ে থামে। হাঁটুতে ভর দিয়ে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। ইফতিয়ারও পূর্ণতার দেখাদেখি থামে। পা ভেঙে বসে পড়ে ঘাসের ওপর। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে সুধায়
” এখানে কেনো আসলে পূর্ণতা?
পূর্ণতা হাসে। আঙুল তুলে পশ্চিম দিকে তাক করে বলে
“উয়য় যে আমি এমপি সাহেব। তার জন্যই এসেছি।
ইফতিয়ার তাকায়। সত্যিই দেখতে পায় অভিকে। মাঠের মাঝখানে দুজন লোকের সাথে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে।
থমথমে মুখে ইফতিয়ার বলে
” কি করে বুঝলে তুমি?
অকপটে পূর্ণতা জবাব দেয়
“আমি অনুভব করতে পারি। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি উনি কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, কি করছে।
আলতো হাসে ইফতিয়ার।
আনমনে বলে
” এতো ভালো কেনো বাসো পূর্ণতা? সে তো ভালো না।
“বাহহ রে ভালোবাসবো না?
তিনি যে আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।
এই দুনিয়ার সব থেকে জঘন্যতম পাপীও যদি তিনি হয়। আমি তখনো বুক ফুলিয়ে বলবো ” বড্ড বেশি ভালোবাসি আমি আমার স্বামীকে। আমার এমপি সাহেবকে”
“ক্ষমা করবে তাকে?
ইফতিয়ারের চোখে চোখ রেখে পূর্ণতা জবাব দেয়
প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৮
” আমি এমপি সাহেব ক্ষমার অযোগ্য কোনো কাজ কোনোদিনও করতে পারে না। এই দুনিয়ার সব থেকে শুদ্ধ পুরুষ তিনি। আমার অহংকার।
ক্ষমা শব্দটা তার সাথে মানানসই নয়।